পুষ্পের নিদ্র পর্ব-০৯

0
283

#পুষ্পের_নিদ্র
#আনআমতা_হাসান
পর্ব : ৯

সাদা কালো চেকের শার্টের হাতা গোটাটে গোটাতে সিড়ি দিয়ে নেমে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা সাহানাকে পল্লব বলল
– মা আমি একটু বের হচ্ছি।

সাহানা আর রেনু সোফায় বসে গল্প করছিল। ছেলের কন্ঠ শুনে সাহানা মাথা ঘুড়িয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
– কোথায় যাচ্ছিস তুই?

পল্লব সাহানার সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– যমুনা ফিউচার পার্কে আমার কিছু ফ্রেন্ড আসছে। তাদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।

রেনু খুশি হয়ে পল্লবকে বলল
– তুমি বসুন্ধরায় যাচ্ছ। তাহলে তো ভালোই হলো। রিমঝিমও তো সেদিকেই যাচ্ছে। সোহানের সাথে দেখা করতে। তুমি তাহলে মেয়েটাকে একটু কষ্ট করে সঙ্গে করে নিয়ে যাও বাবা।

‘সোহান’ নামটা শুনেই পল্লব ভাবতে থাকে এই সোহানটা আবার কে? কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল
– আন্টি সোহান কে?

রেনু একগাল হেসে বলল
– সোহান আমার এক কোওয়ার্কারের বোনের ছেলে। রিমঝিমকে দেখে ওর খুব পছন্দ হয়। ওর নিজের কোন ছেলে নেই। শুধু দুটো মেয়ে। তাই ওর বোনকে গিয়ে তার ছেলের জন্য রিমঝিমের কথা বলে। রিমঝিমের ছবি দেখে তারাও রিমঝিমকে পছন্দ করে। ছেলেও মাশাল্লাহ। নম্র, ভদ্র। এভারকেয়ার হসপিটালের ডাক্তার। দুই ভাই এক বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। হাসবেন্ডের সাথে ইতালিতে সেটেল। ছোট ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পরে। ছেলেটা কয়েকমাস ধরেই দেখা করতে চাচ্ছে। কিন্তু রিমঝিম রাজি হচ্ছেনা। কত বলে টলে আজকে দেখা করতে যাওয়ার জন্য রাজি করিয়েছি। তুমি ওকে একটু বুঝিও তো বাবা।

পল্লবের নিজের চুল নিজেরই টেনে ছিড়তে ইচ্ছা করছে। তার শাশুড়ী তাকে বলছে সে যেন তার বউকে পাএ দেখতে নিয়ে যায়। আবার বলছে তাকে বুঝাতে সে যেন অন্য ছেলেকে বিয়ে করে। হায় কপাল। যতই মুখে যাই বলুক রিমঝিমকে যে সে আজও ভালোবাসে। আর আজও তাকেই নিজের বউ হিসেবেই মানে। যদিও সে রিমঝিমকে নিজের করে নিবে না। কিন্তু তাই বলে তাকে অন্য ছেলেকে বিয়ে করার কথা বলা তার পক্ষে অসম্ভব।

তখনি রিমঝিম নিচে নেমে আসে। পড়নে আকাশী রঙের সেলোয়ার-কামিজ। চুলগুলো পনিটেল করে বাধা। কানে ছোট দুল। হাতে চিকন কালো ফিতার গড়ি। না আছে মুখে কোন মেকাপ আর না আছে ঠোঁটে কোন লিবিস্টিক। এমন কি চোখের কাজলটা পর্যন্ত নেই। তবুও পল্লবের চোখে তাকে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী রমণী লাগছে। রিমঝিমের সাথে চোখাচোখি হলে সাথে সাথেই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সে। রিমঝিমকে দেখেই রেনু বিরক্ত নিয়ে বলল
– এমন ফকিন্নির মতো যাচ্ছিস কেন? একটু সাজগোছ করে গেলে কি ছেলেটা এখনি তোকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে।

রিমঝিম মার কথায় কান না দিয়ে পল্লবের পাশে দাঁড়িয়ে আড়চোখে পল্লবের মুখের দিকে তাকিয়ে তার বিয়ের কথা শুনে পল্লবের রিয়েকশন বুঝার চেস্টা করে। কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারে না। সাহান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা পল্লব আর রিমঝিমের দিকে। পাশাপাশি দুজনকে কি সুন্দরইনা লাগছে। খুব ইচ্ছা ছিল তার রিমঝিমকে নিজের ছেলের বউ করে নিজের কাছে রেখে দেওয়ার। কিন্তু তার ছেলেতো বিয়ের কথা বললেই রেগে যায়। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করে সাহানা রেনুকে উদ্দেশ্য করে বলল
– আরে আমাদের রিমঝিমকে এমনেই অনেক সুন্দর লাগে। এতো সাজা লাগবে না। যাও মা পল্লব তোমাকে নিয়ে যাবে। তুমি পল্লব ভাইয়ার সাথে যাও।

রিমঝিম একটা চাপা নিশ্বাস ছাড়ে। তার একটা মাএ ভুলের জন্য আজ তার স্বামী তার ভাইয়া হয়ে তাকে তার উডবির সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাচ্ছে।

পল্লব গম্ভীর কন্ঠে বলল
– মা আন্টি আসি তাহলে।

কথাটা বলে তাদেরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে যায়। হাসি মুখে ‘আসি’ বলে রিমঝিমও পল্লবের পিছন পিছন বের হয়ে যায়। পল্লব গিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে। রিমঝিমও তাড়াতাড়ি করে গিয়ে পল্লবের পাশের মেসেঞ্জার সিটে বসে পরে। গম্ভীর মুখে গাড়ি চালাচ্ছে পল্লব। রিমঝিম আশা করেছিল তার বিয়ের কথা শুনার পর হয়তো পল্লব তাকে কিছু বলবে। আর তাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে না। কিন্তু না কথা বলা তো দূরের কথা সে তো তার দিকে তাকায়ওনি। আর রেস্টুরেন্টের দিকেই গাড়ি যাচ্ছে। চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। মনে শুধু একটা প্রশ্নই জাগচ্ছে, কি করলে সে তার সেই হিমরাজকে ফিরে পারে যে তাকে ভালোবাসার চাদড়ে মুড়িয়ে রাখতো? বেশ কিছুক্ষণ পর রিমঝিম জিজ্ঞেস করল
– আমাকে কি এবারের মতো ক্ষমা করা যায় না?

পল্লব কোন উত্তর দেয়নি। উল্টো তার ভাবসাব এমন যে তার পাশে কেউই নেই। কেউ তাকে কোন প্রশ্নও করছে না। আর না কেউ তার পাশে বসে চোখের জল ফেলছে। বসুন্ধরার পগতি সরনীর ফুটওভার ব্রিজের পাশে গাড়ি থামিয়ে পল্লব এবার নিজের মুখ খুললো। রিমঝিমের দিকে না তাকিয়ে বলল
– নামুন মিস রিমঝিম।

রিমঝিম আবার জিজ্ঞেস করল
– আপনি চান আমি গিয়ে ঐ সোহান না দোহান এর সাথে দেখা করি! কেমন স্বামী আপনি? নিজের বউয়ের বিয়ে ঠিক করছেন। নিজের বউকে কেউ বিয়ে দেয়?

পল্লব এবার রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে রেগে দাত কটমট করে বলল
– আপনার এই একই প্রশ্ন বারবার করতে ইচ্ছে করলেও আমার এই একই উত্তর বারবার দিতে খুবই বিরক্ত লাগে মিস রিমঝিম। শুধুমাএ আপনার মা বলেছে দেখে আমি ভদ্রতার খাতিরে আপনাকে সাথে করে নিয়ে এসেছি। এখন আপনি আপনার ফিয়সির সাথে দেখা করবেন না কি করবেন তা আমার দেখার বিষয় না। নামুন গাড়ি থেকে।

রিমঝিম ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল
– হিমরাজ প্লিজ।

পল্লব রেগে একপ্রকার চিল্লিয়ে বলল
– আই সেড গেট আউট ওফ মাই কার।

রিমঝিম ছলছল চোখে গাড়ি থেকে নেমে যায়। সে নামার সাথে সাথেই পল্লব জোড়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। রিমঝিম সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পল্লবের চলে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে কত অভাগা সে। না হলে তার নিজের স্বামী তাকে অন্য একটা ছেলের সাথে দেখা করার জন্য রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যেতে পারে।

🌺

গুলশানের ১ এর ভাসাভি ফ্যাশন হাউস থেকে দুই হাত ভরে ব্যাগ নিয়ে বের হলো নিদ্র। তার পিছনে খালি হাতেই বের হয় পুষ্প। পুষ্প ভেবে পায় না নিদ্র এতো শপিং কেন করলো। হঠাৎ কালকে রাতে ফোন করে বলল আজকে সে যেন সকাল দশটায় রেডি হয়ে থাকে। সকাল দশটায় এসে তাদের বাসায় না ডুকে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা থেকে যমুনা ফিউচার পার্কে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কিছু কেনাকাটা করে তাকে এই শপিং মলে নিয়ে আসে। তার জন্য ছয়টা শাড়ি আর আটটা লং গ্রাউন কিনে। সাথে মেচিং জুতো, ব্যাগ তো আছেই। নিজের জন্যও চারটা সুটসেট আর দুইটা পাঞ্জাবি কিনে। কিন্তু কেন? তার জানা মতে তাদের বিয়ের সব ড্রেস নিদ্রের এক ফ্যাশন ডিজাইনার বন্ধু বানাবে। এংগেজমেন্টের সব ড্রেস সেই বানিয়েছিল। এংগেজমেন্ট, হলুদ, বিয়ে আর বউভাতের জন্য নিদ্র, পুষ্প, তাদের বাবা-মা, পল্লব, রিমঝিম, তার মা আর কিছু রিলেটিভদের কিছু ড্রেস মিলে মোট পঞ্চাশটা ড্রেসের ওডার নিয়েছে। যার মধ্যে তেতাল্লিশটা বানিয়ে দিয়ে দিয়েছে বাকি গুলো পরশু দিয়ে দিবে। তাহলে আবার এগুলো কেন? গাড়িতে পেসেঞ্জার সিটে বসে নিদ্রকে জিজ্ঞেস করে
– এগুলো কেন?

নিদ্র ব্যাগগুলো পিছনের সিটে রাখতে রাখতে উল্টো জিজ্ঞেস করল
– কোনগুলো?

– এই যে এতো এতো ড্রেস কিনলেন। আমাদের বিয়ের ড্রেস তো বানানো প্রায় শেষ তাহলে এগুলো?

নিদ্র গাড়ি চালাতে চালাতে উত্তর দিল
– কিছু তোমার বিয়ের সময় আর পরের জন্য। যেমন ধরো বিয়ের দিন সকালে, বউভাতের দিন সকালে আর বউভাতের পরে দুই-তিনদিন পরার জন্য। আর বাকিগুলো ব্যাংকক যাওয়ার সময় লাগবে।

পুষ্প অবাক হয়ে বলল
– আমি ব্যাংকক যাবো!

– আমি না আমরা ব্যাংকক যাবো।

– কিন্তু কেন?

– কেন আবার হানিমুনের জন্য।

‘হানিমুন’ কথাটা শুনেই পুষ্প লজ্জায় লাল হয়ে যায়। নিদ্রের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। সেদিকে আড়চোখে একনজর দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনের দিকে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল
– “অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি –
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় –
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।

না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

🌺

চলবে………..