পূর্ণতা নাকি শূন্যতা ২ পর্ব-০২

0
321

#পূর্ণতা_নাকি_শূন্যতা
#সিজন_২
#রেজওয়ানা_রমা
#পর্ব_০২

মমতা বেগম : তুমি এসেছো? ফ্রেস হয়ে নাও আমি খাবার দিতে বলছি
আরিয়ান চৌধুরী : হ্যাঁ। আর সিদ্ধাতকেও ডেকো। আর তো কয়েকদিন পরে ওকে যেতে হবে। এই কয়েক দিন আমাদের সবার সাথে এক টেবিলে খাওয়া দাওয়া করুক কি বলো
মমতা বেগম : আচ্ছা বলছি আমি।

অতি যত্নে মমতা বেগম সেই ছবিটি লুকিয়ে বেরিয়ে আসেন আরিয়ান সাহেবের সামনে থেকে। নয়তো আরিয়ান সাহেবের চোখে পড়লে অনর্থ হয়ে যাবে। অতঃপর সিদ্ধাতকে ডেকে নিচে আসেন। এই বাড়িতে সিদ্ধাত, মা, বাবা, আর দুইজন সার্ভেন্ট থাকে। সিদ্ধাত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপটেন।পড়া লেখা এখনো চলছে। এক্সামের জন্য তাকে বাড়ি আসতে হয়েছে। খাওয়া টেবিলে,

আরিয়ান চৌধুরী : তা কবে যাচ্ছো তুমি সিদ্ধাত?
সিদ্ধাত: এই তো বাবা এক্সাম টা শেষ হলেই
আরিয়ান চৌধুরী : তা বেশ বেশ। আর তো বেশি দিন নেই তাহলে
সিদ্ধাত: না বাবা।
মমতা বেগম: এতো কষ্টের চাকরি না করলেই কি হতো না? আমাদের তো কিছু কম নেই।
সিদ্ধাত: মা প্লিজ! আমি নিজে কিছু করতে চাই। বাবা যেমন পরিশ্রম করে এতো দূর এসেছে তেমনি আমিও নিজের পরিশ্রমে বড় হতে চাই।
আরিয়ান চৌধুরী : মমতা আমার ছেলে যা চাইছে সেটাই হবে। তুমি ওকে বাধা দিও না।
সিদ্ধাত: হুম ঠিক তাই। আর তোমার বউমার পুরো সাপোর্ট আছে বাবা
আরিয়ান চৌধুরী : আরে তাই নাকি। তা তো বেশ ভালো কথা
মমতা বেগম: এতো স্বাধীনতা দিও না। একটু শাসন করো। পরে পস্তাতে হবে
আরিয়ান চৌধুরী : বেশি শাষনের ফল কি হয় ভুলে গেছো?
মমতা বেগম : দোষ টা তোমার ছিল। তুমি মেনে নাও নি ওদের কে।
সিদ্ধাত: কি নিয়ে কথা বলছো তোমারা?

আরিয়ান চৌধুরী টেবিল ছেড়ে উঠে যান। মমতা বেগমেরও মন ভার হয়ে যায়। সিদ্ধাত কিছু বুঝতে পারে না। হঠাৎ এমন আচরণের কারন কি। খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে আসে সিদ্ধাত। ল্যাপটপ নিয়ে বসে যায় কিছু কাজের জন্য। প্রতিদিনের মত কাজ শেষ করে শুয়ে পড়ে আর ফোনে তার প্রিয়শীর একটি ছবি দেখতে থাকে।

পরের দিন সকালে ঈশা,
প্রতিদিনকার মত আজও আমি লেট। খুব তারাতারি রেডি হয়ে দৌড়ে নিচে নামছি আর চিৎকার করে ডাকছি,

ঈশা: আম্মু ও আম্মু,আম্মু গো খেতে দাও। আম্মুউউউ
মায়া বেগম: ছাগলের মত ম্যা ম্যা করছো কেন? খাবার রেডি আছে খেয়ে নাও যাও
ঈশা: এই আম্মু তুমি আমাকে ছাগল বললা? যাও কথা নাই তোমার সাথে।
আম্মু: আমার বয়েই গেছে তুমি কথা না বললে।

মুখ ঘুরিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম। খাওয়া শেষ করে বাড়ি থেকে হয়েছি তখনই দেখি মিস্টার রাগী রাক্ষস ভাইয়া আমার বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখলেও চিনতে আমার অসুবিধা হয় নি। বরাবরের মতই হার্ট বিট বেড়ে গেছে। যত উনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই বেশি বাড়ছে। কাছে গিয়ে বললাম,

ঈশা: সিদ্ধাত ভাইয়া তুমি এখানে?
সিদ্ধাত: হুম তারাতারি গাড়িতে উঠ। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার এক্সাম শুরু হয়ে যাবে

বলেই নিজে গাড়িতে উঠে বসলো। আমি হা করে দাঁড়িয়ে আছি। আজ সিদ্ধাত ভাইয়া নিতে এসেছে আমাকে? কিভাবে যাবো বুকের ভিতর যেভাবে ব‍্যাঙ লাফালাফি শুরু হয়েছে কখন না জানি হার্ট টা লাফিয়ে বেরিয়ে আসে।

সিদ্ধাত: কথা কি কানে যাচ্ছে না? বলছি তো আমার এক্সাম আছে
ঈশা: তো এক্সাম ছেড়ে এখানে এসেছো কেন?
সিদ্ধাত: সেটা বোঝার ক্ষমতা তোর হয় নি। উঠে বস

আমি আর কোনো কথা না বলে গাড়ি তে উঠে বসলাম। খুব নার্ভাস আমি। কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। আচ্ছা সিদ্ধাত কেন এলো? তাও আবার এক্সাম রেখে। আচ্ছা উনার মনে কি আমার জন্য কিছু আছে? না না কি সব ভাবছি উনার তো আছেই একজন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,

ঈশা: আচ্ছা সিদ্ধাত ভাইয়া তোমার জিএফ এর নাম কি?
সিদ্ধাত: সেটা জেনে তোমার কি লাভ পিচ্চি?
ঈশা: না এমনি। বলো না। কে সেই ভাগ্যবতী
সিদ্ধাত: ভাগ্যবতী? হাহাহা। হুম সত্যি সে ভাগ্যবতী
ঈশা: দেখা করাও না প্লিজ।
সিদ্ধাত: ওকে দেখার এতো ইচ্ছা কেন?
ঈশা: জানতে ইচ্ছা করে কে সে?
সিদ্ধাত: হয়তো তুই
ঈশা: এ‍্যাহ! কি বললা?
সিদ্ধাত: রেডিওতে যা বলে এক বারই বলে রিপিড হয় না।
ঈশা: তুমি কি রেডিও নাকি
সিদ্ধাত: যা মনে করবি

এই লোকটার সাথে কখনও কথায় পেরে উঠি না। আর এখনো পারবো না তাই চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছে যাই। আমি গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ক্লাসে চলে যাই কারন এখন সিদ্ধাত ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। একটু আগে যা বলেছে তাতে আমার হার্ট বিট এতো পরিমাণে বেড়েছে যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সিদ্ধাত ভাইয়া ও হয়তো ক্লাসে চলে গিয়েছে। উনার এক্সাম গুলো শেষ হলেই উনি চলে যাবে। জানি না আবার কবে আসবে, কবে দেখা হবে।

ক্লাস শেষ করে আমি, নোভা, অয়ন, আর রিয়া ক্যাম্পাসের ভিতরে আড্ডা দিচ্ছি। সিদ্ধাত ভাইয়ার এক্সাম হয়তো শেষ। চলে গিয়েছে কি না কে জানে। এরই মধ্যে নোভা বলে,

নোভা: ঈশা তোমার সিদ্ধাত ভাইয়া এদিকে আসছে।

আমি চোখ তুলে দেখি সত্যি সিদ্ধাত ভাইয়া আসছে। আমার উনার দিকে তাকাতে দেরি আছে কিন্তু আমার হার্টের লাফালাফি করতে দেরি নেই। আমি এখনো সোজা তাকিয়ে দেখছি তাকে। হঠাৎই আমার মাথার একটা চড় মেরে কেউ বলে,

-ওদিকে কি দেখিস?
ঈশা: আউচ। এই কোন বাদর রে?

তাকিয়ে দেখলাম আমাদের সেই বাদর টা। শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

ঈশা: একি বাদর ভা… থুড়ি সিদ্ধাত ভাইয়া তুমি?
সিদ্ধাত: কি ভাইয়া?
ঈশা: সিদ্ধাত ভাইয়া। ভালো ভাইয়া, লক্ষী ভাইয়া, সোনা ভাইয়া, কলিজা ভাইয়া,

সিদ্ধাত ভাইয়ার মুখ টা একবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর অয়ন, নোভা তো হাসতে হাসতে শেষ। আমিও চুপ হয়ে গেছি। সবাইকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়ে সিদ্ধাত ভাইয়া বলে,

সিদ্ধাত: স্টপ।

সবাই ধমক খেয়ে চুপ হয়ে যায়। আর আমাকে আরেক ধমক দিয়ে বলে,

সিদ্ধাত: এখানে বসে আড্ডা না দিয়ে বাড়ি যা।
ঈশা: এই শোনো একদম আমাকে ধমকাবে না বলে দিলাম। ভয় পাই নাকি আমি তোমায়?
সিদ্ধাত: তাই? ভয় পাস না? (ঈশার দিকে একটু ঝুকে)
ঈশা: পাই পাই পাই অনেক ভয় পাই

ঝড়ের গতিতে কথা টা বলে দিলাম। আর আমার এভাবে বলায় বাকিরা হেসে দেয়। সাথে রাগী রাক্ষস টাও।

সিদ্ধাত: চল তোকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসি।
ঈশা: এখনি?
নোভা: ভাইয়া শুধু ওকেই বাড়ি ছাড়তে যাবেন? আমাদেরকেও একটু দেখেন।
সিদ্ধাত: ওকে মাই ডিয়ার শা..
রিয়া: ভাইয়া কথা টা শেষ করেন।
সিদ্ধাত: ওকে আজ ঈশাকে বাড়ি ছেড়ে আসি অন্য কোনো একদিন তোমাদেরকেও ছেড়ে আসবো।
অয়ন: না ব্রো রিয়ার জন্য আমি আছি।

অয়নের কথায় আমরা জোরে হেসে দেই। সাথে রাক্ষস রাজাও। অতঃপর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সিদ্ধাত ভাইয়া ড্রাইভ করছে আর আমি পাশে বসে আছি। মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছি। আসলে সিদ্ধাত ভাইয়ার মাঝে একটা মায়া আছে। যত দেখি তত ভালো লাগে। উনার স্টাইল গুলো সবার নজর কাড়ে। বার বার চোখ নামিয়ে নিচ্ছি তবুও বেহায়া মন আবারও দেখতে চাইছে।
চোখ নামিয়ে এবার বাইরের দিকে তাকাতে দেখলাম আকাশে কালো মেঘ করেছে। এক্ষুনি বোধহয় বৃষ্টি নামবে। চারিদিক টা কেমন জানি অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাতাস বইছে। আমার খুব ভালো লাগছে প্রকৃতির এই রূপটাকে। এতো সুন্দর একটা আবহাওয়া আর সাথে আমার প্রিয় মানুষ টা। অনুভূতিটাই অন্য রকম। মূহুর্তেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলাম। প্রান ভরে বৃষ্টির গন্ধ নিচ্ছি আর তখনই সিদ্ধাত ভাইয়ার ধমক খেয়ে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়লাম। শালা রাক্ষস একটা। নিজে একটা আনরোমান্টিক, ভিলেন, খালি মেজাজ দেখাতে পারে। সারাদিন যতটা ধমক খাই ততটা খাবারও খাই না। কিছুক্ষন পর বাড়ি চলে এলাম। গাড়ি থেকে নামা মাত্রই আমি বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করে দিয়েছি। বৃষ্টির ফোটা গুলোকে অনুভব করছি। উফফ এতোক্ষন যেন আমার প্রান ফিরে এলো। এতো সুন্দর বৃষ্টি ছেড়ে আমি গাড়িতে বসে থাকবো। জাস্ট ইমপসিবল। আমি খেয়াল করলাম কেউ একজন আমকে মুগ্ধ চোখে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। আমি তাকে বললাম,

ঈশা: অনেক মজা সিদ্ধাত ভাইয়া নামো না প্লিজ। আসো ভিজি।
সিদ্ধাত: নো ওয়ে। এসবে আমি নেই।
ঈশা: প্লিজ একবার এসো না প্লিজ প্লিজ প্লিজ
সিদ্ধাত: না না। তুইও ভিজিস না। যা ভিতরে যা।
ঈশা: না। আমিও ভিজবো তুমিও ভিজবা। এসো।

অনেক রিকুয়েস্ট করেও যখন রাজি করাতে পারলাম না তখন এক প্রকার জোর করে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়েছি। বাধ্য হয়ে আনরোমান্টিক রাক্ষস কে নামতেই হলো।দুজন এক সাথে ভিজছি। আমি বৃষ্টিকে অনুভব করছি আর কেউ একজন নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে দেখছে। আমি আমাদের বাগানে লাফালাফি করছি। হঠাৎই আমাকে শান্ত করে দিয়ে কেউ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আমি পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে যাই। তার এমন স্পর্শে আমার হার্ট বিট এতো পরিমানে বেড়েছে যেন কেউ ঢোল, তবলে বাজাতে শুরু করেছে। তার স্পর্শ আরো গভীর হতে লাগলো। পেটের ওপর তার শক্ত হাতের চাপে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো আপনাআপনি। সে আমার গলায় মুখ গুজে দিতেই আমি উল্টো ঘুরে জড়িয়ে ধরলাম। আর মুহুর্তেই সেও তার শক্ত বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর আমার ভেজা চুলে মুখ গুজে দেয়। আমার পুরো শরীর ভারী হয়ে এসেছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে মেঘ ডাকছে, বিদ‍্যুৎ চমকাচ্ছে আর মেঘ ডাকার শব্দে আমার হাত দুটি আরও শক্ত মুষ্টিবদ্ধ করে তার ভেজা টিশার্ট। অনুভব করলাম সেও আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিয়েছে। ঠান্ডা আবহওয়ায় তার উষ্ণ স্পর্শে এক অন্য রকম ভালো লাগা বিরাজ করছে। তার গরম নিশ্বাস আমার গলায় অনুভব করতে পারছি। এ যেন এক নেশা যেখানে ডুবেছি দুজনই। হঠাৎই আম্মুর এসে উপস্থিতি। চিৎকার করে বলেন,

মায়া বেগম : ঈশা!

আম্মুর ডাকে দুজন দুজনকে ছেড়ে আম্মুর দিকে তাকাতেই সজোরে একটা থাপ্পর পড়ে আমার গালে। তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যাই।

মায়া বেগম: আমার লজ্জা করছে তোকে নিজের মেয়ে ভাবতে। এতোটা অধপতন হয়েছে? এইভাবে বাড়ির সামনে ছিহ! তোর মত মেয়ের মা বলতে লজ্জা করছে আমার।

হঠাৎই সিদ্ধান্ত ভাইয়া বিস্মিত কন্ঠে বলে,

সিদ্ধাত: মায়া মা!

সিদ্ধাতের এমন কথায় মায়া বেগমের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সিদ্ধাতের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। তিনি বোঝার চেষ্টা করছে কিছু একটা। কিন্তু বুঝতে পারছে না। এই নামে তো তাকে একজনই ডাকতো। তাহলে কি এই সেই…..? মুহুর্তেই মায়া বেগমের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কৌতুহলবশত তিনি কাপাকাপা কন্ঠে বলেন,
মায়া বেগম: কে-কে? কে তুমি?

চলবে?