পূর্ণতা পর্ব-০৬

0
502

#পূর্ণতা❤️
#লেখনীতে-তানজিলা তাবাচ্ছুম

৬.

এত সব কিছুর মাঝে তারার মাথাটা ঘুরে আসছে। সে ব্যালকনি থেকে দ্রুত রুমে প্রবেশ করে।শত শত প্রশ্ন যেনো তাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে। প্রতিদিন ই কোনো না কোনো ভাবে নতুন কিছুর উপলব্ধি করছে। কিভাবে জানবে সে এত সব কিছুর সত্যি টা।কে তাঁকে উত্তর দেবে?আলোক কি সত্যি একজন সাইলেন্ট কিলার হবে?না চাইতেও তারার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরেই যাচ্ছে।এক অজানা কষ্ট হচ্ছে তার।তারা নিজেও বুঝতে পারছে না কেনো তার এমন হচ্ছে। আলোককে তো সে স্বামী হিসেবে মেনে নেয় নি।আর না কখনো তাকে নিয়ে ভেবেছে। তবুও কেনো আলোককে একজন কিলার ভাবতে,মানতে কষ্ট হচ্ছে তার?হয়তো এই কয়েকদিনে আলোকের সম্পর্কে তার ধারনা টা পাল্টে যাচ্ছিল।আলোকের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করেছিল।তাই হয়তো এখন সে এইসব মানতে পারছে না।তারা কাঁদছে। জোরে জোরে কাঁদছে।তারা কাঁদো কাঁদো গলায় নিজেকেই বলতে শুরু করে,’কেনো ওই লোক টার সত্যি টা মানতে এত কষ্ট লাগছে আমার? লোকটাকে তো আমি কখনো স্বামী মানি নি বা ওভাবে দেখিও নি!তাহলে কেনো মানতে এতটা কষ্ট হচ্ছে?’তারা নিজের দু’হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো টেনে ধরলো।তারপর আবারো কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করল,’এত দিন হয়তো লোকটাকে তার আচার-আচরণের জন্য ভালো ভেবেছিলাম।ভালো লাগতে শুরু করে ছিল।তার সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যাচ্ছিল আমার। কিন্তু আমি ভুলে গেলাম কি করে, যে উনি একজন ক্রিমিনাল?১০ বছর ধরে জেলে থাকা একজন ক্রিমিনাল।উনি যেমন তেমনই। হয়তো শুধু নিজেকে ভালো দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার আসল রূপ লুকাতে গিয়েও পারলেন না। ভেবেছিলাম মানুষের অতীতে যেমন থাকুক না কেন সে বর্তমানে একজন ভালো মানুষ হতে উঠতে পারে।আলোক নামে এই লোকটাকে ও এইরকম মনে হয়েছিল।’বলে একটা দীর্ঘশ্বাস হাফ ছাড়লো তারা। আবারো বলতে শুরু করল,’না।ওই লোকটার সাথে আমি কিছুতেই থাকবো না। কিন্তু যাবো কোথায়?কে আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবে?কে নিয়ে যাবে?কার কাছে যাবো আমি? নিজের বাড়ি থাকতেও তো আমি যেনো অনাথ!’বলে জোরে জোরে কাঁদছে তারা। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে গিয়ে নিজের চোখের পানি মুছতে শুরু করল তারপর মুছতে মুছতে ই বলল,’কোথায় যাবো!কি করবো! জানি না। কিন্তু এই খুনি লোকটার কাছে আমি কিছুতেই থাকবো না। কিছু তেই না’ বলে ধপ করে নিচে বসে পড়লো তারা।মাথা নিচু করে কেঁদে ই চলছে সে।কিছুতেই তার কান্না থামছে না উল্টো কান্নার বেগ বেড়েই চলছে তার।এত কাঁদতে কাঁদতে তার কানে ফজরের আজানের শব্দ এলো। আজান দিচ্ছে। কিন্তু তারার মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে।আবার তার খুব খিদে ও পেয়েছে কারন কাল রাতে সে কিছু খায় নি। গতকালকে রাতে গরুর মাংস রান্না হয়ে ছিল যেটাতে তারার এলার্জি রয়েছে তাই সে খায় নি।আশা তাকে অন্য কিছু করে দিয়ে খেতে বলেছিল , কিন্তু তবুও তারা না খেয়েই ঘুমিয়ে যায়।তারা উঠে দাঁড়ালো।সে নামাজ পড়ার জন্য ওযু করতে যাবে তখন দেখে তার বিছানার পাশে থাকা ছোট ড্রায়ার টার উপরে একটা বাটি ঢেকে রাখা।তারা ওখানে গিয়ে বাটিটার উপর থেকে ঢাকনা টা সরালো দেখলো ভেজিটেবল স্যুপ।তবে ঠান্ডা।তারা ভাবছে এটা এখানে কিভাবে এলো?নাকি তার শাশুড়ি দিয়ে গেছে? হয়তো তাই হবে তার শাশুড়ি দিয়েছে।তারা ওযু করে এসে নামাজ পড়ে নিলো।তারপর স্যুপের বাটি টা নিয়ে কিচেনে গিয়ে গরম করতে দিলো।তারা হাত ধোয়ার জন্য বেসিনে যেতেই ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে যায়।সে দেখলো পানির ট্যাপের হ্যান্ডেলে ছিটে ছিটে রক্ত।রক্ত দেখেই তার গা কাঁপতে শুরু করে দেয়।তারা বার বার ঢোক গিলছে।তারপর পানি ছেড়ে দিয়ে রক্ত গুলো ধুয়ে দেয়।তারপর সে দ্রত স্যুপ ঢেলে নিয়ে নিজের ঘরে আসে। খাওয়া শুরু করে কিন্তু কালকে রাতে আলোকের রক্ত মাখা সেই সিন আর কিছুক্ষণ আগের দেখা ছিটে ছিটে রক্তের দাগ ,সেগুলো মনে পড়লেই তার গলা থেকে যেনো খাবার নামছে না। কিন্তু তার তো খুব খিদে পেয়েছে তার জোর করে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ হতেই দরজার দিকে তাকাতেই দেখে আলোক দাঁড়িয়ে আছে।আর তার মুখে হাসি।তারা হঠাৎ আলোককে দেখে একটু ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু তার কাছে রহস্যময় লাগছে আলোক এভাবে মুচকি হাসছে কেনো?এমন অবস্থায় হাসির কারণ টা তার কি হতে পারে?তারার এবার আলোককে একটু বেশিই ভয় লাগছে। কোথাও আলোক জানতে পারে নি তো কালকে রাতে তারা আলোককে হাতে ছুড়ি আর রক্ত সহকারে দেখেছিল?তারা ভাবছে ,আলোক কি বুঝতে পেরেছে যে সে জানে আলোক খুনি? তাহলে কি আলোক তাকেও মেরে ফেলবে?নাহলে এভাবে হাসছে কেনো?আলোক ব্যালকনিতে চলে যায়।আর তারা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।তারা কিছুতেই বুঝতে পারছে না আলোককে!আলোকের হঠাৎ এভাবে হাসির মানে টা কি?যেনো সে কোনো কিছুতে সফল হয়ে গেছে।তাহলে কি সত্যি আলোক?তারার চোখ থেকে না চাইতেও পানি পরতে লাগলো। হঠাৎ আলোকের কন্ঠ শুনে তারা তার চোখ মুছে পিছনে ঘুরে তাকায়,

‘শুনুন।’

তারা আলোকের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না তাই মাথা নিচু করে আছে।আলোককে তার কেমন ভয় লাগছে।

‘আপনাকে মা ডেকেছিলো।’

তারা মাথা নাড়িয়ে দরজা খুলে নিচে চলে আসলো।

.

.

__________

এভাবেই কেটে যায় এক সপ্তাহ।তারা আর আলোকের সম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে। শুধু বদলেছে তো তারার মনের ধারনা।এখন তারা আলোককে কিছু বলার তো কি ,তার দিকে তাকানোর ও সাহস পায় না।সে আলোককে সেদিনের পর থেকে খুব ভয় পায়। আলোকের সেদিনের হঠা্ৎ তাকে দেখে হাসার কারন টা অজানা।তার মনে করে নিয়েছে হয়তো তারা তার সম্পর্কে সব জেনে গেছে ।আর হয়তো এই জন্যই আলোক তারাকে দেখে হাসছিল। বিছানায় বসে আছে তারা।আর ভাবছে, না নিজের বাড়িতে শান্তি তে থাকতে পারলো আর না এখানে। প্রতিনিয়ত তার সামনে নতুন কিছু আসছে।যেন বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ আর বাড়ির প্রত্যেকটি কোনায় কোনায় রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রত্যেকটি মুহূর্তে ই তার প্রশ্নের সংখ্য বেড়েই চলছে কিন্তু সব কিছুর উত্তর একটাই।সেটা হলো অজানা।সব কিছু র উত্তর ই তার কাছে অজানা।তারা শশুর শাশুড়ি ডাকছে। তার কানে ডাকার শব্দ আসছে।তারা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখে তার শশুর শাশুড়ি হয়তো কোথাও যাচ্ছে।তার শাশুড়ি আশা বোরকা পরা আর তার শশুর রায়হান শার্ট প্যান্ট পরা।আর তাদের পাশে থাকা সুটকেস টা দেখে তারা ভ্রু কুঁচকালো।তারা কিছু বলবে তার আগেই আশা তার কাছে এসে হাত ধরে বলতে শুরু করে,

‘মামনি ভালো থেকো।আর নিজেকে একদম একা মনে করবে না আলোক আছে তোমার সাথে।’

তারা এতক্ষণ একটু হাসছিল। কিন্তু আশার কথা গুলো সে ঠিক বুঝতে পারলো না।তাই আস্তে আস্তে বলল,

‘আ___আলোক__আলোক আছে মানে?আর নি__নিজেকে একা কেনো ভাববো?’

আশা ভ্রু উঁচু করে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘আসলে আমি আর তোমার বাবা চলে যাচ্ছি।’

তারা কথাটা শুনে হতবাক হলো।

‘চ__চলে__চলে যাচ্ছেন মানে?’

‘মানে আমরা আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি।তারা এবার হালকা হাসলো তারপর বলল,

‘ওহ।একটু দাঁড়ান আমি রেডি হয়ে আসছি।

বলে যেতে লাগলো আশা বলে উঠে,

‘আরে আরেএএএ।’

তারা থেমে গিয়ে পিছনে তাকাতেই আশা বলে,

‘তুমি কোথাও যাচ্ছ না।’

তারা নিচের ঠোঁট টাকে জিভ দ্বারা ভেজালো তারপর বলল,

‘মা আপনি তো বললেন বাড়ি তে যাবেন তাহলে?’

আশা হাসতে শুরু করলো।তারপর বলল,

‘হ্যা সেটা আমি আর তোমার শশুর মশাই যাচ্ছি।’

তারা একটা ঢোক গিলে বলল,

‘তা_তা__তাহলে__তাহলে আম__আমি একা থাকবো কিভাবে?’

‘আলোক! আলোক থাকবে তো তোমার সাথে।

আশার পিছন থেকে তার শশুর রায়হান বলল।তারা জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করলো।

‘আর স্বামী থাকলে আর কি লাগে?আর আমি আলোকে বলে যাচ্ছি যাতে আমার বউ মাকে কখনো একা না রাখে।’

তারপর রায়হান হাসতে শুরু করলো সাথে আশাও।হঠাৎ রায়হান কিচেনের দিকে তাকিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘আলোক বাবা আমার বউ মাকে কখনো একা রাখবা না। সবসময় ওঁর সঙ্গে থাকবা।’

তারা কথাটা শুনে কিচেনের দিকে তাকিয়ে দেখে আলোক হাতে একটা ছুড়ি নিয়ে তাদের দিকে আসছে।আলোক এসে দাঁড়ালো।আশা আলোকের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল,

‘শুন বাবা।বউ মার খেয়াল রাখবি!’

আলোক ছোট করে’হুম’উত্তর দিলো। আশা আবারো আলোককে বলল,

‘ও কি চায় শুনবি।ওকে দেখে রাখবি।’

আলোক আবারো ছোট করে ‘হুম’উত্তর দিলো।

‘ওকে কখনোই একা রাখবি না। সবসময় ওর সাথে থাকবি।’

এবার আলোক তারার দিকে তাকালো।তারা নিজের চোখ নামিয়ে নিল।আলোক তারার দিকে তাকিয়ে নিজের হাতে থাকা ছুরি টা হাতের তালুতে স্লাইড করতে করতে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘আচ্ছাআআ। ক-খ-নো-ই_এ-কা__রা-খ-বো_নাআআ।'[টেনে টেনে]

তারার ভয় বেড়েই চলছে। আলোকের কথা বলার ভঙ্গি টা অদ্ভুত লাগলো।আগে কখনোই তাকে এভাবে কথা বলতে শুনে কিংবা দেখে নি তারা।তারা আলোকের দিকে তাকানোর সাহস ই পাচ্ছে না। আলোককে তার এতটাই ভয়ংকর লাগছে।তারার এটা ভেবে আরো ভয় লাগছে আজকে থেকে এই বাড়িতে কেউ থাকবে না। শুধু সে আর আলোক ই থাকবে।যদি আলোক নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দেয়?তাহলে কি হবে? ভাবতেই তারার গলা শুকিয়ে আসছে।
_______

#চলবে…