প্রজাপতি উৎসব পর্ব-০৭

0
221

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ৭
রঞ্জন রক্তের অক্ষরে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে।
-রূপা,
তোমার ঠোঁটে একটা চুমু খেতে চেয়েছিলাম। তাই নিয়ে তুমি সাতকাহন করে সাতদিন কথা বন্ধ রেখেছো। আমি এখনো বুঝতে পারছি না আমার দোষটা কোথায়। প্রেম করলে এখনকার ছেলেমেয়েরা আরও কত দুষ্টু দুষ্টু কাজ করে, শুনলে তোমার কান লাল হয়ে যাবে। আমি রঞ্জন তো সেই তুলনায় নিরীহ, নির্বোধ, নাবালক, নাদান ছেলে, ভোরের শিশিরে ধোয়া সবুজ তুলসি পাতা।
লোকে বলে বেশী ভালো হতে নেই, বেশী ভালো হলে জীবনে অনেক দুঃখ পেতে হয়। কিন্তু কী করবো বলো, আমি জন্মগতভাবে একটা ভালো ছেলে। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, জিনে, ক্রোমোজোমে কেবল ভালোত্ব আর ভালোত্ব। চাইলেও আমি খারাপ হতে পারি না। তাই বুঝি তোমার অহেতুক অবহেলা সইছি, হে রূপামণি।
এখন অনেক রাত। আকাশে মেঘে ঢাকা, একটা তারাও নেই। বন্ধুরা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাই ঘরের বাতি নিভিয়ে হারিকনের টিমটিমে আলোয় তোমাকে চিঠি লিখছি। একটু আগে সুইস নাইফ দিয়ে কাটা ডান হাতের কেনি আঙ্গুলটা কলম হিসেবে ভালোই কাজে দিচ্ছে । না, না, পুরো আঙ্গুল কেটে আলাদা করিনি, আঙ্গুলের আগা কেটেছি।
ডাইরেক্ট আঙ্গুল দিয়ে লিখছি, তাই রক্তের অক্ষরগুলো মোটা মোটা আর বাঁকাত্যাড়া হলো। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আঙ্গুল কাটা বলে দু হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে পারছি না, এ জন্য আমি অতীব দুঃখিত।
রূপা, কাল বিকেল তিনটায় সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে আমি তোমার জন্য অনন্ত অপেক্ষায় থাকবো। প্লিজ, লক্ষ্মীমণি, আর রাগ করে থেকো না, ধ্রুব তারার মত আবার দেখা দাও। তোমার অভিমানের মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরুক আমার দেহে, আমার মনে, আমার কাটা আঙ্গুলে।
-রঞ্জন
রঞ্জনের চিঠ পড়ে আমার নিজের উপর রাগ হলো। আসলেই তো এখনকার ছেলেমেয়েরা কত কী করে। বাসা উঠলেই ইটিস পিটিস দেখে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিই। সেই তুলনায় রঞ্জনের চুমু নিয়ে আমি একটু ওভার রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছি। বেচারার মান-সম্মান আর পৌরুষে লেগেছে। তারপরও রঞ্জন আমাকে ভালোবাসে বলেই লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে নিজের কেনি আঙ্গুলের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে। কাল বিকেল তিনটায় আমি লাইব্রেরি যাবো। রঞ্জনের সঙ্গে দেখা করে স্যরি বলবো। এখুনি টেক্সট করতে পারি, কিন্তু কোন কিছুতেই তাড়াহুড়া আমার অপছন্দ।
আজ প্রীতিলতা হলে দুটো নতুন মেয়ে এসেছে। একজনের নাম চন্দ্রিমা, অন্যজনের নাম ক্রমেলা। দুজনই ভীষণ হাসিখুশি আর সাজানো গোছানো। ওদেরকে দেখেই মনের উপর দিয়ে সতেজ হাওয়া বয়ে গেলো। আমাদের হলের হাউজ টিউটর চঞ্চু কোরায়েশি বলেলন, ওরা ঢাকা ভার্সিটি থেকে এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে এসেছে। কী একটা গ্রুপ প্রজেক্ট কাজে কিছুদিন এখানেই থাকবে।
কিন্তু দিলশাদ আমাকে ফিসফিস করে বলেছে,
-রূপা, কাউকে বলিস না, এরা ইন্সপেক্টর লাবণির লোক, আন্ডারকভারে কাজ করবে। প্রাথমিক তদন্ত এরাই চালাবে। তারপর ইন্সপেক্টর লাবণি মাঠে নামবে।
-ইন্সপেক্টর লাবণি দেখা যাচ্ছে খুব মেথোডিকাল ডিটেকটিভ।
-তুই নিউজ দেখিস না বলে কিছুই জানিস না। ইন্সপেক্টর লাবণি এখন বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান গোয়েন্দা। উনি যখন এই কেইসে হাত দিয়েছেন, রেপিস্ট যে বা যারাই হোক, ধরা তাদের পড়তেই হবে।
-আমার তো নিজেরই এখন ইন্সপেক্টর লাবণির সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে।
– ঠিক আছে, লাবণি আপা যখন আসবে, তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।
দিলশাদের সঙ্গে কথা সেরে রুমে এসে দেখলাম মিতি বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছে। একটু পরপর ওর ভাইবার নাকি হোইয়াটসঅ্যাপে টুং করে টেক্স আসছে, মিতি বিদ্যুৎ গতিতে উত্তর দিয়ে আবার বইয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। আমি ল্যাপটপ খুলে হটমেইলের ইনবক্সে দেখলাম মস্কো স্টেইট ইউনভার্সিটি থেকে ইমেইল এসেছে। নিশ্চয় টিটু ভাই। কী একটা অবস্থা, আজ কি বিশ্ব চিরকুট দিবস? টিটু ভাই লিখেছেন,
প্রিয়তমা রূপা,
তিন সপ্তাহ হয়ে গেলো আমি মস্কো এসেছি। একদা সমাজতন্ত্রের রাজধানী এখন মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য। জনগণের রক্ত শুষে অগাধ সম্পদ কুক্ষিগত করছে কতিপয় নব্য পুঁজিপতি। নেশা, দারিদ্র্য, নাইটক্লাব আর প্রস্টিটিউশনে পুরো শহর সয়লাব। মানুষ আবার মানুষকে পণ্য করছে, মানুষ আবার মানুষকে জীবিকা করছে।
হয়তো এ কারণেই এই মুহূর্তে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘৃণিত নেতা হলেন গ্লাস্তনস্ত আর পেরেস্ত্রইকার জনক গর্বাচেভ। তিনি একটা লৌহযবনিকা সরিয়ে অসংখ্য ভাঙ্গা আয়নার বিভ্রমে ফেলে গেছেন পুরো জাতিকে। গর্বাচেভ বোঝেননি মাফিয়ার রাজ্যে কেবল বাকস্বাধীনতাই লোপ পায় না, ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তাও হারিয়ে যায়।
মস্কো এসে প্রথম কী করেছি জানো? রেড স্কয়ারে লেনিনের মোসোলিয়ামে গিয়েছি। প্রায় এক শতাব্দী হয়ে গেলো ওনার মৃত্যুর। কিন্তু মানুষটা আজও ওখানে শায়িত আছেন। দূর থেকে মনে হবে লেনিন একটা কাঁচের বাক্সে ভেতর নিবিড় নিদ্রায় নিমগ্ন। আমি কাছে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধাভরে ওনাকে দেখলাম। শুধুমাত্র অসম্ভব মনের জোর আর সিঙ্গেলনেস অফ পারপাজের কারণে এত বড় একটা দেশকে বলশেভিকদের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। লেনিনের অস্বাভাবিক রকম বিরাট মাথা আর বলিষ্ঠ চোয়ালে এখনো সেইএকরোখা ভাবের ক্ষীণ কিন্তু দুরন্ত রেশ রয়ে গেছে।
কী দুর্ভাগ্য, অক্টোবর বিপ্লবের প্রথম বছরেই লেনিন গুলিবিদ্ধ হলেন। বিপ্লবের মাত্র তিন বছরের মাথায় শরীরে বিঁধে থাকা বুলেটের অক্সিডেশনের কারণে তিনি প্যারালাইজড হলেন। ১৯১১ সালে কার্ল মার্কসের মেয়ে যখন সুইসাইড করলো, ফিউনেরাল থেকে ফেরার সময় লেনিন তার স্ত্রী ক্রুপস্কায়াকে বলেছিলেন, ভালোই করেছে, জাতিকে কোন কিছু দিতে না পারলে বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না। আর ১৯২১ সালে নিজেই যখন ধীরে ধীরে অথর্ব হয়ে যাচ্ছেন, উনি ক্রুপস্কায়ার সাথে পরামর্শ করলেন পটাসিয়াম সায়ানিড খেয়ে সুইসাইড করবেন কি করবেন না। এটাকেই বলে ইন্টিগ্রিটি। ওনার অসুস্থ অবস্থায় ক্ষমতা চলে এলো এমন এক অসুরের হাতে যে হত্যার পর হত্যা চালিয়ে সমাজতন্ত্রের গায়ে কালিমা লেপে দিলো। এত রক্ত ঝরেছে, কালিমা না বলে বরং লালিমা বলা ভালো। অনেকে ভুলে যায় স্টালিন এসে বারোটা বাজিয়ে দেয়ার আগে লেনিন মিশ্র অর্থনীতির নিউ ইকনমিক পলিসি চালু করেছিলেন ওই ১৯২১ সালেই। লেনিনের চিন্তার এই ফ্লেক্সিবিলিটির কারণে ওনার পলিসিকে মার্কসিজম না বলে লেনিনিজম বলা হয়। লেনিন যদি সত্যি বেঁচে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাহলে হয়তো আমরা আরও সহনশীল সাম্যবাদী সমাজ পেতাম।
রূপা, লেনিনের মোসোলিয়াম থেকে ফিরে আসতে আসতে অর্থনীতি, রাজনীতি, কোলাহল-হলাহল ভুলে তোমার ওই গহন গভীর চোখ দুটো মনে ভেসে উঠলো । মস্কো আসার আগে তোমাকে আমার মুগ্ধতা নিবেদন করেছি। তোমার দিক থেকে সাড়া পাইনি। সবার সামনে শিশুর মত কেঁদেছি। কিন্ত তা নিয়ে আমি লজ্জিত নই। যে ভালোবাসা কাঁদাতে না পারে, তা কি আসলেই ভালোবাসা? জনম জনম তব তরে কাঁদিব, যতই হানিবে হেলা, ততই সাধিব।
মনে পড়ে তুমি বলেছিলে রাশিয়াল ললনারা আমাকে লুফে নেবে। একেবারে ভুল বলোনি। লুফে না নিলেও লুদমিলা নামের একটা মেয়ে আমাকে খুব পছন্দ করে। আমার মরমী কবির মত মুখায়ব নাকি ওর মনে মর্মর ধ্বনি জাগায়। লুদমিলা প্রায়ই আমাকে এখানে ওখানে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করে। আমি এড়িয়ে যাই। মেয়েটা পরীর মত সুন্দর, ঝর্নার মত স্বচ্ছ। কিন্তু আমি যে আর কাউকে মনে স্থান দিতে পারছি না।
রূপা, তোমার উপেক্ষা আর অপ্রেম তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা একবিন্দুও ম্লান করেনি। ক্রিস্টাল বোতলে পুরোনো দ্রাক্ষাসুধার মত এই প্রেমের মূল্য দিন দিন বাড়ছে। আমার নিঃসঙ্গ, নিঃশর্ত, একমুখী প্রেম একটা খরস্রোতা নদী, চিরকাল তোমার ফেনিল সাগরের দিকে ধাইছে।
মস্কোতে শীত নামছে। এখন তাপমাত্রা পনেরো ডিগ্রী সেলসিয়াস। আগামী মাসে দশ হবে, তারপর পাঁচ, তারপর শূন্য। অথচ তোমার বিরহে আমার মনের ঝাউবনে এখুনি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। আমার পাতায় পাতায়, কুসুমে-কোরকে তোমার না-থাকা শুভ্র তুষার হয়ে অবিরত ঝরছে। আমি ব্যথায় ব্যথায় হিম হয়ে যাচ্ছি।
ইতি,
টিটু
টিটু ভাইয়ের চিঠিটা পড়ে আমি বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ চাপা দিলাম। জানি না কেন, আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে। মিতি অবাক হয়ে বললো,
– এই রূপা, কী হলো, কাঁদছিস নাকি?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-আমি কনফিউজড মিতি, আমি ভীষণ কনফিউজড।
(চলবে)