প্রণয়ের সূচনা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
237

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৩
__________________________
সকাল এগারোটা।সূচনাদের বাসা থেকে এসে পড়েছে প্রণয়রা।আসার সময় হৃদুর সে কি কান্না।বারবার একটা কথাই বলছিলো-মিত্তি আমাল ফুপাকে নিয়ে যাততে।আমাল ফুপাকে নিওনা।এদিকে মিহুও তার বাসায় চলে যেতে চাইছিল কিন্তু সূচনা এক প্রকার জোর করে ই রেখে দিয়েছে।সূচনা, ইরাদের বাসায় পৌছে দিয়েই তন্ময়ের সাথে অফিসে চলে গেছে প্রণয়।ইসহাক সাহেবও অফিসে। মিসেস আফিয়া সব কাজ সেড়ে পা বাড়ালেন রুমের উদ্দেশ্যে সূচনার কাছে।ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে সবে বের হয়েছে সূচনা,তখনই আগমন ঘটেছে মিসেস আফিয়ার।ঠোঁটে হাসি টেনে সূচনাকে জিজ্ঞেস করলেন –

–‘আসতে কোনো অসুবিধা হয়েছে?

–‘ না হয়নি।

–‘ফ্রেশ হয়েছো না চলো কিছু খাবে।

–‘এখন কিছু খাবনা ক্ষুদা নেই।আপনি নাস্তা করেছেন?

–‘ নাস্তা করেছি।চা করে রেখেছি।এক সাথে খাব আর কথা বলবো চলো।

সূচনা মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো।
.
.
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে মিসেস আফিয়া আর ফ্লোরে বসে আছে সূচনা।মিসেস আফিয়া সূচনার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন।অবশ্যই সূচনার ইচ্ছায় না জোর করেই।বিয়ের আগে মিসেস দিশা জোর করে দিয়ে দিতেন আর আজকে মিসেস আফিয়া দিচ্ছেন।সূচনার পাশে বসেই চা খাচ্ছেন ফিরোজা খালা।আর হা করে তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে।সে আবার স্টার জলসার নাটকের ফ্যান নাকি।সব কাজ শেষ করে নেন আগে ভাগেই যেন নাটক দেখার সময় কোনো ডিস্টার্ব না হয়।সূচনা আমতা আমতা করে মিসেস আফিয়া কে বললো-

–‘মামী বেশি তেল দিলে কেমন কেমন লাগে না?

মিসেস আফিয়া হেসে বললেন-

–‘টেনশন করো না বেশি দেইনি।পরিমান মতো দিয়েছি।কালকে না হয় শ্যাম্পু করে নিও।

সূচনা মাথা নাড়ালো।হুট করে মিসেস আফিয়ার দিকে ঘুরে বললো-

–‘মামী আপনি না হয় আমাকে তুই করে সম্বোধন করুন।তুমি সম্বোধন টা কেমন জানি লাগে।

মিসেস আফিয়া হাসলেন সূচনার কথায়। হাসি টেনে ই বললেন –

–‘ঠিক আছে।

সূচনার মাথায় তেল দেয়া শেষ হলে বেনী করে তার কাধের একপাশে রেখে দিয়ে মিসেস আফিয়া বললেন –

–‘শোন আমি গোসল করতে যাচ্ছি।মিহু,দিনা তো ঘুমোচ্ছে ওদের ডেকে দেয়।ইরা বোধহয় রুমেই একটু দেখে আসিস আর তিথি তো পড়ছে ওকে গোসলে পাঠিয়ে দিবি আর বের হওয়ার জন্য তাড়া দিস না হয় দেরি করে ফেলবে। ওয়াশরুমে একবার গেলে তো আর আসার নাম নেয়না।আর হ্যা প্রণয়কে একটু ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করিস তো ও কখন আসবে।সম্ভব হলে দুপুরেই আসতে বলিস।

–‘ঠিক আছে।

মিসেস আফিয়া চলে যেতেই ফিরোজা খালা সূচনাকে বললো-

–‘আপনে তো ভাগ্যবতী আফামনি। এমন পরিবারে বিয়া হইসে আপনের।আমি সাত বছর ধইরা এহানে কাজ করতাসি বহুত ভালা তারা।আর আব্বাজান তো একেবারে সোনার টুকরা।যার সাথে আপনের বিয়া হইসে।আমারও বিয়া হইসিলো কিন্তু আপনের মতো অত ভাগ্য নাই।ছোড বয়সেই বাপে মা*য়ে বয়সে বড় এক বে*টার লগে বিয়া দিয়া দে।পথম পথম ভালোই আছিলো কিন্তু পরে টেকার লাইগা চা*প দিতে থাকে।ধার দেনা কইরা বাপে পঞ্চাশ হাজার টেকা দিসিলো বাকিটা দিতে পারেনা।ডেলি ডেলি গায়ে হাত তুলতো,এক কাহিনি আর কত ভাল্লাগে কন।টিকলোনা সংসার।বাপে মা*য়েও রাখলোনা।হেরপর আইলাম ঢাকা শহরে।গেরামের এক পরিচিত খালায় এদিকে দিয়া গেল কাজে লাগায় তারপর তে এহানেই আছি।এই পরিবারের কেউই আমার লগে খা*রাপ ব্যবহার করেনাই।থাকার লাইগা আলাদা কামরা ও দিসে আমারে।এই গরিবের ক*পালে কিন্তু এডা অনেক আফা।এই ঢাকা শহরে কে করে এতখানি কার লাইগা।বলেন।

নিরব ভঙ্গিতে ফিরোজা খালার কথাগুলো শুনছিল সূচনা।তার কথা শেষ হলে সূচনাও তাকে বললো-

–‘হ্যা।খালা আমি এখন যাই।গোসল করতে।

–‘ঠিক আছে যান।আমিও উঠি।

ড্রয়িং রুম থেকে প্রথমে মিহু আর দিনার কাছে আসলো সূচনা।এখনও ঘুমাচ্ছে তারা।তাদের ডেকে দিয়ে ইরার রুমে আসলো।পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে কিছু একটা নিয়ে দেখছিল ইরা।সূচনা পেছন থেকে ডাক দিতেই চমকে উঠলো ইরা।হাতের জিনিস টাও আড়াল করলো।সূচনা জিজ্ঞেস করতে নিয়েও করলো না।চেয়ার থেকে উঠে তার সামনে দাড়ালো ইরা।মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কিছু বলবে ভাবি?

তৃতীয় বারের মতো সূচনাকে ভাবি বলে সম্বোধন ইরার।প্রথম দেখতে যেয়ে দুইবার করেছিল।তারপর বিয়ের তিনদিনের মাথায় আজকে।মৃদু হাসলো সূচনা।বললো-

–‘এমনি দেখতে এসেছিলাম কি করছো।

–‘দেখা হয়ে গেছে এখন কি চলে যাবে?

–‘তোমার সমস্যা না থাকলে থাকব তবে আমিতো শাওয়ার নেইনি,নামাজ ও পরতে হবে।

–‘আচ্ছা তাহলে দুপুরে খেয়ে একসাথে বসব।

–‘ঠিক আছে। যাই তাহলে।

সূচনা যেতে নিলে পিছু ডাকলো ইরা।থামলো সূচনা।কাবার্ড থেকে নীল রঙের একটা শপিং ব্যাগ বের করে হাতে দিল সূচনার।অধর কোণে হাসি টেনে বললো-

–‘তোমার জন্য ছোট্ট গিফ্ট।

সূচনা ঘোর আপত্তি জানালো।কিন্তু ইরা শুনলো না।অধিকারের স্বরে বললো-

–‘আমার একমাত্র ভাবীর জন্য ননদ হিসেবে আমি ছোট কিছু একটা গিফ্ট করতেই পারি তুমি না করছো কেন?খবরদার,,না করবেনা।নাও।

এবার নিঃশব্দে হাতে নিল সূচনা।মুচকি হেসে বললো-

–‘এত মূল্যবান উপহারের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

বিনিময়ে মুচকি হাসলো ইরা।ইরার রুম থেকে তিথির রুমে আসতেই দেখল সে এখনো পড়ার টেবিলে বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে বসে আছে।

–‘এখনো পড়ার টেবিলে?

তিথি মুখটা কাঁদো কাঁদো ফেসে বললো-

–‘সামনে পরীক্ষা ভাবি।

–‘টেনশন হচ্ছে?

–‘হ্যা অনেক।

–‘টেনশন করো না একদম।সব কমপ্লিট করে ফেলো। ঠান্ডা মাথায় একেবারে চিল মুডে পরীক্ষা দিবে।টেনশন করলে পরীক্ষা খা*রাপ হয় বুঝলে?

–‘হ্যা বুঝলাম।

–‘গুড।এখন শাওয়ার নিতে যাও আর হ্যা অবশ্যই তাড়াতাড়ি বের হবে নাহলে মামাী কিন্তু আমাকে ব*কবে।

–‘ঠিক আছে।

রুম থেকে চলে আসতে নিলেই তিথির পড়ার টেবিলের সেলফের এক কোণে সূচনার চোখ আটকে গেল।অলকানন্দা ফুল।অদ্ভুত সৌন্দর্য সে হলুদ ফুলে।কিন্তু এই অলকানন্দা এখানে আসলো কিভাবে আসলো।গাছ তো দেখল না।আগ্রহ দমি*য়ে রাখতে না পেরে তিথিকে জিজ্ঞেস করলো-

–‘এই বাসায় কি অলকানন্দা গাছ আছে তিথি?

–‘হ্যা বাড়ির পেছন দিকটায় আছে।সেখানে অলকানন্দা গাছ আছে তিনটা।একটু আগে গিয়েছিলাম যেয়ে দেখি নিচে পড়ে আছে তারপর নিয়ে এসেছি।

–‘আচ্ছা আমি নিতে পারি?

সূচনার বাচ্চা সুলভ কণ্ঠে করা আবেদন। তিথি হেসেই ফেলল।হাসতে হাসতেই বললো-

–‘এমন ভাবে বলছ যেন আমি না করব।নিয়ে নাও যতটা খুশি।

হাসলো সূচনা। দুইটা ফুল নিল সেখান থেকে।রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখলো।প্রণয়কে ফোন করতে হবে।ফোন হাতে নিয়ে প্রণয়ের নাম্বারে ডায়াল করলো।রিং হলেও ফোন রিসিভ হচ্ছে না।টানা তিনবার কল করলো সূচনা।কিন্তু রিসিভ করা হলো না।রিসিভ কেন করছেনা?হয়তো ব্যস্ত।একটু পরে ট্রাই করবে বলে ফোন রেখে দিল।আয়নার সামনে যেয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে একটা ফুল হাতে নিল।গুজে দিল বিনুনী করা চুলের পাশে।
.
.
কলিং বেলের আওয়াজে এক প্রকার দৌড়ে গেল ফিরোজা খালা। দরজা খুলে প্রণয়কে দেখেই মিষ্টি হাসি দিলেন।বললেন-

–‘আব্বা আইজকা এত তাড়াতাড়ি যে?

প্রণয় ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো-

–‘হ্যা খালা আজকে কাজ কম ছিল আর মামী বললো তাড়াতাড়ি আসতে।সবাই কোথায়?

–‘খালাজান তো রুমে।আফামনি রা সবাই তো দেখলাম রুমে।আপনে রুমে যান।আমি শরবত কইরা আনতাসি।

–‘ঠিক আছে খালা।

রুমে এসে সূচনাকে পেলনা প্রণয়।বিছানায় ব্যাগ রেখে টাই খুলতে খুলতে ব্যালকনিতে গেল।ব্যালকনির একপাশে মানি প্ল্যান্ট গুলোকে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল সূচনা।নিঃশব্দে তার পেছনে যেয়ে দাড়ালো প্রণয়।সূচনা এক পা পেছাতেই প্রণয়ের বু*কের সাথে পিঠ ঠেকলো।চম*কে গেল সূচনা।সে তো একাই ছিল তাহলে কে আসলো?চকিতে সামনে ঘুরলো সূচনা।প্রণয়কে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লো সে।তার ওপর প্রণয় তার এত সন্নিকটে।প্রণয়ের দিকে মাথা তুলে তাকালো সূচনা।প্রণয়ের তপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়ছে তার চোখেমুখে।হৃদকোমলে অস্থিরতার জোগান তার।তাতে নতুন মাত্রা যোগ দিল প্রণয়ের ফিচেল কণ্ঠে বলা উক্তি –

–‘রঙ্গন থেকে অলকানন্দা হয়েছ কেন আজকে।এলোকেশী কন্যার চুলে হলুদ রঙা ফুল।একদম অলকানন্দা রাণী লাগছে।

দৃষ্টি নত করে নিল সূচনা।সরে আসলো প্রণয়।সূচনা ধীর পায়ে ব্যালকনি প্রস্থান করল।একটুপর হাতে এক গ্লাস শরবত নিয়ে আসলো সূচনা।প্রণয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলে প্রণয় জিজ্ঞেস করলো-

–‘কে বানিয়েছে?

সূচনা মুখ ছোট করে উত্তর দিলো-

–‘ফিরোজা খালা বানিয়েছেন।

–‘আমি লেবু বেশি খাই।খেয়ে দেখ তো লেবু কতটুকু।

সূচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘খেয়ে দেখব মানে?

–‘খেয়ে দেখবে মানে খেয়ে দেখবে।খাও

আমতা আমতা করে এক চুমুক খেয়ে বললো-

–‘ঠিক আছে।

–‘এটা কি করলে,, তোমার মুখ দেয়াটা আমি এখন খাব?

প্রণয়ের কথায় সূচনা অপমানিত বোধ করলো।চোখ নামিয়ে ফ্লোরে নিবদ্ধ করলো।এভাবে কেন বললো প্রণশ?সে নিজেই তো বলেছিল।প্রণয় সূচনার সামনে এসে দাড়ালো।তার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে এক চুমুকেই শেষ করলো।সূচনার দৃষ্টি এবার ফ্লোর থেকে প্রণয়ের দিকে নিবদ্ধ হলো।প্রণয়ের অধর কোণে বা*কা হাসি।সেই হাসি বজায় রেখেই তার কানের কাছে এসে বললো-

–‘এখন থেকে রোজ তুমি শরবত বানাবে, খেয়ে চেক করবে তারপর আমাকে দিবে।

সূচনা হা হয়ে গেল প্রণয়ের কথা শুনে। প্রণয় আবার বললো-

–‘গট ইট?

মাথা ঝাকালো সূচনা।

——————————————
–‘ মা-বাবা হারানো সন্তানদের সুখে থাকা কিন্তু আসলেই সহজ না,,তার ওপর অন্য কাউকে খুশও রাখা তো তার চেয়ে ও কঠিন।

প্রণয়ের করা উক্ত উক্তি শুনে চমকে তার দিকে তাকালো সূচনা।

#চলবে

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৪
__________________________
–‘ মা-বাবা হারানো সন্তানদের সুখে থাকা কিন্তু আসলেই সহজ না,,তার ওপর অন্য কাউকে খুশি রাখা তো তার চেয়ে ও কঠিন।

প্রণয়ের করা উক্ত উক্তি শুনে চমকে তার দিকে তাকালো সূচনা।তার মানে প্রণয় সব শুনেছিল কালকে।আসরের নামাজ শেষে ব্যালকনিতে দাড়িয়েছিল সূচনা।একটু পর প্রণয় এসে ও দাঁড়ালো তার পাশে।মিনিট দুয়েক এর মতো নিরব থেকে করলো এই উক্তি।সূচনার দৃষ্টি দেখে হাসলো প্রণয়।বাইরের দিকে চোখ রেখে মিহি স্বরে বললো-

–‘যা ভাবছ তাই।ওনার কথা শুনে খা/রাপ লেগেছে কিন্তু তোমার দেয়া জবাবে তার চেয়ে দ্বিগুণ ভালো লাগা কাজ করেছে।আমি তো জবাব দিতে পারতমনা আর দেইওনা কিন্তু তুমি দিয়েছ।আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো এতই চুপচাপ স্বভাবের যে কেউ ভুল বা খা/রাপ কিছু বললেও তার প্রতিবাদ করোনা।আমার হয়ে কথা বলার জন্য ধন্যবাদ। তবে সত্যি কি জানো মামা মামি না থাকলে আমাদের অবস্থা হয়তো ফুপির দেয়া বর্ণনার মতোই হত।হয়তো,,

এতটুকু বলেই থামলো প্রণয়।তার দিকে চোখ রেখে ই সূচনা নিচু স্বরে বললো-

–‘আস, আসলে উনি এমনই। চও/ড়া কথা বলেন এজন্য আমার ও তেমন একটা পছন্দ না।আপনি তার কথায় কিছু মনে করবেন না।এত বার বলি আমি কিন্তু উনি তবুও এমনই। কিছু মানুষ আসলে নিজেদের কিছু স্বভাব কখনোই পরিবর্তন করতে পারে না।আমার তো মনে হয় উনি পরিবর্তন করতেই চায়না।

–‘কিন্তু ইরাদ ,নিহাদ ভাইয়া, রিশা ওরা কিন্তু অনেক ভালো,মিশুক অনেক।

ইরাদের নাম শুনে মুখটা মলিন হয়ে গেল সূচনার।ছোট্ট করে –‘হুম। বললো শুধু।ব্যালকনিতে থাকা সন্ধ্যা-মালতী গাছে ফুল ফুটেছে আট দশটার মতো।
কোনোটা হলুদ রঙের তার মধ্যিখানে গাঢ় গোলাপি রঙের আভা।আবার কোনোটা পুরো গাঢ় গোলাপি রঙের।সূচনার দৃষ্টি আপাদত প্রণয়কে ছাপিয়ে সে ফুলের মধ্যে ই।সূচনার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রণয় ও তাকালো সেই দিকে।সেখানে তাকিয়েই প্রণয় বলে উঠলো –

–‘যা সুন্দর তা দূর থেকেই সুন্দর।আর কাছ থেকে দেখা যদি তার সৌন্দর্যের পতনের, সৌন্দর্য ফি’কে হয়ে যাওয়ার কারণ হয় তাহলে তো অবশ্যই।

প্রণয়ের কথার মানে বুঝতে অসুবিধা হয়নি সূচনার।প্রণয়ের দিকে তাকাতেই হাঁটু হালকা ভাজ করে ফ্লোরে বসল প্রণয়।ভ্রু কুটি করল সূচনা।সন্ধ্য-মালতী গাছের টবের দিকে হালকা ঝুকে কিছু একটা করছে প্রণয়।কিন্তু কী?ফ্লোর থেকে উঠে আবার সূচনার সম্মুখে দাড়ালো প্রণয়।আলতো স্পর্শ করলো তার বাম হাত সূচনার ডান হাতে।সূচনার ডান হাত মেলে ধরল তার সামনে।নিজের ডান হাতে থাকা গাঢ় গোলাপি রঙা সন্ধ্যা-মালতী ফুলখানা রাখল সূচনার হাতে।তারপর মিহি স্বরে শোধালো-

–‘যদি সে সৌন্দর্য নিজ থেকেই কারো হাতে ধরা দেয় তাহলে তা ছুয়ে দিলে ও সৌন্দর্য বহাল থাকবে।

সূচনা মৃদু হাসলো।তার হাতের নিচে তখনও প্রণয়ের হাত। হাত সরিয়ে আনতে নিলে বাধ সাধলো প্রণয়।চেপে ধরল হাত।হাত থেকে ফুল নিয়ে সন্তপর্ণে গুজে দিল কানের পিঠে।ফিচেল কণ্ঠে বললো –

–‘হাত থেকে তার খোলা চুলে কানের পিঠে বেশি সুন্দর লাগে।

প্রণয়ের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সূচনা।তাকিয়ে থাকা দায় তার জন্য।অদ্ভুত তার দৃষ্টি, যেই দৃষ্টিতে আছে অন্যরকম কিছু। কিন্তু কী?গ্রিলে হাত রেখে প্রণয় আবারো দৃষ্টি রাখলো বাইরে।নরম কণ্ঠে বললো –

–‘ইরাদ তোমাকে সত্যি ই ভালোবাসে।

চমকিত,বিস্ময়াহত সূচনা। অক্ষি যুগল তার কোটর থেকে বের হবার উপক্রম। প্রণয় কি করে জানল?এত বছরে কাউকে জানতে দেয়নি আর শেষে কি না।সূচনা ভাবতে পারল না আর।কম্পন রত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

–‘আপ,,আপনি ক,,কী বলছেন?কী,,কীভাবে জানলেন?

সামনে তাকিয়ে ই প্রণয় উত্তর দিলো-

–‘কালকে কথা বলতে দেখেছিলাম দুজনকে।কথাগুলো ক্লিয়ারলি শুনিনি।আড়ি পেতে অন্যের কথা শোনা নট আ গুড হেবিট রাইট?তবে আজকের সকালের চিঠি টা দেখে বুঝেছি।

সূচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘চিঠি? কিসের চিঠি?

প্রণয় ট্রাউজারের পকেট থেকে সাদা রঙের একটা ভাজ করা কাগজ ধরল সূচনার সামনে।এটা পেয়েছি তোমার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারটা আছে না ওখানে।আমার মানিব্যাগ রেখেছিলাম সেখানে।সেটা নিতে যেয়েই পেয়েছি।

কি লেখা আছে তা কে জানে?ভাবতে ভাবতে কাঁপা কাঁপা হাতে নিল সূচনা।এর মধ্যে প্রণয় বললো –

–‘আমি চিঠি পড়িনি,শুধু উপরের লিখাটা পড়েছি “প্রিয় বেলী রাণী,ইতি ইরাদ। কী সুন্দর সম্বোধন!
বলে হালকা হাসল প্রণয়।

সূচনার কাছে এই মুহূর্ত টা লজ্জাজনক। বিয়ে হয়েছে দুইদিন কি তিনদিন এর মধ্যে বরের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ভালোবাসে এমন একজনের চিঠি পড়তে হচ্ছে তাও সেই চিঠি নিজের বরই তার কাছে পোঁছে দিয়েছে।আবার তার করা সম্বোধন কে বলছে সুন্দর।ভাজ খুলে কাগজে চোখ রাখল সূচনা।কালো কালিতে স্পষ্ট লেখা-

“বেলী রাণী,
চিঠির শুরুতে তে প্রিয় বলে সম্বোধন করে কিন্তু তোকে প্রিয় বলার বিন্দুমাত্র অধিকারটুকু আমার নেই।দিসনি তুই আমাকে।তোকে ভালো বাসি,কত টুকু তা পরিমাপ করতে পারবনা।আর করেই বা কি তুই তো এখন অন্য কারোর ঘরের ঘরণী।অন্য কারো রাণী কিন্তু বিশ্বাস কর আমি সত্যি তোকে ভালোবাসি।আমার পক্ষে সম্ভব না তোকে অন্য কারো সাথে দেখা।কষ্ট হয় অনেক,পুড়ে যায় একদম।আমার
অত শক্তি নেই বেলী রাণী,অত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবনা,তোকে অন্য কারোর সাথে চোখের সামনে চুপচাপ দেখে যেতে পারবনা।কিন্তু আমি যে এখন পথের কা/টা হব তাও না।তুই যখন বলছিলি যে তুই মেনে নিয়েছিস তোর বিয়ে তখন অনেক কষ্ট হয়েছিল জানিস।ইচ্ছে করছিল চেচিয়ে বলি ” আমার তোকে লাগবে,আমার বেলী রাণীকে লাগবে।”কিন্তু পারিনি,সাহস হয়নি।আমি পারছি না এখানে থাকতে তাই চলে যাচ্ছি পরীক্ষার বাহানা দিয়ে।কিন্তু ইরাদ সত্যি ই তার বেলী রাণী কে ভালোবাসে, অনেক বেশি ভালোবাসে।

সূচনা চিঠি টা পড়ে হাতে মুঠ করে নিল দলা পাকিয়ে।

–‘এমন করলে কেন?

–‘রেখে কী লাভ?

–‘সামান্য চিঠিই তো ছিল।সে ভালোবাসে তোমায়।

–‘তাহলে কি বলছেন আমিও যেয়ে বলব?সাড়া দিব তার ভালোবাসায়?

–‘যদি ভালোবাসা থাকে দুজনায় তাহলে আটকানোর সাধ্য নেই।

–‘মজা করছেন?

–‘তা কেন করতে যাব?

–‘শুনে মনে হলো।

–‘মোটেও না।

–‘আমি তাকে ভালেবাসিনা,না বেসেছি কখনো।আমার জন্য নিহাদ ভাইয়া যেমন ইরাদ ভাইয়া ও তেমনই।এই কথাটা শুরু থেকেই ওনাকে বলে এসেছি কিন্তু উনি তাও পিছু হাটেননি।ওনার জন্য সূচনার মনে কোনো অনুভূতিরা জন্ম নেয়নি।

–‘জন্মেছিল কারো জন্য

–‘হ্যা তবে মিলিয়ে যাচ্ছে তা ধুলোয়।

–‘নতুন অনুভূতির কি জোগান হবে?

–‘আর একটু সময় লাগবে ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগতে।

–‘দিব সময় যত প্রয়োজন। তবে

–‘তবে?

–‘বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা কি রাখে এই অধম?

ক্ষণিকের নিরবতা।তারপর স্মিত হেসে জবাব-

–‘রাখে তবে সে নিশ্চয়ই অধম না, বেস্ট কেউ।

–‘এত বড় উপাধি কেন?

–‘জানিনা,,শুনলাম যে সে মামা-মামীর আদর্শ ছেলে,,ইরা,তিথি দিনাপুর দায়িত্ববান ভাই।আর..

–‘আর?

–‘কিছু না।

–‘ বলো বলো।

–‘সত্যি ই কিছু না।

–‘আমি কিন্তু জানি।

সূচনা হালকা অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কী জানেন?

সূচনার কানের সামনে প্রণয় ফিসফিস করে বললো-

–‘এটাই যে খুব শীঘ্রই কেয়ারিং আর দায়িত্ববান হাসবেন্ডের উপাধিও পেয়ে যাব।

বলেই উচ্চ স্বরে হাসলো।সূচনা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল হয়তো।গালে লাল আভা ধরা দিল তার।
.
.
.
–‘এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করবে তো ঠিকঠাক মতো?

ড্রয়িংরুমে ইরা আর সূচনা বসে কথা বলছিল।মিহু, দিনা ওপরের রুমে।তিথি পড়তে বসেছে।ইরা আর সূচনার কথার মাঝখানে ই প্রণয়ের এই উক্তি। সূচনা আর ইরা দুজনই ভ্রু কুচকে তাকালো প্রণয়ের দিকে।প্রণয় আয়েশি ভঙ্গিতে সোফায় বসতে বসতে বললো-

–‘এভাবে তাকানোর কি আছে?ইরা পানি দে তো এক গ্লাস।

সোফা থেকে উঠে ইরা পা বাড়ালো রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।সূচনা কপাল কুচকে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি?

–‘দুজনকেই তবে তুমি যেহেতু আছ এখন তুমিই আগে বলো।পাস তো করবে নাকি আবার আমার মান সম্মান ডুবাবে?

–‘আপনার কি আমাকে গো/বর মার্কা স্টুডেন্ট মনে হয়?

–‘সন্দেহ নেই হতেই পারে।

–‘ আমি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সবসময় ক্লাসের টপার হিসেবেই থেকেছি।

–‘ আই থিংক ভুল শুনেছি আমি, তুমি কি বিল্ডিং স্টুডেন্ট বললে?

–‘মজা করছেন আমাকে নিয়ে।

–‘হ্যা সেটা মাত্র বুঝলে বুঝি।

–‘আপনি কিন্তু,,

সূচনা দাড়িয়ে প্রণয়ের দিকে আঙুল তাক করে কিছু বলতে নিয়ে থেমে গেল।খেয়াল হলো তার আঙুল নামিয়ে নিল সাথে সাথে।প্রণয় মুখে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বললো-

–‘তুমি দেখি সুহাসিনী হয়ে যাচ্ছ মিস রঙ্গন।

ভ্রু কুচকালো সূচনা।তারপর এক হাত কোমরে রেখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললো-

–‘ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি আর এখন মিস নেই মিসেস হয়ে গেছি।

প্রণয় ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-

–‘হ্যা তাইতো।তাহলে তো নতুন কোনো নাম ভাবতে হবে।কি দেয়া যায় বলোতো।

সূচনা বললো না কিছু। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের পানে।এমনিতে তার দেয়া রঙ্গন নামটাই তার জন্য অন্য রকম কিছু তার ওপর নাকি নতুন নাম?তার ভাবনার মাঝেই প্রণয় একেবারে তার সন্নিকটে দাড়ালো।মৃদু কেঁপে উঠলো সূচনা।সূচনার কানের সামনে এসে বললো-

–‘তোমার নতুন নাম প্রণয়ী,প্রণয়ের প্রণয়ী।

প্রণয়ের শীতল কণ্ঠের অদ্ভুত সম্মোধনে মৃদুমন্দ কেঁপে উঠলো সূচনার সমস্ত কায়া।অজান্তেই বুজে এলো চোখ জোড়া কিঞ্চিৎ। প্রণয় সরে এসে আগের ভঙ্গিতে ই বসে পড়লো সোফায়।সরে আসার আগে হালকা করে ফু দিক সূচনার মুখশ্রীতে। চোখ খুললো সূচনা,হুশ ফিরল তার।সরে আসল সেও।
_____________________________________

–‘ আমরা সবাই হসপিটালে সূচি। ইরাদের এক্সিডেন্ট হয়েছে।অবস্থা বেগতিক।

মাঝ রাতে মিসেস দিশার উদ্বেগ মিশ্রিত গলায় করা উক্তি।চমকে উঠলো সূচনা।

#চলবে

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৫
______________________________
নিস্তব্ধ মধ্যরাত।নিকোশ কালো অন্ধকার আকাশে ক্লান্ত মেঘের আনাগোনা।নিস্তব্ধতায় ঘেরা৷ করিডরে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস।ফিনাইলের তীব্র গন্ধে নাক জ্বলে যাওয়ার উপক্রম।হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে আছে সূচনা।সবার থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে সে। ফিনাইলের গন্ধ হিজাব ভেদ করে ও লাগছে নাকে।তাই দূরে দাড়িয়েছে।বাকিরা সবাই কেবিনের সামনে সারি করে রাখা চেয়ারে বসে আছে।মিসেস আফরোজা কান্না করতে করতে এখন একেবারে চুপ মে/রে আছে।মিসেস দিশা তার পাশে বসে আছেন।রিশা, হৃদুকে নিয়ে বাড়িতে আছে আফরিন।রিশা আর হৃদু জানেনা কিছু।সবাই যেন চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে ডক্টর কি বলে?কী অবস্থা ইরাদের? তা জানার জন্য।বাইক নিয়ে এই মধ্যরাতে বেড়িয়েছিল ইরাদ,হয়তো বেপোরায়া ভাবে চালাচ্ছিল বাইক।দুর্ভাগ্যবশত ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ।কিন্তু এত রাতে বাড়ি থেকে বের হলো কেন?আর বাড়ির লোকেরা ই বা দিল কেন?

–‘এটা পড়ে নাও,গন্ধ টা কম লাগবে।

ভাবনার মাঝে কানে আসলো প্রণয়ের শান্ত কণ্ঠে বলা কথাটা।সামনে তাকাতেই দেখা গেল তার দিকে বাড়ানো প্রণয়ের ডান হাত,সে হাতে একটা সার্জিক্যাল মাস্ক।সূচনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রণয় আবার বললো –

–‘ধরো,,পড়ো এটা।

প্রণয়ের হাত থেকে মাস্কটা নিতে নিতে মৃদুস্বরে বললো-

–‘থ্যাঙ্কিউ,দরকার ছিল এটা।

জবাবে কিছু বললো না প্রণয়।তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।একটু পরই পড়নে সাদা এপ্রোন,মুখে মাস্ক পড়া মধ্য বয়স্ক একজন লোক বের হলেন অপারেশন থিয়েটার থেকে।মাস্ক খুলতেই দর্শন হলো তার চিন্তিত মুখ।ঘাবড়ে গেল সবাই।নিহাদ, আরহাম সাহেব সামনে এগিয়ে গেলেন।প্রণয়ও গেল। ডাক্তার চিন্তিত মুখ নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন-

–‘রোগীর অবস্থা খুব একটা ভালো না,প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে মাথা থেকে।এখনো তার জ্ঞান ফেরেনি,তাই আপাদত কিছু বলতে পারবনা।যত দ্রুত সম্ভব জ্ঞান ফিরতে হবে।নাহলে

মাথা নিচু করে নিলেন ডক্টর।বুঝতে বাকি রইলো না কারো।আবার শুরু হলো মিসেস আফরোজার কান্না।উপায় না পেয়ে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হলো।
সূচনা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাড়ালো।ইরাদের এই অবস্থার জন্য কী কোনোভাবে সে দায়ী? আচমকাই মস্তিষ্কে নাড়া দিল প্রশ্নটা।ফ্যাকাশে রূপ ধারন করল মুখশ্রী।তার জন্য কেউ মৃত্যুর দ্বারে?

–‘ ভাগ্যের লিখন কেউ টালতে পারেনা, তাই অযথা নিজেকে দোষারোপ করার কোনো প্রয়োজন ই নেই।

কথাটুকু কর্ণধার হতেই পাশ ফিরে তাকালো সূচনা।বু/কে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়।দৃষ্টি তার মধ্যেই নিবদ্ধ।প্রণয়ের দিকে ঘুরে সোজা হয়ে দাড়ালো সূচনা।তারপর নিচু হতে নিচু স্বরে বললো-

–‘ভয় করছে

–‘নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।যা করবেন ভালোই করবেন,চিন্তা করো না।

মাথা ঝাকালো সূচনা।তবে বললেই কী হয়।ভেতরে ভেতরে যে খচখচ করছে তার।
_________________________________
রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে রজনীর আগমন।চারদিকে আলোতো ফুটে গেছে অনেক আগেই এখন তীব্র হচ্ছে রোদের আলো। বেলা এগারোটা এখন। ইরাদ এখনো অজ্ঞান অবস্থাতেই আছে।মিসেস আফরোজাও ঘুৃমে বিভোর।মিসেস দিশা বাসায় গিয়েছেন।আরহাম সাহেব ও অফিসে গিয়েছেন কিছুক্ষণের জন্য।ইরাদ,নিহাদ,রিশার বাবা নেই।মা/রা গিয়েছেন বছর চারেক আগে।হাইওয়েতে বাস এক্সিডেন্ট করে,গুরুতর আহ/ত অবস্থায় হসপিটালে নেয়া হলেও ফিরতে হয় মৃত লা/শ নিয়ে। এই অবস্থায় এভাবে তাদের রেখে যেতে মন মানছিল না আরহাম সাহেবের।তবে না যেয়ে উপায়?তার তো আর ছেলে নেই যে সে সামলাবে।অগ্যতা যেতে হয়েছে।নিহাদ আর প্রণয় আছে।সূচনা মিসেস দিশার সাথে চলে গিয়েছে।দম বন্ধ লাগছিল তার এখানে থাকতে।মানুষ ঠিকই বলে হসপিটালে থাকলে মানুষ অর্ধেক অসুস্থ হয়ে যায়। আফরিন এসেছে।রিশা হৃদু সূচনাদের বাসায় এখন।
.
.
বাসায় এসেই সূচনা শাওয়ার নিয়েছে।কোনোরকম চুল মুছে রিশা আর হৃদুর কাছে গেল। হৃদু ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। রিশা তার পাশেই মনমরা হয়ে বসে আছে। সূচনা শব্দহীনভাবে তার পাশে যেয়ে বসল।রিশার মাথায় হাত রেখে আলতো স্বরে বললো-

–‘এমন মন মরা হয়ে আছিস কেন রিশু?

–‘ কি হয়েছে মিষ্টিপু?ভাইয়া কী খুব বেশিই ব্যথা পেয়েছে?ঠিক হয়ে যাবেনা?

সূচনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচুস্বরে বললো-

–‘কিছু হয়নি তো।ইরাদ ভাইয়া ঠিক হ’য়ে যাবেন তবে একটু সময় লাগবে,তুই চিন্তা করিস না।সামনে পরীক্ষা না,ঠিকমতো পড়তে থাক।

–‘আমি দেখা করব ভাইয়ার সাথে।

বিপা/কে পড়লো সূচনা।কী বলবে এখন?ইরাদের তো এখনো জ্ঞান ই ফিরল না আর বলছে দেখা করবে।অনেক ভেবেচিন্তে সূচনা জবাব দিল-

–‘ঠিক আছে কিন্তু সময় লাগবে।পুরোপুরি ঠিক হলে ডাক্তার দেখা করতে দিবেন না হয় দিবেন না।

–‘কিন্তু আপু

–‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?

–‘হয়েছে তো।

–‘তাহলে এখন চুপচাপ চল আমার সাথে, কিছু খাবি।

–‘হু।

ফোন হাতে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে রুমে পায়চারী করছে সূচনা।হসপিটাল থেকে এসেছে প্রায় দুই ঘন্টার বেশি। প্রণয়কে কল দিচ্ছে কিন্তু রিসিভ করার খবর ই নেই। মেজাজ চরম পর্যায়ে গর/ম এখন।ফোন কেন রিসিভ করেনা।আশ্চর্য!কলিং বেলের আওয়াজে বিরক্তি তে চোখমুখ কুঁচকালো সূচনা।রুম থেকে দ্রুত পায়ে ড্রয়িং রুমে গেল।সদর দরজা খুলতেই দর্শন হলো প্রণয়,মিসেস আফরোজা আর আফরিনের মুখ।মিসেস আফরোজাকে একহাতে ধরে আছে আফরিন। মিসেস আফরোজার চোখমুখ শান্ত।আফরিন ধরে সোফায় বসিয়ে দিল তাকে।ইতিমধ্যে রিশা আর মিসেস দিশাও উপস্থিত হলেন সেখানে। মিসেস দিশাকে দেখে আফরিন বললো-

–‘আসতে চাইছিলেন না।অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে এনেছি,বিকেলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে।

মিসেস দিশা ব্যস্ত গলায় বললেন-

–‘ভালো করেছো নিয়ে এসেছো।

প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে সূচনাকে বললেন-

–‘সূচনা প্রণয়কে নিয়ে যা রুমে।তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো বাবা।

মাথা নাড়ালো প্রণয়।তাকে উদ্দেশ্য করে সূচনা ছোট্ট করে বললো –

–‘চলুন।

সূচনার পেছন পেছন প্রণয় পা বাড়ালো।আফরিন
মিসেস আফরোজা কে নিয়ে গেল,রিশা ও গেল তাদের পেছনে।
.
.
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল প্রণয়। ঘুম হয়নি রাতে,তারওপর এত বেলা হয়ে গেলেও এক মুহূর্তের জন্য বিছানায় পিঠ লাগাতে পারেনি।মাথা ধরেছে,সাথে মেজাজ ও খিটখি/টে হয়ে আছে।ঘুমানো প্রয়োজন একটু।কিন্তু তারও চিন্তা হচ্ছে এখন।মনে প্রাণে প্রার্থণা করছে যেন ইরাদের জ্ঞান ফিরে আসে।অকালে ঝরে না যায় প্রাণ।আর তারওপর সূচনা ও তো মনে মনে দোষারোপ করবে নিজেকে, তা ঢের জানে সে।

–‘আপনি শুয়ে পড়লেন কেন? খাবেন না?

সবে চোখ বন্ধ করতে নিয়েছিল প্রণয় তখনই হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসে সূচনা উক্ত কথাটুকু বললো।উঠে বসলো প্রণয়। মিহি স্বরে বললো-

–‘একটু ঘুমানো দরকার,মাথা ধরেছে।খাবনা এখন পরে খাব।

–‘অল্প কিছু খেয়ে নিন।তারপর চা করে দিব।

–‘পরে দিও এখন ঘুমাই।

–‘আম্মু বারবার বলে দিয়েছে, খেয়ে নিন একটু। না-হয় রুমে নিয়ে আসি?

মিনিটের নীরবতা।তারপর উঠে দাড়িয়ে বললো-

–‘চলো।
.
.
ড্রয়িং রুমে বসে আছে সূচনা।প্রণয় রুমে, হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।সূচনার সাথে বসে আছে আফরিন।মিসেস আফরোজা দুপুরের পরে রুম থেকে একবার ও বের হননি।তাকে পছন্দ না করলেও তার জন্য খা/রাপ লাগছে সূচনার। আর যাই হোক সে একজন মা, আর তার ছেলের অবস্থা যেখানে এমন সেখানে তার অবস্থা তো সে আর আল্লাহ ই ভালো জানেন।আফরিনের মুখশ্রী ও মলিন।এখন সাঝ বেলা।ধরনীতে আলোর বিচরণ থেমে গেছে প্রায়।মেঘেরা ও ক্লান্ত বোধহয় তাই তাদের গতি ও কমে গেছে।আযান পড়লেই বেরোবে প্রণয় আর আরহাম সাহেব।নামাজ পরে হসপিটালে যাবে।সময় যেন কেমন পলকেই কেটে গেল।সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে এখন সন্ধ্যা।ইরাদের অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি তবে সে রেসপন্স করছে এখন ট্রিটমেন্টের।নিহাদ এসেছিল বাসায় চলে গেছে আবার।রুম থেকে প্রণয় ড্রয়িং রুমে আসতেই ফোন বেজে উঠলো তার। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল নিহাদের ফোন।রিসিভ করল অবিলম্বে। ওপাশ থেকে নিহাদ ব্যস্ত গলায় বললো কিছু। প্রণয় ফোন রাখতেই চোখে পড়লো উৎসুক কয়েক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরহাম সাহেব কিছুটা ভীত গলায় জিজ্ঞেস করলেন-

–‘কী হয়েছে প্রণয়?নিহাদ কী বললো?

–‘ বাবা ইরাদ,,

#চলবে