প্রণয়ের সূচনা পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
229

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৬
____________________________
হসপিটালের করিডরে সবার অবস্থান। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিঃসৃত হচ্ছে। ইরাদের জ্ঞান ফিরেছে। তখন নিহাদ ফোন করে এটাই জানিয়েছে।তারপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটেছে সবাই হসপিটালের উদ্দেশ্যে।আফরিন বাসায় রিশা আর হৃদুকে নিয়ে।মিসেস আফরোজা অধীর অপেক্ষায় বসে আছেন করিডরে সারি করে রাখা চেয়ারে।তার পাশে আরহাম সাহেব, মিসেস দিশা। আর সূচনা দাড়িয়ে আছে তার মায়ে’র পাশে।প্রণয় আর নিহাদ ফার্মেসি তে গিয়েছে ঔষধ পত্র আনতে ঘন্টাখানেক পরেই কেবিনে দেয়া হবে ইরাদকে।
.
.
কেবিনে দেয়া হয়েছে ইরাদকে।মিসেস আফরোজা ইরাদের হাত ধরে বসে আছেন আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছেন।ইরাদকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে তাই কিছু বলতেও পারছেনা।মিসেস দিশা ইরাদের বেডের আরেক পাশে বসে আছেন টুল টেনে। সূচনা ভেতরে যায়নি।সে মুখোমুখি হতে চায় না এখন।একটু পর মিসেস দিশা কেবিন থেকে বের হলেন। ব্যস্ত গলায় সূচনাকে বললেন-

–‘তাড়াতাড়ি বাসায় চল সূচি, রান্না করতে হবে। আপা,নিহাদ রাতে হসপিটালে থাকবেন বলছেন,খাবার পাঠাতে হবে তাদের জন্য।

–‘মামী কিছু করতে হবে না।কিনে খেয়ে নিব, আর রাতের বেলা অত কিছু খাওয়া লাগবেনা।আপনি ব্যস্ত হবেন না।

–‘নাহ আমি রান্না করে পাঠাচ্ছি। প্রণয় তো যাবে এখন নিয়ে আসবে।

বারবার বলার পরে মিসেস দিশা রাজি হলেন।এখন বাসায় যেয়ে রান্না করা তারপর নিয়ে আসা টা অনেক সময়ের ব্যাপার।প্রণয়ের সাথে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে গেলেন আরহাম সাহেব, সূচনা আর মিসেস দিশা।পেছনের সিটে মিসেস দিশা আর সূচনা।ড্রাইভিং সিটে প্রণয় আর তার পাশে আরহাম সাহেব। সময়টা এখন রাত সাড়ে আটটা প্রায়। শুক্রবার আজকে, আর বরাবরের মতোই শুক্রবারে ঢাকা শহরে জ্যামটা একটু বেশিই হয়। লম্বা জ্যাম ঠেলে বাসায় পোঁছাতে পোঁছাতে সাড়ে নয়টা বেজে গেল।কলিং বেল বাজাতেই আফরিন দরজা খুললো সাথে সাথে। হৃদু ছিল তার কোলে।প্রণয়কে দেখেই লাফ দিয়ে চলে গেল তার কোলে।কিন্তু প্রণয় আটকে দিল। কোমল স্বরে বললো-

–‘আমি হসপিটাল থেকে এসেছি পাখি,আমার হাতে জা/র্মস আছে। এখন তোমাকে কোলে নিলে সেগুলো তোমার কাছে চলে যাবে। আগে জার্মস ক্লিন করি তারপর কোলে নিব।

হৃদু মাথা নাড়িয়ে আধো আধো বুলিতে বললো-

–‘ঠিক আতে যাও।

মিসেস দিশা আর আরহাম সাহেব রুমে চলে গেলেন।প্রণয় ও চলে গেল।সূচনা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়লো সোফায়।আফরিন তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো-

–‘ফ্রেশ হবে না?

–‘হ্যা হব।

–‘তোমার ভাইয়া ফোন দিয়েছিল,বললো ইরাদের কথা।আমার মাথায় একটা জিনিস ঢুকছে না এত রাতে ও একা বাইরে গেল কেন?যদি বন্ধুদের সাথে যেত তাহলে একটা কথা ছিল।কিন্তু একা গিয়েছে। ও তো এমন করে না কখনো।

সূচনা চোরা চোখে তাকালো আফরিনের দিকে।তার মুখ পানেই তাকিয়ে আছে আফরিন।মুখশ্রীতে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ।সূচনা থমথমে গলায় বললো –

–‘আমিও তাই ভাবছি ভাবি।কখনো তো শুনিনি যে ভাইয়ার রাত বিরাতে বাইরে থাকার বদঅভ্যেস আছে।তাহলে কেন যে কালকে গেল।

–‘ তা তো ইরাদ ই বলতে পারবে।তবে এখন ও যে সুস্থ আছে এটাই আলহামদুলিল্লাহ।যাক গে তুমি ফ্রেশ হতে যাও।

–‘হ্যা
.
.
ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে মিসেস আফিয়া কে ফোন করলো সূচনা।সেই দুপুরে কথা হয়েছিলো।উনিই কল করে করে খবর নিয়েছেন।সারাদিনে তো ঠিক করে কথা বলার সুযোগ হয়নি।একবার রিং হতেই রিসিভ করলেন মিসেস আফিয়া,যেন ফোন হাতে নিয়েই ছিলেন সূচনার কলের অপেক্ষায়। সূচনা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘ আসসালামু আলাইকুম মামী।

–‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম,তোকেই ফোন দিতাম এখন।তোর ফুপাতো ভাইটা এখন কেমন আছে?বাসার সবাই ঠিক আছে?

–‘জ্বি সবাই ঠিক আছে আর ভাইয়াও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে এখন।

মিসেস আফিয়া যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।বললেন-

–‘যাক আলহামদুলিল্লাহ।

–‘ইরা,তিথি ওরা কোথায়?

–‘তিথি তো পড়ছে,ইরা এতক্ষণ আমার কাছেই ছিল এখন তিথির রুমে।দিনার শরীরটা একটু খারাপ তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

–‘কী হয়েছে আপুর?

–‘তেমন কিছু না,হালকা জ্বর আর মাথা ব্যথা।

–‘আচ্ছা।

–‘হ্যা।

–‘মামা বাসায় এসছেন?

–‘হ্যা। প্রণয়কে ছাড়া ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ঘর দোর।তুইও ছিলি আর কালকে তো মিহুও ছিল।

হালকা হাসলো সূচনা।বললো-

–‘কালকে চলে আসব।

–‘আমি আসতে বলিছি তোকে?

–‘না বলেননি তো।

–‘তাহলে?

–‘না মানে,

–‘বেশি বুঝিস।এখন এখানে থাকার চেয়ে তোর ওখানে থাকাটা বেশি জরুরি।এখন তোর পরিবারের মানুষদের তোকে দরকার।যখন সব ঠিক হবে তখন আমিই বলব প্রণয়কে তোকে নিয়ে আসতে।প্রণয়ের কাছ থেকে তো জানবই আমি।বুঝেছিস?

সূচনা নিচু স্বরে বললো-

–‘জ্বি।

–‘হুম,,শোন অনিয়ম করবি না একদম,কোনো সমস্যা হলে বা কিছু লাগলে আমাকে বলবি কল দিয়ে। ঠিক আছে?

–“জ্বি,, আপনিও কোনো অনিয়ম করবেননা। আনি ফোন দিব।

–‘আচ্ছা এখন তাহলে রাখি।

–‘জ্বি,, আসসালামু আলাইকুম।

–‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম।

ফোন রেখে লম্বা করে শ্বাস নিল সূচনা।সে ভেবে পেল না মানুষগুলো তাকে চেনেই না ক’দিন ধরে,অথচ তাদের ব্যবহার এমন যে মনে হয় কত আগের চেনা পরিচিত সে।কত তাড়াতাড়ি আপন করে নিয়েছে তাকে।ভাবতেই প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো, এমন পরিবার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার আজকাল।
.
.
–‘আপনি এখন আবার যাবেন?

প্রণয়কে তৈরী হতে দেখে প্রশ্ন করলো সূচনা।প্রণয় শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে জবাব দিল-

–‘হ্যা নিহাদ ভাই আর ফুপি তো একা।

–‘রাতে ওখানে থাকবেন কীভাবে তিনজন?

–‘ সমস্যা নেই এক রাতের ব্যাপার।

–‘অসুস্থ হয়ে যাবেন।

–‘সমস্যা নেই এখন বউ আছে।

–‘বউ অকর্মার ঢেকি।কিছু করতে পারেনা।

–‘তাতেও সমস্যা নেই,সব শিখিয়ে দিব ধীরে ধীরে।কিপ পেশেন্স।

সূচনা আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কী শিখিয়ে দিবেন?

ভ্রু কুটি করল প্রণয়।জিজ্ঞেস করলো-

–‘আসলেই জানতে চাও?

সূচনা মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললো-

–‘হুম।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে প্রণয় এক ঝটকায় দাঁড়ালো সূচনার সম্মুখে।একেবারে মুখোমুখি দু’জন। সূচনা ভড়কে গিয়ে পিছিয়ে গেল দু কদম।প্রণয়ের ঘোর লাগা দৃষ্টি সূচনার মুখে,ঠোঁটে।লজ্জা আর ভয়ে মিইয়ে গেল সূচনা।না চাইতেও চোখে মুখে লাজুকতা ধরা দিল।বু/কের ভেতর অস্বাভাবিক রকমের ধুকপুকানির সুর উঠল তার।হাত, পা যেন জমে গেছে সেখানেই।সূচনার মুখের উপর ঝুঁকে প্রণয়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার কম্পনরত ঠোঁট জোড়ায়।বা’কা হাসলো প্রণয়।আরেকটু ঝুঁকতে ই ভয় পেয়ে গেল সূচনা।সূচনার মুখে জোরে ফু দিতেই আখি জোড়া বন্ধ করে নিল সে। মিনিট দুয়েক বাদেও যখন কোনো কিছুর টের পাওয়া গেল না তখন চোখ খুললো সূচনা।দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে প্রণয়।মুখে সেই বা’কা হাসি। তাকে তাকাতে দেখে প্রণয় দুষ্টুমির স্বরে বললো-

–‘ কী ভাবছিলে?কী করব আমি?

সূচনা আমতাআমতা করে বললো-

–‘আব,,ব,,ক,,কি ভাববো আবার।আপনিই তো

–‘আমি ই তো?

–‘ আপনি কী করছিলেন?

–আমি তো ডেমো দেখাচ্ছিলাম যে কী শিখাব।

সূচনা মাথা নিচু করে নিল। প্রণয় হাসলো নিঃশব্দে। তারপর বললো-

–‘আমি গেলাম,,সাবধানে থেক।

নত মস্তক উপরে করে মৃদু স্বরে বললো-

–‘আপনিও সাবধানে যাবেন।

মুচকি হেসে প্রণয় রুম থেকে বেরোলো, সূচনা পেছনে পেছনে গেল তার।
.
.
পড়ার টেবিলে বসে কলম নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তিথি, তার বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করছে ইরা।একটা অঙ্ক কোনোভাবেই মেলাতে পারছেনা তিথি তাই খাতা আর বই নিয়ে ইরার সামনে বিছানায় বসে পড়লো। ইরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালনা।তিথি ইরার বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিতে কেঁপে উঠলো ইরা।তিথি ভড়কে গেল।ইরা চকিতে তিথির দিকে তাকিয়ে কম্পনরত কণ্ঠে বললো –

–‘ক,,কী, হ,হয়েছে তিথি?

তিথি অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

–‘তুমি এমন কেঁপে উঠলে কেন ইরাপু?

–‘আব,,ব,,ক,,কিছুনা তো

–‘কী হয়েছে বলো তো,কয়দিন ধরে দেখছি তুমি কেমন যেন হয়ে গেছ।পরীক্ষার পর কত প্ল্যান করেছিলে এই করবে সেই করবে কিন্তু এখন ঘরে ঘাপটি মে/রে বসে আছ।কী হয়েছে বলো?আমি না হয় ছোট তাহলে দিনাপু কে বলো।

হালকা হাসলো ইরা।বললো-

–‘কিছু হয়নি এমনি।তুই বল কি হয়েছে?

–‘এই ম্যাথটা বুঝিয়ে দাও একটু।

–‘ঠিক আছে দেখা।

তিথিকে ম্যাথটা বুঝিয়ে দিয়ে ইরা এক সেকেন্ড ও দেরি করলো না সেখানে।দ্রুতপায়ে রুমে আসলো নিজের।রুমে আসতেই কর্কশ আওয়াজ তুলে বেজে উঠল ফোন।আবারো কেঁ/পে উঠলো ইরা।ভয়ে হাত পা কাঁপছে তার,গলা শুকিয়ে আসছে।কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করলো ফোন।
——————————————————-
কেবিনের বাইরে চেয়ারে বসে আছে নিহাদ আর প্রণয়।টুকটাক কথা হচ্ছে তাদের। নিহাদের মুখশ্রীতে চিন্তার ছাপ নেই।ঠান্ডা মাথায়ই সামলাতে চেষ্টা করছে সব। বাবা নেই মা,দুই ভাই -বোনের দায়িত্ব তার ওপর। আবার নিজের স্ত্রী -সন্তান ও আছে তারওপর হুট করে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা।অথচ সে ঘাবড়াচ্ছে না একটুও।

–‘তুমি একটু বসো আমি কেবিনের ভেতর থেকে আসছি।

–‘ঠিক আছে যান।

নিহাদ যেতেই প্রণয় ফোন বের করে সূচনা কে কল করলো। একবার রিং হতেই ফোন তুললো সূচনা।রিসিভ হতেই প্রণয় হাসিমাখা কণ্ঠে বললো –

–‘বাহ ফোন বুঝি হাতে নিয়েই রেখেছিলে।

–‘হ্য,,হ্যা আসলে,,

–‘আমার কলের অপেক্ষা করছিলে?

সূচনা নিশ্চুপ। সে প্রণয়কে কল দেয়ার জন্য ফোন হাতে নিয়েছিল।আর তখনই ফোন দিয়েছে প্রণয়।

–‘খেয়েছো?

–‘জ্বি।

–‘ঘুমাওনি কেন?

–‘এমনি

-‘আপনি কোথায় এখন?

–‘কেবিনের বাইরে,,করিডোরের কোণায়।

–‘ঘুম হবেনা আজকে আপনার।

–‘হ্যা বোধহয়। সমস্যা নেই কালকে ঘুমিয়ে নিব।

কিছু বললো না সূচনা।প্রণয় ও চুপ।এই মুহূর্ত টাও অদ্ভুত রকমের সুন্দর।ফোনের দুপাশে নিশ্চুপ দুইজন মানব মানবি, রা নেই তাদের মুখে শুধু শোনা যাচ্ছে তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ।

#চলবে

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৭
_________________________________
–‘আপনি বুঝতে পারছেন না আমি আপনাকে পছন্দ করি না,কেন বারবার কল করছেন,কেন মেসেজ দিচ্ছেন?

ওপাশ থেকে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে কেউ বললো-

–‘ কেন কী সমস্যা?এত অপছন্দ কেন আমাকে?

উত্তর দিতে পারলনা ইরা।কী দিবে সে?তার তো অপছন্দ না।তাহলে অপছন্দ হওয়ার কারণ হিসেবে কী দেখাবে সে?

–‘আমি তোমাকে ভালোবাসি ইরুপাখি।কতবার বলব আর, এতদিনে কী আমার জন্য একটু অনুভূতি ও জন্মায়নি তোমার মনে?

ইরা শক্ত কণ্ঠে বললো –

–‘না জন্মায়নি আর জন্মাবে ও না।আমি এসব পছন্দ করিনা বললাম তো।আমার দ্বারা এসব দুইদিনের স্বার্থের সম্পর্ক করা সম্ভব না।আপনি স্বার্থপর আর আপনার মতো মানুষের সাথে তো কোনোদিনও না।

ওপাশ থেকে হাসির শব্দ, তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে হাসতে ই বললো-

–‘কোন অপরাধে এই সুন্দর উপাধি দিকে সেটাও বলো।

–‘নিজের কৃতকর্মের ব্যাপারে আপনি জানেন না বুঝি।

–‘যখন কিছু করিই নি তাহলে জানব কী করে?

–‘অপ/রাধ করার পর সেটা সামনে আসলে সব অপ/রাধী এ কথাই বলে।

–‘অপরা/ধ না করেই যদি তার জন্য দো/ষী সাব্যস্ত করা হয় তখন কি বলে সেটা বলতে পারো?

চুপ হয়ে গেল ইরা।তা দেখে ওপাশের মানুষটা কড়া গলায় বললো-

–‘তুমি আমার, এটা মাথায় রাখবে।তোমাকে নিজের করে নিতে জোর করতেও দু’বার ভাবব না।রাখলাম,,খুব শীঘ্রই আসছে মুগ্ধ,তার ইরাবতীকে নিজের করতে।

বিচ্ছিন্ন হলো সংযোগ।থম মে’রে বসে রইলো ইরা।এ কথাগুলো যদি সত্যি হত তাহলে কী খুব খা/রাপ হয়ে যেত?কিন্তু এগুলো তো মিথ্যা,ক্ষণিকের জন্য।একাধারে দুই দুইটা মেয়ের জীবন যে নষ্ট করতে চাইছে সে নিশ্চয়ই ভালো হবেনা।আর এমন মানুষের জন্য ই কিনা এই ছোট্ট হৃদয়ে অনুভূতির মেঘ জমেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইরা।
____________________________________
মাঝে কেটে গেছে তিনদিন।সূচনা ফিরে যাচ্ছে তাদের বাসা থেকে।ইরাদকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হয়েছে আজকে সকালেই।আরহাম সাহেব নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু ইরাদ কোনোভাবেই রাজি হয়নি,অসুস্থ তাই তার মতামতের বাইরে কেউ কিছু বলেনি আর।বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে।সূচনাও আর থাকেনি প্রণয়কে ফোন দিয়ে বলেছে নিয়ে যেতে।বিকেলের শেষভাগে অফিস শেষে সূচনাদের বাড়িতে এসেছে প্রণয়।দেরি করেনি একটু বসেই বেড়িয়ে গেছে তাকে নিয়ে।প্রকৃতির এক মায়াবী ক্ষণ সন্ধ্যা।উজ্জল ধরণী,কর্মমুখর দিনের ইতি ঘটিয়ে রাতের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষণিকের জন্য তার আগমন ঘটে, মিলিয়ে যায় আবার।গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরেই তাকিয়ে ছিল সূচনা।হুট করেই উঠে গেল জানালার কাচ।সূচনা কিঞ্চিৎ ভড়কে গেল।পাশ ফিরে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কাচ উঠালেন কেন?

–‘ধুলো আসছে।

কিছু টা মন খা/রাপের স্বরে সূচনা বললো-

–‘ভালো লাগছিল দেখতে।

–‘উঠিয়ে দিব?

–‘দিন একটু।

জানালার কাচ বেশ খানিকটাই উঠিয়ে দিল প্রণয়।সূচনা আবার মনোযোগী হলো বাইরের পরিবেশ দেখতে।
.
.
বাসায় এসে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুললেন মিসেস আফিয়া।প্রণয়রা দোতলায় থাকে।নিচ তলা আর উপর তলা ভাড়া দেয়া।মিসেস আফিয়া দরজা খুলেই ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন জুড়লেন-

–‘তোর চোখমুখ এমন লাল দেখাচ্ছে কেন প্রণয়?

মিসেস আফিয়ার কথা শুনে সাথে সাথে ই সূচনার চোখ গেল প্রণয়ের দিকে।অসম্ভব রকমের লাল প্রণয়ের চোখ।শ্যামবর্ণের সে তবু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার নাকের ডগা লাল।প্রণয় মিসেস আফিয়া কে বু/ঝুং বা/ঝুং বোঝানোর চেষ্টায় ব্যস্ত।মিসেস আফিয়া চিন্তিত মুখে বললেন-

–‘ধুলো তে এমন হয়েছে তাই না?জানালার কাচ লাগাসনি কেন? তুই জানিস তোর ধুলো-বালি তে এলার্জি তাহলে খেয়াল রাখিসনা কেন?কী সমস্যা তোর?আমাকে এভাবে টেনশন দিয়ে কী মজা পাস বল তো তোরা।এদিকে ইরা টা ও কিছু বলেনা,ইদানিং কেমন চুপচাপ,গোমরা হয়ে থাকে।তুই তো কিছু বলিস ই না।তোরা কিছু মনে করিস না আমাকে। জানি তো আমি।

এক নাগাড়ে কথাগুলো বললেন মিসেস আফিয়া।কেদে দেয় দেয় এমন অবস্থা তার।প্রণয় এক পাশ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বললো-

–‘আমাদের কাছে তুমি কি সেটা মুখে বলে প্রকাশ করার প্রয়োজন আমি মনে করিনা।তোমার এই ব/কা গুলোতেও ভালোবাসা আছে তাই মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে এমন করি।

–‘আমাকে বাচ্চা পেয়েছিস হ্যা?চার চারটা ছেলে মেয়ের মা আমি,ক’দিন পর দাদি হয়ে যাব আর তুই আমাকে এসব পড়া দিস।চোখের সামনে থেকে যাবি না কান টেনে ছিড়/ব?

–‘ হ্যা তারপরের দিন নিউজে হেডলাইন হবে-“ছেলের কান টেনে ছিড়/লেন তার মা।” তারপর মিসেস আফিয়া ভাইরাল।

প্রণয়ের কথা শুনে মিসেস আফিয়া ফিক করে হেসে দিলেন।প্রণয়ও হাসলো সাথে।কিন্তু সূচনা নিশ্চুপ, নত মস্তক,ফ্লোরে দৃষ্টি।মিসেস আফিয়ার তখনকার কথায়,সূচনার লজ্জা পাওয়ার কথা কিন্তু সে ভাবলেশহীন। মাথায় তার একটা জিনিস ই ঘুরছে।প্রণয়ের ধুলোবালিতে এলার্জি,কিন্তু সে বলল না কেন?তাহলে তো আর এমন হত না।তার জন্য এমন অবস্থা হয়েছে। অন্ধকার ছিল আর সে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে এতই মনোযোগী ছিল যে খেয়ালই করেনি প্রণয়ের দিকে।এদিকে মিসেস আফিয়া যেন ভুলেই গিয়েছিলেন সূচনার কথা।নিজের কাজে নিজেই খানিক লজ্জাবোধ করলেন।মেয়েটা কি ভাববে -এখানে যে সে আছে তাকে কোনো গুরুত্ব ই দেয়া হচ্ছে না।তারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।মিসেস আফিয়া কড়া কণ্ঠে প্রণয়কে বললেন-

–‘প্রণয় যা তো, তোর জন্য আমার মেয়েকেই ভুলে গেছি আমি।

প্রণয় বিনা বাক্যে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।মিসেস আফিয়া সূচনার থুতনিতে হাত রেখে তার নত মস্তক উপরে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

–‘কেমন আছে আমার মেয়েটা?

–‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

–‘আলহামদুলিল্লাহ।জানিস তো আজকে শান্তি লাগছে তুই এসে পড়েছিস।এবার মনে হচ্ছে আমার ছেলে বিয়ে করিয়েছি,ঘরে ছেলের বউ এসেছে।

সূচনা জোরপূর্বক হাসল।মনের ভেতর খচখচ করছে তার।প্রণয়কে জিজ্ঞেস করতে হবে,সে ঠিক আছে তো?

–‘রুমে যা,,হাত মুখ ধুয়ে নেয়।

মাথা নাড়ালো সূচনা। দ্রুত পায়ে ছুটলো রুমে।সে রুমে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ই প্রণয় ওয়াশরুম থেকে বের হলো।সূচনা তড়িৎগতিতে তার সামনে দাড়ালো।সোজা জিজ্ঞেস করলো-

–‘আপনি আগে বলেননি কেন আপনার ধুলোতে এলার্জি?তাহলে তো আমি জেদ ধরতামনা।কেন করলেন এমন?

প্রণয় অবাক হলো না যেন তার আগে থেকেই জানা ছিল এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।সে সোজাসাপটা উত্তর দিলো-

–‘এমনি বলিনি,কিছু হয়নি,ঠিক হয়ে গেছে। যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।

সূচনা কয়েক মিনিট প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর বড় বড় পা ফেলে কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। সে যেতেই প্রণয় টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।অতকিছু ভাবার সময় নেই।ঘুমাতে হবে নাহলে নির্ঘাত সে পাগ/ল হয়ে যাবে।টানা তিনরাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে,আর না।
.
.
হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাড়িয়ে আছে সূচনা।দৃষ্টি তার ঘুমন্ত প্রণয় এর ওপর।সাড়ে নয়টার মতো বাজে এখন।প্রণয় খায়নি এজন্য দুজনের খাবার রুমে নিয়ে এসেছিল।কিন্তু প্রণয় তো কত আরাম করে ঘুমোচ্ছে।সূচনার একটু ও ইচ্ছে হলো না তার এই আরামের ঘুম হারা/ম করতে। বে/চারা তিনরাত ঘুমাতে পারেনি।এখন ঘুমিয়েছে আর সে জাগিয়ে দিবে।অসম্ভব, সে ভালো করে জানে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে মেজাজের যে কয়টা বাজে। হাতের প্লেটটা টেবিলে রেখে দিল।রুমের দরজা লক করে আস্তে করে শুয়ে পরল প্রণয়ের পাশে।মনে মনে ভাবল ইরার সাথে কালকে কথা বলতে হবে।কিন্তু বলবে কিছু তাকে?
.
.
–‘প্রণয়ী উঠ।

ঘুমের ঘোরে কানে আবছা কণ্ঠ আর হাতে টান পড়ায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালো সূচনার।উপেক্ষা করলো সে,তলিয়ে যেতে চাইল ঘুমে কিন্তু পারলনা।এক ঝটকায় তাকে শোয়া থেকে টান দিয়ে উঠিয়ে দিল কেউ।চমকে গেল সে কিন্তু ক্ষণিকের জন্য বটে।পিটপিট চোখে দর্শন হলো প্রণয়ের মুখ।চোখমুখ কুচকে বিরক্তি মাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

–‘রাত দুপুরে এমন টানাটানি করছেন কেন? কী হয়েছে?

–‘শখ হয়েছে বউয়ের আঁচল ধরে ঘুমাব।দেখি আঁচল টা।

–‘পা/গল হয়ে গেছেন?সরুন আমি ঘুমাব।
সূচনা আবার শুতে নিলে হাত ধরে আটকে দিল প্রণয়। বললো-

–‘শোও সমস্যা নেই। কিন্তু আগে খেয়ে নাও তারপর।

–‘মাঝরাতে খাওয়ার জন্য ঘুম ভাঙিয়েছেন?আশ্চর্য!

–‘মাঝরাত কোথায় পেলে?সবে সাড়ে দশটা বাজে ম্যাডাম।

–‘কিহ?

–‘জ্বি।এখন চোখে মুখে পানি দিয়ে আসেন,আমি খাবার গরম করে এনেছি।

–‘আমি খাবনা,ঘুমাব।

–‘যাবে নাকি আমি ওয়াশরুমে দিয়ে আসব?

–‘না যাচ্ছি।

কোনোরকম অল্প একটু খেল সূচনা।প্রণয় আর বাগড়া দিলনা।ঘুম থেকে উঠে খাওয়া যায় না। যতটুকু খেয়েছে তাই বেশি।খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে রেখে রুমে আসতেই দেখল সূচনা বিছানায় এলোমেলো অবস্থায় শুয়ে আছে।মুচকি হাসল প্রণয়।মিসেস দিশা কথায় কথায় বলেছিল “আমার মেয়েটা আবার একেবারেই ঘুমকাতুরে, যেন দুনিয়া একদিকে আর ওর ঘুম অন্য দিকে।সূযোগ পেলেই ঘুমাতে উদ্যত হয়।” খুব সাবধানে সন্তপর্ণে সূচনাকে ধরে ঠিক ভাবে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল।
.
.
জানালার কাচ ভেদ করে সারারুমে সূর্যের ঝলকানি। ঘুম ভেঙে গেল সূচনার। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছিল সে।নিজের হাতের অবস্থান টের পেল,কোলবালিশ টপকে প্রণয়ের পিঠের ওপর।সূচনা একমুহূর্তের জন্য থমকালো।হাত সরাতে পারলনা সাথে সাথে।যদি জেগে যায় প্রণয়?যতটুকু সাবধানে সরানো যায় ঠিক তাই করল সূচনা।নিঃশব্দে উঠে পড়লো বিছানা থেকে নেমে পড়ল।
.
.
–‘আমি যাচ্ছি,একটু সুন্দর করে বিদায় ও তো দিতে পার।

সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রণয় মুখ বা’কিয়ে সূচনাকে বললো কথাটা।

সূচনা মিহি স্বরে বললো-

–‘সাবধানে যাবেন।

–‘এটা ভালো করে বিদায় দেয়া?

সূচনা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো-

–‘তাহলে কিভাবে দেয়?

সূচনার এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই বোধহয় ছিল প্রণয়।ঝট করে সূচনার মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো সে।বরাবরের ন্যায় ভড়কালো সূচনা।প্রণয় কিছুটা ফিসফিসিয়ে ই বললো-

–‘আমি যতটুকু জানি জড়িয়ে ধরে বলতে হয় যে” যেয়ে আবার তাড়াতাড়ি আসুন।আর তারপর হাসবেন্ড কপালে চুমু খেয়ে বিদায় নেয়।এই তো।তবে তেমার জন্য জড়িয়ে ধরা আর চুমু খাওয়াটা তোলা থাক,পরে নিব সেটা,অধিকার নিয়ে। আপাদত ওইটুকুই বলো।

যেন লাজরাঙা হলো সূচনা।লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো –

–‘যেয়ে আবার তাড়াতাড়ি আসুন।

প্রণয় হাসিমাখা কণ্ঠে বললো –

–‘দ্যাট্স লাইক মাই গার্ল।

চলে গেল প্রণয়। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে যতক্ষণ তাকে দেখা যাচ্ছিল সূচনা দাড়িয়ে রইলো ততক্ষণ।দরজা লক করে সূচনা সোজা আসল ইরার রুমে।ইরা বিছানায় শুয়ে ছিল।সূচনাকে দেখেই উঠে বসল।সূচনা হালকা হেসে বললো-

–‘তোমার সাথে কথা ছিল।

ইরা জানে সূচনা কী বলবে,তবুও জোরপূর্বক হেসে বললো-

–‘হ্যা বসো।কী কথা বলো।

#চলবে

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৮
______________________________
ইরার রুমে মুখোমুখি বসে আছে সূচনা আর ইরা।সূচনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ইরা।সূচনা ইতস্তত বোধ করছে কিছু জিজ্ঞেস করতে।লম্বা করে দম নিয়ে ইরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

–‘তুমি কি কোনো কারণে ডিস্টার্বড ইরা?মন খারা/প?কিছু কী হয়েছে?

–‘না ভাবি কী হবে?আমি ঠিক আছি,সবাই একটু বেশি ভাবছ তোমরা।আসলে ঘরে বসে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি চলে এসেছে,এখন কিছু করতেও ভালো লাগেনা। এজন্য আর কি, অন্য কিছু না।দুইদিন পর এমনি ঠিক হয়ে যাব।চিন্তা করো না।

ইরার কথা খুব একটা বিশ্বাস হলো না সূচনার কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারল যে সে লুকচ্ছ কিছু।হয়তো তাকে বলতে ইতস্তত বোধ করছে। তাই আর কথা বাড়ালো না।বললো-

–‘ঠিক আছে বুঝলাম,কিন্তু কোনো সমস্যা হলে সেটা অবশ্যই কাছের কারো সাথে শেয়ার করবে।তোমার কাছে কঠিন মনে হলেও সে হয়তো সহজেই সমাধান দিতে পারবে।নিজের মধ্যে চাপিয়ে রেখনা।আমি অবশ্য এমনই, নিজের কথাগুলো না সবার মতো করে সহজেই কারো সাথে শেয়ার করতে পারি না,অসুখ হলে তো আম্মু ‘কে বলতেও ইতস্তত করতাম,জানাতাম না তাকে।নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলোও কারো সামনে তুলে ধরতে পারিনা। এটা মারা/ত্মক একটা সমস্যা,তুমিই বলো নিজের মনের কথা যদি নিজেই না প্রকাশ করতে পারি তাহলে মানুষ জানবে কি করে?আর না জানলে কেউ তো কিছু করতেও পারবে না।তবে একটা জিনিস কি জানো আমি প্রচুর বক/বক করি অথচ নিজের অনেক অব্যক্ত কথা আছে,যা অনেকেই জানে না।এমনকি আম্মুকেও বলতে পারিনি।ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত।যে কথাগুলো বলা দরকার সেগুলোবলতে পারিনা আর হুদাই বক/বক করি।তাই বলছি তুমি এমন করো না আবার।বুঝেছ?

ইরা মাথা নাড়িয়ে বললো-

–‘বুঝেছি, তুমি সত্যি ই বক/বক করতে পার।

ইরার কথায় হালকা হাসল সূচনা।
.
.
পার্কে বেঞ্চের দুই কোণায় বসে আছে দিনা আর জাওয়াদ।জাওয়াদের চোখে মুখে চরম বিরক্তির ছাপ। বার বার মুখ বা’কিয়ে তাকাচ্ছে দিনার দিকে।দিনা কাচুমাচু মুখ করে বসে আছে,আর আড় চোখে দেখছে জাওয়াদকে।সে জানে জাওয়াদ বিরক্ত আর বিরক্তির কারণ ও তার জানা।দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব কিঞ্চিৎ ঘুচাঁল জাওয়াদ। দিনা ঝট করে চোখ তুলে তাকালো তার দিকে।জাওয়াদ পাত্তা দিল না তার দৃষ্টি,স্বাভাবিক ভাবেই বসে রইল সামনের দিকে তাকিয়ে। দিনা থেমে থেমে বললো –

–‘অত কা,,কাছে আ,,আসবেন না প্লিজ,আ,,আমার

–‘তোমার কী?কী সমস্যা তোমার?

–‘কিছু না।

–‘কিছু না কেন বলো।বলবে তোমার লজ্জা করে।দুনিয়ার সব মেয়েদের লজ্জা তো তুমি একাই বয়ে বেড়াচ্ছ।এম আই রাইট?

–‘দুনিয়ার সব মেয়েদের কথা তো জানিনা কিন্তু আমরটা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি।

জাওয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো-

–‘হ্যা সেটাই তো কাল হয়েছে আমার।

–‘কী বললেন?

–‘আমার মাথা।

–‘দেখুন লজ্জা পাওয়া ও কিন্তু একটা আর্ট যেটা সবাই পারে না।

–‘হ্যা তো এই খুশিতে কেউ নোবেল ছুড়ে মা/রুক আপনার দিকে।

–‘এভাবে বলছেন কেন?

–‘এবার আর বলবনা কিছু, যা করার করব।

–‘কী করবেন?

–‘করলেই দেখবে।চলো।

–‘কোথায়?

–‘এখানে সঙ সেজে বসে থেকে তো লাভ নেই, বাসায় যাব।

জাওয়াদের ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলা কথাগুলোতে ব্যথিত দিনার হৃদয়।ভেতর থেকে কান্না আসছে তার।এভাবে না বললেই কী না?সে কি ইচ্ছে করে করে?আর জাওয়াদ তো কখনো এমন ব্যবহার করে না তাহলে আজকে কী হলো?

–‘উঠো

জাওয়াদের ধমকানো স্বর।কেঁপে উঠল দিনা।বেঞ্চ থেকে উঠে তার সাথে পা বাড়ালো।
.
.
মিসেস আফিয়া রান্না করছেন রান্নাঘরে।ফিরোজা খালা থালাবাসন ধুচ্ছিল। সূচনা দাড়িয়ে আছে চুপচাপ। তাকে মূলত কিছু করতে দিচ্ছেন না মিসেস আফিয়া।তাই মুখ ছোট করে দাড়িয়ে আছে।মিসেস আফিয়া তরকারি নাড়তে নাড়তেই জিজ্ঞেস করলেন –

–‘কী হয়েছে মুখটা অমন করে রেখেছিস কেন?

–‘আমার খালি বসে থাকতে ভালো লাগেনা।বাসায় তো আম্মুর সাথে কাজ করতামই তাহলে এখানে করতে কি সমস্যা?দুজন মিলে করি।আপনার আর খালার দুজনের ই চাপ কমবে,আর কাজ ও তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।

মিসেস আফিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-

–‘ঠিক বলেছিস।

মিসেস আফিয়ার কথা শুনে সূচনার মুখ টা চকচক করে উঠল।যাক এবার আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবেনা।এভাবে কতক্ষণ ভাল্লাগে বসে থাকতে।অসহ্য লাগে।

সূচনার মুখ দেখে মিসেস আফিয়া বললেন-

–‘অত খুশি হতে হবে না আমি ভেবে দেখব। এখন ও বলিনি কিছু।আচ্ছা শোন ইরার সাথে কথা হয়েছে?

–‘হ্যা হয়েছে। আপনি চিন্তা করিয়েননা,ঠিক হয়ে যাবে।

–‘ঠিক আছে।
.
.
.
বিছানায় বসে কাঁদতে কাঁদতে নাকের পানি চোখের পানি এক করতে ব্যস্ত দিনা। আর তার এই অবস্থা দেখে তিথি আর ইরার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম। সূচনা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শক্ত হয়ে বসে আছে। বলা যায় না তাদের হাসি দেখে সে ও যদি হেসে দেয়।হায়!লজ্জা।কী ভাববে দিনা?যত যাই হোক বয়সে তো বড়।দিনা এবার রা/গে দুঃখে টিস্যু দলা পাকিয়ে ছুড়ে মা/রলো ইরা, তিথির দিকে।বাজ/খাই গলায় বললো-

–‘মজা পেয়েছিস হ্যা।আমি কান্না করছি আর তোরা দাঁত বের করে হাসছিস।চোখের সামনে থেকে যা।রুম থেকে বেরো।

ইরা হাসি থামিয়ে বললো-

–‘তুমি শুধু শুধু ই কান্নাকাটি করছ, ভাইয়া দেখবে একটু পরেই কল দিয়ে বলবে সরি লজ্জাবতী ভুল হয়ে গেছে। এবারের মতো মাফ করে দাও।

–‘সত্যি? তোর মনে হয়?

–‘আরে হ্যা রে ভাই।

–‘ঠিকই বলছে ইরা।মামী খেতে ডেকেছে আপু ফ্রেশ হয়ে আসো।(সূচনা)

–‘ঠিক আছে আসছি।
.
.
পশ্চিমা বাতাস স্পষ্ট জানান দিচ্ছে শীতের আভাস।বাতাসে শরীরে কাটা দেয়ার মতো।সূচনার হাত খোঁপা করা চুলগুলো খুলে গেছে,শ্যাম্পু করেছে আজকে এজন্যই বোধহয়।চুল খোপা করে ব্যালকনির একপাশে শুকাতে দেয়া জামাকাপড় গুলো নিয়ে রুমে
আসলো। ভাজ করে কাবার্ডে রেখে দিয়ে ওয়াশরুমে গেল ওযু করতে।আজকে বাসায় আসেনি প্রণয়।দুপুরেই ফোন দিয়ে বলেছে –

–‘শোনো,আজকে আসতে দেরি হবে।অনেক কাজ,অফিসে খেয়ে নিব আমি।

জবাবে শুধু হুম বলতেই ফোন রেখে দিয়েছে প্রণয়।হয়তো ব্যস্ত।

নামাজ পড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে বিড়াল পায়ে এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে।চা বানাবে সবার জন্য। এ বাড়ির সবারই চা খাওয়ার অভ্যাস।তবে ইসহাক সাহেব গ্রীন টি আর রং চা ব্যতিত খান না।ইসহাক সাহেবের সাথে তেমন কথা বা দেখাও হয় না বলতে গেলে।উনি সকাল সকাল ই চলে যান অফিসে,রাতে আসে,এশারের নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েন। সেই যে প্রথম দিন তার সাথে কথা হয়েছিল সূচনার।সেদিন তো মনে হয়েছিল অনেক সহজ,সরল, খোলামেলা স্বভাবের।কিন্তু মিসেস আফিয়ার কাছ থেকে জেনেছে উনি নাকি গম্ভীর স্বভাবের অনেকটা,তেমন কথা বলেন না,অত কথা পছন্দ ও করেন না।পৃথিবীতে দু রকমের মানুষ ই তো আছে। কেউ সহজেই সবকিছু শেয়ার করতে পারে, খোলাখুলিভাবে আলোচনা করতে পারে।কেউ আবার পারে না,গম্ভীর স্বভাবের হয়।ইরা আর তিথি নিচতলার ফ্লাটে গিয়েছে। কোনো দরকারে বোধহয়।দিনা এখনোো মন খারাপ করে বসে আছে। ফোন করে নি জাওয়াদ আর।সে ও রা/গ করে আর কল দেয়নি।কিন্তু কেঁদে কেটে ভাসাচ্ছে।ট্রেতে করে চা নিয়ে প্রথমে মিসেস আফিয়ার কাছে গেল সূচনা। দরজার কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই মিসেস আফিয়া ভেতর থেকে বললেন-

–‘আয় ভেতরে।

রুমে প্রবেশ করে টেবিলের ওপর ট্রে রেখে একটা কাপ বাড়িয়ে দিল তার দিকে।চা খেতে খেতে মিসেস আফিয়া বললেন-

–‘শোন এখন থেকে রোজ করে এসময় টায় আমার রুমে আসবি।এক সাথে আড্ডা দিব।মা -মেয়ে মিলে।

মাথা নাড়ালো সূচনা।মিসেস আফিয়া কথা বলতে বলতে তার কণ্ঠ মলিন হলো হুট করে।মলিন কণ্ঠেই বললেন-

–‘জানিস প্রণয় ছোট বেলায় না একেবারে ভিতু টাইপ ছিল। একটু কিছু তেই ঘাবড়ে যেত,রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যেত তার।কিন্তু আপা মা/রা যাওয়ার পর সবকিছু কেমন যেন বদলে গেল।ইরা তো ছোট ছিল তখন।সব চেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে প্রণয়ের মধ্যে। আগের মতো আর কোনো পরিস্থিতিতে ভয় পায় না,ঘাবরায় না,কাউকে কিছু বলেও না,নিজের মতো করে সব করে।

মিসেস আফিয়ার কথার মাঝেই কলিং বেলের আওয়াজ।উনি ব্যস্ত গলায় বললেন –

–‘প্রণয় বোধহয় এসে গেছে যা রুমে যা তাড়াতাড়ি।

মিসেস আফিয়ার কথায় সূচনার লজ্জা হলো খাানিক।এভাবে উঠে রুমে চলে আসবে,ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে তার।মিসেস আফিয়া আবারও বললেন-

–‘কী হলো যা।

এবার উঠে পড়লো সূচনা।ট্রে হাতে বেড়িয়ে পড়ল রুম থেকে।রান্নাঘরে গেল প্রণয়ের জন্য শরবত বানাতে।ফিরোজা খালা বোধহয় শরবত বানাতেই নিচ্ছিলেন।সূচনা ধীর কণ্ঠে বললো –

–‘খালা আমি বানাই।

ফিরোজা খালা জোড়াজুড়ি করলেন। সূচনা বলতে পারলনা প্রণয় বলেছে তাকে বানাতে।তবুও বুঝ দিল। সূচনা ই বানালো।গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করলো রুমে হাতে গ্লাস নিয়ে।প্রণয় দু হাত দু দিকে মেলে দিয়ে,চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে ছিল।পায়ের আওয়াজে চোখ খুলে তাকালো। সূচনাকে দেখেই ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কোথায় ছিলে?

–‘মামীর রুমে।

–‘আমি এসেছি দেখনি?

–‘দেখেছি তো।

–‘তাহলে আসো নি কেন?

সূচনা জবাব দিতে পারলনা।

–‘শরবত দিবে না নিয়ে দাড়িয়ে ই থাকবে?

হকচকিয়ে গেল সূচনা।তাড়াতাড়ি বাড়িয়ে দিল গ্লাস।প্রণয় ভ্রু কুচকে বললো –

–‘দুই দিন না যেতেই ভুলে গেছ।

সূচনা প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি তে তাকালো তার দিকে। প্রণয় বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বললো –

–‘কে বানিয়েছে?

–‘আমি

–‘খেয়ে দেখো।ফাস্ট।

একচুমুক খেয়ে প্রণয়কে গ্লাসটা দিল সূচনা।

সূচনাকে গ্লাস ফেরত দিয়ে আদেশের স্বরে বললো-

–‘এখন থেকে আমি আসলে দরজা তুমিই খুলবে।যদি কোনো কাজে ব্যস্ত থাকো তাহলে দরকার হয় আধা ঘন্টা দাড়িয়ে থাকব আমি তবুও তুমিই খুলবে আর আসার পর আমার পিছন পিছনই ঘুরঘুর করবে।বোঝা গেছে কথা?

–‘আপনার পেছনে ঘুরঘুর করব মানে?আমার খেয়ে কাজ নেই?আর মামী বলেছে এই সময়টায় ওনার সাথে বসে কথা বলতে ওনার রুমে।

–‘অতকিছু দেখার বিষয় আমার না, যা বলেছি তা হলেই হয়।আমি আবার ভালোর ভালো খারা/পের থেকেও বহুগুণে খারা/প।আমার কথার নড়চড় হবে এটা আমার পছন্দ না। গট ইট?

সূচনা মুখ বা’কিয়ে বললো-

–‘হু বুঝেছি।

–‘দেটস গুড।
______________________________________
অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ।মেঘের আনাগোনা ও নেই,না আছে তারার মেলা।কেমন যেন গুমোট পরিস্থিতি।শুধু বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে।ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে।বৃষ্টির পানির ঝাপটায় প্রণয় হয়তো ভিজেও যাচ্ছে খানিক। কিন্তু সূচনা বলতে পারল না।ঘন ঘন পলক ফেলে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।ব্যালকনির গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে প্রণয়। মনে মনে ভাবছে অনেক কিছু ই।সূচনা প্রণয়ের পেছন পেছনই এসেছে সেই কখন।কিন্তু কেন যেন তার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে ঘিরে ধরেছে আড়ষ্টতা। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাম/ড়াচ্ছে সে।তার বদ অভ্যাস গুলোর মধ্যে অন্যতম এটা।কত শত ব/কা খেয়েছে এরজন্য তার হিসাব নেই।কিন্তু ঔ-যে বলে না মানুষ অভ্যাসের দাস।তার ক্ষেত্রেও তাই।সে বদলাতে পারেনি,অতিরিক্ত টেনশন বা ভয় হলেই আপনা আপনি ঘটে যায় এই ক্রিয়া।

‌঎তুমি যদি না দেখা দাও,কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদলা-বেলা।঍

সামনে চোখ রেখেই রবি ঠাকুরের উক্ত উক্তি টুকু করল প্রণয়। সূচনা অবাক হয়ে গেল। তার বিস্ময়াভাব কাটার আগেই প্রণয় বললো-

–‘এভাবে পেছনে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ালে হবে,কাছে আসো,দেখা দাও পাশাপাশি দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখব।বউ থাকতেও যদি এই মুহূর্ত উপভোগ না করতে পারি তাহলে তে বলতে হবে “প্রণয় তুই বিবাহিত ব্যাচলর।”

সূচনা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে প্রণয়ের পাশাপাশি দাড়ালো। করবে না করবে না করেও জিজ্ঞেস করেই ফেললো-

–‘আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি পেছনে তাও আবার ঠোঁট কামড়া/নোর কথাটা,,

প্রণয় হাসল।শব্দহীন সেই হাসি,গম্ভীর, গভীর আখিঁ জোড়া তার।শীতল কণ্ঠে বললো –

–‘সে জানে না তাকে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে কেউ,বিশেষ করে সে যখন তার আশেপাশে থাকে।

সূচনা থমকালো। অজান্তেই শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেল শীতল স্রোত,মুষ্টি বদ্ধ হলো হাত নিজেকে সংযত রাখতে।নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো দুজন বাইরের দিকে।কমে এসেছে বৃষ্টি। বৃষ্টির পানির হালকা ঝাপটা তবে তার জোর কম বিধায় স্পর্শ করছে না শরীর।

#চলবে