প্রণয়ের সূচনা পর্ব-৪+৫+৬

0
296

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_০৪
__________________________
রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসলো সূচনা।ফোন হাতে নিয়ে কল লা’গালো মিহুকে।তিনবার রিং হতেই কল রিসিভ করলো মিহু।মিহু ফোন রিসিভ করতেই সূচনা বললো-

–‘কই ছিলি?এত দেরি কেন হলো রিসিভ করতে।

–‘আরে বাবা ঘুমাচ্ছিলাম।আর দেরি কোথায় হলো?মাত্র তিনবার রিং হয়েছে।

–‘হুহ।শোন।

–‘বল,,

–‘আজকে আমাদের বাসায় আসতে পারবি?

–‘আজকে?

–‘হ্যা,,

–‘আচ্ছা দেখি আম্মুকে বলে।

–‘ঠিক আছে আন্টিকে জিজ্ঞেস করে বল আমায়।

–‘আচ্ছা।

ফোন রেখে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো সূচনা।
.
.
ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিলো সূচনা। আর বারবার তাকাচ্ছে ফোনের দিকে,মিহুর ফোনের অপেক্ষায়। কিন্তু ফোনই করছে না সে।তার ওপর ফোন ও রিসিভ করছেনা।মেজাজ তার চ’রম পর্যায়ে।কলিং বেলের আওয়াজে ভ্রুকুটি করে তাকালো সূচনা।আবারো কলিং বেলের আওয়াজ।রান্নাঘর থেকে মিসেস দিশা গ’লা উচি’য়ে বললেন-

–‘দরজা খুলছিস না কে সূচি?কা’নে কি তালা দিয়েছিস হ্যা।খো’ল তাড়াতাড়ি।

–‘খুল’ছি খু’লছি।এমনিতেই মে’জাজ খা’রাপ তারওপর আবার কে জ্বালাতে এসেছে কে জানে।

বিড়বিড় করতে করতে দরজা খুললো সূচনা।দরজা খু’লতেই কেউ শক্ত করে ঝাপ’টে ধরলো তাকে।হতবিহ্বল সূচনা।আচমকা আক্রমণে বুক ধ্বক করে উঠলো এক মূহুর্তের জন্য।আগুন্তক ব্যক্তির দুই বাহু ধরে ছা’ড়িয়ে নিল নিজেকে।আরে এ তো মিহু।সূচনার দিকে তাকিয়ে দাঁত কে’লিয়ে হাস’ছে সে।যার দরুন সূচনার রা’গ বেড়ে গেলো আরও।তার মাথায় চা’টি মে’রে বললো-

–‘কয়টা ফোন দিয়েছি হ্যা? ফোন রিসিভ করিসনি কেন?ফোন দিয়ে জানাতে বলেছিলামনা?

–‘উফফফ,, জা’ন। আস্তে একটা একটা করে প্রশ্ন কর।আর আগে ভেতরে তো আসতে দিবি নাকি বাইরে দাড় করিয়ে ই ক্লাস নিবি?

সূচনা মুখ বা’কিয়ে বললো-

–‘আয়।

সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে মিহু বললো-

–‘দেখ তোকে যদি ফোন দিয়ে বলে দিতাম তাহলে কিন্তু তুই সারপ্রাইজড হতে পারতিনা।তাই বলিনি।সারপ্রাইজ দিলাম এখন।

–‘সারপ্রাইজ না ছাই,হা’র্ট এট্যা’ক হয়ে যেত এখনই।

–‘এতটুকুতেই এই অবস্থা।তোর হা’র্ট এত দুর্বল?

মিহুর কথায় মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল সূচনার।তার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বললো ও না সে।শুধু মলিন হাসলো।তা দেখে মিহু বললো-

–‘আ’ম সরি আমি মিন করে বলিনি।রা’গ করিসনা প্লিজ।

সূচনা স্মিত হেসে বললো-

–‘রা’গ করিনি একটুও। তুই যা আম্মুর সাথে দেখা করে আয়।

–‘সত্যি তো?

–‘হ্যা সত্যি।

–‘আচ্ছা।
.
.
.
বিকেল সাড়ে চারটার মতো।গা’ল ফু’লিয়ে বিছানায় বসে আছে মিহু,,মাঝেমধ্যে আড় চোখে দেখছে সূচনাকে,,তার ভাব ভঙ্গি বোঝার জন্য। কিন্তু ফলাফল শূন্য।তাই মিহু আবারো বললো-

–‘সূচনা চল না যাই এমন করিস কেন?সামনেই তো। জাস্ট যাব,খাব, চলে আসব।কি হবে গেলে।তুই তো এতদিন বলেছিস পরীক্ষা শেষ হলে যাবি।এখন এমন করছিস কেন?

–‘বলেছিলাম কিন্তু,,

–‘আমি কিন্তু রা’গ করছি সূচি।(মুখ বা’কিয়ে)

অগ্যতা রাজি হতে হলো সূচনা কে।এত করে বলছে মেয়েটা,না রাজি হয়ে কি পারে।মিহু যদি রা’গ করে তার সাথে তাহলে তার কি হবে?যদিও রা’গ তার ক্ষণিকের তবুও।সূচনা রাজি হওয়ার পর মিহু আরেক বায়’না জুড়ে দিল।শাড়ী পড়ে যেতে হবে।তা শুনে সূচনা বললো-

–‘এখন কিন্তু আমি যাবইনা মিহু।

–‘তুই শাড়ী না পড়লে তোকেও নিবনা আমিও যাবনা।

–‘মিহু

–‘সূচি

–‘উফফ,,আমি পড়বোনা।

–‘উফফ,,বলেছিনা পড়বি।

–পড়বোনা।

মিহু কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো-

–‘পড়বি।প্লিজ।

সূচনা মুখ ল’টকিয়ে বললো-

–‘ঠিক আছে।

বিজয়ের হাসি হাসলো মিহু।

–‘তোকে আসতে বলাটাই এখন ভুল মনে হচ্ছে।

–‘হিহিহি।আচ্ছা শোন,,লাস্ট যে বেবি পিংক কালার শাড়ী কিনেছিলাম দুজন,সেটা পড়বি।আমি আমার শাড়ী, হিজাব সব নিয়ে এসেছি।

সূচনা ভ্রুকুটি করে তাকালো। বললো-

–‘মানে সব প্রিপ্লেন্ড।

–‘ইউ নো মিহু কখনো প্ল্যানিং ছাড়া কাজ করেনা।এখন তাড়াতাড়ি কর তোকে রাজি করাতে যেয়ে অনেক সময় অপচয় হয়ে গেছে। ফাস্ট ফাস্ট।

মিহুর কথা শুনে স্মিত হাসলো সূচনা।মেয়েটা আস্তো একটা পা’গলি।
.
.
–‘উফফ আন্টি তুমি একদম টেনশন করোনা তো,আমি আছি তো।আর সামনেই তো যাচ্ছি মাত্র ষাট টাকা ভাড়া লাগবে যেতে আসতে।তাহলে বুঝো কতটুকু দূরত্ব। কিছু হবে না যাব আর আসবো।

মিসেস দিশা আমতা আমতা করে বললেন-

–‘ঠিক আছে তুই নিয়ে যাচ্ছিস এজন্য যেতে দিচ্ছি নাহলে কিন্তু দিতামনা। সাবধানে যাস দুজন আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।

–‘হ্যা আম্মু,,তুমি টেনশন করো না তো।

–‘হুম।

মিহু দুষ্টুমীর স্বরে বললো-

–‘এক কাজ করো আন্টি তুমি শাড়ীটা চেন্জ করে একটু রেডি হয়ে আসো,,তোমাকেও সাথে নিয়ে যাই।এমনিতেও তুমি আর আমিতো মিতা ই।একসাথে না হয় ঘুরলাম একটু।

–‘আমার কি সেই সময় এখন তোরা যা।

–‘এটা কি বললে?তুমি এখনো দেখতে মাধুরী দীক্ষিত এর মতো সুন্দর,তোমাকে নিয়ে বের হলে আমরা দুইজন তো পাত্তাই পাবনা আর তুমি বলছো সেই সময় নেই।এটা কোনো কথা।

মিহুর কথায় সূচনা মুখ টিপে হাসছে সাথে মিহুও। তা দেখে মিসেস দিশা বললেন-

–‘তবে রে।মজা করা হচ্ছে আমার সাথে।যা তাড়াতাড়ি না হয় কান মু’লে দিব দুইটার।

–‘আম্মু হিজাব পড়া কান মু’লে দিবে কিভাবে?হিহিহি।

কথাটুকু বলেই সূচনা আর মিহু কেটে পড়লো রান্না ঘর থেকে।মিসেস দিশা রান্নাঘরে দাড়িয়েই হাসতে লাগলেন।মনে মনে দোয়া করলেন -‘তার মেয়ে দুটো যেন সারাজীবন এভাবেই হাসিখুশি থাকে।
.
.
–‘আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?

রিকশায় বসে মিহুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো সূচনা।

মিহু সামনের দিকে চোখ রেখেই বললো-

–‘প্রথমে লেকের দিকটায় যাব তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে থাকব।ওখানে নতুন একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে সেখানে যেয়ে তাদের পাস্তা আর কোল্ড কফিটা ট্রাই করবো।এই দুইটা নাকি বেস্ট তাদের।রিভিউ দেখেছি অনেক তাই ট্রাই করব।তারপর বাসায় যাব।

–‘ওহ।

–‘হুম।
.
.
দিনের শেষে ধরনীতে থেমে গেছে চারপাশের কর্ম কোলাহল।চারিদিকে বিরাজমান নৈসর্গিক নীরবতা।যেন অন্য রকম এক প্রশান্তি।র’ক্তিম সূর্যের র’ক্তিম আভায় পৃথিবী যেন নিজেকে অন্য কোনো রঙে সাজাতে ব্যস্ত।এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাধুরী দেখতে ব্যস্ত দু’জন কিশোরী।লেকের স্বচ্ছ পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় তাদের পা জোড়া।লেকের চারিদিকে বাগানবিলাস, সন্ধ্যা-মালতি আর টগর ফুলের মে’লা।
টগর ফুল সূচনার পছন্দের ফুলের মধ্যে একটা।কেন যেন অনেক বেশি মুগ্ধকর মনে হয় সাদা,স্বচ্ছ এই ফুলকে।যেন সবুজ শিয়রে মুক্তো দানার ন্যায়।লেকের এই দিকটা এখনো পুরোপুরি সচ’ল না।এই দিকটায় তেমন লোকের আনাগোনা ও দেখা যায় না।তাদের থেকে একটু দূরে একটা আট-নয় বছর বয়সী ছেলে।হাতো তার বেলীফুলের গাজরা। হেটে হেটে বিক্রি করছে,হা’ক ছাড়ছে-একটা নিন দশ টাকা। গাজরা দশ টাকা।’ তা দেখে মিহু গ’লা উঁচিয়ে ডা’ক দিল-

–‘এই ছেলে এদিকে আসো তো।

তার ডা’ক শুনে ছেলেটা এগিয়ে আসলো তাদের দিকে। পড়নে তার ঢিলেঢালা একটা শার্ট আর একটা পুরোনো প্যান্ট।শার্টের কয়েক জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে ফু’টো হয়ে গেছে।ছেলেটার চেহারাতে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ।এতটুকু বয়সে কোথায় খেলাধুলা করবে,পড়ালেখা করবে তা না করে উত্তপ্ত রোদে,বৃষ্টিতে ভিজে, শীতের তীব্রতা সবকিছু উপেক্ষা করে রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে হচ্ছে।মায়া হলো দু’জনের।সূচনা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো-

–‘একটা গাজরা কত করে বিক্রি করো?

–‘দশ টাকা কইরা বে’চি।কয়’টা নিবেন কন।

–‘আচ্ছা,, দুইটা দাও।

–‘ঠিক আছে বিশ টাকা দেন।

ব্যাগ থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে ছেলেটার হাতে দিল সূচনা।তা দেখে ছেলেটা বললো-

–‘আমার কাছে তো এত টাকার ভাংতি নাই।বিশ টাকা দেন।

–‘ভাংতি দিতে হবে না পুরোটা রেখে দাও।

–‘ না আপা আমি পুরা টাকা রাখতে পারতামনা,,দুইটা নিছেন বিশ টাকা ই দেন।

মিহু জিজ্ঞেস করলো-

–‘তোমার কাছে কয়টা গাজরা আছে?

ছেলেটা হাতের গাজরা গুনে বললো-

–‘এগারোটার লা’হিন আছে।কেন?

–‘দশটা দাও।আর একশো টাকা নাও।

সূচনা ও বললো-

–‘হ্যা।এবার তো সমস্যা নেই?

ছেলেটা ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললো-

–‘না আফা এহন সমস্যা নাই।নেন।

হালকা হেসে তার হাত থেকে গাজরা গুলো নিল সূচনা।

মিহু আবারো জিজ্ঞেস করলো-

–‘তোমার নাম কি?

ছেলেটা হাসি টেনে ই জবাব দিল-

–‘আমার নাম শান্ত।

–‘সুন্দর নাম।

এর মধ্যে ই আযানের মধুর ধ্বনি।ছেলেটা তাড়াহুড়ো করে বললো-

–‘আমি এহন যাই। আযান পইরা গেছে।

–‘ঠিক আছে যাও।

ছেলেটা যেতেই সূচনা আর মিহু ও চলে আসলো সেখান থেকে।
.
.
রেস্টুরেন্টে বসে আছে সূচনা আর মিহু।তাদের অর্ডারের অপেক্ষায়।টুকিটাকি কথা হচ্ছে তাদের মধ্যে। কথার এক পর্যায়ে মিহু বললো-

–‘আমার কিন্তু প্রণয় ভাইয়ার কথাগুলো ভালো লেগেছে। দেখ সে কিছু জানেও না সেই ব্যাপারে। তুই বলতে চাইলেও সে শুবতে রাজি হলো না।উল্টো বললো -অতীতে এমন টুকটাক সবারই থাকে।সে চাইলেই তোকে উল্টা পাল্টা কথা বলতে পারতো।তোকে খা’রাপ কিছুও বলতে পারতো কিন্তু তা না করে কত সুন্দর করে বোঝালো তোকে।সবাই কিন্তু এমন হয় না সূচি।আজকাল সুন্দর মন আর মানসিকতার মানুষ পাওয়া বড্ড কঠিন।আর এমন মানুষ পেয়ে তাকে হারিয়ে ফেলা আমার মতে জীবনের সবচেয়ে বো’কমি হবে।যা করবি ভেবে চিন্তে করিস।বুঝেছিস?

–‘হুম।

তারপর নীরবতা দু’জনের মধ্যে। হুট করেই মিহু বলে উঠলো-

–আরে ভাইয়া কেমন আছেন?

মিহুর কথা শুনে তার দিকে তাকালো সূচনা।মিহুর দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকাতেই চমকে গেলো সে।

#চলবে

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_০৫
_________________________
চ’মকিত দৃষ্টিতে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে সূচনা।মানুষটা আর কেউ না প্রণয় ই।এই মূহুর্তে এখানে তার উপস্থিতি একদমই অকল্পনীয় ছিল।তার ব্যাপারটা যেন এক মূহুর্তের জন্য মাথা থেকে বে’ড়িয়ে গিয়েছিল।হুট করে তাই সামনে আসাতে হতবিহ্বল সূচনা।সে অবশ্য একা নয়।তার সাথে আরেকটা ছেলে আছে।তার বয়সী হবে বা দু-এক বছরের ছোট ও হতে পারে।প্রণয় সূচনাকে তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

–‘কেমন আছো?

সূচনা আরেক দফা অবাক। অবাকের কারণ ‘কেমন আছে’ সেটা জিজ্ঞেস করা না।কারণ হচ্ছে প্রণয় তাকে তুমি বলে সম্বোধন করছে।প্রণয়ের তুমি সম্বোধন যেন তার মন গহীনে অন্য রকম এক অনুভূতির জোগান দিল।সূচনার উত্তরের আশায় প্রণয় তাকিয়ে আছে তার মুখপানে।সূচনা মিনমিন করে বললো-

–‘আলহামদুলিল্লাহ।আপনি?

স্মিত হেসে প্রণয় জবাব দিল-

–‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
.
মিহু কথা বলছে একাধারে,তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রণয় ও ব’কবক করছে।সূচনা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।’এই লোক এত কথা বলতে পারে?প্রথম দেখে তো মনে হয়েছে একেবারে গম্ভীর স্বভাবের মানুষ।আর মিহুটা এমনভাবে কথা বলে যাচ্ছে যেন কত বছরের পরিচয় তাদের।হুহ।মিহু কথা বলার সাথে সাথে আড়চোখে প্রণয়ের পাশে বসা ছেলেটাকে পরখ করছে।এ দিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার ফোন আর ফাইল নিয়ে ব্যস্ত।একবার ফোনের দিকে তো আরেকবার ফাইল পরখ করছে।তার মাঝেই ভুলবশত তার চোখ চলে যায় মিহুর দিকে।মিহু আগে থেকেই তাকিয়ে ছিল যার দরুন চোখাচোখি হয়ে যায় দু’জনের।তার চোখে চোখ পড়তেই মিহু ভে’ঙচি কাট’লো তাকে।ছেলেটা হতবাক হয়ে গেল।কথা নেই বার্তা নেই মুখ বা’কালো কেন?সে কি করেছে?আশ্চর্য!
সে দিকে না ভেবে নিজের কাজে মনোযোগ দিল সে।কথায় কথায়,জানা গেল তার নাম তন্ময়,প্রণয়ের এসিসট্যান্ট।ক্লাইন্টের সাথে মিটিং এসেছিল তারা।যাওয়ার সময়ই মিহুর ডা’ক পড়ে।তাদের অর্ডার করা খাবার ও এসে পড়েছে ইতিমধ্যে। সূচনা কাচুমাচু’ হয়ে বসে আছে। এমনিতেই বে’চারি সর’মে ডুবে যাচ্ছে তারওপর প্রণয় সামনে আবার সাথে আর একজন ছেলে এখন তো মনে হচ্ছে টু’স করে টেবিলের নিচে ঢু’কে যায়।কোনোরকম খাওয়ার পর্ব শেষ করলো। খাওয়া শেষে বাধলো আর এক বিপত্তি। বিল কে দিবে?তর্কবিতর্কের পর অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো যার যার বিল সেই দিবে। অন্য সময় ট্রিট দেওয়া যাবে।রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে মিহু বললো-

–‘আমরা তাহলে আসি ভাইয়া।

বাধ সাধলো প্রণয়। বললো-

–‘তোমাদের আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো।

সূচনা তড়িৎ গতিতে জবাব দিলো –

–‘না না দরকার নেই।আমরা যেতে পারব।

–‘আমিও জানি তোমরা যেতে পারবে।কিন্তু আমার সাথে দেখা যেহেতু হয়েছে সো এখন আমার সাথেই যেতে হবে।

–‘কিন্তু,, আমরা তো

–‘বিশ্বাস হচ্ছে না?রিল্যাক্স আই কেন আন্ডারস্ট্যান্ড, কি ভাবছো তুমি।আমারও বোন আছে।ইউ কেন ট্রাস্ট মি।

আর কিছু বললো না সূচনা।রেস্টুরেন্ট থেকে একটু দূরেই পার্ক করা ছিল গাড়ি।তাই হেঁটেই সেখানটায় যেতে হবে।শুরুতে তন্ময় তারপর মিহু তার পেছনে সূচনা আর তার থেকে এক কদম পেছনে প্রণয়।ফোন স্ক্রোল করতে করতে হাঁটছে সে।

–‘তুমি বলে সম্বোধন করায় সে কি রাগ হয়েছে?

আচমকা কানে’র কাছে বে’জে উঠলো কথাটা।পা থেমে গেল সূচনার। তার সাথে প্রণয় ও থেমে গেল। সূচনা আমতাআমতা করে বললো-

–‘আসলে,,

–‘আমার উত্তর এটা না।আঙ্কেলের কাছ থেকে জেনেছি সে নাকি আমার থেকে সাত -আট বছরের মতো ছোট হবে।তাই তাকে আপনি বলে সম্বোধন করাটা আমার কাছে মানানসই মনে হয়নি তাই তুমি বলেই সম্বোধন করলাম।

এবার সূচনা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো –

–‘আমি রা’গ করিনি।

তার জবাবে ছোট্ট করে হাসলো প্রণয়।এদিকে মিহু তন্ময়ের পেছনে হাঁটতে হাটতেই বিড়বিড় করছে।’ভাব কত!পেছনে যে কেউ আছে সেদিকে একটুও পাত্তা নেই।হুহ!মি.তেলময়!

–‘কিছু বললেন?

মিহু হকচকিয়ে বলে উঠলো-

–‘আব,,ব,,ক,,কই কিছু বলিনি তো।

–‘আমি তো শুনলাম।

–‘বেশি শোনেন।কা’নে সমস্যা আছে।

তন্ময় একটু রা’গ দেখিয়ে বললো-

–‘কি বললেন?

মিহু মুখ ল’টকে বললো-

–‘এমা,,আপনার তো দেখি আসলেই কা’নে সমস্যা। কানে কম শোনেন।

–‘কি উল্টাপাল্টা ব’কছেন? কা’নে সমস্যা হতে যাবে কেন?ঠিকঠাক ই আছে।

মিহু চিন্তিত গ’লায় বললো-

–‘সেটা বড় কথা না। আমিতো ভাবছি আপনার ভবিষ্যৎ এর কথা।সে তো পুরো অন্ধকার আর অন্ধকার।

তন্ময় কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো-

–‘ভবিষ্যত অন্ধকার হতে যাবে কেন?

–‘আরে এমন কা’লা ছেলেকে কে বিয়ে করবে?যদি বিয়ে করে ও দেখা যাবে বিয়ের পর বউ বলবে চাল আনতে আপনি নিয়ে আসবেন তেল।রোজ রোজ একই কাজে অতিষ্ঠ হয়ে বউ ঝ’গড়া করে চলে যাবে।তো বউ না থাকলে হলো না আপনার ভবিষ্যত অন্ধকার।

কথাগুলো বলে মিহু তন্ময়কে পাশ কা’টিয়ে চলে গেল।তন্ময় বো’কার মতো দাড়িয়ে রইলো। তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রণয় বললো –

–‘এমন মূ’র্তির মতো দাড়িয়ে আছো কেন?তোমায় আবার কে কি করলো?

তন্ময় থতমত খেয়ে বললো-

–‘আব,,ব আমায় কে কি করবে স্যার।কিছু না এমনি।

গাড়ীর পেছনের সিটে সূচনা আর মিহু।ড্রাইভিং সিটে তন্ময় আর তার পাশে প্রণয়।

সূচনাদের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো সূচনা আর মিহু গাড়ি থেকে নাম’লো সাথে প্রণয় ও।সদর দরজার সামনে যেয়ে কলিং বেল দেয়ার সাথে সাথে ই দরজা খুলে দিলেন মিসেস দিশা।প্রণয়কে দেখেই মিষ্টি হাসলেন।প্রণয় ও হাসিমুখে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো।তারপর বললো-

–‘আপনার কথা মতো ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছে দিয়ে গেলাম।এবার তাহলে যাই।

–‘সে কি ভিতরে তো আসবে

–‘না আন্টি দেরি হয়ে যাবে।আসি।

প্রণয় চলে গেল।সূচনা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো মিসেস দিশার দিকে।অবাক কণ্ঠে ই জিজ্ঞেস করলো-

–‘তোমার কথামতো দিয়ে গেছে মানে?

–‘হ্যা!তোদের সাথে রেস্টুরেন্টে নাকি দেখা হয়েছে। প্রণয় ফোন দিয়ে বলেছিল আমায়। আমি ই বলেছিলাম।সেসব বাদ দেয়।ফ্রেশ হয়ে আয় দু’জন।

–‘হ্যা চল(মিহু)
.
.
রাত সাড়ে দশটার কাছাকাছি।বারান্দায় কাউচে বসে আছে সূচনা।ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বাইরে,,বাতাসের বেগটা একটু বেশিই।আস্তে আস্তে হিমশীতল ঋতুর আগমন হওয়ার পথে।তারওপর এই শীতল ভেজা বাতাস,শরীর কা’টা দিয়ে উঠছে তার।গায়ে জ’ড়ানো ওরনা টা আরও ভালোভাবে জ’ড়িয়ে নিল।

–‘ঠান্ডা লাগ’ছে তবুও এখানে বসে আছিস কেন?রুমে যা।

তার পাশে বসতে বসতে উক্ত কথাটুকু বললো মিহু।তার দিকে তাকিয়ে সূচনা বললো-

–‘ঠান্ডা লাগছে কিন্তু প্রশান্তিময় অনুভূতি।আচ্ছা আন্টির সাথে কথা হয়েছে?

–‘হ্যা হয়েছে মাত্র।সন্ধ্যায় ফোন করে বলেছিলাম এখন আবার কথা বললাম।

–‘যাক ভালো করেছিস।

–‘হুম।একটা কথা বলি?

–‘তুই আবার জিজ্ঞেস করছিস?বলে ফেল।

–‘তুই বিয়ে করে ফেল।

–‘কি?

–‘না মানে বিয়েতে রাজি হয়ে যা আরকি।

–‘জানিনা,,দো’টানায় পরে গেছি জানিস।

–‘তুই এখনো সেখানেই,,

–‘আমি সেটা নিয়ে মোটেও ভাবছি না মিহু। অতীতে যে ছিল, ছিল।এখন নেই। তার সাথে জড়া’নো প্রথম আর শেষ স্মৃতি টুকুও আজকে শেষ করে দিয়েছি। ওই ডায়েরি টা জ্বালিয়ে দিয়েছি আজকে।আমি চাইনা ঔ ব্যাপারে আর কেউ জানুক।আমি নিজেও ভুলে যেতে চাই।

সূচনার কথা শুনে মিহু উৎফুল্লতা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো –
–‘উফফ,,সূচি এতদিন পর একটা ভালো কাজ করেছিস।অনেক খুশি আমি।জানিস একজন ইংরেজ কবি বলেছিলেন- “We will meet many people along the way,we will be friends but at the end of the day only one person will remain who is perfect for us”. ঠিকই তো চলার পথে কত মানুষের সাথে পরিচয় হয় কিন্তু দিনশেষে একজনই থাকে যে বেস্ট হয়।তাই যাই করিস না কেন ভেবে চিন্তে করবি।যেন পরে না আফসোস করতে হয়।আর একটা কথা মনে রাখিস আমি সবসময় আছি তোর সাথে।

জবাবে একগাল হাসলো সূচনা।হাসতে হাসতেই বললো-

–‘থ্যাঙ্কিউ সবসময় পাশে থাকার জন্য আর এই প্রবাদ বাক্য যে কোন ইংরেজ কবি করেছেন তা আমার ভালো করেই জানা।এখন আয় রুমে।

সূচনার কথায় জিভ কা’মড়ে ধরলো মিহু।বুঝে গেছে মেয়েটা।ধ্যাত!বো’কা বো’কা হাসি দিয়ে সূচনার সাথে পা বাড়ালো রুমে।
.
.
.
-‘আব্বু আমি বিয়েতে রাজি।’

ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন আরহাম সাহেব।তখনই সূচনা এসে উক্ত কথাটুকু বললো।মেয়ের এমন সোজাসাপটা কথায় তিনি কিঞ্চিৎ অবাক হলেন।

#চলবে

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_০৬
__________________________
সূচনার দিকে অবাক চিত্তে তাকিয়ে আছেন মিসেস দিশা আর আরহাম সাহেব।সূচনা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।গলা খাঁকারি দিয়ে আরহাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন-

–‘তুমি যা বলছো তাই কি তোমার শেষ সিদ্ধান্ত?

–‘হ্যা আব্বু।

–‘কিন্তু তারা আমাদের কথা কেন মানবে?প্রণয় তাদের একমাত্র ছেলে। আর একমাত্র ছেলের বিয়ে তে তারা কোনো আয়োজন করবে না তা কি করে হয়।

–‘আমি জানিনা আব্বু।কিন্তু আমি চাইনা যে আমার বিয়েতে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান হোক।যদি রাজি থাকো তাহলে আমিও বিয়েতে রাজি না হয় আমি বিয়ে করবোনা।

মিসেস দিশা মনে মনে ভাবতে লাগলেন-সে জানে তার মেয়ে ভিড়ভাট্টা, লোক সমাগম এত পছন্দ করে না, এড়িয়ে চলে কিন্তু তাই বলে নিজের বিয়েতে কিছু করতে দিবেনা?এটা কেমন কথা,,আশ্চর্য!

তার ভাবনার মাঝে আরহাম সাহেব এর কণ্ঠ –

–‘তুমি রুমে যাও।আমি দেখছি।

–‘জ্বি।

সোফা থেকে উঠে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে।রুমে এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরলো।একা একা আর ভালো লাগছেনা।মিহুটা ও চলে গেছে সকালে।ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হয়েছে সে। নিজের কোনো ভাই-বোন নেই।তার বাবার ও আর কোনো ভাই ও নেই।বাবা-মা গত হয়েছেন অনেক আগেই।দু’টো বোন আছে,তাদের মধ্যে একজন ফ্যামিলি নিয়ে ইতালি তে থাকেন।তার এক ছেলে এক মেয়ে।তারা হয়তো ঠিক মতো সূচনাকে চেনেওনা।আর এক ফুপ্পি উনি থাকেন উত্তরাতে। উনি যা ও একটু আসেন সময় পেলে।কিন্তু তাকে খুব বেশি একটা পছন্দ না তার।কারণ তার কথা বলার ধরন,একটু অন্য রকম।কথা দিয়েই খুব সহজে মানুষের অনুভূতিতে আ’ঘাত দিতে পারেন।তার দুই ছেলে এক মেয়ে।রিশা,ইরাদ,আর নিহাদ।নিহাদ বিয়ে করেছে চারবছর এর বেশি হবে।তাদের একটা মেয়েও আছে।হৃদুকা।মেয়েটা বড্ড ভালোবাসে তাকে।বেশ ভাব তার সূচনার সাথে। কিন্তু সূচনা তার ফুপ্পি মিসেস আফরোজার কারণে তাদের বাসায় যায়না, যার দরুন দেখাও হয় না। তবে মাঝেমধ্যে ভিডিওকলে কথা হয়।
ইরাদ এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।আর রিশা সবে এস.এস.সি পরীক্ষার্থী।সূচনার আম্মু তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।ভাই আছে দুইটা।তার বড় মামার দুই ছেলে আর ছোট মামার এক ছেলে এক মেয়ে।কিন্তু তারা সবাই থাকে দূরে দূরে।সব মিলিয়ে সে এ’কাই।ভাবতে ভাবতেই মন আরও খা’রাপ হয়ে গেলো সূচনার।শোয়া থেকে উঠে বসলো সূচনা।প্রণয়ের সাথে দেখা করতে হবে। তার বাবা যা বলবে বলুক তার একান্তে কথা বলাটা জরুরি।কিন্তু কিভাবে বলবে দেখা করার কথা?তার কাছে তো প্রণয়ের নাম্বার টা ও নেই।হঠাৎ খেয়াল হলো তার মায়ের কাছেই তো আছে কিন্তু সোজা যেয়ে তো তাকে বলা যায় না-

–‘আম্মু ওনার নাম্বারটা দাও।

এখন কি করবে তাহলে?একটাই পথ আছে। বিছানা থেকে উঠে কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢু’কলো।শাওয়ার নিয়ে,নিজেকে পরিপাটি করে বেরুলো রুম থেকে। রান্নাঘরের সামনে ঘুরঘুর করছে সে।তা দেখে মিসেস দিশা বললেন-

–‘এভাবে ঘুরঘুর করছিস কেন?কিছু লাগবে?

–‘এম্নিতেই। কিছু লাগবেনা।

রান্নাঘর থেকে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। মিনিট বিশেক বাদ আবার রান্নাঘরে যেতে দেখলো মিসেস দিশা নেই।তার রুমের দিকে পা বাড়ালো।পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করলো কিন্তু রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ পেয়ে বুঝতে পারলো যে শাওয়ার নিতে গিয়েছে।বেড সাইড টেবিল থেকে ওনার ফোন নিয়ে কল লিস্টে ঢু’কতেই দেখা গেল প্রণয় দিয়ে সেভ করা একটা নাম্বার। তাড়াতাড়ি নিজের ফোনে টু’কে,ফোন রেখে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে।নিজের রুমে এসে বারান্দায় যেয়ে ফোন নিয়ে বসলো কাউচে।নাম্বার তো নিয়ে নিয়েছে কিন্তু ফোন করবে?কি বলবে?কি দিয়ে শুরু করবে?দুরুদুরু বু’কে নাম্বারে ডায়াল করলো আবার সাথে সাথে ই কে’টে দিল।আবার ডায়াল করে আবারো একই কাহিনি।অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করলো।বললো-

–‘সে কি বাঘ না ভাল্লুক যে এত ভয় পাচ্ছি? কল দিব,বলবো কথা আছে দেখা করেন শেষ কাহিনি।হুহ!

এবার ডায়াল করল কিন্তু আর কা’টলো না।দুবার রিং হতেই রিসিভ করা হলো।ওপাশ থেকে শীতল কণ্ঠে কেউ বললো-

–‘আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

সূচনা নিচু স্বরে বললো-

–‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম।আমি সূচনা।

ওপাশ থেকে প্রণয়ের তরফ হতে কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না।সূচনা ও চুপ রইলো।হঠাৎ ই প্রণয় বলে উঠলো-

–‘তুমি আমার নাম্বার চু’রি করেছ মিস.রঙ্গন?

সূচনা ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো-

–‘রঙ্গন কে?

–‘কেন তুমি।যাক সেসব আমার নাম্বার চু’রি করে তারপর ফোন দিলে।ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলার আছে?

–‘জ্বি।আমার কথা আছে আপনার সাথে। দেখা করতে পারবেন?

–‘আজকে?

–‘জ্বি।

–‘আজকে অফিস থেকে বের হতে দেরি হবে আমার। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

–‘ওহ।তাহলে কালকে?

–‘ঠিক আছে।

–‘আচ্ছা। এজন্য ই কল করেছিলাম। বিরক্ত করার জন্য দুঃখীত।

জবাবে প্রণয়কে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন রেখে দিল সূচনা।

ফোন রেখে বারান্দায় বসে রইলো চুপচাপ।মনে মনে আওড়ালো -মিস.রঙ্গন।বলে নিজেই হেসে ফেললো।

–‘একা একা হাসছিস কেন?

মিসেস দিশার কণ্ঠে হাসি থেমে গেল সূচনার।থতমত গেয়ে বললো-

–‘ক,,কই হা,,হাসছি।

–‘আমি তো দেখলাম।

–‘ভুল দেখেছো।

–‘হয়েছে মিথ্যা বলিস না এখন খেতে আয়।

–‘হুম চলো।

নিজের ব্যবহারে নিজেই অবাক হলো সূচনা।আসলেই সে হাসছিলো?প্রণয়ের সেই সম্বোধনে?
.
.
গালে হাত দিয়ে মনম’রা হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে সূচনা।মাত্র সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে।এখনে সকাল হতে কত্ত সময় বাকি।কখন হবে সকাল, কখন দেখা হবে,কখন বলবে? ভাবনার সুতোয় টান পড়ল ফোনের আওয়াজে।প্রণয়ের নাম্বার।তড়িৎ গতিতে ফোন হাতে নিল সে।রিসিভ করতেই শোনা গেল প্রণয়ের কণ্ঠ-

–‘মিস রঙ্গন।

আবারো সেই অদ্ভুত সম্বোধনে থমকালো সূচনা।মন গহীনে জোগাড় হলো অদ্ভুত এক অনুভূতির।ওপাশ থেকে আবারে ডাক পড়লো –

–‘মিস রঙ্গন,,আমি আপনার বাসার সামনে, তাড়াতাড়ি আসুন।

চমকে গেল সূচনা।বাসার সামনে মানে? চমকিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

–‘বাসার সামনে মানে?এখানে কেন এসেছেন?আর আমি আসবো কেন?

–‘ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলবে না?

–‘হ্যা,,কালকে দেখা করবেন বলেছিলেন।তাহলে?

–‘আমি ভাবলাম অনেক ইম্পর্ট্যান্ট কিছু আর সেটা আজকেই বলতে চাইছ তাই আসলাম।

–‘আমি এখন আসতে পারবনা।আম্মু আসতে দিবেননা।

–‘আন্টিকে বলো প্রণয় এসেছে।

সূচনা আমতাআমতা করে বললো-

–‘আসলে,,আম্মুকে না জানিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে আসতাম।তাই এখন বলতে পারবনা।

প্রণয় ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো-

–‘এত কিছু জানিনা।কাম ফাস্ট।আ’ম ওয়েটিং।

সূচনা আর কিছু বলার আগেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো প্রণয়।সূচনা পড়লো ঝা’মেলায়। কি করবে?কিভাবে যাবে?না যেয়েও তো পারবেনা।মানুষটা তার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করবে আর সে যাবেনা এতটাও পাষা’ণ হওয়া দায় তার।দুরুদুরু বু’কে মিসেস দিশার রুমে গেল সে।বিছানায় বসে ইসলামিক বই পড়ছিলেন।সূচনা যেয়ে নিচু স্বরে ডাক দিল-

–‘আম্মু?

মাথা তুকে সূচনার দিকে তাকালেন মিসেস দিশা। বললেন-

–‘বল।

–‘আম্মু আমি একটু বাইরে যাই?

মিসেস দিশা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন –

–‘বাইরে যাবি মানে?সন্ধ্যার সময়ে এখন কোথায় যাবি?

–‘বাইরে মানে মেইন গেটেী ভিতরেই থাকব।ঘরে থাকতে দম বন্ধ লাগছে,,একটু হেটে আসি?কামাল চাচা তো আছেনই গেটে।যাই?

–‘ঠিক আছে কিন্তু বেশি সময় নিসনা। তাড়াতাড়ি আসিস।

–‘ঠিক আছে আম্মু।

মিসেস দিশার রুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটলো বাইরে।মেইন গেটের সামনেই একটা কালো রঙ এর গাড়ি,তার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে প্রণয়।সূচনা বিড়াল পায়ে এগিয়ে গেলো।নীল রঙের শার্টটা ঘামে ভিজে একাকার। লেপ্টে আছে শরীরের সাথে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।আচ্ছা এখন তো এত গরম না তাহলে এত ক্লান্তি? আর এদিকে সূচনা,বেচারি হিমশীতল হাওয়ায় যেন জমে যাচ্ছে। মাথার ঘোমটা টা ভালো করে টেনে নিল সূচনা।প্রণয়ের চোখে চোখ পরতেই প্রণয় বললো-

–‘গাড়িতে বসে কথা বলতে আপত্তি আছে?

তার দিকে তাকিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়লো সূচনা।অর্থাৎ সমস্যা নেই।

গাড়ির সিটে বসে হাত কচলাচ্ছে সূচনা।আর প্রণয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

–‘মিস রঙ্গন এভাবেই হাত কচলাতে থাকবে না কিছু বলবে?

–‘বলবো।

–‘তাহকে বলো

সূচনা ফা’কা ঢো’ক গিললো কয়েকটা।তারপর বললো-

–‘আমি বিয়েতে রাজি। তবে

–‘তবে?

–‘আমার শর্ত আছে একটা।

–‘কী শর্ত?

–‘আমি চাইনা আমাদের বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান করা হোক।এত জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী চাইনা আমি।ছোটবেলা থেকেই আম্মুকে বলতাম যে যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবে সে আসবে বিয়ে করে নিয়ে চলে যাবে।আম্মু ভাবত আমি মজা করতাম কিন্তু এটা সত্যি। আমি এমনটাই চাই।

–‘এতটুকুই?

–‘আরেকটা আছে তবে সেটা শর্ত নয় অনুরোধ।

–‘কি অনুরোধ?

সূচনা মাথা নিচু করে নিল।নত মস্তকেই বললো-

–‘আমি বিয়েতে রাজি তবে আমার সময় লাগবে,সবকিছু মানিয়ে নিতে, বুঝতে,নিজেকে বোঝাতে।সেই সময় কি পাব?

কিছু বললো না প্রণয়।সূচনা মাথা তুলে তাকালো তার দিকে।তাকে তাকাতে দেখে প্রণয় তখনই বললো-

–‘আপনি বাসায় যান।আন্টি টেনশন করবে।

প্রণয়ের কথা শুনে বু’ক ধ্বক করে উঠলো সূচনার।তার প্রশ্নের জবাব তো দিল না প্রণয়।তবে কি?কিছু না বলে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লো সূচনা।পেছনে তাকালো না আর।বাসায় যেয়ে সোজা রুমে চলে গেল সে।
.
.
“হতে পারে রুপকথার এক দেশের
রাতের আকাশের এক ফালি চাঁদ
তোমার আমার চিরকাল।

তুমি আমি হাতে রেখে হাত
ছুঁয়ে দিয়ে আঙুলে আঙুল
দেখতে পারো কিছু আদুরে সকাল।

হতে পারে এ পথের শুরু
নিয়ে যাবে আমাদের অজানায়
তুমি আমি আমাদের পৃথিবী
সাজিয়ে নিবো ভালোবাসায়।

ভালোবাসি বলে দাও আমায়
বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল
তুমি শুধু আমারই হবে
যদি করো মিষ্টি এই ভুল।”

–‘বাহ বাহ,আজকাল রোমান্টিক গান ও গাওয়া হচ্ছে। কাহিনি কি ভাইয়া?

ব্যালকনিতে দাড়িয়ে গান গাইছিল প্রণয় তার মাঝেই ইরার বলা কথা কানে আসায় গান থামিয়ে পেছনে ঘুরলো সে।ইরা আর তিথি দাড়িয়ে আছে। মুখে দাত কেলানি এক হাসি।গা জ্বালা’নো মতো।কপাল কুচকে
বিরক্তি মাখা কণ্ঠে প্রণয় বললো –

–‘তোদের জ্বালায় শান্তিতে গান ও গাওয়া যাবেনা।এখন বিরহের গান গাইলে বলবি ছে’কা খেয়েছি।

প্রণয়ের কথা শুনে তিথি বললো-

–‘কি যে বলো ভাইয়া সে কথা বলতে যাব কেন?আর ইরুপি কাহিনি কি হবে?তোমার কি মনে হয় যে ভাইয়ার দ্বারা প্রেম করা সম্ভব? মোটেও না।এসব প্রেম ট্রেম তাকে দ্বারা অসম্ভব আর প্রেম না হলে ছেকা খাওয়ার তো প্রশ্ন ই ওঠে না তাই না ভাইয়া?

প্রণয় ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো –

–‘তবে রে তিথু বেশি পে’কে গেছিস দেখা যায়।দিনা আপুর আগে তোর বিয়েটা সেড়ে ফেলি কি বলিস।

তিথি আমতাআমতা করে বললো-

–‘আব,,ব ইরুপি আমি রুমে গেলাম ঘুম পেয়েছে আমার। তুমি আসো।

এক প্রকার ছুটে পালালো তিথি।প্রণয় ইরার উদ্দেশ্যে বললো –

–‘তুই যাবি নাকি তোকেও আলাদা ভাবে বলব কিছু।

ইরা ভেঙচিয়ে বললো –

–‘হুহ যাচ্ছি যাচ্ছি।

–‘শোন

–‘বল

–‘কালকের কথা মনে আছে না?ঠিক ঠাক মতো করিস সবকিছু।

–‘তুমি টেনশন করোনা।

–‘হুম।

ইরা চলে গেলে ব্যালকনির গ্রিলের দুপাশে হাত রেখে আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখলো প্রণয়।বিড়বিড় করে বললো-

–‘সামথিং স্পেশাল ইজ ওয়েটিং ফর ইউ মিস.রঙ্গন।
.
.
অন্য দিকে সূচনাও বারান্দায় বসে আছে। দৃষ্টি তার ওই দূর আকাশে।মনে সহস্রাধিক প্রশ্ন। কি হবে?কি করবে সে?প্রণয় কি সিদ্ধান্ত নিবে?

#চলবে