প্রণয়ী পায়রা পর্ব-২২

0
683

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২২ |

[কপি নিষেধ]

সকাল সকাল আরোরার ডাক পরলো ছোটমার। ছোটমা নাকি কী দিবেন আরোরাকে৷ আরোরা ছোটমার কথা ফেলতে পারেনি। তাই সুন্দর করে রেডি হয়ে মাথায় ঘোমটা উঠিয়ে বেরিয়ে যায়। আইমান-ই ওদের বাসায় দিয়ে যায়। আরোরা আইমানকে সঙ্গে আসতে বললে আইমান বলে,

-‘বিয়ের আগে তুই বেহায়ার মতো শ্বশুরবাড়ি ঢুকতে পারিস, কিন্তু আমি নই!’

আরোরার পুরো গা জ্বলে যায়। আইমানকে কয়েক ঘা দিয়ে আইমানের সঙ্গে চলে যাওয়ার আগেই ছোটমার পিছু ডাক পরে। আরোরা এবং আইমান থমকে যায়।

-‘আরে আরোরা, চলে যাচ্ছো কেন? ভেতরে আসো!’

আইমান আরোরার দিকে তাকিয়ে এমন দাঁত কেলালো, আরোরার সেই মুহূর্তেই ইচ্ছে করছিলো আইমানের গলায় ওড়না শক্ত করে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে। কিন্তু তার এই ইচ্ছেটা অপূর্ণ রেখে সে ছোটমার দিকে এগিয়ে গেলো। বাসায় ভেতরে গিয়ে দেখলো ডেকোরেশনের কাজ চলছে। কিন্তু অবাক করার বিষয়, কোনো মেহমান আসেনি। আরোরার অব্যক্ত প্রশ্নটার উত্তর ছোটমা নিজে থেকেই দিয়ে দেয়।

-‘মেহমান কেউ আসেনি আরোরা, তাই তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। ওরা দুপুরের পরপরই আসতে থাকবে। আর কয়েকজন আসলেও দিয়ার ফ্রেন্ডরা এসেছে যারা এই সাত-সকালে ঘুমে কাত!’

আরোরা উত্তরে শুধু বিনয়ী হাসলো। আসলেই তো, এখনো সকাল দশটাও গড়ায়নি। ছোটমা আরোরাকে কিছু উপহার দিতে দিতে সেগুলো সম্পর্কে বলতে লাগে। আরোরার নেত্রপল্লব একজনকে তৃষ্ণার্ত হয়ে খুঁজে চলেছে কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দর্শন নেই। ছোটমা আরোরার খুঁজাখুঁজি সহজেই ধরে ফেলে। ছোটমা উপহারগুলো গুছাতে গুছাতেই বলে উঠলো,

-‘ফাই ঘুমোচ্ছে। দোতলার দক্ষিণের শেষ ঘরটা ফায়ানের। তাকে জাগিয়ে নিয়ে আসো তো। কাজ তো হাতে কম নেই! সাহেবের আগামীকাল বিয়ে আর সে পরে পরে ঘুমাচ্ছে!’

আরোরা কিছুটা লজ্জা পেলো। সে যাবে কী যাবে না, দ্বিধায় পরে গেলো। ছোটমা আরেকবার যেতে বলতেই একপ্রকার বাধ্য হয়ে সে সিঁড়ির দিকে যেতে অগ্রসর হয়! অবশেষে গুটি গুটি পায়ে ফায়ানের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় নক করার আগেই খেয়াল করলো দরজা ভেঁজানো। আরোরা একটি শুকনো ঢোক গিলে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। পুরো রুম অন্ধকার৷ দরজা খোলায় ফায়ানের বেডে আলোটা পরলো। ফায়ান ব্ল্যাঙ্কেট এ জড়িয়ে উবুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। চোখে আলো পরায় তার ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হলো। ললাটেও স্বল্প ভাঁজ দৃশ্যমান। আরোরা নিশব্দে হাসলো। অতঃপর ফায়ানের দিকে এগিয়ে তার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখতে লাগলো। এই প্রথম ফায়ানের ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখার সৌভাগ্য হলো তার। আরোরা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মুখ খানার পানে। পরমুহূর্তে আরোরার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো ফায়ানকে শাস্তি দেয়ার। খুব ধমকেছে মশাই, আজ আরোরা বুঝাবে তাকে ধমকানোর ফল। আরোরার তার ওড়নার কোণা অংশ দিয়ে ফায়ানের কানে দিয়ে সুঁড়সুঁড়ি দিতে থাকলো। ফায়ান নড়েচড়ে তার কানে হাত বুলাচ্ছে। আরোরা মুখে ওড়না চেপে হাসছে। আবার দিলো কয়েকবার সুঁড়সুঁড়ি! একবার তো ফায়ান সজোরে কানে চড় মারলো। এবার আরোরা অনেক কষ্টের হাসির বেগ কমালো। অতঃপর সুঁড়সুঁড়ি না দিয়ে কানের সামনের নিজের মুখ নিয়ে গেলো। সুঁড়সুঁড়ির জ্বালায় ফায়ানের অর্ধেক ঘুম ভেঙ্গে গেছে অলরেডি! আরোরা কানে জোরে চিৎকার দিয়ে তড়িৎ গতিতে দূরে সরে আসলো। ফায়ান একপ্রকার লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আরোরা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। আরোরার হাসির শব্দ শুনে ফায়ান আরোরার দিকে তাকালো এবং তারও বুঝতে বাকি রইলো না এই অকাজ কার! আরোরা ফায়ানকে ভেঙ্গিয়ে বলে উঠলা,

-‘শুভ লাফানো সকাল!’

বলেই আরোরা রুমে এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। ফায়ান দ্রুত তার টিশার্ট-টা গায়ে জড়িয়ে বেড থেকে নেমে আসে। অতঃপর এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ ফায়ান আসার আগেই আরোরা তার উপহার নিয়ে ফায়ানদের এক গাড়ি করে চলে যায়। ফায়ান নিচে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে আরোরাকে খুঁজতে লাগলো৷ ফায়ানকে দেখে ছোটমা বলে উঠে,

-‘কীরে ফায়ান, উঠে গেছিস? আরোরা তো সবে চলে গেলো। আর হ্যাঁ শুন, তোর চাচ্চু বলেছে যেন দ্রুত খেয়ে তার সাথে দেখা করতে!’
ফায়ান মিনমিন করে ‘শিট’ বলে আবার উপরে চলে গেলো।

—————————–

হলুদের সাজে নিজেকে আবৃত করলো আরোরা। আরোরা নেত্রপল্লব তুলে দর্পণে তাকালো এবং নিজের এই সাজে নিজেই চমকে উঠলো। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। নিজেকে চিনতে ভুল করছে যেন বারংবার। মুখশ্রীতে হলুদের সাজ, ফুলের টিকলি, হাতে চুড়ির ন্যায় ফুলের তোড়া। গলায়, কানে ফুলের অলংকার! আরিশা হলুদ দোপাট্টা সুন্দরভাবে আরোরার মাথায় দিয়ে দিলো। এবার যেন পরিপূর্ণ লাগছে আরোরাকে। আরিশা নিজেও মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো আরোরার দিকে।

-‘এই আরু, এটা কী আদৌ তুই? কল্পনার চেয়েও সুন্দর লাগছে তোকে, মাহশাল্লাহ পরীটা।’

তখনই অনন্যা রুমে প্রবেশ করলো। ফুলে আবৃত হুরকে দেখে তারও নয়নযুগল ধাঁধিয়ে গেল। অনন্যা চোখের কোণ মুছে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-‘আরোরা, চল মা। রিসোর্টে যেতে লেট হচ্ছে।’

আরিশা এবং আরোরা উভয়েরই ধ্যান ভাঙলো। আরোরা অধর জোড়া প্রসারিত করে আরিশার সাহায্যে উঠে দাঁড়ালো৷ অনন্যা নিজেও এগিয়ে এসে মেয়েকে ধরে নিয়ে বাহিরে বেরিয়ে আসে। আইমান তার কমলা পাঞ্জাবি পরে বৈঠকঘরে পায়চারি করছে। মুনীব তার শালা অর্থাৎ আরিশার বাবার সঙ্গে বসে আলাপ করতে ব্যস্ত। আরোরা আসতেই তারা বেরিয়ে গেলো আগেই। আইমান তার বোনকে প্রাণভরে দেখে গালে হাত ছুঁয়ে বলে,

-‘আমার বাচ্চাটা আজ কতো বড় হয়ে গেছে। একেবারে আমার আগেই বিয়ে সেরে ফেলেছে!’

-‘ভাইয়া! আবারও খোটা দিচ্ছো? আম্মু কিছু বলো না!’

অনন্যা আড়ালে চোখ মুছে আইমানকে ধমক দেয়। আইমান খিলখিল করে হেসে নিজে বোনের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। এপার্টমেন্টের সকলেই উৎসুক হয়ে বেরিয়ে এসেছে আরোরা এবং আইমানকে দেখার জন্যে৷ ফটোগ্রাফার’রা ছবি ভিডিও করতে ব্যস্ত। এপার্টমেন্টের উৎসুক জনতা অবাক দৃষ্টিতে এই দুই ভাই-বোনকে দেখছে। আইমান বেশ সাবধানতা অবলম্বন করে আরোরাকে সিঁড়ি দিয়ে নামাচ্ছে। আরোরা হিল না পরলেও কিছুটা উঁচু জুতো তো পরেছেই। তবে তার হাঁটতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। আরোরা এবং আইমান একসাথে একই গাড়িতে উঠলো। আরোরার পাশে আরিশা এবং ফন্ট সিটে রুহান। রুহানকে দেখে আরোরা বেশ অবাক হয় তবে টু-শব্দও করলো না। বেশ হৈ-হুল্লোড় করতে করতেই ওরা রিসোর্টে পৌঁছালো। রিসোর্টের গেটে দাঁড়িয়ে ফায়ান। সে নিজে রিসিভ করবে তার প্রণয়ীকে। ইকবাল তার গেস্টদের সাথে কথা বলছে আর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার মেয়ে জামাই এবং বউমার জন্যে।

অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময়টি হাজির হয়। ফায়ান তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গাড়ির ডোর খুলে দেয়৷ প্রথমে আরিশা বেরিয়ে পরে। আরোরার তো ফায়ানকে দেখে চোখ কপালে উঠে গেছে। সাদা শেরওয়ানিতে ফায়ানকে অনেক সুদর্শন লাগছে। ফায়ান হাত বাড়াতেই তার ধ্যান ভাঙ্গে। অতঃপর মুখশ্রীতে লাজুক ভাব এনে ফায়ানের হাতে তার মেহেদি রাঙা হাত এগিয়ে দিলো। অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় আরোরা। ফায়ানের চোখ যেন সরছেই না তার পিজ্যানের থেকে।

দুজন একত্রে প্রবেশ করলো রিসোর্টে। ফটোগ্রাফার’রা ছবি, ভিডিও করেই চলেছে অনবরত। আরোরা আড়চোখে যতবারই ফায়ানকে লক্ষ্য করেছে ততবারই ফায়ানকে নিজের দিকেই তাকিয়ে থাকতে দেখেছে৷ এতে যেন তার লজ্জার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

————————

আইমান দিয়া পাশাপাশি এবং ফায়ান আরোরা পাশাপাশি বসে আছে। গান-বাজনার সাথে হলুদের অনুষ্ঠান বেশ ভালোভাবেই চলছে। একের পর এক দুই জোড়াকে হলুদ মাখিয়ে যাচ্ছে। ফায়ান এখন শেরওয়ানি ছেড়ে সাধারণ সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত। ফায়ান আরোরার কানে ফিসফিস করে বলতে লাগে,

-‘এইযে, হলদেপরী! আর কতো নিজের বিচিত্র রূপে ঝলসে দিবে বলো তো? ইচ্ছে তো করছে ঝাপটে ধরে আমার চিত্তে তোমায় লুকিয়ে রাখি। এই রূপ যে আমার চিত্তের অগ্নিধারা ক্রমগত বাড়াচ্ছেই।’

আরোরা যেন পুরো জমে গেলো। লেহেঙ্গার কিছু অংশ দুই হাতে খামচে ধরে মূর্তির মতো বসে রইলো সে। তার গলার স্বর কখনই তো উবে গেছে। ফায়ান আবারও বলে ওঠে,

-‘এড়িয়ে যাচ্ছো আমায়? ফাইন! আমিও দেখে নিবো আগামীকাল বাসরে কীভাবে এড়িয়ে চলো। এই কয়েকদিনের করা ইগনোর, ফাইলামি! সবকিছুর হিসাব আমি নিজে নিবো। গেট রেডি ফর টুমরো! খুব হবে সুখ-দুঃখের আলাপ!

~চলবে, ইনশাল্লাহ!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।