প্রণয়ী পায়রা পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0
1102

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
|পর্ব ২৪ + শেষাংশ |

[কপি নিষেধ]

সুমিষ্ট নতুন সকাল। সূর্যের নরম কিরণ জানালা ভেদ করে রুমে প্রবেশ করেছে। পর্দাগুলোও অসমান্তরাল ভাবে উড়ছে। আরোরা পিটপিট করে চোখ মেলতেই ফায়ানের মুখশ্রী দেখতে পেলো। কতো নিষ্পাপ লাগছে ফায়ানকে। ঘুমন্ত মানুষদের এতো নিষ্পাপ, নম্র কেন লাগে, যেন তারা পৃথিবীর সবচেয়ে অবুঝ। আরোরা আশেপাশে চোখ বুলালো। তৎক্ষনাৎ তার নজর আটকালো দেয়াল ঘড়িতে। ন’টা বিশ! আরোরা তড়িৎ গতি উঠে বসলো এবং নিজের অগোছালো শাড়ি ঠিক করতে করতে নেমে দাঁড়ায়। একপলক ফায়ানের মুখশ্রীর দিকে তাকালো। লজ্জায়, জড়তায় কাবার্ড থেকে একটা থ্রি-পিস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। তার পক্ষে সম্ভব না শাড়ি সামলানো। গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসতেই দেখলো ফায়ান উঠে বসে আছে। গায়ে তার সাদা টি-শার্ট জড়ানো। আরোরাকে দেখতেই সে ঘুমঘুম কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘এটা কী ঠিক বউ, তুমি আমায় একা ফেলে উঠে গেছো?’

-‘চুপ করুন! আপনি কী বাচ্চা যে আপনার সঙ্গে আমার শুয়ে থাকতে হবে। ঢঙ বাদ দেন, অলরেডি দশটা বেজে গেছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান, কী ভাববে তারা?’

-‘হু কেয়ার’স?’

-‘ইংলিশে পটর পটর ছাড়ুন! কেউ কেয়ার না করলেও আমি করি। আপনার শরম-লজ্জা লোপ পেলেও আমার যথেষ্ট আছে!’

বলেই আয়নার সামনে গিয়ে বসলো। ফায়ান বিড়বিড় করে বলতে বলতে লাগে,

-‘বিয়ের একদিন পার হতে না হতেই বউ আমার বাঘিনী রূপ নিয়েছে!’

-‘কিছু বললেন?’

ফায়ান ডানে বামে মাথা নাড়ায়, যার অর্থ না। আরোরা চুল মুছতে মুছতে জবাব দেয়, ‘ফ্রেশ হয়ে আসুন, একসাথে নিচে যাবো!’

———-

ব্রেকফাস্টের সময় ছোটমা সকলের সঙ্গেই আরোরাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আরোরা খেতে খেতে সকলের সঙ্গেই কুশল বিনিময় করলো। ফায়ান আরোরার পাতে একটু পর পর এটা ওটা তুলে দিচ্ছে। ফায়ানের কাজিনরা এ নিয়ে বেশ ঠাট্টা মশকরা করছে। এ নিয়ে আরোরা লজ্জায় দৃষ্টি নত করে আছে। খাবার টেবিলে সব কাজিনরা। বড়’রা আগেই খেয়ে নিয়েছে। আরোরা ফায়ানকে থামাতে গেলেই ফায়ান তাকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দেয়। যা দেখে মুনিয়া নামের এক কাজিন বলে উঠলো,

-‘ভাবী, এতো লজ্জা পেও না। খেয়ে পেট ভরো নয়তো ভাইয়ের ধমকে পেট ভরতে হবে!’

সঙ্গে সঙ্গে হাসির শব্দ শোনা গেলো সবার। ছোটমা মুনিয়াকে থামাতে বলে,

-‘এই চুপ কর তো। আর ফাই, এটা কিরকম? একদম ধমকাবি না আমার মেয়েকে। ধমক দিয়ে দেখা, তারপর দেখ তোর কী হাল করি!’

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমেরিকা থেকে ফায়ানের মায়ের কল এলো। সারা এবং আজমান উভয়েই আরোরার সাথে কথা বলে। আজমান আজ জেগে আছে তার বউমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে। এর মাঝেই আরোরা ফায়ানের মা-বাবার সাথে মিশে গেলো। তারা দুজন এতোই মিশুক এবং বিনয়ী হবে আরোরার কল্পনার বাইরে ছিলো। সবশেষে আজমান বলে উঠলো,

-‘বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে ডিরেক্ট আমেরিকা চলে আসবে ফায়ান। আমরা আমাদের বউমাকে স্ব-শরীরে দেখতে চাই।’

বউভাত শেষে ফায়ান আরোরাকে নিয়ে আরোরার বাড়ি এসেছে। দিয়া, আইমান আপাতত পরে যাবে। আইমান তো বউভাত সেরে বোনের রুম গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। দিয়া আইমানকে সাহায্য করতে চাইলে আইমান বাঁধা দেয়!

-‘এসব তোমার করতে হবে না। তুমি আরাম করো, আমি আছি কী করতে?’

-‘করি না! সামান্যতে কী সমস্যা?’

-‘বাড়ির নতুন বউ তুমি। আমার নতুন বউকে কাজ করতে দিয়ে পাপ বাড়াতে চাই না। আল্লাহ জানে বুয়া কই গেছে!’

শেষোক্ত বাক্যটি আইমান বিড়বিড় করেই বললো। দিয়া মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো আইমানের দিকে। আইমানকে সে যতো চিনছে ততোই যেন মানুষটার প্রতি দুর্বল হচ্ছে। ফায়ান ভুল করেনি তার প্রকৃত জীবনসঙ্গীকে চিনতে। হুট করে রুহানের হাঁক শোনা গেলো।

-‘আরে তোমরা কে কোথায় আছো? আমাদের অতিথি তো চলে আসলো।’

—–

-‘এই শুনেছিস? আরোরার নাকি ফায়ান স্যারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে?’

-‘এই মেয়ের মধ্যে কী আছে যে ফায়ান স্যারের মতো হার্ড পার্সোনালিটির একজন তাকে পছন্দ করলো?’

আরোরা সকলের এসব কানা-ঘুষা শুনলেও কিছু বলছে না। বারংবার এসব কথায় তার হাতের কলম থেমে গেলেও দমে না গিয়ে একই ভাবে নোটসগুলো লিখে চলেছে সে। আরিশা তখন একপ্রকার ছুটে ক্লাসে আসলো এবং আরোরার পাশে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

-‘আরু। রুহান আবার আরেক মেয়ের পাল্লায় পরেছে। এই বদ আমার সামনেই ফাস্ট ইয়ারের একটা মেয়েকে প্রপোজ করে। কেমন লাগে বল তো?’

তখনই আরিশা পেছনের কানা-ঘুষা শুনতে পেয়ে আরোরার বাঁধা না মেনে উঠে দাঁড়ায় এবং ওদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-‘মেয়েদের পেটে পেটে যে এতো হাড়িভরা হিংসে থাকে সেটা তোমাদের মতো নিচ মেন্টালিটির পোলাপানদের না দেখলে বুঝতাম না। ফায়ান স্যার যাকে ইচ্ছে তাকে বিয়ে করুক তাতে তোমাদের অধিকার কে দিলো আরোরার সম্পর্কে কটু বাক্য ব্যবহার করার, তাকে নিয়ে আজেবাজে বলার! আরোরা ফায়ান স্যারের মতো হাসবেন্ড পেয়েছে বিকজ শি ডিজার্ভ হিম৷ অন্যকে হেয় করার আগে নিজেদের চেহারাটা একটু আয়নায় দেখে নিও। সকল সৃষ্টি-ই সুন্দর, তাই বলে তোমরা নিজেদের বিশ্ব সুন্দরী মনে করো না। নিজেদের লিমিটের মধ্যে থাকো, নয়তো ফায়ান স্যার যে তোমাদের কী হাল করবে ইউ কান্ট ইভেন থিংক!’

বলেই আরিশা আরোরাকে একপ্রকার টেনেটুনে বাইরে নিয়ে গেলো।

-‘কী হলো, আমার বউটা এমন মুখ গোমড়া করে আছে কেন?’

আরোরা কোনো উত্তর দিলো না। সে একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়ান স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে তপ্তশ্বাস ফেলে এবং থমথমে গলায় বলে,

-‘ইউ আর এ স্ট্রং গার্ল। কে কী বললো তা নিয়ে এতো ভাবো কেন তুমি? মনে রাখবে তোমার হাসবেন্ড আমি, ফায়ান। ফায়ান কারো ধার ধারে না ইভেন তুমিও ওদের কথায় বিয়ে করোনি। হয় হাসো নয়তো আমি তোমার কোনো বাঁধা মানবো না, ডিরেক্ট একশন নিবো!’

শেষোক্ত বাক্যে যেন কাজ হলো। আরোরা থমথমে গলায় বে উঠলো,

-‘একদম কিছু করতে যাবেন না।’

-‘তাহলে ইগনোর দেম।’

কিছুক্ষণ চললো নিরবতা। নিরবতা প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই ফায়ান বলে উঠলো,

-‘আগামী পরশু আমরা আমেরিকায় যাচ্ছি। এতদিন যেতে পারিনি কারণ এখানে অফিসের শাখা খোলা নিয়ে বেশ ব্যস্ততায় সময় পার করতে হয়েছে। নাও আই এম ফ্রি। আমেরিকায় তোমায় ঘুরিয়ে বাবা-মাকে নিয়ে একবারে ফিরবো!’

আরোরার অধরে যেন এতক্ষণে হাসি দেখা গেলো। সে ফায়ানকে জড়িয়ে ধরে রইলো। আরোরা উৎকন্ঠা হয়ে বলে উঠলো,

-‘আমি অনেক খুশি। কিন্তু আমার পাসপোর্ট…’

আরোরাকে এক হাতে জড়িয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগী হয়েই ফায়ান বলে উঠলো,

-‘আমাকে এতো কাচা ভেবো না বউ। আমার কাজের সঙ্গে তোমার পাসপোর্টও রেডি করেছি। যদিও আমি করিনি, পাসপোর্টের পুরো ক্রেডিট তোমার চাচাশ্বশুরের। চাচ্চু নিজে সব করেছে। তবে অনলও তাকে হেল্প করেছে।’

আরোরা মুচকি হাসলো। তার যেন সুখের শেষ নেই। এতো এতো আপনজন পেয়েছে সে, আর কী চাই?

আরোরা এবং ফায়ান মিলেমিশে লাগেজ প্যাকিং করছে। আগামীকাল ভোরে তাদের ফ্লাইট। আরোরা প্যাকিং করতে করতে বলে,

-‘জানেন আমি কখনো প্লেনে উঠিনি, ফরেইনে যাওয়া তো অনেক দূর। ওই এয়ারপোর্ট অবধি-ই যাওয়া হতো। আমি সত্যি আমার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।’

-‘আল্লাহ তোমার ইচ্ছেগুলো আমার উছিলায় পূরণ করে দিচ্ছে। শুকরান আদায় করো তার দরবারে যে আমার মতো একজন বর পেয়েছো!’

আরোরা লাজুক হাসলো, প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। কারণ সে তো জানে এই মানুষটার জন্যে আরোরা কতবার মাবুদের দরবারে শুকরিয়া আদায় করে। আরোরা মিনমিন করে বলে উঠলো, “আলহামদুলিল্লাহ!”

সকলে একসাথে বসে ডিনার করলো। আরোরার আগামীকাল ফ্লাইট দেখে আরোরার পুরো ফ্যামিলি ফায়ানদের বাসায় এসে হাজির। এমনকি রুহান এবং আরিশাও এসেছে। রুহান ভালোই চালাচ্ছে তার প্রেম। আরিশা তো রুহানের এই প্রেম দেখে আফসোসের স্বরে আরোরাকে বলতে লাগে,

-‘সবাই মিঙ্গেল হয়ে গেলো একমাত্র আমি-ই সিঙ্গেল পরে রইলাম!’

হঠাৎ পেছন থেকে পুরুষালি কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,
-‘মেকআপ সুন্দরীদের ধোকায় পরে না ছেলেরা! আমারই তো কোমড় ধরে যায় ওয়াশরুমের বাইরে তোর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে।’

রুহানের বচনে আরিশা ভিষণ রেগে যায় এবং রুহানের পিছে ধাওয়া করে আরিশা। আরোরা হাসতে হাসতে বলে, “তোরা আর শুধরালি না!”

—–

আরোরা হা করে রাতের আমেরিকা দেখছে। ভার্জেনিয়ার এক এয়ারপোর্টে ওরা ল্যান্ড করেছে। আরোরা ভার্জেনিয়ার এই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আনমনে ফায়ান্রর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-‘আপনার জম্মভূমি একটু বেশি-ই সুন্দর ইংরেজ সাহেব!’

ফায়ান লাগলো। এক হাতে দুই লাগেজ নিয়ে বলতে লাগে,

-‘ওটা একটু আকটু লাগবেই। কিন্তু পরমুহূর্তে দেখা যাবে তুমি বিডিকে মিস করছো, জম্মভূমি গুলো এমনই!’

আরোরা অধর জোড়া প্রসারিত করলো। ফায়ান চারপাশে চোখ বুলিয়ে ভিকিকে দেখতে পেলো। ফায়ান অধর বাঁকিয়ে হাসলো। অতঃপর ফায়ান আরোরাকে নিয়ে ভিকির সঙ্গে দেখা করলো। ফায়ান ভিকির সম্মুখে আসতেই ভিকি হাসিমুখে বলে উঠলো,

-‘ওয়েলকাম স্যার!’ ফায়ানের প্বার্শে অবস্থিত আরোরার দিকে নজর বুলিয়ে বিনয়ী স্বরে বলে ওঠে,

-‘ওয়েলকাম ম্যাম!’

অতঃপর ভিকি তার পেছনে অবস্থিত গাড়ির দরজা খুলে দেয়। ফায়ান আরোরাকে ইশারায় গাড়িতে উঠতে বললে আরোরা উঠে বসলো। ফায়ান ভিকিকে লাগেজ গুলো দিয়ে নিজেও উঠে বসলো। ভিকি লাগেজ গুলো গাড়িতে উঠিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। চলতিপথেই আরোরা হোয়াইট হাউজ দেখতে পেলো। ফায়ান আরোরার কানের কাছে মুখে নিয়ে বলে,

-‘এটাই হোয়াইট হাউজ। রাতে দেখে খুব একটা মজা নেই। সময় নিয়ে একদিন ঘুরতে আসবো ইনশাল্লাহ!’

———-

আরোরা এবং ফায়ান আমেরিকায় অবস্থান করছে প্রায় পঁচিশদিন পার হয়েছে৷ এতদিনে আরোরা বেশ ঘুরেছে ফায়ানের সঙ্গে। ফায়ান এখন ভিষণ ব্যস্ত অফিস নিয়ে। কাজ শেষ হলে শীঘ্রই তারা দেশে ফিরে যাবে আজমান এবং সারাসহ। আমেরিকার অফিসের দায়িত্ব ফায়ানের বিশ্বস্ত একজনকে এবং ভিকিকে দিয়ে যাবে। ভিকি ফায়ানের বিশ্বস্ত লোক অর্থাৎ তার ল্যাসি আন্টিকে সব কাজে হেল্প করবে। আর বিডিতে বাপ-বেটা একসাথে সামলাবে। ফায়ানের এসিস্ট্যান্ট হবে অনল। আরোরার কথায় ফায়ান তার গ্যাং ছেড়ে দিয়েছে। সে আর খুন-খারাবি করে না। নিজে খুন খারাবি না করলেও তার কেস সামলানো অব্যাহত আছে। ইকবালকে সে বেশ ভালো ভালো আইডিয়া দিতে সক্ষম।

ইদানীং আরোরা বেশ দুর্বল ফিল করে। কিছু খেতে পারে না, খেতে গেলেই সব বমি করে ফেলে দেয়। মাঝেমধ্যে তার ভিষণ মাথা ঘুরায়। তার এমন অবস্থা দেখে ফায়ান নিজেও বেশ চিন্তিত হয়ে পরে। এদিকে আরোরার অসুস্থতা অপরদিকে কাজের চাপ। ফায়ান চাইলে তার বাবাকে কাজে দিতে পারে কিন্তু তার বাবাকে এসবে জড়াতে চাগ না। ফায়ানকে চিন্তিত দেখে আরোরা টলমল হাত এগিয়ে ফায়ানের গাল ছুঁয়ে দেয় এবং দুর্বল কন্ঠে বলে উঠে,

-‘এতো চিন্তা করছেন কেন? আমি মায়ের সঙ্গে ডক্টরের কাছে যাবো, ইট’স ওকে!’

-‘কিন্তু…’

-‘কোনো কিন্তু না। দ্রুত কাজ শেষ করুন, আমাদের তো দেশেও যেতে হবে নাকি?’

ফায়ান দীর্ঘশ্বাদ ফেলে মাথা নাড়ায়। অতঃপর আরোরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-‘দ্রুত সুস্থ হয়ে যাও বউ, তোমার এই অসুস্থতা আমায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে!’

আরোরা কিছু বললো না। আবেশে চোখ বুজে রইলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে ঢলে পরলো।

———

আরোরা অশ্রুসিক্ত নয়নে তার পেটে হাত দেয়। অদ্ভুত এক শিহরণ, ভালো লাগা কাজ করছে তার মধ্যে। তার ক্রন্দন দুঃখের নয়, সুখের। রিপোর্ট নিয়ে ওরা সোজা বাড়িতেই ফিরে। সারা তো বাড়ি এসেই সকলকে কল করে সুখবর জানাতে লাগলো। শেষমুহূর্তে ফায়ানকে যখন জানাতে যাবে, আরোরা বাঁধা দেয়।

-‘না মা। এখন নয়, আপনার ছেলের জন্যে এটা সারপ্রাইজ হিসেবে তুলে রাখলাম। আমার ভেতরের আরেকজন অস্তিত্বের খবর আমি নিজমুখে বলতে চাই!’

সারা হাসলো এবং আরোরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। দূর থেকে আজমান সোফায় বসে ওদের দুজনকে খেয়াল করছে। তার মুখেও সুখের হাসি। সে দাদা হবে!

রাতে ফায়ান অনেকটা চিন্তিত হয়েই বাড়িতে ফিরলো। এসেই মাকে বলতে লাগলো,
-‘মা, কাজটা মোটেও ভালো করলে না। তোমাকে বলেছিলাম রিপোর্ট আসলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে! আমায় টেনশনে দেখতে ভালো লাগছে বুঝি?’

সারা আয়েশ করে চা পান করতে করতে বলে,
-‘তোর বউ না করেছে তাই বলিনি!’

-‘কেন? মানা করবে কেন? আমি জানলে কী সমস্যা?’

-‘তোর বউকেই জিজ্ঞেস করে নে, আমরা কী জানি?’

ফায়ান চোখ-মুখ লাল করে নিজের রুমের দিকে যেতে অগ্রসর হয়।

-‘হাউ ডেয়ার ইউ আরোরা, তুমি মাকে রিপোর্ট জানাতে না করেছো কেন?’

-‘রিপোর্টটা আমি পড়ে শুনাতে চেয়েছিলাম তাই!’

-‘তাহলে একটু রহম করো এই বান্দার উপর! দয়া করে পড়ে শুনাও!’

আরোরা মুখ টিপে হাসে। অতঃপর গলা ঝেড়ে রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগে,

-‘আমার হাসবেন্ড ওরফে মিস্টার ইংরেজ সাহেবকে অধিক সুখের সঙ্গে জানানো হচ্ছে যে..’

থেমে আরোরা ফায়ানের দিকে তাকালো। অতঃপর ফায়ানকে পাশে বসার ইশারা করলো। ফায়ান উত্তেজিত হয়ে আরোরার পাশে গয়ে বসে পরলো। আরোরা আলতো করে ফায়ানের ডান হাত নিজের পেটে রেখে আলতো কন্ঠে বললো,

-‘অভিনন্দন, আপনি বাবা হতে চলেছেন!’

ফায়ান এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। কেমন যেন অনুভুতিশুণ্য হয়ে পরে ফায়ান। আরোরা ফায়ানকে গভীরভাবে বোঝার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। হঠাৎ ফায়ান আরোরাকে জড়িয়ে ধরলো, খুবই নিবিড়ভাবে।

-‘বউ, বউ, বউ! তুমি জানো না তুমি আমায় কোন খুশি দিয়েছো। সত্যি আমি ভাবতে পারছি না আ.. আমি বা- বাবা হবো, আমায়ও কেউ পা-পা বলে ডাকবে, আমিও কাউকে নিজ হাতে হাঁটতে শিখাবো। সব স্বপ্ন লাগছে আমার। থ্যাঙ্কিউ পিজ্যান! আমার জীবনে আসার জন্য, আমায় ভালোবাসার জন্য, আমায় এই সুখের দিন অনুভব করানোর জন্য! সবশেষে আমার কালো দুনিয়াকে রাঙিয়ে তোলার জন্যে।’

আরোরা হেসে বলে, “আপনাকেও ধন্যবাদ আমার বাবুর আব্বু। আমায় এতো এতো ভালোবাসার জন্য, আমার যত্ন করার জন্য, আমায় এতো সুন্দর পরিবার দেয়ার জন্য। এখন শুধু শীঘ্রই দেশে ফিরতে চাই আমি!”

-‘হবে পিজ্যান, সব হবে। দ্রুত ফিরবো আমরা বিডিতে। তুমি আমার অভ্যন্তরের প্রণয়ী পায়রা, তোমার প্রণয়াসিক্ত বচন অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে পারে বলো? ভালোবাসি আমার প্রিটি পিজ্যানকে!’

-‘চলুন না, একসাথে নামাজ আদায় করি এবং আল্লাহ’র দরবারে এই সুখের জন্যে শুকুরিয়া জ্ঞাপন করি?’

-‘অবশ্যই, আমি ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসছি৷ তোমার ওযু আছে তো?’

আরোরা মাথা নাড়ায়।
-‘ঠিক আছে, আমি তাহলে দ্রুত যাই। আর হ্যাঁ, একদম বিছানা থেকে নামবে না। কিছু দরকার হলে মাকে ডাকবে!’ উত্তরে আরোরা স্মিত হাসলো৷ এখনই ফায়ানের যত্ন বেড়ে গিয়েছে। ফায়ান যেতেই আরোরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে এবং জানালা ভেদ করে আকাশের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে মাবুদের প্রতি অসংখ্য শুকরান গুজার করে।

-‘হে আমার করুণাময়, আমাদের এই সুখে কারো নজর না লাগুক! আমাদের এই ভালোবাসাময় মুহুর্তগুলো এভাবেই কাটুক দীর্ঘদিন, আমিন!

~সমাপ্ত।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পুরো গল্পটি কেমন লেগেছে অবশ্যই অবশ্যই জানাবেন। এতদিন ধৈর্য ধরে গল্পটি পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। গল্পে ভুলত্রুটি থাকলে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন, আমি শুনবো৷ সবশেষে গল্পটি সম্পর্কে মন্তব্য চাইছি।