প্রণয়ী পায়রা পর্ব-২৩

0
735

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৩ |

[কপি নিষেধ]

-‘তোমায় এখানে ডেকেছি কারণ, আমি জানি তুমি কোন আতঙ্কে আছো!’

ফায়ানের এমন চটপটে ভঙ্গি শুনে আরোরা গোল গোল চোখে ফায়ানের দিকে তাকালো। নিস্তব্ধ গভীর রাত। অদূর থেকে নিশাচর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। গভীর অন্ধকার গ্রাস করেছে ধরনীতে। এই অন্ধকারকে কৃত্রিম আলো গ্রাস করতে অক্ষম। আরোরা এখন ফায়ানের গাড়িতে অবস্থান করছে। অনেকটা পালিয়েই বাহিরে এসেছে আরোরা। ফায়ান নিরব হয়ে আরোরাকে কাছে টেনে নেয়। আরোরা ফায়ানের বুকে আবেশে চোখ বুজে রইলো। ভিষণ ক্লান্ত লাগছে তার। ফায়ান আরোরার গাল থেকে চুলগুলো সরাতে সরাতে বলতে শুরু করলো,

-‘তোমার মনে হয়তো আমায় নিয়ে অনেক প্রশ্ন। হয়তো ভেবেও নিয়েছো আমি কোনো খুনী অথবা খারাপ কাজে লিপ্ত। আমার কিশোরকাল কেটেছে পিস্তল চালানো শিখে। তুমি তো জানো আমি আমেরিকায় জম্ম নিয়েছি। ছোট থেকেই আমি বেশ মুভি দেখতাম, স্পেশালি থ্রিলার, এডভেঞ্চার টাইপ। সেগুলা দেখতে দেখতে আমার অস্ত্রের প্রতি এক আগ্রহ জমে যায়। মা আমায় খেলনা পিস্তল, রাইফেল এগুলো কিনে দিতো। আমিও খেলতাম। একসময় আমার এক গ্র‍্যান্ডপার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন সিআইএ এর একজন অফিসার। সিআইএ রা পুলিশদের থেকেও বিচক্ষণ, বুদ্ধিসম্পন্ন। তাদের জন্যই মূলত আমেরিকা সামরিক শক্তিতে টপ টেনে আছে। ওই গ্র‍্যান্ডপা তার কর্মসময়ের বিরাট কেসগুলো আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। একদিন মনে হলো আমারও এসবে প্রবল ইচ্ছা জেগেছে, গ্র‍্যান্ডপাকে জানাতেই গ্র‍্যান্ডপা বলেন, আমি চাইলে সম্ভব তবে তার জন্য অনেক প্র‍্যাক্টিস এবং অনুশীলনের প্রয়োজন। আমি রাজি হই, তারপরই গ্র‍্যান্ডপা আমায় ওদের এক গোপন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আমার মা-বাবা অবধি জানতো না সেই ঠিকানা।”

আরোরা চমকে সোজা হয়ে বসলো। অতঃপর অস্ফুট স্বরে বলে,

-‘কেন?’

-‘অনেক সিকিউরিটি আছে এসবে যা বাহিরের কাউকে বলা হতো না। আর আমি বরাবরই মা-বাবার প্রতি দুর্বল, তাই গ্র‍্যান্ডপা সেসব বুঝে তাদের ঠিকানা জানায়নি। যদি আমি তাদের সঙ্গে দেখা করে দুর্বল হয়ে যাই আর আমার মত পাল্টে যায়, সেই ভয়ে। গ্র‍্যান্ডপার আদেশে আমি পুরো আট বছর সেই ক্যাম্পে ছিলাম। আমার পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়ম করে ট্রেনিং হতো, ইভেন টর্চারও। এভাবে হয়েছিলাম আমি একজন শক্ত, কঠিন মানুষ। আমার ভালোবাসার দরজাটা খোলা ছিলো শুধুমাত্র ফ্যামিলির জন্যেই। সিআইএ তে জয়েন হওয়ার আগে আমি দুই বছর ফ্রিডম নেই। এই দুইবছরে আমার বিডি, আমেরিকায় বেশ গার্ড হয়। বিজনেস বলতে আমার পাপার আছে, সেটাতেই জয়েনিং ছিলাম। সিআইএ তে জয়েন হওয়ার ঠিক দুইমাস আগে চাচ্চু আমায় কল করে জানায় বিডিতে বড় সন্ত্রাসীর আবির্ভাব ঘটেছে যার দায়িত্ব সে আমায় দিতে চায় তবে গোপনে। এ নিয়ে আন্ডার ওয়াল্ডের কিছু মাফিয়া আমায় সঙ্গ দিবে। চাচ্চুর কথায় কিছুদিনের মধ্যেই আমি দেশে আসি এবং প্রথমবারের মতো বিডিতে পা রাখি। পনেরো দিনের মতো সময় লাগে এদেশের নিয়ম-কানুন, সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে। এর মাঝে আমি সব রপ্ত করে নেই। বেরিয়ে পরি সন্ত্রাসী প্রতিরোধে। মাফিয়াদের সাথে আমি মিশে বুঝেছিলাম পলিটিক্স সরকার নয় এই মাফিয়ারা পরিচালনা করে। একসময় আমিও হয়ে গেলাম এই অন্ধকারের সদস্য, আমার ডিসিশন হয়ে উঠে এদেশের আইন যা সাধারণ মানুষকে দিতে পারেনি তা আমি দিবো। আমার আদালতে সাধারণ মানুষেরা সুবিচার পাবে। আমার এখানে টাকার গোলামি চলবে না। আমার এই অন্ধকার রাজ্যে আমি এক মুঠো আলোর সন্ধান পেলাম কিছুদিনের মধ্যেই৷ সেটা হলে তুমি। অদ্ভুত ছিলো আমাদের পরিচয়টা। যদিও সামনা-সামনি নয়, অদূরে।’

বলেই ফায়ান থামলো। অতঃপর লম্বা শ্বাস ফেলে বলে,

-‘আর কোনো প্রশ্ন?’

-‘সিআইএ তে আর জয়েন করেননি?’

-‘নাহ! তোমার জন্যই আমি সেদিকে পা মাড়াইনি। আমার কাছে তুমি বেশি ইম্পোর্টেন্ট।’

-‘আমায় কীভাবে চিনলেন, বললেন না যে?’

-‘অন্য একদিন বলবো। এখন প্রশ্নের উত্তর পেয়েছো? আমি কিন্তু কোনো দু’নম্বরি ব্যবসা করি না, ওই ইয়ামিনের মতো!’

-‘ইয়ামিনকে টানছেন কেন?’ অন্যদিকে ফিরে মুখ বেজার করেই বলে আরোরা। ফায়ান ফিচেল হাসি দিয়ে আরোরার কাঁধে থুঁতনি দিয়ে বলে,

-‘অনেক রাত হয়েছে, যাও ঘুমাও। আমিও যাই, বেশ টায়ার্ড!’

——————————

-‘বিয়ের ঢোল বেজেছে!’

বলতে বলতেই রুহান আরোরার রুমে প্রবেশ করলো। আরোরা হেসে রুহানকে বেরিয়ে যেতে বলে। কিন্তু রুহান আরোরাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে এক সোফায় গিয়ে বসলো। এবার ধুম লাগলো আরিশা এবং রুহান। আরোরা ওদের ঝগড়া দেখছে আর হাসছে। গতকাল রাতে আরোরা আরিশার থেকে জেনেছে সবটা। রুহানকে ফায়ান আগেই জেবা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে দেয় এবং ফায়ানের হয়েই রুহান জেবার সঙ্গে এক্টিং করেছে। জেবার নাকি এখন এক বুড়ো আঙ্কেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, এমনটাই জানায় আরিশা। মজার ব্যাপার হলো সেই আঙ্কেলও ফায়ানের লোক।

-‘ইতর! মসজিদে না গিয়ে এখানে কি করছিস? এত মেয়েদের সাথে থাকতে লজ্জা করে না?’

-‘লজ্জা করবে কেন? আমিও নাহয় একটা পটিয়ে নিলাম, প্রব্লেম কী? আর মসজিদের কাজ শেষ করেই ফিরেছি। দেখে নে এখনই কাজি এসে আমাদের কনেকে দ্বিতীয়বারের মতো কবুল বলতে বলবে। দেখ আরিশা! ফাস্ট টাইম মিস দিলেও এবার আমি দিচ্ছি না। আফটার অল বেস্টফ্রেন্ড হু মে! আমিও দেখবো আমাদের বঁধু কীভাবে কবুল বলে!’

আরোরা লজ্জায় দৃষ্টি নত করে ফেললো। রুহানের কথা মতোন কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজি এসে হাজির হলো। আরোরা বেশ সময় নিয়েই কবুল বলে। আরোরা কবুল বলতেই সকলে খুশিতে এক চিৎকার দেয় সাথে আরোরাকেও বেশ পচানো শুরু করে। কাজি বের হতেই অনন্যা আসে মেয়ের কাছে। সকলের উদ্দেশ্যে বলে,

-‘অনেক চেঁচামেচি করেছো এখন রিসোর্ট যেতে হবে। ফায়ান, আইমান মসজিদ থেকে ডিরেক্ট চলে গিয়েছে। দেরী করো না মেয়েরা!’

বলেই আরোরার দিকে তাকায়। মুহূর্তেই বুকের মধ্যে হাহাকার অনুভূত হলো অনন্যার। কষ্টকে মাটি চাপা দিয়ে আরোরার থুঁতনি ধরে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-‘মাহশাল্লাহ, আমার মেয়েটা। কারো নজর না লাগুক!’

পাশ থেকে আরোরার কয়েকজন কাজিন বলে উঠলো,

-‘ভুল বললে ফুপি। কারো না লাগলেও আমাদের জিজুর ঠিকই লেগে যাবে! দেখবে বিয়ের প্রোগ্রাম ছেড়ে মশাই বউকে দেখবে!’

এমন বচনে রুমের সকলে হেসে উঠলো। আরোরা তাকে এক চাপড় মেরে বলে, ‘বদ!’

অনন্যা হেসে মেয়েকে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। অতঃপর সকলে বেরিয়ে গেলো রিসোর্টের উদ্দেশ্যে।

——————————–

বিয়ের প্রোগ্রাম, ফটোগ্রাফি, খাবারের পর এলো সবচেয়ে কঠিনতম মুহূর্ত। বিদায়ের সময়। দুই ভাই দুই বোনকে জড়িয়ে ধরে রইলো অনেকক্ষণ। আইমান আরোরাকে তুলে দিলো ফায়ানের হাতে আর ফায়ান দিয়াকে তুলে দিলো আইমানের হাতে। দুই পরিবার একইভাবে ক্রন্দনরত। আইমান এবং ফায়ান উভয়ই একে অপররের দিকে তাকিয়ে একসাথে বলে,

-‘আমি তোমার বোনকে ভালো রাখবো!’

অতঃপর দুই প্রাইভেট কার দু’দিকে চলে যায়। অনন্যা পুরো রাস্তা কেঁদেই চললো। সহ্য করতে পারছে না সে কন্যার বিরহ৷ প্রতিদিন সকালে আরোরার ঘরে গিয়ে আরোরাকে ডেকে তুলতে পারবে না, নিয়ম করে নিজের হাতে আরোরাকে খাইয়ে দিতে পারবে না।

কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পরে আরোরা। ফায়ান আরোরাকে বুকে নিয়ে ভাবতে থাকে সেদিনের ঘটনা যেদিন ফায়ান আরোরাকে প্রথম দেখেছিলো। ফায়ান সেদিন অনলকে কিছু সন্ত্রাসীদের ছবি কালেক্ট করতে বলেছিলো। সেই ছবির একটির মধ্যে সন্ত্রাসীর ঠিক পেছনে এক হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী দেখতে পায়। সেই রমনীর মুখশ্রী রোদে চকচক করছিলো। ফায়ান কিছুক্ষণের জন্যে থমকে যায়৷ এভাবেই সে চেয়ে রইলো পুরো রাত। নতুন সকালের সঙ্গে তার হৃদয়ও আলোকিত হয় এই কিরণ অর্থাৎ আরোরাকে নিয়ে। এরপর শুরু হয় আরোরার খোঁজ। দু’দিন সময় লাগলো আরোরার সকল ডিটেইলস সহ তার ছবি সংগ্রহ করতে। এভাবেই তার রাতের পর রাত, দিনের পর দিন অতিবাহিত হয় এই এক তরুণীকে ভেবে। একসময় ফায়ানও নিয়ত করে, তার এই প্রণয়ী-ই হবে তার অর্ধাঙ্গিনী। হলোও তাই। ফায়ানের আজ নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে।

——————————

ঘুম ভাঙলে ফুলে সজ্জিত বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করলো আরোরা। ধীরে ধীরে সে উঠে বসলো। মাথাটা কেমন ব্যথা করছে। আরোরার নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ের অলংকার গুলো শব্দ করে গেলো। আরোরা তার হাতের চুড়ি ঠিক করতে করতে সামনে তাকাতেই আরোরা চমকে উঠলো। ফায়ান শেরওয়ানি খুলছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আরোরা চোখ বড় বড় করে তাকালো ফায়ানের দিকে। ফায়ান আয়নায় আরোরাকে দেখলো। ফায়ান বাঁকা হেসে বলে,

-‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন জান? ডোন্ট বি পেনিক, হবে আমাদের বাসর!’

আরোরা চোখ গরম করে তাকালো ফায়ানের দিকে এবং লজ্জায়, জড়তায় দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। ফায়ান অধরজোড়া বাঁকিয়ে শেরওয়ানি খোলায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। আরোরা পুরো ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নেয়। বেশ সুসজ্জিত রুমটা। ফায়ানের রুমে সে দ্বিতীয়বারের মতো অবস্থান করছে। পুরো ঘর ফুলে ছড়াছড়ি। বাতি বন্ধ, ছোট ছোট ক্যান্ডেল অনেকগুলো চারপাশে যার ফলে বেশ আলোকিত রুমটা। এর মাঝেই ফায়ান লাল পাঞ্জাবি পরে আরোরার দিকে এগিয়ে গেলো। আরোরা তা টের পেতেই তড়িৎ গতিতে ফায়ানের দিকে তাকালো। শুকনো একটা ঢোক গিলে আরোরা কিছুটা পিছিয়ে গেলো। ফায়ান বাঁকা হেসে চট করে আরোরার সামনে বসে গেলো। আরোরার গাল ছুঁয়ে অনেকক্ষণ আনমনে তাকিয়ে রইলো। আরোরার তো জড়তায় কাঁপাকাঁপি অবস্থা। পারছে না দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে। ফায়ান নেশাতুর কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ভালোবাসি আমার প্রণয়ী পায়রাকে। তুমি ব্যতীত আমি ফায়ান নিঃস্ব পিজ্যান। তুমি কী আমাদের এই সম্পর্কের গভীরে পর্যন্ত যেতে অনুমতি দিবে? দিবে কী তোমায় স্পর্শ করার অনুমতি?’

আরোরা এবার পুরো লাল হয়ে গেলো। কী বলবে মুখে আর, তার দু কান দিয়ে যেন উষ্ণ ধোয়া বের হচ্ছে। আরোরার এরূপ অবস্থা দেখে ফায়ান হাসলো। ফায়ান আরোরার থেকে কিছুটা সরে বসে বলে,

-‘কুল, রিল্যাক্স! এখন বাজে সবে ন’টা। তুমি এই অলংকার খুলে ফেলো। ইজি ফিল হবে। আমি যাই, সার্ভেন্ট কে দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করি। একসাথে ডিনার করবো আমরা!’

আরোরা দৃষ্টি নত করে রইলো, কোনো উত্তর দেয় না। ফায়ান তার মুখ আরোরার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে,

-‘প্লেট কিন্তু একটা হবে। বিছানার মতো প্লেট এডজাস্ট করতে দ্বিধা নেই তো?’

আরোরা লজ্জায়, জড়তায় অপরপাশ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো। ফায়ান আরোরার লজ্জা দেখে হাসতে হাসতে বলে,

-‘ওয়াশরুমটা ওদিকে!’

আরোরা কোণা চোখে ফায়ানের দিকে তাকিয়ে লাগেজের দিকে হাঁটা দেয়। মিনমিন করে বলতে লাগে, “ঠোঁটকাটা একটা!”

~চলবে।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।