প্রণয়ী পায়রা পর্ব-২১

0
624

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২১ |

[কপি নিষেধ]

রৌদ্রজ্বল সকাল। রুহান আরিশার সঙ্গে কথা বলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু আরিশা তাকে এক মুহূর্তের জন্যেও সহ্য করতে পারছে না। রুহান একসময় না পেরে আরিশার হাত ধরে হেঁচকা টান দেয়।

-‘কী সমস্যা তোর? এতো ঢং করছিস কেন? একটু তো এক্সপ্লেইন করতে দে?’

-‘কী এক্সপ্লেইন করবি তুই? কী করার বাকি আছে? নিজেরই বন্ধুর সঙ্গে তুই যা বেঈমানী করেছিস তাতে তোর সাথে কোন দুঃখে কথা বলতে যাবো আমি? যা জেবাকে নিয়েই মর, তুই! আমার বা আরোরার খবর নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তোর!’

-‘রুহান বেঈমানী করেনি!’

আরিশা চমকে পিছে ফিরে তাকালো। ফায়ান পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে। তার নেত্রে গোল ফ্রেমের চশমা।

-‘কিন্তু রুহান তো…’

-‘হ্যাঁ! রুহান মিশেছে জেবার সাথে। তবে জানো কী, এই রুহানের জন্যই তুমি তোমার বান্ধুবিকে সহি-সালামতে দেখছো।’

——————————

-‘ভাইয়া তুই কী এখনো রেগে আছিস?’

আইমান কিছু বললো না। নিশ্চুপ হয়ে পাউরুটিতে মাখন মেখে আরোরার পাতে তুলে দিচ্ছে৷ অনন্যা গেছে আরোরার নানুবাড়ি, সকলকে বিয়ের দাওয়াত দিতে। আইমান আরোরাকে নিয়ে বাড়িতে। আরোরা একই প্রশ্ন আবারও করলো কিন্তু আইমান নিরুত্তর৷ আরোরা বেশ হতাশ হলো ভাইয়ের এরূপ ব্যবহারে। বিয়েটা তো এক্সিডেন্টলি হয়েছে, তার কী দোষ? আরোরা খাবারের প্লেটে হাত দেয় না। নিশ্চুপ হয়ে দৃষ্টি নত করে রাখলো। আইমান খাবার চিবুতে চিবুতে কোণা চোখে আরোরাকে খেয়াল করলো। আরোরাকে কিছুটা খোঁচা মেরে বলে,

-‘কী? জামাইর জন্য বসে আছিস? নব্বই দশকের বউদের মতো শুরু করেছিস? ফায়ানকে তুই কল করবি নাকি আমি? জিজ্ঞেস করা লাগবে ফায়ান খেয়েছে কি না? ওয়েট কল দিচ্ছি। জেনে এই খাবার খেয়ে আমায় উদ্ধার কর! তোর খাওয়া নিয়ে বসে থাকলে বস আমায় মাথায় বসিয়ে রাখবে না!’

আরোরার গা জ্বলে উঠলো৷ আইমান ফোন দিতে পকেট থেকে ফোন বের করতেই আরোরা আসন ছেড়ে উঠে ধপ ধপ করে নিজের ঘরে চলে গেলো। দরজাটাও সশব্দে বন্ধ করলো। আইমান কয়েকবার পিছু ডাকলো। কিন্তু আরোরা তো আরোরাই। আইমান শেষে বুয়াকে আরোরার খাবারের কথা বলে অফিসে চলে গেলো। বুয়া খাবার নিয়ে আরোরার দরজায় অনেকবার কড়াঘাত করেছে কিন্তু আরোরা রেসপন্স করেনি।

——————————–

-‘বুয়া বললাম তো আমি খাবার খাবো না আপ…’

বলতে বলতেই আরোরা লিভিংরুমে চলে আসে। লিভিংরুমে বসা আগন্তুকটিকে দেখে আরোরার বচন বন্ধ হয়ে গেলো। ফায়ান বসে আছে তাও আবার চোখ মুখ গরম করে। আরোরাকে দেখতে পেতেই ফায়ান বলে উঠলো,

-‘বুয়া না আমি! আবার তুমি খাওয়া নিয়ে ঢং শুরু করেছো? কখনো কী চড়-থাপ্পড় খেয়েছো নাকি খাইয়ে টেস্ট করানো লাগবে?’

আরোরা শুকনো ঢোঁক গিলে। অতঃপর দৌড় দিয়ে আবার রুমের দিকে চলে যায়। দরজা বন্ধ করার পূর্বেই ফায়ান এসে হাত দিয়ে ফেলে। আরোরা আপ্রাণ চেষ্টা করে দরজা লাগানোর কিন্তু ফায়ানের শক্তির সঙ্গে সে পেরে উঠলো না। ফায়ান এক হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। আরোরার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। খাবারটা টেবিলের উপর রেখে ফায়ান ফোঁস করে বলে উঠলো,

-‘দ্রুত খাবারটা ফিনিশ করো! আমায় অযথা রাগিও না। আমার রাগ তোমার জন্য অকল্যাণকর!’

আরোরা পিছে কদম দিতে দিতেই বলতে লাগলো,
-‘আমি আপনার কথা কেন শুনবো? বের হন আমার রুম থেকে! আপনি একটা গুন্ডা!’

ফায়ান হঠাৎ-ই আরোরার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আচমকা আরোরার কোমড় জড়িয়ে নিজের খুব কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলে,

-‘হ্যাঁ, আমি গুন্ডা। কিন্তু তুমি এই গুন্ডারই বউ। এখন তুমি খাবে নাকি আমি আমার গুন্ডামীর স্টাইলে তোমায় এই খাবারগুলো গেলাবো? নাও চয়েজ ইজ ইওরস!’

বলেই আরোরাকে কোলে তুলে নেয়! আরোরা এক চিৎকার দিয়ে হাত পা ছুঁড়তে থাকে।

-‘এ কী করছেন? কোলে তুলেছেন কেন? নামান!’

-‘বাসর করবো তাই আমার বউকে কোলে নিয়েছি, তোমার কোনো প্রব্লেম? এখন চেঁচামেচি বাদ দেও, ডাফার!’

আরোরার কলিজা শুকিয়ে এলো ভয়ে। ভীতি দৃষ্টিতে ফায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। অনুভূত হলো তার ললাট বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পরছে। আজ বুঝি তার রক্ষা নেই? ফায়ান আরোরার ভাবনার কিছুই করলো না। বিছানায় বসিয়ে খাবার নিয়ে আসে সে। অতঃপর রুটিটা আরোরার মুখের সামনে ধরলো। আরোরা বেকুব দৃষ্টি তখনো ফায়ানের দিকে নিবদ্ধ। ফায়ান ভেতরে ভেতরে মুচকি হাসি দিচ্ছে।

-‘আমার রূপ বেয়ে বেয়ে পরছে না, ব্রেকফাস্ট দ্রুত ফিনিশ করো!’

——————————-

-‘রেডি হও!’

আরোরা চোখ বড় বড় করে ফায়ানের দিকে তাকালো। অতঃপর জিজ্ঞাসু স্বরে বলে উঠলো,

-‘কেন?’

-‘আমার সাথে বাড়ি যাবে তুমি, ছোটমা তোমায় নিয়ে যেতে বলেছেন!’

ফোনের মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই বললো ফায়ান। আরোরা বিড়বিড় করতে করতে কাবার্ড খুললো। ফায়ান আবারও পেছন হতে বলে উঠলো,

-‘এই তোমার কী শাড়ির কম পরেছে? শাড়ি নেই কেন?’

-‘আমি শাড়ি পরি না তাই রাখি না!’

ফায়ান ভ্রু কুচকালো। অতঃপর ফোন রেখে সে নিজেই কাবার্ড হাতাতে লাগলো। পুরো কাবার্ড খুঁজে মাত্র তিনটা শাড়ি পেলো সে। ফায়ান সেগুলো হাতে নিয়ে গোল গোল চোখে দেখতে লাগলো। ললাটে কিঞ্চিৎ ভাঁজ! আরোরা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। সামনের মানুষটির হাবভাব বোঝার জো পাচ্ছে না। ফায়ান একপ্রকার হুমকি দিয়েই বলে উঠলো,

-‘শপিং এ তোমার জন্য বাড়তি শাড়ি আমি নিবো ওয়েট! আমার বউকে শাড়িতেই আবৃত করে রাখবো আমি!’

ফায়ানের এমন বচনে আরোরা হতভম্ব হয়ে গেলো! আরোরা গোল গোল চোখে আমতা করেই বললো,

-‘আ.. আমি শাড়ি পরতে জানি না!’

-‘তো শ্বাশুরি মায়ের থেকে শিখে নিবা। কয়েকটা প্যাচ দিলেই তো এনাফ, এতো না পারার কী আছে?’

ফায়ানের এমন উত্তরে আরোরার মুখ ঘুচে গেলো। সে বিনা-বাক্যে পছন্দের একটা ড্রেস নিয়ে ফায়ানকে রুম থেকে বের করে দিলো। ফায়ান বেচারা নিজের ফোনটাও নিতে পারলো না। এদিকে আরোরা লাল হয়ে আছে, কী বললো সে কয়েকটা প্যাঁচেই শাড়ি পরা হয়ে যায়? এতোই যখন অবুঝ, বিয়ে করেছে কেন?

—————————

প্রথমবারের মতো আরোরা ফায়ানের বাড়ি অর্থাৎ তার চাচ্চুর বাড়িতে এসেছে। ছোটমা তো আরোরাকে নিয়ে কী খুশি। আরোরা আসতেই ছোটমা ফায়ানকে ভুলে আরোরার যত্ন করতে লাগলো। এ নিয়ে অবশ্য ফায়ানের মাথা ব্যথা নেই। সে এসব ভালোবাসাময় খুনশুটি দেখতে বড্ড ভালোবাসে। সেখানে তার প্রণয়ীনির হাসিটা তার বড্ড প্রিয়। ফায়ান ওদের দেখতে দেখতেই উপরে চলে গেলো। আরোরা খুব সহজেই মিশে গেছে ছোটমায়ের সঙ্গে। আন্টি বলায় কয়েকবার বকাও খেয়েছে বেশ। এই মানুষটা এতোটা মিশুক হবে, আরোরার ভাবনার বাইরে ছিলো। আইমানের এঙ্গেজমেন্ট পার্টিতে খুব একটা সাক্ষাৎ না হওয়ায় ওনাকে চিনতে পারেনি৷ ছোটমা হাসিমুখেই একবার বলেছিলো,

-‘ভাবীকে অর্থাৎ তোমার শ্বাশুড়িকে কল দিবো ভেবেছিলাম কিন্তু তাদের ওখানে এখন রাত বেশ। তাই তোমার সাথে তোমার শ্বাশুড়ির সাক্ষাৎ করুয়ে দিতে পারলাম না।’

-‘সমস্যা নেই আন্টি!’

-‘আবার আন্টি? বকা দিবো কিন্তু!’

আরোরা জিহবায় কামড় দেয়। অতঃপর এক কান ধরে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,

-‘সরি ছোটমা। দিয়া ভাবী কোথায়?’

-‘সে কোনো ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে গেছে। সন্ধ্যায় শুনেছি আইমানের সঙ্গেই ফিরবে!’

আরোরা প্রতিত্তুরে নিরব থাকে। হঠাৎ আরোরার এক দেয়ালে চোখ আটকে যায়। রাইফেল ঝুলিয়ে রাখা! আরোরার মনে পরে গেলো সেই বিষাক্ত দিনটি। সাথে মনে পরে গেলো ফায়ানের হিংস্রতা। আরোরা মুহূর্তেই চুপসে গেল। ভেবে নিলো ফায়ানকে সে সব প্রশ্ন করবে৷ দুপুরের লাঞ্চটা আরোরা ফায়ানদের বাড়িতেই সারলো। ফায়ান লক্ষ্য করলো, আরোরা তাকে এড়িয়ে চলছে। ছোটমা থাকায় আরোরাকে সে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাচ্ছে না। তবে সে নড়লো না ওদের কাছ থেকে। ছোটমা ফায়ানকে তাদের সাথে লেগে থাকতে দেখে বলে উঠলো,

-‘কী বাপ? এখনই বউয়ের সাথে চিপকে আছো? বাকি জীবন কী করবে?’

—————————-

অনন্যা আরোরাকে শাড়ি-থ্রিপিসসহ নানান অর্নামেন্টস দেখাচ্ছে। আরোরা কিছুটা আনমনে থাকলেও অনন্যাকে তা বুঝতে দিচ্ছে না। অনন্যা সব বেছে এক অতিব সুন্দর লেহেঙ্গা চয়েজ করলো, বিয়ের জন্যে। লেহেঙ্গাটা বাহির থেকে অর্ডার দিয়ে বানানো। ফায়ান নিজেই এই ডিজাইন পছন্দ করেছে। লেহেঙ্গাটা এমন, যেন লেহেঙ্গা হয় আরোরা শাড়ি পরে আছে। বোঝার জো নেই এটা একটা লেহেঙ্গা। টকটকে লাল, ছোট বড় ব্ল্যাক স্টোনের কাজের ফলে বেশ ভারিও। অনন্যা হেসে বলে,

-‘দেখেছিস কেমন চয়েজ? আমি তো প্রথমে শাড়ি ভেবে ভুল করেছিলাম। এই লেহেঙ্গার সাথে এই জুয়েলারি মানাবে কী বলিস?’

পাশ থেকে আরিশা জুয়েলারি দেখতে দেখতে বলে,

-‘অবশ্যই মামী! কী গর্জিয়াস কাজ! আমি তো তোর এই লেহেঙ্গার প্রতি ক্রাশ খেয়ে গেছি। না জানি আমাদের এই পরীকে লেহেঙ্গা পরিহিত অবস্থায় কতো সুন্দর লাগবে!’ আরোরার চিবুক ধরে বললো আরিশা। আরোরার অদ্ভুত কারণে হুট করেই লজ্জা লাগতে শুরু করলো। সে বিনা-বাক্যে দৃষ্টি নত করে লেহেঙ্গার এক অংশ আলতো খামচে ধরলো। কল্পনা করতে লাগলো এই অসাধারণ লেহেঙ্গাতে তাকে ঠিক কেমন লাগবে? ফায়ান কী তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে? আরোরার লজ্জা আরও তীব্র হয়। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে তার!

বিয়ের পোশাক শেষে হলুদের পোশাক নিয়ে কথোপকথন শুরু হলো। হলুদেও লেহেঙ্গা পাঠিয়েছে ফায়ান তবে এটা ভারি নয়। দামী হলেও লেহেঙ্গা বেশ পাতলা, হলুদ বর্ণের। হলুদ লেহেঙ্গার সঙ্গে ম্যাচিং ফুলের জুয়েলারি! হলুদের অনুষ্ঠান আগামী পরশু, ভাবতেই আরোরার বুকটা ধক করে উঠলো।

~চলবে।