#প্রিয়া_তুমি
#পর্বঃ২
#লেখিকা_লক্ষী_দেব
তানিয়া রান্নার অজুহাতে রান্নাঘর থেকে বের হলো না। দশ মিনিট পর রাফসানের জন্য পানি নিতে রিতা রান্নাঘরে আসে। তানিয়াকে রান্না করতে দেখে বলল,
“ভাবী তুমি রান্নাঘরে রান্না করছো। ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেলে না?
রিতার কথায় তানিয়া চমকে উঠল। মনে মনে বলতে থাকল তাকে যেন কেউ রাফসানের সামনে না নিয়ে যায়। শুকনো ঢোক গিলে রিতার প্রশ্নের উত্তরে বলল,
“কি করে যাবো বল? সবাই চলে গেলে রান্না হবে কি করে? আমি এখানে আছি। পরে তোমার ভাইয়ার সাথে দেখা করবো।
তানিয়ার কথায় রিতা একমত হতে পারল না। দ্বি’মত পোষন করে বলল,
“তা কি করে হয় ভাবী? তুমি রান্নার জন্য ভাইয়ার সাথে দেখা করবে না? তুমি ভাইয়ার জন্য পানি নিয়ে যাও। আমি এইদিকে একটু রান্নাটা দেখছি।
তানিয়া আরেক দফা চমকে উঠল। উফ, মেয়েটা এতো বাড়াবাড়ি করছে কেন? তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে মি’থ্যে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তুমি এ বাড়ির মেহমান। তোমাকে কি করে রান্না করতে দেই? তাছাড়া তোমার ভাইয়া তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। আমি একটু পরে গিয়ে দেখা করে আসবো।
তানিয়ার কথায় রিতা এবারো রাজী হতে চাইল না। মেহমান হলে কি হয়েছে? একটু রান্না কি করা যায় না? রিতা যেই না মুখ খুলতে যাবে তখনই তানিয়া বলে উঠল,
“তুমি আর কথা না বাড়িয়ে যাও তো। তোমার ভাইয়া পানির জন্য অপেক্ষা করছে।
তানিয়ার কথায় রিতা দাঁত দিয়ে জিভে কামড় দিয়ে বলল,
“ইশ রে। ভাইয়া কখন পানি নিতে বলেছে আর আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
রিতা পানির জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তানিয়া স্ব’স্তির শ্বাস ফেলে নি’র্বিঘ্নে বলল,
“উফ বাবা, বাঁচলাম।
রাফসানকে ঘিরে সকলে বসে আছে। একেক জন একেক রকম প্রশ্ন করছে। রাফসান সকলের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লা’ন্ত। এমনিতেই জার্নি করে এসেছে। তার উপর আবার পানি পিপাসা পেয়েছে। রিতা পানি আনতে যে গিয়েছে এখনও আসার নাম নেই। তাছাড়া তানিয়ার ও দেখা নেই। মেয়েটা বোধহয় ইচ্ছে করেই আসছে না।
রাফসান সোফায় মাথা এলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরই মধ্যে রিতা পানির গ্লাস নিয়ে হাজির হলো। রাফসানের দিকে গ্লাস ভর্তি পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া এই নাও, তোমার পানি।
রাফসান রিতার হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল। গ্লাসটা রিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি খুব ক্লা’ন্ত। আমি একটু রুমে গিয়ে রেস্ট নিই। তোমরা একটু সর তো।
রাফসানের কথাটা সকলের কানে পৌঁছাতেই তাদের কথায় ভাটা পড়ল। রাফসানকে সাইড দিয়ে যে যার কাজে চলে গেল।
রাফসান নিজের রুমে গেল। রুমের সব কিছু পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন দেখল। সেই সাথে মেয়েলী জিনিসপত্র ও। রাফসান বিছানায় গিয়েই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিল।
আমেনা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে তানিয়াকে দেখলেন। ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
“তুমি কি এতক্ষণ এখানে ছিলে? রাফসানের সাথে তোমার দেখা হয়নি?
তানিয়া প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে তার আগেই রিতা বলে উঠল,
“দেখা হবে কি করে ফুফু? ভাবী তো রান্নাঘর থেকে বের-ই হয়নি। এখন তো ফুফু চলে এসেছে। এবার তুমি ভাইয়ার সাথে দেখা করে এসো। ভাইয়া রুমে গেছে।
শেষের কথাটা তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল রিতা। তানিয়া রিতার কথায় বাঁধ সাধতে নিলে আমেনা বেগম বলে উঠল,
“হ্যাঁ-হ্যাঁ। তুমি রুমে যাও। ছেলেটা কখন এসেছে অথচ তুমি এখনও দেখা করো নি।
তানিয়া এবার আর মানা করতে পারলো না। এতো বার মানা করলে ওরা নিশ্চিত সন্দেহ করবে। তানিয়া ওদের কথায় সায় দিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেল। গুটি গুটি পায়ে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখল রাফসান বিছানার উপর শুয়ে আছে। তানিয়া একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কি-না। নাহ, কাউকে দেখা গেল না। তানিয়া আবার রুমের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল রাফসান এখানো আগের মতোই শুয়ে আছে। উফ! লোকটা কি ফ্রেশ-ট্রেশ হবে না?
তানিয়া মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রাফসান ওয়াশরুমে গেলে সে রুমে যাবে। ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার আগেই আবার রুম থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু রাফসানের রুম থেকে ওয়াশরুমে যাওয়ার খবর নেই। এদিকে তানিয়ার বুকের হৃদ’পিন্ডটা দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। যদি কেউ এই দিকে এসে দেখে ফেলে। তখন তো না চাইতে ও রাফসানের সামনে যেতে হবে।
তানিয়া রুমের দিকে তাকিয়ে দেখল রাফসান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। শরীরে থাকা শার্টটা খুলে বিছানায় রেখে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। ভেতর থেকে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ পেতেই তানিয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দ্রুত রুমের বাহির থেকে রুমের ভেতরে চলে গেল।
তানিয়া রুমের ভেতরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ওয়াশরুমের ভেতর থেকে ট্যাপ কল থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। তানিয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল চিরুনি নিয়ে চুল গুলো আঁচড়ে বেঁধে নিল। তখনই বুঝতে পারল ট্যাপ কলের পানি পড়ার শব্দ কমে যাচ্ছে। তানিয়া আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওয়াশরুমের দরজা খুলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল।
রাফসান ওয়াশরুমের দরজা খুলে রুম থেকে কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখল। তবে মানুষটার মুখ দেখতে পারেনি। কেবল শাড়ির আঁচলের শেষ প্রান্তটা দেখতে পেল।
রাফসানের বুকটা ধক করে উঠল। কে এসেছিল রুমে? তবে কি তানিয়া রুমে এসে দেখা না দিয়েই পালিয়ে গেছে? রাফসান এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিচে তাকিয়ে দেখল শাড়ি পরিহিতা মেয়েটা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে।
তানিয়া রান্নাঘরে গিয়ে দেখল তার শাশুড়ি আর চাচী শাশুড়ি রান্না করছে। রিতা ওদের টুকটাক কাজে সাহায্য করছে। তানিয়া রুম থেকে কিছুটা দৌড়ে বের হওয়ায় এখন হাঁপাচ্ছে। তানিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে রিতাকে বলল,
“তুমি এখন যাও। যা করা লাগবে আমি করবো।
তানিয়াকে হাঁপাতে দেখে রিতা তানিয়ার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
“কি গো ভাবী। এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন? ভাইয়া কি শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো কিছুমিছু করেছে নাকি?
রিতার কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে তানিয়ার শরীরটা রী রী করে উঠছে। মেয়েটার কি লাজ-লজ্জা বলতে কিছু নেই নাকি? তানিয়া রিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধুর, কি যা তা বলছো।
তানিয়ার কথায় রিতা উচ্চস্বরে হেসে উঠল। রিতা হাসি শুনে আমেনা বেগম আর তার ছোট জা সালমা বেগম রিতার দিকে তাকালেন। সালমা বেগম তানিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,
“কি মেয়ে মানুষ রে বাবা। দেখছে শাশুড়ি দুই জন কাজ করছে আর বউ হয়ে ননদের সাথে হাসছে। বলি এখন কি হাসার সময়? একটু কাজ করো তো বাপু। কীভাবে কাজ ছাড়া থাকবে সবসময় সেই তালে থাকে।
সালমা বেগমের ক’র্কশ স্বরের কথায় রিতার মুখের হাসি মিলিয়ে থমথমে হয়ে গেল। এই মহিলা সব সময় এমন কড়া কড়া কথা বলে। তারচেয়ে বড় কথা তানিয়ার সাথে একটু বেশিই কড়া কথা বলে। রিতা বুঝতে পারে না তানিয়ার মতো এমন শান্ত, ভদ্র একটা মেয়ের সাথে উনি এমন আচরণ কেন করেন। রিতা মুখটা মলিন করে বলল,
“সরি ভাবী। আমার জন্য তোমাকে কথা শুনতে হলো।
তানিয়া দুদিকে মাথা নাড়ালো। সালমা বেগমের এমন কথা প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর আগের মতো খারাপ লাগে না। তিনটা বছরে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। সালমা বেগমের এমন অনেক কথাই সে শুনেছে। রিতার মাথায় হাত রেখে বলল,
“এভাবে বলছো কেন? তোমার জন্য কেন কথা শুনবো। আমিই তো কাজ না করে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তাছাড়া বিয়ের পর মেয়েদের অনেক কথাই শুনতে হয়।
তানিয়ার কথায় রিতা হা করে তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবী কীভাবে কথাটা বলল? রিতার কানে তানিয়ার শেষের কথাটা বাজতে লাগলো। ‘বিয়ের পর মেয়েদের অনেক কথাই শুনতে হয়’। রিতার মনে প্রশ্ন জাগলো,
“আচ্ছা, বিয়ের পর কি মেয়েদের দোষ না করেও দোষী হতে হয়?
রিতার প্রশ্নের মিললো না। মিলবে কি করে? তার তো বিয়ে হয়নি। তবে তানিয়ার কথা শুনে মনে হলো, বিয়ের পর সত্যিই মেয়েদের দো’ষ না করেও দো’ষী হতে হয়।
________________
তানিয়া সারাদিন নানা তাল বাহানা করে রাফসানের সামনে গেল না। তবে কতক্ষন এভাবে রাফসানের সামনে না গিয়ে থাকতে পারবে তা বলতে পারছে না। রাত হলে কোথায় যাবে? তখন তো ঠিকই রাফসানের সামনে যেতে হবে।
তানিয়া সন্ধ্যার আগে ছাদে গেল। ছাদ থেকে রোদে দেওয়া কাপড় গুলো হাতে নিয়ে নামতে নামতে ভাবতে লাগলো এখন কাপড় গুলো কোথায় রাখবে? কাপড় রাখতে গেলে তো রুমে যেতে হবে। আর রুমে রাফসান আছে। তানিয়া চিন্তিত ভঙ্গি’তে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে দেখল রাফসান রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
তানিয়া খুশি মনে রুমের ভেতর গিয়ে কাপড় গুলো ভাঁজ করতে লাগলো। তখনই তানিয়ার হাতটা কেউ ধরে ফেলল। তানিয়ার বুকটা কেঁপে উঠলো। ডান হাতে থাকা ভাঁজ করা কাপড় হাত থেকে পড়ে গেল। তানিয়া দুরুদুরু বুকে পাশ ফিরে তাকাল। সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে মুখ শক্ত করে বলল,
“হাতটা ছেড়ে দিন।
#চলবে