প্রিয়া তুমি পর্ব-১৯

0
102

#প্রিয়া_তুমি
#পর্বঃ১৯
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

সকাল হতেই তানিয়ার উপর ভার পড়ল নাস্তা তৈরি করার। রুটির সাথে শয়লা শুঁটকি ভর্তা করার। অনেকগুলো শুকনো মরিচের সাথে শুঁটকি মাছ শীল পাটায় বেটে ভর্তা করতে হবে। এই ইচ্ছে বা আদেশটা মনোয়ারা বেগম পোষন করেছেন। আমেনা বেগমের কাছে ইচ্ছেটা পোষণ করতেই আমেনা বেগম নিজে শুঁটকি ভর্তা করতে উ’দ্যত হলেন। তবে মনোরায়া বেগম তা হতে দিলেন না। আমেনা বেগমকে আটকে তানিয়ার উপর ভার দিলেন।

তানিয়া মনোয়ারা বেগমের কথা মতো শুঁটকি ভর্তা করতে লাগলো। মরিচ বাটার ফলে ডান হাতটা অসম্ভব জ্ব’লতে লাগলো। রাফসান রান্নাঘরে এসে তানিয়াকে ডান হাতে ফুঁ দিতে দেখল। পাটার মধ্যে লাল মরিচ গুলো দেখে তানিয়ার সামনে গিয়ে বসল। রাফসানকে দেখে তানিয়া থতমত খেয়ে গেল। আবারো বাটতে লাগলো। ভাবটা এমন করল যেন কিছু হয়নি। রাফসান তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হাতটা কি জ্বা’লা করছে?

তানিয়া ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“মরিচ বাটতে গেলে একটু তো জ্বা’লা করবেই। তবে ব্যাপার না। একটু পরে ঠিক হয়ে যাবে।

রাফসান নিষ্প’লক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা বেশ শান্ত’শিষ্ট। তবে এতোদিন তা বুঝা যায়নি। বুঝবে কি করে? তার সাথে তো এতোদিন ভালো মতো কথা হয়নি, মেশা হয়নি। রাগ, জে’দ, অভিমানে সবসময় উ’গ্র আচরণ করেছে। কিন্তু আস্তে আস্তে সকল রাগ, জে’দ, অভিমান ধূলোয় মিশে গেছে। তানিয়া এখন আর রাফসানের সাথে উ’গ্র আচরণ করে না।

রাফসান তানিয়ার কাছ থেকে চলে গেল। সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার সময় মনোরায়া বেগমের কথা শুনে থমকে দাঁড়াল। রাফসানের রুমের ঠিক আগের রুমটা মনোরায়া বেগমের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রাফসান তার রুমে যাওয়ার পথে মনোরায়া বেগমের রুমের ভেতর থেকে শুনতে পেল,
“ওই তানিয়ার এমন হাল করবো যে সংসার করার সাধ গুছে যাবে।

রাফসান কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক’ন্ঠটা তার খুব পরিচিত। তারই ছোট আম্মুর ক’ন্ঠ। রাফসান রুমের বাহিরে থেকে রুমের ভেতরে কে কে আছে দেখার চেষ্টা করল। অমনি খাটের উপর মনোয়ারা বেগম, সালমা বেগম আর রিমাকে দেখতে পেল। মনোয়ারা বেগম ওদের মাঝখানে বসে আছে। সালমা বেগম কথাটা শেষ করতেই মনোয়ারা বেগম রিমার থুতনিতে হাত রেখে বলে উঠলেন,
“আমার মেয়েটা কোন অংশে খা’রাপ? দেখতে খা’রাপ নাকি স্বভাব চ’রিত্র খারা’প? রাফসান আমার মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজী হলো না। আচ্ছা রাফসান না হয় রাজী হলো না কিন্তু আমেনা তো পারতো ছেলেকে রাজী করাতে। তা না করে উল্টো নিজেই না করে দিল।

সালমা বেগম মনোয়ারা বেগমের কথায় মে’কি হাসলেন। নিজ মনে বললেন,
“আহা! আপনার মেয়েটা কতো ভালো? এক ছেলের সাথে ভেগে গিয়ে এক মাস পর ফিরে এসেছে। এই মেয়েকে রাফসান বিয়ে করবে? হুহ। তাছাড়া কাজের যে বাহার। এই মেয়ে বউ হয়ে এলে সারাদিন কাজ করতে করতে চলে যেত।

সালমা বেগম মনে মনে কথাটা বললে ও মুখে বলল আরেক কথা। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“এটাই তো। রিমার মতো মেয়ে যদি এই বাড়ির বউ হতো তাহলে কোনো চিন্তাই ছিল না। রিমা দেখতে কত সুন্দর। রাফসান কেন বিয়ে করল না বলুন তো?

মনোয়ারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার এতোদিনের যত রাগ, ক্ষো’ভ ছিল সব এসে পড়ল তানিয়ার উপর। কি আছে তানিয়ার মাঝে? তার মেয়েকে বিয়ে না করে রাফসান তানিয়াকে কেন বিয়ে করল? তার মেয়েটা কি ফেলনা নাকি? মনোয়ারা বেগম ফুঁসে উঠে বললেন,
“রিমার মুখে যখন শুনলাম তানিয়া আর রাফসানের সম্পর্ক ভালো না তখন যে কি পরিমান খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এখন তো দেখি কাহিনী উল্টো। দুজনের মধ্যে বনিবনা বেশ ভালো।

রিমা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বনিবনা ভালো তো কি হয়েছে? ভুল বোঝাবুঝি করাতে কি খুব বেশি সময় লাগবে আম্মু?

সালমা বেগম রিমার কথায় কঠোর গলায় বলল,
“তোমার আম্মু আর আমি যদি একসাথে থাকি তাহলে ওদের আলাদা করা কোনো ব্যাপারই না। এখন শুধু দেখতে থাকো তানিয়ার সাথে ঠিক কী কী হয়। আমার ছেলেটাকে মেরে যতটা জ’খম করছে তার তিনগুণ আমি তানিয়ার সাথে করবো।

মনোয়ারা বেগম এবার বলে উঠলেন,
“একবার শুধু আমেনার ব্রে’ন ওয়াশ করতে পারি তারপর দেখবে আমাদের চালের কাছে তানিয়া ধূপে টিকবে না।

রাফসান অনেকক্ষণ যাবত ধরে ওদের কথাগুলো শুনছে। রাগে তার চো’য়াল শ’ক্ত হয়ে এসেছে। মনোয়ারা বেগমের এখনের কথাটা শুনে আর স’হ্য হলো না। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ক’ন্ঠে তী’ব্র তে’জ, কঠো’রতা, ক্ষো’ভ নিয়ে শা’ন্ত গলায় বলল,
“আম্মুকে এখন ডেকে দেই? আমার সামনেই ব্রে’ন ওয়াশ করুন। দেখি আম্মুকে ঠিক কী কী বলে ব্রে’ন ওয়াশ করেন।

রাফসানের ক’ন্ঠ স্বর শুনে তিনজনই চমকে দরজার দিকে তাকাল। সকলের চোখে মুখেই অস্থি’রতা স্প’ষ্ট দেখা যাচ্ছে। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। সালমা বেগম কথা ঘুরাতে বলে উঠল,
“ছিঃ ছিঃ। কি বলছিস রাফসান। তোর আম্মুর ব্রে’ন ওয়াশ করতে যাবে কেন? আমরা তো অন্য কথা বলছিলাম। তুই কি থেকে কি শুনেছিস কে জানে।

সালমা বেগমের সাথে সাথে মনোয়ারা বেগমও তাল মিলিয়েছেন। মে’কি হেসে বললেন,
“হ্যাঁ-হ্যাঁ। সালমা তো ঠিকই বলেছে। আমরা কেন আমেনার ব্রে’ন ওয়াশ করবো? আমরা অন্য বিষয়ে কথা বলছিলাম।

রাফসান দুজনের কথা শুনে বেশ মজা পেল। এতক্ষণ এরাই তো কত কুমত’লব করছিল। কিন্তু এখন? এখন এদের ভালো সাজার কতো চেষ্টা। রাফসান তাচ্ছি’ল্যমাখা ক’ন্ঠে বলল,
“আমার আপনাদের দেখে ল’জ্জা হচ্ছে। আপনাদের মতো মানুষদের জন্যই সংসারে অশা’ন্তি সৃষ্টি হয়। দুটো মানুষ আলাদা হয়। একটা সুখী পরিবার ভে’ঙেচুড়ে শেষ হয়ে যায়।

রাফসানের কথায় মনোয়ারা বেগম চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“রাফসান।

মনোরায়া বেগমের চেঁচানোতে রাফসানের খুব একটা ভাবা’ন্তর হলো না। উল্টো রাগটা আরো বেড়ে গেল। মনোয়ারা বেগমের থেকে দ্বি’গুণ চেঁচিয়ে বলল,
“রাফসান কি হ্যাঁ? কথাগুলো বড্ড গায়ে লাগলো তাই না? আপনাকে আমাদের বাড়িতে আসতে কে বলেছে? কে বলেছে আমাদের বাড়িতে এসে অশা’ন্তি সৃষ্টি করতে? ছোট আম্মু বলেছে তাই না?

রাফসান কথাটা চেঁচিয়ে বলেছে বিধায় আমেনা বেগমের রুম অব্দি কথাটা গেল। আমেনা বেগম হন্ত’দন্ত হয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সালমা বেগম রাফসানের কথাটা শুনে বললেন,
“না রাফসান। আমি এসব বলিনি। বিশ্বাস কর আমি কিচ্ছু বলিনি।

আমেনা বেগম রাফসানের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ব্যতি’ব্যস্ত ক’ন্ঠে বললেন,
“কি হয়েছে রাফসান? তুই এভাবে চেঁচামেচি করেছিস কেন?

রাফসান আমেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি জানো আম্মু তোমার ভাবী কেন এখানে এসেছে? তানিয়া আর আমার মাঝে দূরত্ব তৈরি করার জন্য। তোমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে তানিয়ার সাথে সম্পর্ক ছি’ন্ন করার জন্য। তোমার ভাবীকে সায় জানাচ্ছিল ছোট আম্মু। আমি উনাদের সব গুলো কথা শুনেছি।

রাফসান সংক্ষেপে আমেনা বেগমকে ওদের বলা সবগুলো কথা বলে দেয়। সব শুনে আমেনা বেগম ঘৃ’ণিত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাল। এক আকাশ সম ঘৃ’ণা নিয়ে বলল,
“আমি আপনার থেকে এমনটা আশা করিনি ভাবী। আপনি এতটা নিকৃ’ষ্ট ছিঃ।

মনোয়ারা বেগম কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। রাফসান ওদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমাদের বাড়িতে থেকে এসব করার চেয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াই ভালো। আপনারা এক্ষুনি আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আর ছোট আম্মু তুমি ও।

শেষের কথাটা সালমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল রাফসান। সালমা বেগম চমকে উঠে বলল,
“আমি কোথায় যাব?

“কোথায় যাবে মানে? এই বাড়িটা আমার আব্বুর। ছোট আব্বু তো একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। তুমি সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকবে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে থাকা চলবে না। আম্মু তুমি কিছু বলছো না কেন?

আমেনা বেগম বললেন,
“কি বলবো আমি? এদের বলার মতো কোন ভাষা আছে? তুই তো বলে দিয়েছিস। যদি নূন্যতম ল’জ্জা থেকে থাকে তাহলে তোর কথাতেই বেরিয়ে যাবে।

মায়ের কথায় রাফসান খুশি হলো। ওদের উদ্দেশ্যে আবারো বলল,
“আম্মু কি চায় অবশ্যই বুঝেছেন। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছি। নাকি ঘাড় ধা’ক্কা দিয়ে বের করতে হবে।

রাফসানের কথা শেষ হওয়া মাত্রই মনোয়ারা বেগম ব্যাগ হাতে নিলেন। একটা রাত, মাত্র একটা রাতই তো ছিল। সকালেই যে এমন ভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবতে পারেননি। সালমা বেগম মুখটা মলিন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এটাই বোধহয় এ বাড়িতে তার শেষ দিন। হয়তো আর কখনো আসতে পারবে না। কিংবা আসতে পারলেও মাথা উঁচু করে কথা বলার মুখ থাকবে না।

#চলবে