প্রিয়া তুমি পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
120

#প্রিয়া_তুমি
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

সময়টা স’ন্ধ্যে বেলা। এদিক ওদিক নির’ন্তর ছুটে বেড়ানো পাখিগুলোর নীড়ে ফেরার সময়। ক্লা’ন্ত পথিকের ঘরে ফেরার সময়। সূর্য ডুবে চাঁদ উঠার পূর্ব মুহূর্ত। তানিয়া রুমে এলো। ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে নিল। রাফসানের কথামতো আজকে সকালেই সালমা বেগম, মনোয়ারা বেগম, রিমা, রিতা এই বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে। তবে কারো মধ্যেই অনু’শোচনার বিন্দুমাত্র রে’শ দেখা যায়নি। অথচ কোনো দো’ষ না করে, কোনো অন্যা’য় না করেও বারবার মা, বোনের কাজের জন্য ক্ষ’মা চেয়েছে রিতা। মা বোনের অন্যা’য় কাজে ল’জ্জিত হয়েছে। মাথা নিচু করেছে।

তানিয়া নামাজ পড়া শেষ করে আলমারির সামনে গেল। আলমারিটা খুলতেই চোখে পড়ল রাফসানের দেওয়া সেই শাড়ির ব্যাগটার দিকে। তানিয়া হাত বাড়িয়ে শাড়ির ব্যাগটা হাতে নিল। ব্যাগ থেকে শাড়িটা খুলে শাড়ির গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। তানিয়ার হুট করেই মনে প্রশ্ন জাগলো,
“আমি যদি শাড়িটা পড়ে উনার সামনে যাই, তবে কেমন হবে? উনি কি খুব বেশি অবাক হবেন? অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন?

তানিয়ার প্রশ্নের উত্তর মিললো না। তবে খুব করে ইচ্ছে করল প্রশ্নের উত্তর গুলো জানতে। রাফসানের অবাক হওয়া চাহনি দেখতে। তানিয়া শাড়িটা বুকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হাসল। তারপর? তারপর সিদ্ধা’ন্ত নিয়ে ফেলল শাড়ি পড়ে ফেলার। নীল রঙের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে ফেলল তানিয়া। বুকের মাঝে এক আকাশ অস্থি’রতা নিয়ে রাফসানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রহর গুনতে লাগলো রাফসানের ঘরের ফেরার।

অপেক্ষার প্রহর গুলো যেন কাটতেই চায় না। মানুষ অপেক্ষা করে সময় কখন শেষ হবে। কখন সেই কা’ঙ্ক্ষিত মুহুর্ত আসবে। কিন্তু কা’ঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এতো সহজে ধরা দেয় না। ধরা দিতে অনেকটা অনেকটা সময় নেয়। তানিয়ার বেলায় ও তাই হলো। সন্ধ্যে থেকে রাফসানের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আজকে রাফসানের আসার নাম নেই। হয়তো বাসায় ফেরার এতো তাড়া নেই। রাফসান যদি জানতো তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে তবে কি এতোটা দেরী করতো? সব ফেলে ছুটে বাসায় ফিরতো না? তানিয়ার সামনে এসে দাঁড়াতো না?

হয়তো বা আসতো। ঘড়ির কাঁটা এখন নয় এর ঘরে। রাত এখন নয়টা বাজে। তানিয়া মুখ ভার করে খাটের উপর বসে রইল। উফ! অস’হ্য লাগছে। মানুষটা আজকে বাসায় ফিরতে এতো দেরী কেন করছে? বিছানায় পড়ে থাকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাফসানের নাম্বারে দ্বিতীয় বারের মতো ডায়াল করল। ঠিক এক ঘন্টা আগে একবার কল করেছিল। রাফসান কল ধরেনি। তানিয়াকে ফিরিয়ে কল দেয় ও নি। এইবার তিনবার রিং হওয়ার মাঝেই কলটা রিসিভ করে ফেলল। ফোনের ওপাশ থেকে হর্ন বাজানোর বি’কট শব্দ শুনে তানিয়া ফোনটা কান থেকে নিচে নামিয়ে ফেলল। উফ! হর্ন বাজানোর আর সময় পেল না? কানটা ঝাঁঝড়া করে ফেলল। তানিয়া ফোনটা কানে নিল। অমনি রাফসানের ব্য’স্ত ক’ন্ঠ শুনতে পেল,
“হ্যালো তানিয়া। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না?

রাফসানের কথার সাথে গাড়ি চলার, হর্ন বাজার শব্দ শুনতে পাচ্ছে তানিয়া। শীতল, শান্ত স্ব’রে বলল,
“কোথায় আপনি?

“বাসায় ফিরছি।

তানিয়া ‘আচ্ছা’ বলে কলটা কেটে দিল। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাফসান এলে বারান্দা থেকে দেখতে পাবে। তানিয়া আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তবে পূর্ণ চাঁদ না, অর্ধ চাঁদ। তানিয়া অপলক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে কতো কি ভাবল। সময় পেরিয়ে গেল। ঠিক কতোটা সময় জানা নেই। তানিয়া হঠাৎ নিচ থেকে রিকশার হর্নের শব্দ শুনতে পেল। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকাল। রাফসান রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাসার দিকে আসছে। রাফসানকে দেখে তানিয়ার শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। বুকের ধুকপুকানি দ্বিগুণ গতিতে বাড়তে লাগলো।

অপেক্ষার প্রহর শেষে কা’ঙ্ক্ষিত সময়টা যেমন খুব দ্রুত ধরা দেয় না ঠিক তেমনি কা’ঙ্ক্ষিত সময়টা যখন ধরা দেয় সময়টা হয়ে উঠে খুব রঙিন, খুব স্পেশাল।
রাফসান রুমে এসে চোখ বুলিয়ে কোথাও তানিয়াকে দেখতে পেল না। কোথায় গেল মেয়েটা? নিচে ও তো ছিল না। রাফসান ডেকে উঠল,
“তানিয়া।

তানিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাফসানের ডাক শুনল। তবে উত্তর দিল না। রাফসানের চোখ বারান্দার দিকে যেতেই হাওয়ায় উড়তে থাকা শাড়ির আঁচল দেখতে পেল। মুহুর্তেই বুঝতে পারল তানিয়া বারান্দায়। তবে রাফসান বারান্দায় গেল না। প্রথমে ওয়াশরুমে চলে গেল। শরীরটা ব’ড্ড ক্লা’ন্ত লাগছে। রাফসান ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিল। তানিয়াকে রুমে না দেখে পা বাড়াল বারান্দার উদ্দেশ্যে।

রাফসান বারান্দায় গিয়ে থমকে দাঁড়াল। বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা নীল শাড়ি পরিহিতা নারীকে দেখে বুকের ভেতর দমকা হাওয়া বয়ে গেল। বাতাসের বদৌলতে তানিয়ার নীল শাড়ির আঁচলটা উড়ছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে ছেড়ে রাখা কোমর অবদি লম্বা চুল গুলো নেচে বেড়াচ্ছে।

রাফসানের পায়ের আওয়াজ থেমে গেলে তানিয়ার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। রাফসান এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে ঠিক তানিয়ার পেছনে দাঁড়াল। তানিয়া কাঁধে হাত রাখলে তানিয়ার সর্বা’ঙ্গ কেঁপে উঠল। রাফসান তানিয়ার কেঁপে উঠার দৃশ্য দেখে মৃদু হাসল। তানিয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তানিয়ার মুখের দিকে তাকাল। মেয়েটা আজকে সেজেছে। তার দেওয়া শাড়িটা পড়েছে। তানিয়া মুখটা নিচু করে রেখেছে। চোখ দুটো মেঝের দিকে নি’বদ্ধ। রাফসান তানিয়ার থুতনিতে হাত রেখে মুখটা উপরে তুলে বলল,
“আজ এতো সাজ কেন?

তানিয়ার চোখ দুটো ব’ন্ধ। আজ প্রচুর ল’জ্জা লাগছে। চোখ খুলে তাকানো যাচ্ছে না। তার চেয়ে বড় কথা রাফসানের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। কীভাবে দিবে? তার যে ল’জ্জা লাগছে। উত্তর দিতে গেলে ক’ন্ঠ থেকে স্ব’র বের হচ্ছে না। ঠোঁট জোড়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাফসান তানিয়ার নীরবতা দেখে আবারো বলল,
“কি হলো? বলছো না? আজ এতো সাজ কেন?

তানিয়া চোখ খুলে তাকালো। রাফসানের চোখের দিকে তাকিয়ে আবারো চোখ ব’দ্ধ করে ফেললো। সব লাজ-ল’জ্জা সরিয়ে বলল,
“আপনার জন্য।

তানিয়ার মুখে অপ্রত্যা’শিত কথাটা শুনে রাফসান অবাক হলো। সেই সাথে মনের মাঝে ভালোলাগার শীতল পরশ বয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে তানিয়াকে আরো ল’জ্জা দিতে বলল,
“আমার জন্য? আমার জন্য কেন?

তানিয়ার ল’জ্জা যেন আরো বেড়ে গেল। ইচ্ছে করল মাটি ফাঁক করে মাটির নিচে ঢুকে পড়তে। কিন্তু সেই উপায় নেই। রাফসান আবারো বলে উঠল,
“বলো না, আমার জন্য কেন সেজেছো?

তানিয়া চোখ খুলে রাফসানের মুখের দিকে তাকাল। রাফসানের চোখে মুখে দুষ্টুমির ছোঁয়া দেখে মুহূর্তেই বুঝে গেল রাফসানের মনোভাব। তানিয়া উল্টো দিকে ফিরে বলল,
“উফ! আপনি ইচ্ছে করে আমায় ল’জ্জা দিচ্ছেন কেন?

রাফসান তানিয়ার কথায় হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে তানিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তানিয়ার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
” এই শুনো না।

তানিয়া ছোট্ট করে বলল,
“বলুন।

রাফসান হাসলো। তানিয়ার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ভালোবাসি।

তানিয়া দুচোখ ব’ন্ধ করে ফেলল। শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় শীতল স্রো’ত বয়ে গেল। তানিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়তে লাগলো। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বলল,
“আমিও ভালোবাসি।

রাফসান হাসলো। মেয়েটা আজকে চমকের উপর চমক দিচ্ছে। আজ কি হলো? রাফসানের খুশি যেন ধরছে না। এতো খুশি, এতো খুশি কেন লাগছে? ভালোবাসার মানুষটার ভালোবাসা পাচ্ছে বলে? হয়তো তাই। রাফসান আবারো বলল,
“এই বউ?

রাফসানের ডাকে তানিয়ার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। হৃৎ’পিণ্ডটা তড়িৎ গতিতে লাফাচ্ছে। তানিয়া আবারো বলল,
“হ্যাঁ, বলুন না।

“আমার না, ফারিনের মতো ছোট্ট একটা পরী লাগবে। আমায় পরীর বাবা হওয়ার সুযোগ দেবে?

তানিয়া মুখে জবাব দিল না। তবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। রাফসান তানিয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
“সত্যি?

তানিয়া হাসল। মৃদু হেসে বলল,
“হুম।

রাফসানের খুশি দেখে কে? তানিয়ার দুই বাহু জড়িয়ে বলল,
“ভালোবাসি বউ। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। ইশ, আমার কি যে খুশি লাগছে।

তানিয়া মুচকি হাসল। দুচোখ ভরে রাফসানের হাসি মুখটা দেখল। মানুষটা এতো ভালোবাসে কেন? ভালোবাসা এতো সুন্দর হয় কেন? রাফসান তানিয়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তানিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার প্রিয়া তুমি।

সমাপ্ত