প্রিয়া তুমি পর্ব-১৭

0
105

#প্রিয়া_তুমি
#পর্বঃ১৭
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তানিয়া যেন নীরবে নিভৃতে রাফসানকে মেনে নিচ্ছে। আগের মতো রা’গ, তে’জ, কঠো’রতা কোনটাই নেই এখন। তানিয়া গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রাফসান এখনো ঘুমে বিভোর। তানিয়া রাফসানের দিকে একপলক তাকিয়ে ফের আয়নার দিকে তাকাল।

চুলগুলো আঁচরে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘুমটা টেনে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে আমেনা বেগমকে দেখতে পেল না। তানিয়ার ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো। আমেনা বেগমের তো এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে যাওয়ার কথা। এখনও উঠেনি? তানিয়া আমেনা বেগমের রুমের দিকে গেল। ভেজানো দরজাটা খুলে রুমে প্রবেশ করল। আমেনা বেগম কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে। তানিয়া আমেনা বেগমের দিকে এগিয়ে গেল। নরম সুরে বলল,
“আম্মা আপনি এতক্ষণ ঘুমিয়ে আছেন। শরীর খারাপ করছে?

তানিয়ার গলায় আমেনা বেগম চোখ খুলে তাকালেন। আজ প্রচন্ড মাথা ব্যা’থা করছে। মাথা ব্যা’থার কাছে টিকতে না পেরে শুয়ে আছেন। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
“মাথাটা ব্যা’থা করছে। তাই উঠিনি।

আমেনা বেগমের কথায় তানিয়া চমকে বলে উঠল,
“আম্মু চা করে দেই? মাথা ব্যা’থা কমে যাবে। নাকি মাথা ব্যা’থার ওষুধ খাবেন?

আমেনা বেগম মুচকি হাসলেন। সামান্য মাথা ব্যা’থায় মেয়েটা কেমন উতলা হচ্ছে। আমেনা বেগম তো এমন পুত্রবধূই চেয়েছিলেন। যে তাকে মায়ের মতো ভালোবাসবে। শাশুড়ি বলে অবহেলা করবে না, অনাদর করবে না। আমেনা বেগম নরম সুরে বলল,
“চা করে দাও। তাহলেই হবে। ওষুধের দরকার নেই।

তানিয়া আমেনা বেগমের কথায় সায় জানিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় চা বসাতেই রিতা এসে হাজির হলো। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে উ’দাস মুখে বলল,
“আমরা বোধহয় আজ কালের মধ্যে চলে যাব।

তানিয়া রিতার দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বলল,
“এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে যে? তোমাদের তো আরো কয়েকদিন থাকার কথা।

রিতা আবারো আগের মতো উদা’সী ভ’ঙ্গিতে বলল,
“আমার তো এখন যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আম্মু ফোন দিয়ে বলল আজকে আসবে। আম্মু তো এখানে এসে থাকবে না। তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের এখান থেকে নিতে আসবে।

তানিয়া রিতার কথাটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আবারো আগের মতো মাথায় একটা প্রশ্ন জাগলো। যে প্রশ্নটা আজ পর্যন্ত সে কাউকে করতে পারেনি। আজ কৌতুহল নিয়ে রিতাকে বলল,
“আচ্ছা তোমার আম্মু কখনো এখানে আসলে থাকে না কেন? সবসময় তোমাদের এই বাড়িতে দিয়ে আবার চলে যায়। এক রাতের জন্যও থাকে না। তোমার ভাইয়া আসার আগের দিন ও এসে চলে গেল। আমি জানতেই পারলাম না কখন চলে গেল।

তানিয়ার কথায় রিতার মুখটা শুকিয়ে গেল। চোখ মুখে ফুটে উঠল দ্বি’ধার চি’হ্ন। তানিয়া রিতার নীরবতা দেখে আবারও বলল,
“কি হলো রিতা? কথা বলছ না কেন?

রিতা তানিয়ার দিকে তাকিয়ে মে’কি হাসল। হালকা একটু কেঁশে নিজেকে ধা’তস্থ করল। নিজের মাঝে থাকা সং’কোচ কাটিয়ে তুলে বলল,
“আসলে আম্মু চেয়েছিল রাফসান ভাইয়ার সাথে রিমা আপুর বিয়ে হোক। কিন্তু ফুফু, রাফসান ভাইয়া কেউই এতে রাজি হয়নি। তারপর থেকে আম্মু আর এখানে এসে থাকে না।

তানিয়া রিতার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কাজে মন দিল। রিতা ঠিক বুঝতে পারল না তানিয়ার মনোভাব। রিতা মিনিট দুয়েক চুপ থেকে বলে উঠলো,
“ভাবী তুমি কি রাগ করেছো?

তানিয়া চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে এক পলক রিতার দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তোলে বলল,
“রাগ করবো কেন? তুমি তো রাগ করার মত কিছু বলনি। তোমার আম্মু শুধু বিয়ের কথা বলেছিলেন। এই কথা শুনে রাগ করার কিছু নেই রিতা।

রিতা কোনো জবাব দিল না। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। তানিয়া আমেনা বেগমের জন্য চা নিয়ে আমেনা বেগমের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। রিতা নি’র্বাক হয়ে চেয়ে রইল। তানিয়ার থমথমে মুখ এমন চুপ হয়ে যাওয়া দেখে অবাক হলো। নিজ মনে প্রশ্ন আওড়ালো,
“ভাবী কি সত্যি সত্যি রাগ করলো নাকি আমার কথায় ক’ষ্ট পেল?

রিতা তার প্রশ্নের উত্তর পেল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে গেল।
_________________

সালমা বেগম খিটখিটে মেজাজে রনিতের সামনে রুটি আর ডিম ভাজির প্লেটটা রাখল। প্লেটটা রাখার সময় ঝনঝন শব্দ হলো। এ যেন তার রাগের বহিঃপ্রকাশ। রনিত মোবাইল থেকে চোখ তুলে সালমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে আম্মু। জিনিসপত্র এভাবে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছো কেন?

রনিতের কথায় সালমা বেগমের রাগটা তড়িৎ গতিতে বেড়ে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“কি করবো হ্যাঁ? কি করবো? তোর জন্য হাত পুড়িয়ে রান্না করবো আর তুই বসে বসে খাবি।

সালমা বেগমের কথার মানে রনিত বুঝতে পারল না। ভ্রুঁ-কুটি করে বলল,
“রান্না করবে এতে রেগে যাওয়ার কি আছে? রান্না তো মানুষ খাওয়ার জন্যই করে। তুমি রান্না করলে আমি খাব না?

সালমা বেগম যেন আরো রেগে গেলেন। রনিতের দিকে জল’ন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রু’দ্ধ স্বরে বললেন,
“তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে রান্না করা খুব সহজ কাজ। যা না একবেলা রান্না করে আয়।

রনিত সালমা বেগমের কথায় থতমত খেয়ে গেল। আচমকা মায়ের এমন রণ’মূর্তি দেখে অবাক হলো। সালমা বেগম আবারো বলে উঠল,
“আগে আমার তেমন কিছুই করা লাগত না। রান্নাঘরের বেশিরভাগ কাজই তানিয়া করতো। একমাত্র তোর জন্য এখন আমার সব কাজ করা লাগছে। এখন তাড়াতাড়ি নাস্তা করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যা।

সালমা বেগমের শেষের কথাটা শুনে রনিত আ’শ্চর্য হলো। অবাক ক’ন্ঠে বলল,
“বাড়ি থেকে বের হয়ে কেন যাবো? আর কোথায় যাবো?

সালমা বেগমের ঠোঁটে সু’ক্ষ্ম হাসি দেখা দিল। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল,
“আপাতত চট্রগ্রামে তোর মামার কাছে যা। কেন যাবি সেটা ফোনে বলবো।
_________________

তানিয়া কাপড়গুলো ভাঁজ করে আলনায় রেখে পেছনে ফিরতেই রাফসানকে দেখতে পেল। রাফসান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তানিয়া রাফসানের একদৃষ্টিতে তাকানো দেখে থমকে গেল। রাফসানের থেকে চোখ নামিয়ে রাফসানকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিল। কিন্তু যেতে পারল না। যাওয়ার আগেই রাফসান তানিয়ার বাম হাতটা ধরে ফেলল। তানিয়াকে নিজের সামনে এনে দাঁড় করালো। তানিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কি?

রাফসান তানিয়ার সামনে এগিয়ে যেতে যেতে তানিয়ার মতো করেই বলল,
“কোথায় কি?

তানিয়া রাফসানকে এগিয়ে আসতে দেখে নিজে পিছনের দিকে যেতে লাগল। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে আবারো প্রশ্ন করল,
“আপনি এভাবে এগিয়ে আসছেন কেন?

তানিয়া প্রশ্নটা করার সাথে সাথে অনুভব করল যে আর পেছনে যেতে পারছে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার আর পেছনে যাওয়ার উপায় নেই। রাফসান একদম তানিয়ার সামনে এসে থামল। বাম হাতটা তানিয়ার মাথার কাছে দেয়ালে রেখে তানিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে ভালোলাগে।

রাফসানের কথায় তানিয়ার বুকে যেন দমকা হাওয়া বয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বলল,
“তো?

রাফসান তানিয়ার কথার জবাব দিল না। এক দৃষ্টিতে তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তানিয়ার অ’স্বস্তি হলো। বুকের ভেতরে থাকা হৃৎ’যন্ত্রটা তড়িৎ গতিতে লাফাতে লাগলো। তবে রাফসানের মাঝে কোনো পরিবর্তন হলো না। সে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রাফসান তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকাই বলে উঠল,
“তোমাকে চুমু দিতে ইচ্ছে করছে, দেই?

তানিয়া চমকে রাফসানের চোখের দিকে তাকাল। তবে বেশিক্ষণ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে ফেলল। রাফসান তানিয়ার থেকে প্রশ্নের উত্তর আশা করল না। তাদের মধ্যে যতটুকু দূ’রত্ব ছিল ততটুকু দূ’রত্ব নীরবে নিভৃতে ঘুচিয়ে দিয়ে তানিয়ার কপালে ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিল। তানিয়া আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

রাফসান তানিয়ার কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে তানিয়ার মুখের দিকে তাকাল। তানিয়া তখনও চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছে। রাফসান তানিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ভালোবাসি।

রাফসান কথাটা বলার সময় তানিয়ার কানের সাথে তার ঠোঁটের স্ব’ল্প স্প’র্শ লাগলো। তানিয়ার সর্বা’ঙ্গ কেঁপে উঠলো। ল’জ্জায় চোখ মেলে তাকাতে পারলো না। রাফসান তানিয়ার অব’স্থা দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো। তানিয়া রাফসানের হাসির শব্দে চোখ মেলে তাকাল। রাফসানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজ মনে বলল,
“আপনি বড্ড অ’সভ্য।

#চলবে