প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
399

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-২৩+২৪+২৫
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
যাইফ চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী বিষণ্ণ মুখে বসে রইল ওভাবেই লম্বা সময় ধরে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে আনমনে চেয়ে আছে দেয়ালের দিকে। ভীষণ দুর্ভাবনা চেহারায়। বড্ড দুঃখী দুঃখী লাগছে। উদাসী শুষ্ক চোখ। কষ্ট হচ্ছে সঙ্গে আক্ষেপও। যাইফ ছিলো ওর একমাত্র ভরসাস্থল। যাইফের কথায় সাহস পেত। যাইফ ওকে অভয় দিতো, ও আবিষ্ট হয়ে শুনতো। নরম-কোমল শ্রাবণী যাইফের কথার মন্ত্রেই যেন হঠাৎ হঠাৎ দুর্দম, দুঃসাহসী হয়ে ওঠত। শ্রাবণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতন লাগছে দেখতে। দুপুর গড়িয়েছে। রোদের তেজ ক্রমশ বাড়ছে। এই কাঠফাঁটা রোদ মাথায় নিয়ে এখন হাসপাতালে যাবে? বাসায় একা হাঁসফাঁস, অস্থির লাগছে। নিদারূণ এক যন্ত্রণা বুকের ভিতর দলা পাকাচ্ছে। বাইরে বের হলে যেন‌ কিছুটা স্বস্তি মিলবে। শ্রাবণী হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। রাস্তায় মানুষের ভিড়ে মিশে যায়। তবুও মনের হাঁসফাঁস ভাব কমে না। যে একা; সে শত মানুষের ভিড়েও একা। ফুটপাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগছে। তাই গাড়ি ডাকলো না। হাসপাতাল বেশ দূরে বাসা থেকে। যেতে আধা ঘন্টার বেশি লাগলো। সেলিম হোসেন ঘুমাচ্ছেন। রাতে নাকি এক ফোঁটাও ঘুম হয় না তার। সেলিম হোসেনের সাথে দেখা করা গেল না। শ্রাবণী বসে বসে তার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছে। পারভীন বেগমও বসে বসে ঝিমাচ্ছেন। নীলা আর তুহিন কি নিয়ে যেন খিলখিল করে হাসছে। সেলিনা চৌধুরী শ্রাবণীর পাশে এসে বসে বলল,
–‘শ্রাবণী, যাইফ কি এখনো ঘুমাচ্ছে? ওর নাকি কি জরুরী কাজ পড়েছে। দুপুরের দিকে চলে যাওয়ার কথা। কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি। রিসিভ করছে না।’

–‘যাইফ ভাই চলে গেছে।’

–‘চলে গেছে? ওকে তো আমার সাথে হাসপাতালে দেখা করে তারপর যেতে বলেছিলাম।’

শ্রাবণী গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
–‘ঘুম থেকে ওঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল তোমার ছেলের। তাই বোধ হয় হাসপাতালে আসার সময় পায়নি।’

শ্রাবণী মিথ্যা বলল। ঘুম থেকে ওঠার পরও যথেষ্ট সময় ছিলো। শ্রাবণীর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়েছে। সেলিনা চৌধুরী জিজ্ঞেস করল,
–‘কয়টার বাসে গেছে ও?’

–‘সাড়ে বারোটার।’

–‘আচ্ছা তুই দুপুরে খেয়েছিস? গরুর মাংস, ভুনা খিচুড়ি আছে টিফিন ক্যারিয়ারে। ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নে।’

–‘খেয়েছি।’
আবারো মিথ্যে বলল শ্রাবণী। খায়নি বললে সেলিনা চৌধুরী বার বার খেতে বলবে। এই মুহূর্তে শ্রাবণীর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সেলিনা চৌধুরী একের পর এক প্রশ্ন করেই চলল,
–‘পাবেল বাসায় চলে গেছে?’

শ্রাবণী অন্যমনস্কভাবে বলে,
–‘হুঁ।’

–‘ছেলেটাকে তেমন সুবিধার ঠেকে না। কেমন যেন হালচাল। তোদের ভিতর সব ঠিকঠাক চলছে তো?’

শ্রাবণী চমকে যায়। কিছুটা অপ্রস্তুত ভাব। যাইফ কি তাহলে সেলিনা চৌধুরীকে কিছু জানায়নি? না-কি সব জেনেও না জানার ভান করছে সেলিনা চৌধুরী? শ্রাবণী কি বলবে তাই নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল। দ্বিধাগ্রস্ত গলায় আমতা আমতা করে বলল,
–‘হ্যাঁ সব ঠিকঠাক চলছে।’

–‘সব ঠিকঠাক চলছে? সব ঠিকঠাক চলার তো কথা না।’

শ্রাবণী আবার চমকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সেলিনা চৌধুরী বলে,
–‘সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ের যখন উচ্চবিত্ত পরিবারে বিয়ে হয় তখন শ্বশুর বাড়িতে নানান রকমের ঝামেলা পোহাতে হয়। আমিও পোহিয়েছে ঝামেলা। প্রথম প্রথম খুব দুঃখ পেতাম, কাঁদতাম। আস্তে আস্তে শক্ত হলাম। যাইফ হলো। তারপর কিছুটা শান্তি পেয়েছি।’

এ পর্যায়ে শ্রাবণীর ধারণা হলো সেলিনা চৌধুরী সব জানে। যে ব্যাপারটা ও সবার কাছ থেকে গোপন করে; ভীষণ সুখে আছে বলে অভিনয় করে যাচ্ছে। সেই গোপন সত্যিটা সেলিনা চৌধুরী জানে। তবে তিনি সরাসরি না বলে এভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেন বলছে তা শ্রাবণীর বুঝে আসছে না। সেলিনা চৌধুরী আবার বলল,
–‘আসলে বাচ্চাকাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যায়।’

এখন কি শ্রাবণীরও উচিত বাচ্চা নেওয়া? সেলিনা চৌধুরী ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটাই বলতে চাচ্ছেন। শ্রাবণীর এসব শুনতে ভালো লাগছে না। ও মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। শ্রাবণীর ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর। জয়নাল সাহেব ফোন করেছে। অনেক দিন পর ফোন করলো। জয়নাল সাহেবকে শ্রাবণী ভালো মানুষই মনে করত।‌ কিন্তু সেদিনের পর সেই ধারণা বদলে যায়। জয়নাল সাহেব বললেন,

–‘শ্রাবণী কেমন আছো?’

–‘ভালো বাবা। আপনি কেমন আছেন?’

–‘আমার শরীরটা ক’দিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। আচ্ছা তুমি বাসায় ফিরবে কবে? তোমার বাবার সুস্থ হতে যদি আরো ছয় মাস লাগে তাহলে তুমি কি আরো ছয় মাস বাপের বাড়ি উঠে থাকবে? আমরা গ্রামে আটকে আছি। পাবেলও বাসায় থাকে না তেমন। বাসাটা একদম খালি পড়ে আছে। চোর-ডাকাতে সব লুট করে নিয়ে গেলেও দেখার কেউ নেই।’

শ্রাবণী কিছু বলল না। ওর বলতে ইচ্ছে হলো, আমি আপনাদের বাসার কেয়ারটেকার না। আমি আর আপনাদের বাসায় ফিরবো না। কিন্তু এসব বলার উপযুক্ত সময় এখন না। জয়নাল সাহেব আরো কিছুক্ষণ এসব নিয়ে অনর্থক বকবক করে ফোন রাখলো। শ্রাবণী ওসব কানে নিলো না, গায়েও মাখলো না।
সেলিম হোসেনের ঘুম ভাঙলো বিকালে। গলার স্বর ভীষণ রুগ্ন, ক্লান্ত শোনালো। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে একদম। চেহারা চেপে গেছে। দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারেন না। একটু কথা বললেই হাঁপিয়ে যান। রাতে শ্রাবণী হাসপাতালেই ছিলো। তিন দিন পর সেলিম হোসেনকে বাসায় আনা হলো। এই তিন দিনে পাবেল বেশ কয়েকবার এসেছে। শ্রাবণী স্বাভাবিক আচরণই করেছে। ওর মনে যে বিচ্ছেদের চিন্তা চলছে তা পাবেলকে বুঝতে দেয়নি একদম। সেলিম হোসেনকে যেদিন বাসায় আনা হলো সেদিনই সেলিনা চৌধুরী চলে গেলেন।
_____________
বিকাল বেলা। নীলা, তুহিন বাসার বাইরে হৈচৈ করে কানামাছি খেলছে। পারভীন বেগম ঘুমাচ্ছে। সেলিম হোসেন বারান্দার চৌকিটায় বসে আছে খেয়ালহীন ভাবে। শ্রাবণী আস্তে আস্তে গিয়ে সেলিম হোসেনের পাশে বসলো। কিছুক্ষণ নীরবে বসে থেকে বলল,
–‘বাবা আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।’

শ্রাবণীর কথার সুর ভালো ঠেকছে না। সেলিম হোসেন কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,
–‘কি কথা?’

শ্রাবণী লম্বা দম ফেলে বলল,
–‘আমি একদম হাঁপিয়ে গেছি বাবা। আমি আর পারছি না। প্রতিনিয়ত শারীরিক, মানসিক অত্যাচার করে ওই বাড়ির সবাই মিলে আমায় শেষ করে দিচ্ছে। ওরা আমায় মেরে ফেলবে।’

সেলিম হোসেন চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলে,
–‘আমি বেশিদিন বাঁচবো না। আমি মারা যাওয়ার পর তোর কি এই বাড়িতে জায়গা হবে? হবে না! আর আমি বেঁচে থাকলেও বা কি করতে পারবো তোর জন্য? আয় রোজগার কিছুই নেই আমার। তুই ডিভোর্স দিতে চাচ্ছিস পাবেলকে? ডিভোর্সের পর কি হবে সেটা ভেবেছিস? তোর কি মনে হয় ডিভোর্সের পর তুই এরচেয়ে ভালো থাকতে পারবি? আরো অনিশ্চিত হয়ে যাবে তোর জীবনটা। এখন তো মাথা গোঁজার মতন ঠাঁই আছে। তখন এই ঠাঁইটুকুও থাকবে না। যা কিছু হয় নিজেকে মানিয়ে নে। এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে।’

–‘চেষ্টা করেছি মানিয়ে নিতে। কিন্তু ধৈর্য আর কুলায় না বাবা। কখনো ঠিক হবে না।’

সেলিম হোসেন মেয়ের হাত ধরে অনুরোধ করে বলে,
–‘ডিভোর্সের চিন্তা মাথায় আনিস না মা। মানুষের দুঃখ সারাজীবন থাকে না। এক সময় ও বাড়িতেই তোর শান্তি হবে।’

শ্রাবণী উঠে চলে যায় সেলিম হোসেনের কাছ থেকে। এসব কথা তো ও শুনতে চায়নি। ও তো চেয়েছিল সেলিম হোসেন মেয়ের সমস্ত দুঃখের কথা শুনে হাহাকার করে উঠে বলবে, তোকে আর ও বাড়িতে যেতে দিবো না মা। ডিভোর্স দিয়ে দে ওই অমানুষটাকে।’
বাপের প্রতি আবারো গাঢ় অভিমান হয় শ্রাবণীর। অসুস্থ মানুষটার উপর অভিমান করে বা কি হবে? তিনিও তো নিরূপায়। তার বা কি করার আছে?
______________
রাতে পাবেল আসে‌। শ্রাবণী শুয়ে ছিলো। চোখে তদ্রা ভাব। পুরোপুরিও ঘুমোয়নি। নীলার কান্না শব্দ ভেসে আসছে পাশের রুম থেকে। সেটাও শুনতে পাচ্ছে। রুমে কারো উপস্থিতিও টের পেলো। কিন্তু চোখ মেলে তাকাতে ইচ্ছে হলো না।

–‘শ্রাবণী ঘুমাচ্ছো?’

পাবেলের গলা। শ্রাবণী চমকে ওঠে বসে। পাবেল আজ মেরুন রঙের একটা শার্ট পড়ে এসেছে। কড়া পারফিউম দিয়েছে। পারফিউমের ঘ্রাণে রুম ছেয়ে গেল। দেখতে বেশ ভালো লাগছে তাকে। পাবেলের হাতে একটা কেক। কেকের ওপর লেখা, শুভ জন্মদিন। কার জন্মদিন? টেবিলের উপর নীল রঙের একটা গিটারও রাখা। পাবেল কেকটাও টেবিলের উপর রাখলো। তারপর শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে এসে বলল,
–‘শুভ জন্মদিন শ্রাবণী।’

শ্রাবণী বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল। আজ তো ওর জন্মদিন না। ওর জন্মদিন তিন মাস আগে চলে গেছে। পাবেল গিটারটা শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–‘এটা তোমার জন্মদিনের উপহার। তুমি ভালো গান‌ করো তাই।’

–‘আপনায় কে বলেছে আজ আমার জন্মদিন? আজ তো আমার জন্মদিন না।’

শ্রাবণীর হঠাৎ মনে পড়ে আজ ছয় মে। ওর স্কুলের কাগজপত্রে জন্মদিন ছয় মে’ই দেওয়া। কিন্তু ওর জন্মদিন নয় ফেব্রুয়ারি। শ্রাবণীর স্কুলের সমস্ত কাগজপত্র ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখা। পাবেল বোধ হয় সেখান থেকেই দেখেছে। জন্মদিন‌ আজ না হোক কিন্তু পাবেল উপহার, কেক নিয়ে এভাবে হাজির হয়েছে সেই বিস্ময়ই কাটছে না শ্রাবণীর।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-২৪)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
পাবেল সামান্য বিব্রত বোধ করলো। জন্মদিনে পত্নীকে বিস্মিত করতে উপহার নিয়ে হাজির হয়ে শুনে আজ তার জন্মদিন না। অতি হাস্যকর ব্যাপার। সঙ্গে আবার শুভ জন্মদিন লিখে কেকও নিয়ে এসেছে। পাবেল বিরক্ত মুখে বলে,
–‘জন্মদিন নয় ফেব্রুয়ারি তাহলে কাগজপত্রে ছয় মে দিয়েছো কেন?’

জন্মদিন‌ কবে সে নিয়ে শ্রাবণী ভাবছে না। ওর মাথায় অন্য চিন্তা। পাবেল ওর কাগজপত্র ঘেঁটেঘুটে জন্মদিন জেনে উপহার নিয়ে এসেছে; এই নিয়ে বিস্ময়টুকুনই কাটছে না এখনো। সত্যি কি তাহলে শ্রাবণীর জন্য পাবেলের মনে আবেগ, অনুভূতি তৈরি হয়েছে? পাবেলের মতন অমন নিষ্ঠুর মানুষের হৃদয়ে এত দ্রুত শ্রাবণীর ঠাঁই হয়েছে? নাকি এসব পাবেলের মতিভ্রম? ক’দিন পর আবার সেই আগের মত হয়ে যাবে। একটা মানুষ দুইদিনের ভিতর এতখানি বদলে গেল? কর্কশ, রুক্ষ গলা ছেড়ে নরম, মোলায়েম গলায় কথা বলছে। নির্দয় হৃদয়ের মানুষটা হঠাৎ করে নমনীয় হয়ে গেল একেবারে। শ্রাবণী এসব নিয়ে নিগূঢ় ভাবনায় বুঁদ হয়ে রইল। পাবেল এখনো বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রাবণীর দিকে। বিভ্রান্ত ভাব নিয়ে বলল,
–‘কি ভাবছো এত? জন্মদিন নয় বলে কি কেকটা ফেলে দিবো?’

–‘আমি কি সেরকমটা একবারও বলেছি? আসলে আমি ভাবছি…।’

–‘কি ভাবছো?’

শ্রাবণী হাসিঠাট্টার ছলে বিদ্রুপ করে বলল,
–‘পৃথিবীতে আজকাল ভালো মানুষের সংখ্যাটা বাড়ছে বোধ হয়।’

শ্রাবণীর ইঙ্গিত পাবেল ধরতে পারে। কিন্তু ইচ্ছে করেই ও প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না। বলে,
–‘কেকটা কাটো। তারপর আমায় একটা গান শুনাও।’

শ্রাবণী আজ সবচে বেশি অবাক হয়েছে গিটারটা দেখে। পাবেল ওর কোনো ব্যাপারে একদমই মনোযোগী নয়। শ্রাবণীর ধারণা ছিলো পাবেল জানে না ও খুব ভালো গান করে। ও আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করে,
–‘আপনি কিভাবে জানেন আমি ভালো গান করি?’
–‘তুমি তো প্রায়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান করো, ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গুনগুন করো, রান্না করতে করতেও গান করো।’

পাবেল এতসব খেয়াল করে শ্রাবণীর তা অজানা। ও বিস্মিত গলায় আবার জিজ্ঞেস করে,
–‘আপনি কিভাবে জানলেন আমার ভীষণ গিটারের শখ? আপনি কি আবার মানুষের মন পড়তে জানেন নাকি?’

–‘না,আমি মানুষের মন পড়তে পারিনা। তুমি ভালো গান করো সেজন্য গিটার উপহার দিয়েছি।’

–‘কিন্তু আজ তো আমার জন্মদিন না।’

–‘আবার সেই এক কথা! এই নিয়ে কয়বার বললে কথাটা? জন্মদিন নয় বলে কি এখন এসব ফেলে দিবো?’

শ্রাবণী কেক কাটলো। যত সময় গড়াচ্ছে ততই দুর্ভাবনায় পড়ে যাচ্ছে শ্রাবণী। এই মানুষটার কাছ থেকে এত ভালো আচরণ আশাতীত। কিছুতেই ওর মন থেকে এই চিন্তা দূর হয় না। শ্রাবণী তো চেয়েছিল পাবেলের সাথে আর কখনো ওর দেখা না হোক। পথচলার সমাপ্তি, সম্পর্কের বিচ্ছেদ এখানেই ঘটুক। পাবেলের উপর ওর সেই প্রচণ্ড রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ, অভিমান কি সব হালকা হয়ে গেল? পাবেলের এই সামান্য ভালো আচরণেই ওর মন নড়বড়ে হয়ে গেল? সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় মানুষকে নিজের মন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেয়নি। মন বড়ো অবাধ্য জিনিস। শ্রাবণী এতদিন পাবেলের থেকে ওর প্রতি এমন মনোযোগ, খেয়াল, দরদ প্রত্যাশা করতো। কিন্তু সেসবের বদলে অবহেলা, অত্যাচার পেতে পেতে হাঁপিয়ে উঠেছিল। এখন আবার একটু ভালোবাসা পেয়ে সকল অভিমান, অভিযোগ ছাপিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।

শ্রাবণী বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। পাবেল ওর দুই গালে কেকের ক্রিম লাগিয়ে দিলো। শ্রাবণী কপট রাগ নিয়ে পাবেলের দিকে তাকায়। পাবেল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,
–‘তুমি এত সুন্দর কেন শ্রাবণী? তোমার এই সৌন্দর্য আমায় আজকাল ভীষণ টানে।’

–‘শুধু আমার সৌন্দর্যই আপনায় টানে? এছাড়া আর কিছু না?’

সংকোচ নিয়ে প্রশ্ন করে শ্রাবণী। পাবেল প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হাসলো। শ্রাবণী স্পষ্ট জবাব আশা করেছিল। কিছুটা আশাহত হলো। তবে দ্বিতীয় বার আবার প্রশ্নটা করলো না। শ্রাবণী জানে দ্বিতীয় বারও পাবেল শুধু হাসবে। শ্রাবণীর গালে লেগে থাকা কেকের ক্রিম পাবেল নিজেই মুছে দিলো। তারপর বলল,
–‘এবার গান শোনাও। মিষ্টি, রিনরিনে গলায়।’

শ্রাবণীর মাথায় এখন নানান চিন্তা। গান গাওয়ার মেজাজ নেই। সেলিম হোসেন যদি আজ ওকে সায় দিতো, তাহলে কি ও সত্যি সত্যি পাবেলকে ডিভোর্স দিতে পারতো? এই প্রশ্নের উত্তরটা হঠাৎ করে হারিয়ে ফেলে শ্রাবণী। এর কারণ কি হতে পারে? পাবেলের এইটুকু ভালোবাসা বা ভালো আচরণ? ও কি তাহলে ভালোবাসার কাঙাল? একটু ভালোবাসা, সহানুভূতি পেলেই সব রাগ, অভিমান ভেঙে গলে যায়। পাবেলের সমস্ত অন্যায়, অপরাধ এত সহজে ক্ষমা করে দেওয়া সমীচীন? ক্ষমা না করে বা উপায় কি? সেলিম হোসেন বলেছে, যাই হোক মানিয়ে নিতে। মানিয়ে না নিতে পারলে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারাবে। এখন তো যাইফও নেই। শ্রাবণীর ভরসার জায়গাটা আবার শূণ্য। সেদিন চলে যাওয়ার পর থেকে যাইফ একবারও ফোন দেয়নি শ্রাবণীর কাছে। শ্রাবণী নিজ থেকে দুইবার দিয়েছি। কিন্তু ধরেনি। শ্রাবণীর উপর কিসের রাগ যাইফের? শ্রাবণীও ঠিক করেছে ও আর ফোন দিবে না যাইফের কাছে। নিছকই রাগ করছে যাইফ ওর উপর। রাগ না-কি একটা ঘটনার অজুহাতে শ্রাবণীর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে কোনো কারণে তাও স্পষ্ট না।

পাবেলের অনুরোধে শ্রাবণী গান করতে রাজি হলো। পাবেল আজ হঠাৎ গান শোনার জন্য এত অনুরোধ কেন করছে, এত মরিয়া হয়ে ওঠেছে কেন কে জানে। সে গিটারটা টেবিলের উপর থেকে নিয়ে শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে দিলো। শ্রাবণী বলল,
–‘আমি গিটার বাজাতে পারিনা।’

পাবেল সামান্য আশাহত হয়ে বলল,
–‘আমি তো ভেবেছি তুমি গিটার বাজাতে পারো। গিটারের টুংটাং শব্দ তুলে সুললিত কন্ঠে গান করবে তুমি আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনবো।’

শ্রাবণী অনিচ্ছাকৃত ভাবে খালি গলায়ই গাইতে শুরু করে,
আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রেখো।
আমায় পড়বে মনে,
কাছে দূরে যেখানেই থাকো।

গান শেষ করে শ্রাবণী জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। কি সুন্দর ঝকঝকে জ্যোৎস্না রাত। পাবেল মুগ্ধ গলায় বলল,
–‘খুব সুন্দর গেয়েছো শ্রাবণী। আসলেই ভীষণ সুন্দর।’
_________________
খুব ভোরে ওঠে ব্যাগ গোছানো শুরু করে শ্রাবণী। চলে যাবে আজ পাবেলের সাথে। ভালো হোক মন্দ হোক মানিয়ে নিবে। এনিয়ে আর কখনো কিছু বলবে না সেলিম হোসেনকে। মেয়ের অভিমান সেলিম হোসেন ধরতে পারে। কিন্তু তার কিছু করার সামর্থ্য নেই। ডিভোর্সি একটা মেয়েকে সমাজের মানুষ যে কি চোখে দেখে তা তো শ্রাবণী বুঝবে না। কত কটুক্তি, অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়। এরকম নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ডিভোর্স হলে দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়া দুঃসহ কাজ। এসব চিন্তা কি শ্রাবণীর মাথায় আছে? ও শুধু ভাবে ডিভোর্স হয়ে গেলেই ও বেঁচে যাবে।

ব্যাগ, লাগেজ নিয়ে বাসার সামনে এসে দাঁড়ায় শ্রাবণী। সেলিম হোসেনও দুর্বল শরীর নিয়ে এসেছে মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিতে। পাবেল কাল নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছে। শ্রাবণী গাড়িতে ওঠে বসলো। মুখ ভার আর বিষণ্ণ তার। গাড়ি চলতে শুরু করে। শ্রাবণী বার বার পিছনে ফিরে তাকায়। সেলিম হোসেনও তাকিয়ে আছে। দ্রুত গতিতে গাড়ি চলছে। ক্রমশই সব কিছু অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিজের চিরচেনা বাসাটা, গেটের সামনে সেলিম হোসেনের দাঁড়িয়ে থাকা। কেন জানি শ্রাবণীর বুক চিরে বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই দু’জনের কেউই কোনো কথা বলছে না। দীর্ঘ সময় পর পাবেল হঠাৎ বলল,
–‘শ্রাবণী তুমি এবার আমার সাথে আসতে চাওনি তাই না?’

শ্রাবণী চমকে যায়। এ কথা পাবেল কিভাবে জানলো? পাবেলের তো জানার কথা না এসব।

–‘কি হলো শ্রাবণী? কথা বলছো না কেন? আমি যা বলেছি তা সত্যি না?’

–‘আশ্চর্য! কি বলছেন এসব? আমি কেন আপনার সাথে আসতে চাইবো না?’

পাবেল অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বলল,
–‘তোমার চেহারার অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে আমি যা বলেছি সত্য।’

শ্রাবণী দ্রুত গাড়ির আয়নার দিকে তাকায়। কই ওর চেহারার ভঙ্গি তো স্বাভাবিকই। পাবেল যা বলছে তা সত্য। কিন্তু এই সত্যিটা স্বীকার করতে ওর এত জড়িমা, সংকোচ হচ্ছে কেন?

–‘তুমি আমায় ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলে তাই না শ্রাবণী?’

পাবেল স্বাভাবিক গলায় প্রশ্নটা করলো। শ্রাবণীর চেহারায় তীব্র অপ্রস্তুত ভাব। কি উত্তর দিবে? ও চমকিত চোখে তাকিয়ে রইল। পাবেল বলল,
–‘কি হলো? উত্তর দেও।’

–‘এসব আপনার মনগড়া কথা। আমি নিরুপায়। যত যাই হোক সব আমার সহ্য করতে হবে। ডিভোর্সের কথা ভাবার সুযোগ নেই আমার।’

–‘নিরুপায় না তুমি। তোমার তো উপায় আছে। যাইফ।’

শ্রাবণী স্তব্ধ হয়ে যায় কয়েক মুহুর্তের জন্য। পাবেল হাসে। হাসিতে ক্রূর বিদ্রূপ। পাবেলের কথার বিপরীতে কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারে না শ্রাবণী। পাবেলও থেমে আছে। কিছু বলছে না। শ্রাবণীর উত্তরের অপেক্ষায় করছে। অনেকক্ষণ পর শ্রাবণী শান্ত গলায় চাপা রাগ নিয়ে বলে,
–‘যাইফ ভাইয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাকে নিয়ে ফের এসব বলবেন না। বিশ্রী লাগে শোনতে।’
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-২৫)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
গাড়ি এসে থামে বাসার গেটের সামনে। শ্রাবণী গাড়ি থেকে নামে উন্মনা চেহারা নিয়ে। পাবেল এতসব জানলো কিভাবে? এব্যাপারটা সেলিম হোসেন আর যাইফ বৈ আর কেউ জানে না। এর মানে কি দাঁড়ালো? যাইফ আর সেলিম হোসেনের ভিতর কেউ একজন পাবেলকে বলেছে। এমন বিশ্রী কাজটা করলো কিভাবে তারা? শ্রাবণীর বড়ো রাগ হয়। ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েও মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য এই বাড়িতেই আবার ফিরে আসতে হলো। এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বুঝে গেছে পাবেল। বুঝবেই বা না কেন? সহজ একটা হিসেব।‌ তিন বছরের বাচ্চাটিও বুঝবে। এখন তো পাবেল আরো সুবিধা পেয়ে গেল। যত যাই হয়ে যাক, শ্রাবণীর যাওয়ার কোথায়ও নেই; পাবেলের এই ধারণা আরো পোক্ত হলো।

শ্রাবণী ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনে পা বাড়ায়। পাবেল গাড়ি থেকে নামলো না। জরুরি কাজ আছে তার। আবার বেরুবে। একবারে বেকার মানুষ, কাজকর্মহীন। তবুও রোজ নিয়ম করে সকাল-বিকাল তার জরুরি কাজ থাকে। শ্রাবণীও কখনো মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করেনি, কিসের এত জরুরি কাজ? জানতে ইচ্ছে হয় না ওর। গেট দারোয়ান আনোয়ার মিয়া শ্রাবণীকে দেখে আন্তরিক ভঙ্গিতে বিগলিত হাসলো। সহজ-সরল চেহারা লোকটার। সামনের দুইটা দাঁত নেই। হাসলে বিদঘুটে লাগে। শ্রাবণীও সামান্য হেসে বাসার ভিতরে ঢোকে। ডাইনিং টেবিলটা দেখে মনে হচ্ছে ওটার উপর দিয়ে একটা ছোটখাটো সাইক্লোন বয়ে গেছে। গ্লাস কাত হয়ে আছে, এঁটো থালা বাসনের উপর মাছি ভনভন করছে। আরেকটা প্লেটে মাংস দিয়ে মাখা ভাতের ভিতর পানি ঢালা। দুই তিন আগের বোধ হয়। রুমের অবস্থা এরচেও খারাপ। শ্রাবণীর এখন কাজ হলো সব গোছগাছ করা। ও এঁটো বাসন গুলো হাতে নিলো ধোঁয়ার জন্য। এর ভিতর দরজা ঠেলার শব্দ হলো। শ্রাবণী ভুলে দরজা না আটকিয়ে কেবল চাপিয়ে রেখেছিল। পাবেল তো কেবল গাড়ি নিয়ে বের হলো। আবার ফিরে আসলো কেন? নাকি অন্য কেউ এসেছে? আর কে আসতে পারে? শ্রাবণী দরজার দিকে গেল। আনোয়ার মিয়া এসেছে। শ্রাবণীকে দেখে তিনি আবার হাসলেন। এই লোকটার সাথে দিনে যত বারই দেখা হবে তত বারই এভাবে হাসবে। শ্রাবণী জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–‘চাচা আপনি? কিছু দরকার?’

–‘এভাবে দরজা খোলা রাখো কেন? যে কেউ যখন তখন ঢুকে পরতে পারে। আমি তো সব সময় গেটে থাকি না।’

আনোয়ার মিয়া একদম শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে নাকি। এরপর বাপ মারা গেছে। সেজন্য আর পড়া হয়নি। শ্রাবণীর সাথে একদিন নিজের জীবনের এসব দুঃখের কথা বলেছিল আক্ষেপ করে। শ্রাবণী বলল,
–‘আটকাতে ভুলে গেছিলাম।

–‘বাসায় তুমি একা? আর কেউ নেই?’

শ্রাবণী চমকে যায়। মাথায় বিচ্ছিরি একটা চিন্তা আসে। কোনো কু মতলব নিয়ে এসেছে লোকটা? সামান্য ভীত হলো, প্রকাশ‌ করলো না। বলল,
–‘না, আর কেউ নেই।’

আনোয়ার মিয়া এসে শ্রাবণীর কাছাকাছি দাঁড়ালো,
–‘তোমার সাথে জরুরি কথা আছে শ্রাবণী।’

ফিসফিস করে সতর্ক গলায় বলল। যাতে আর কেউ শুনতে না পায়। শ্রাবণী বিচলিত হলো। কি করবে এখন? লোকটার উদ্দেশ্য এখনো পরিষ্কার না। মিছিমিছি তার সম্পর্কে মন্দ ভাবা অনুচিত। শ্রাবণী নিজের মনকে স্থির করে বলে,
–‘কি জরুরি কথা চাচা?’

আনোয়ার মিয়া বসে। শ্রাবণী আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে। আনোয়ার মিয়া শ্রাবণীকে বসতে ইঙ্গিত করে। শ্রাবণী কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বসে। আনোয়ার মিয়া ভীষণ উৎকণ্ঠা গিয়ে বলে,
–‘কথা গুলো তুমি কাউকে বলতে পারবে না মা। আমি তোমার ভালোর জন্যই তোমায় বলছি।’

আনোয়ার মিয়ার এমন উৎকণ্ঠা দেখে শ্রাবণী ব্যগ্র হয়ে বলে,
–‘না চাচা কাউকে বলবো না। আপনি বলুন।’

আনোয়ার মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
–‘তুমি তো বেশ কয়েকদিন বাসায় ছিলে না। তোমার শ্বশুর শাশুড়ি কেউই তো বাসায় না। পাবেল খালি বাসায়…।’

শ্রাবণী অস্থির গলায় বলে,
–‘খালি বাসায় কি?’

–‘ও মেয়ে নিয়ে আসতো খালি বাসায়। দুই-তিন ঘন্টা থাকতো এক সাথে।’

শ্রাবণী স্তব্ধ হয়ে রয় কিছুক্ষণ। তারপর এক গ্লাস পানি খায়। নীচু গলায় জিজ্ঞেস করে,
–‘কখন নিয়ে আসতো? দিনে নাকি রাতে?’

–‘বেশির ভাগ দিনে। দুইদিন রাতেও এনেছিল।’

–‘পুরো রাত ছিলো? নাকি দুই ঘন্টা থেকে চলে গেছে?’

–‘পুরো রাত ছিলো।’

–‘মেয়েটাকে এর আগে কখনো এই বাসায় আসতে দেখছেন? মানে আমাদের বিয়ের আগে?’

–‘এক এক সময় এক জনকে নিয়ে আসে। কয়জনের চেহারা মনে রাখবো আমি?’

শ্রাবণী বিষণ্ণ ভঙ্গিতে অস্ফুট কন্ঠে বলল,
–‘এক এক সময় এক এক জন?’

–‘হুম।’

এরপর শ্রাবণী নীরব হয়ে রইল। বিষাদভারাতুর, থমথমে মুখ। আনোয়ার মিয়াও নিঃশব্দে বসে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে আছে স্নেহের আর্দ্রতা নিয়ে। লম্বা সময় পর শ্রাবণী বলে,
–‘আর কিছু বলবেন চাচা?’

–‘না মা।’

একটু যতি দিয়ে আনোয়ার মিয়া আবার বলল,
–‘আমায় এক কাপ চা খাওয়াবে মা?’

–‘এখন আমার মন ভালো নেই চাচা। অন্যদিন খাওয়াবো। আপনি এখন আসতে পারেন।’

আনোয়ার মিয়া চলে গেলেন। যাওয়ার আগে পইপই করে বলে গেলেন,
–‘আমি যে তোমায় এসব কথা বলেছি ভুলেও যেন কেউ না জানে মা। তাহলে আমার চাকরি থাকবে না। আমার কথা ভুলেও বলো না। আমার খুব খারাপ হবে।’

শ্রাবণী আনোয়ার মিয়াকে আশ্বস্ত করে কেবল বললো,
–‘কেউ জানবে না চাচা।’

আনোয়ার মিয়া চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী দরজা আটকে দিলো। এলোমেলো পা ফেলে সোফায় গিয়ে বসে পড়লো আবার।‌ এঁটো বাসন পরিষ্কার করলো না, অগোছালো ঘরদোরও গোছালো না। শ্রাবণী কাঁদছে না, তেমন দুঃখও করছে না। শুধু আক্ষেপ করছে। এ জনমে বোধ আর হয় সুখ ছোঁয়া হলো না। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণী সোফা ছেড়ে ওঠে পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। বাসার প্রতিটা রুম, বাথরুম। দারোয়ানের কথা অনুযায়ী পাবেল দীর্ঘ সময় থেকেছে মেয়েদের নিয়ে এখানে। কোনো না কোনো চিহ্ন তো থাকবে কিংবা মেয়েদের কোনো জিনিসপত্র। তোয়ালে গুলোও শুঁকে দেখলো। লেডিস পারফিউমের গন্ধ পাওয়া যায় কি-না। পাবেলের সবগুলো শার্ট দেখলো একটা একটা করে। লিপিস্টিকের দাগ লেগে আছে কি-না শার্টে। কিছুই নেই, কোনো চিহ্নই নেই।
______________
সন্ধ্যার দিকে পাবেল আসে। বাসায় এসেই ওর মেজাজ চটে যায়। খাবার টেবিলটা পর্যন্ত পরিষ্কার করেনি শ্রাবণী। বাসায় এসে বোধ হয় কোনো কাজে হাত লাগায়নি। এমন কি রান্নাও করেনি। এই নিয়ে পাবেল কিছুক্ষণ হৈচৈ করলো। শ্রাবণী নির্লিপ্ত চেহারায় বসে রইল পাবেলের সব কথা তুচ্ছ করে। পাবেল শ্রাবণীর কাঁধে জোরে ঝাঁকি দিয়ে বলে,
–‘সমস্যা কি তোমার? মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছো কেন? কথা কানে যাচ্ছে না?’

শ্রাবণী দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। কেন মেয়ে মানুষ নিয়ে বাসায় এসেছে; এসব নিয়ে চেঁচাবে পাবেলের সাথে? নাকি বিষয়টা চেপে যাবে? শ্রাবণীর গায় সয় না আর। ও হঠাৎ বলে ওঠল,
–‘কয়েকদিন তো আমি ছিলাম না। এর ভিতর কি আপনি কোনো মেয়ে মানুষ নিয়ে বাসায় এসেছেন?’

শ্রাবণীর গলায় কোনো জড়তা নেই। ঝরঝর করে আছড়ে পড়ল কথা গুলো। পাবেলের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়লো‌। ভ্রু কুঁচকে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘কি বলছো এসব?’

–‘যা বলছি তা কি সত্যি না? আমি মেয়েদের কানের ঝুমকা পেয়েছি বিছানায়।’

ঝুমকার ব্যাপারটা মিথ্যে। সন্দেহ যেন কোনো ভাবে আনোয়ার মিয়ার দিকে না যায়। সেজন্য কৌশলে জিজ্ঞেস করলো। বেচারা গরীব লোক। তাকে সমস্যায় ফেলে লাভ নেই। পাবেল শব্দ করে হেসে বলল,
–‘কই দেখাও তো ঝুমকা।’

শ্রাবণী ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
–‘ভেঙে ফেলে দিয়েছি।’

পাবেল ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো শ্রাবণীর পাশে। শ্রাবণীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে চলে,
–‘এসব পুরোপুরি তোমার মনগড়া কথা শ্রাবণী। মেয়ে মানুষ নিয়ে বাসায় আসার মতন ঝুঁকি আমি কেন নিবো? মেয়ে মানুষ নিয়ে সময় কাটানোর কত জায়গা আছে! বাসায় কেন?’

শ্রাবণী পাল্টা প্রশ্ন করে,
–‘ফাঁকা বাসা থাকতে অন্য জায়গায় গিয়ে পয়সা খরচ করবেন কেন?’

–‘ফালতু বকবক বন্ধ করো শ্রাবণী। মেজাজ খারাপ হচ্ছে আবার।’

শ্রাবণী চিৎকার করে ওঠলো। আর কত সহ্য করবে পাবেলের এই দ্বৈত আচরণ? পাবেলের মুখে কেবল বিরক্তি ভাব।

–‘কোথায় কানের ঝুমকা? দেখাও আমায়। কোথায় ভেঙে ফেলেছো? ভাঙা টুকরো দেখাও।’

ক্রোধে গর্জন করে ওঠে পাবেল। একটু দম ফেলে আবার বলে,
–‘আমার সাথে সংসার করার ইচ্ছে নেই তোমার। তাই রোজ রোজ মনগড়া কাহিনী বানিয়ে ঝামেলার সৃষ্টি করছো। কয়েকদিন আগে বলেছো, আমি তোমায় কিডন্যাপ করিয়েছি। এখন আবার বলছো, ফাঁকা বাসায় আমি মেয়েদের নিয়ে থেকেছি।’

শ্রাবণীর চিৎকার থেমে গেল। কিডন্যাপের ব্যাপারটা এখন অবধি পরিষ্কার হলো না। কিছুই জানা যায়নি আর। শ্রাবণী এব্যাপারটা প্রায় ভুলতে বসেছিল। আজ আবার পাবেল মনে করিয়ে দিলো। আর পাবেল আজও সব অস্বীকার করছে। তার কাছে কথা ছোঁয়ানোই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একদম নিরীহ, নির্দোষ সে। এত বড়ো পাপ কাজ কেউই স্বীকার করবে না। শ্রাবণীর সব রাগ, ক্রোধ গলে দুঃখে গড়ালো। চোখ ভিজে আসছে। পাবেলের ক্রোধও শান্ত হলো। ও শ্রাবণীর হাত দুটো ধরে নরম গলায় বলল,
–‘ট্রাস্ট মি শ্রাবণী। তুমি যা ধারণা করছো সব ভুল। মায়ের কসম। কোনো কোনো মেয়ে নিয়ে বাসায় আসিনি আমি।’
(চলবে)