প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-২০+২১+২২

0
410

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-২০+২১+২২
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
পাবেল এবার শক্ত করে শ্রাবণীকে নিজের আলিঙ্গনে জড়ায়। এতটাই শক্ত যে শ্রাবণীর শ্বাসরোধ হয়ে আসে। আজ অকস্মাৎ পাবেল এমন আচরণ শুরু করেছে কেন? শ্রাবণীর মনে প্রশ্ন জাগে। শ্রাবণীর কানে মুখ ঠেকায় পাবেল। শক্ত ভাষায় গাঢ় কণ্ঠে ফিস্ ফিস্ করে বলে চলে,
–‘মোটেও ঠাট্টা করছি না শ্রাবণী। আমি সত্যি মেরে ফেলবো তোমায়। এই যে ছুরিটা দেখো। কি তীক্ষ্ণ,ধারালো।’

ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরায় শ্রাবণী। সত্যি কি ছুরি আছে পাবেলের হাতে? সামান্য কুণ্ঠিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে তাকায়। পাবেলের হাত দুটো তো শ্রাবণী কোমড় আঁকড়ে ধরে আছে। ও বোকার মত পিছনে তাকালো কেন? মস্তিষ্কটা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে বোধ হয় পাবেলের এমন উদ্ভট আচরণে। শ্রাবণী দেখে পাবেলের ডান হাতে ছুরি। পাবেল অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বলল,
–‘শ্রাবণী তোমার এখনো মনে হচ্ছে আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি? এই ধারালো ছুরিটা তোমার নরম-কোমল শরীরটা ভেদ করতে কেবল এক মুহুর্ত সময় নিবে।’

বিহ্বল বোবা হয়ে রইল শ্রাবণী। কণ্ঠরোধ হয়ে গেল মৃতকে এত কাছাকাছি দেখে। পাবেল এত শক্ত করে শ্রাবণীকে জড়িয়ে রেখেছে যে ও নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার বা পালিয়ে যাওয়ার নিছক চেষ্টা করলো না। মৃত্যু ভয়ে কাতর শ্রাবণী কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘কেন মারবেন আমায়?’
–‘যা আমার তা একান্তই আমার। আমি তা পছন্দ করি বা না করি।’
শ্রাবণী কথাটার মানে ধরতে পারলো না। ওর চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে অতি ত্রাসে। পাবেল ছুরিটা শ্রাবণীর গলায় ঠেকালো। কিন্তু আঘাতটা করলো কাঁধে। শ্রাবণী চিৎকার করতে ব্যর্থ হলো। পাবেল ওর মুখ চেপে রেখেছে। কাঁধ চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে মেঝেতে। শ্রাবণী ধরে নিয়েছিল ছুরির পরবর্তী আঘাতটা ওর গলায় করা হবে। কিন্তু না, পাবেল ওকে ছেড়ে দিলো। শ্রাবণীর নিস্তেজ হয়ে আসা হাত-পা টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে ঢলে পড়লো। পাবেলও হাঁটু গেড়ে শ্রাবণীর মুখোমুখি বসলো। ছুরিতে লেগে থাকা রক্ত টিস্যু পেপার দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে বলল,
–‘ভয় পাচ্ছো কেন এখন এত? গভীর রাতে হাজবেন্ডের পাশ থেকে উঠে ছাদে গিয়ে প্রেমিকের সাথে সময় কাটাতে ভয় করেনি? বলেছিনা যা আমার, তা একান্তই আমার। তা আমি পছন্দ করি বা না করি। তবুও তা আমারই থাকতে হবে।’
বল্লমের ঘা খাওয়া বাঘের মতন গলার রগ সব ফুলে ওঠে পাবেলের। যন্ত্রণায় কাতর শ্রাবণীর চিবুক ধরে মুখ উঁচু করে পাবেল আবার বলে,
–‘মৃত্যুর হাত থেকে আজ রেহাই দিলাম তোমায়। গলা কেটে ডোবায় ফেলে দিবো। কেউ জানতেও পারবে না। কিসের এত ঘনিষ্ঠতা যাইফের সাথে তোমার?’
চিৎকার করে ওঠে পাবেল। শ্রাবণী শব্দহীন। মাঝে মাঝে কেবল অস্ফুট আর্তনাদ‌ করে ওঠছে। ওর চারপাশটা কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসতে লাগলো। মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করছে। ক্রমশ অচেতন হয়ে ঢলে পড়তে লাগলো। কাঁধের গভীর আঘাতটা যেন হাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। শ্রাবণী ঢলে পাবেলের গায়ের উপর পড়ে যায়। রক্তে শ্রাবণীর গায়ের জামাটা ভিজে গেছে। পাবেল শ্রাবণীকে কোলে তুলে খাটে নিয়ে শুইয়ে দেয়। ভেজা একটা কাপড় দিয়ে আস্তে আস্তে রক্ত পরিষ্কার করে দেয়। হাতের কাছে ব্যান্ডেজ নেই। ক্ষতস্থান ওড়না দিয়েই বেঁধে দেয়। মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। হুঁশ ফিরছে না শ্রাবণীর। পাবেল খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসে সিগারেট ধরায়। মনটা স্থির হয়েছে ওর। শ্রাবণীর অচেতন মুখটার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে।
________________
বাইরের কোলাহল বাড়ছে। সকাল হয়। শ্রাবণী হাত নাড়াতে পারছে না যন্ত্রণায়। গায়ে জ্বর এসেছে। জ্বরের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর রাতের কথা পুনরায় মনে করে শ্রাবণীর। বুকের ভিতরটা আতঙ্কে চুপসে যায়। কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকে। কিছু কিছু সময় মানুষ বিহ্বল হয়ে যায়, কি করা উচিত বুঝতে পারে না।‌ শ্রাবণীও এখন বুঝতে পারছে না ওর কি করা উচিত। পাবেল তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হয়। নিতান্তই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এসে বসে শ্রাবণীর পাশে। শ্রাবণীর কপালে হাত দিয়ে বলে,
–‘জ্বর এসেছে গায়ে। হাত নাড়াতে পারছো না? খুব বেশি যন্ত্রণা করছে?’
শ্রাবণী নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাবেলের দিকে। রাগ, জেদ কিছু নেই শ্রাবণীর চাউনিতে। ভীষণ শান্ত, কোমল দৃষ্টি। পাবেল শ্রাবণীর একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
–‘আচ্ছা ডাক্তারের কাছে চলো।’
শ্রাবণী হ্যাঁ, না কিছু বললো না। পাবেল ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। বেশি সময় লাগলো না। অল্প কিছুক্ষণের ভিতরই আবার বাসায় ফিরলো ওরা। সকাল থেকে শ্রাবণী কোনো কথা বলছে না। পুরোপুরি নীরব। একদম কাঠের পুতুলের ন্যায় অনুভূতিশূন্য।

যাইফের ঘুম ভাঙ্গে সকাল দশটায়। রাতে সবাই বলেছিল, সকাল সকাল হাসপাতালে যাবে আবার। বাসায় কারো সাড়াশব্দ নেই। যাইফ ভেবেছে সবাই ওকে রেখে চলে গেছে। ও ব্রাশ হাতে রুম থেকে বের হয়। রুম থেকে বের হয়ে দেখে শ্রাবণী খাবার টেবিলের পাশে একটা চেয়ার‌ টেনে বসে আছে। অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে শ্রাবণীকে। পাবেল দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণীর পাশেই। যাইফ ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে শ্রাবণীর দিকে তাকায়। ওদের দিকে এগিয়ে যায়। শ্রাবণীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–‘কি হয়েছে তোর? বাসার সবাই হাসপাতালে চলে গেছে? তোরা যাবি না?’
শ্রাবণীর মুখে কোনো কথা নেই। পাবেল বলল,
–‘হ্যাঁ সবাই চলে গেছে। তোমায়ও যেতে বলেছে। শ্রাবণী অসুস্থ তাই আমরা যাইনি। শ্রাবণীর বাবা এখন আগের থেকে সুস্থ।’
যাইফের খটকা লাগলো। কোনো ঝামেলা হয়েছে বোধ হয় আবার ওদের ভিতর। পাবেলের দিকে তাকালেই যাইফের মেজাজ তেতে যায়। সাইকো কোথাকার! যাইফ আর কোনো প্রশ্ন করল না। ফ্রেশ হয়ে নিলো। ফ্রেশ হয়ে টেবিলে এসে দেখলো শ্রাবণী এখনো আগের মত বসে আছে একই ভঙ্গিতে। পাবেলও একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলে দুইটা রুটি আর আলু ভাজি পেলো। পেটে দারুণ ক্ষুধা লেগেছে। ও গোগ্রাসে গিললো। খাওয়া শেষে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলো।

যাইফ বাসা থেকে বের হওয়ার পর পাবেল এক প্রকার টেনেহিঁচড়ে শ্রাবণীকে রুমে নিয়ে গেল। বিরক্ত হচ্ছে পাবেল শ্রাবণীর একরকম আচরণে। বলল,
–‘কি হয়েছে? কথা বলছো না কেন? মুখ আটকে আছো কেন এভাবে? ষোলো বছরের একটা মেয়ে তুমি। বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর আবার পরকিয়াও করছো। রাতে আঘাতটা তোমার গলায় করা উচিত ছিলো। আমায় পাশ কাটিয়ে যাইফের সাথে কথা বলতে বলতে কি সুন্দর হাসিমুখে হেঁটে যাও। আমার চোখের সামনে যাইফকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাও। গভীর রাতে দুইজনে ছাদে সময় কাটাও। আমার হিংস্রতা সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? কি দুঃসাহস তোমার!’

পাবেল থামে। শ্রাবণীর চোখে আগুনের ফুলকি। নীরবতা ভেঙ্গে ও চাপা ক্ষোভ নিয়ে বলে,
–‘যাইফ ভাইয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি হিংস্র, জানোয়ার তা আমি অনেক আগে থেকেই জানি।’

পাবেল বিদঘুটে ভঙ্গিতে হেসে ওঠে,
–‘যাইফ ভাই? তুমি তো পাক্কা অভিনেত্রী।’

শ্রাবণীর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে এই মুহূর্তে। পাবেল বলল,
–‘তোমার এই অভিনয় দেখার সময় আমার নেই। কাজ আছে। বের হবো। রেডি হয়ে থেকো। বিকালে বাসায় যাবে।’

পাবেল চলে গেল। শ্রাবণী যাইফকে ফোন করলো। যাইফের সাহায্য দরকার ওর। যাইফ তখন হাসপাতালে। শ্রাবণীর ফোন পেয়ে বাসায় আসলো। বাসায় এসে যাইফ দেখে শ্রাবণী কেমন উদ্ভ্রান্তের মতন বসে আছে। তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে শ্রাবণী বলল,
–‘ওই লোকটা একটা সাইকো যাইফ ভাই। তার সাথে আমার আর এক ছাদের নিচে থাকা সম্ভব না। আমি ডিভোর্স দিয়ে চাই তাকে। ডিভোর্সের পর আমার কি দুর্দশা হবে তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। কিন্তু এখন আমার রেহাই দরকার, মুক্তি দরকার। আমি আর পারছি না। আমি পাগল যাবো নয়ত আত্মহত্যা করে বসবো।’

যাইফ শ্রাবণীর কথার উত্তর সাথে সাথে দিলো না। অনেকক্ষণ অরব রইল। তারপর বলল,
–‘শান্ত হ। রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। আগে মাথা ঠাণ্ডা কর।’
–‘আমার মাথা একদম ঠাণ্ডা। এটা রাগের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্ত না। লোকটা আপাদমস্তক একটা সাইকো। এত হিংস্র, এত পাষণ্ড!’

শ্রাবণীর গলা ধরে আসছে কান্নায়। যাইফ বলল,
–‘দেখ এটা অনেক বড়ো একটা সিদ্ধান্ত। মামা সুস্থ হয়ে বাসায় আসুক আগে।’

–‘আমায় বিকেলে নিতে আসবে। আমি কিছুতেই যাবো না। আমায় মেরে ফেলবে এবার।’
শ্রাবণীর মুখে চাপা আতঙ্ক। যাইফ বুঝতে পারলো কোনো একটা কারণে ওর মনে প্রচণ্ড ভয় ঢুকে গেছে। যাইফের হঠাৎ নজর পড়লো শ্রাবণীর কাঁধের দিকে। জিজ্ঞেস করল,
–‘তোর কাঁধে কি হয়েছে?’
–‘আমার কাঁধে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে।’
–‘কেন?’
কারণটা শ্রাবণী বললো না। ওর অস্বস্তি হলো তীব্র। কথাটা জানলে যাইফেরও হয়ত অস্বস্তি হবে। তাই ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে শ্রাবণী বলল,
–‘ঝগড়া হয়েছিল।’
যাইফ আশ্চর্য হয়ে গেল,
–‘ঝগড়া হয়েছে বলে এভাবে আঘাত করবে?’

শ্রাবণী আবার চুপচাপ বসে রইল। হাতটা অবশ হয়ে আছে ব্যথায়। ওষুধ খেয়েছে তবুও ব্যথা কমছে না। পাবেলকে ডিভোর্স দিবে এই সিদ্ধান্তে শ্রাবণী অনড়। এ নিয়ে আর কোনো দ্বিধা নেই। শ্রাবণীর কান্না পাচ্ছে। কিন্তু ও কাঁদছে না। ওরকম মানুষের জন্য চোখের পানি ফেলতে ইচ্ছে করছে না। যে মানুষটা শ্রাবণীকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। সেলিম হোসেন সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার অপেক্ষা এখন শুধু।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-২১)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
শ্রাবণী শুয়ে আছে। মুখটা ম্লান ওর। চোখের পরিশ্রান্ত দৃষ্টি। কানের কাছে মৃদু ভলিউমে গান চলছে ক্যাসেট প্লেয়ারে। অনেক পুরানো ক্যাসেট প্লেয়ার। সেলিম হোসেন ভীষণ যত্ন করে টিকিয়ে রেখেছে এত বছর। তার ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার শখ। এখনো শোনেন অবসরে। শ্রাবণীর গায়ের জ্বর কমেনি। ওষুধ খেতেও ইচ্ছে করছে না। শরীরের অসুখের চেয়ে মনের অসুখটা এই মুহূর্তে ওর জন্য বেশি পীড়াদায়ক। ডোরবেল বেজে চলেছে। একবার বাজিয়ে মিনিট খানেক থেমে থেকে আবার বাজাচ্ছে। এই নিয়ে সাতবার। এখন প্রায় শেষ বিকাল। দুপুরের সেই তির্যক প্রখর রোদের তেজ ফুরিয়ে এখন নিস্তেজ। বিকালে পাবেলের আসার কথা ছিলো শ্রাবণীকে নিতে। শ্রাবণী মন বলছে পাবেলই দুয়ারে দাঁড়িয়ে। ও বিছানা ছেড়ে ওঠে অনিচ্ছাকৃত ভাবে দরজার দিকে যায়। হলুদ একটা শার্ট গায়ে পাবেল দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। হলুদ শার্টে বিশ্রী লাগছে তাকে দেখতে। গায়ের রং বেশি ময়লা দেখাচ্ছে। পাবেল বিরক্ত মুখে বলে,
–‘কতক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছি। কোথায় ছিলে?’
শ্রাবণী যন্ত্রের মত জবাব দেয়,
–‘শুনিনি।’
–‘মিথ্যে বলছো। শুনেছো কিন্তু ইচ্ছে করে দরজা খুলোনি।’
একটু যতি দিয়ে আবার বলে,
–‘বাসায় একা না-কি যাইফ আছে?’
শ্রাবণীর মনের ভিতর জমে থাকা রাগটা ফার্নেসের চুল্লির মতো জ্বলে ওঠে আবার। কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করলো না। মানসিকভাবে অসুস্থ পাবেল। তাছাড়া ক’দিন পর বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। এখন না হয় তর্কবিতর্ক, রাগারাগী থাক। অসুস্থ মস্তিষ্কের একজন মানুষের সাথে বিবাদ করা মূঢ়তা বৈ কিছুই না। শ্রাবণী শান্ত গলায় বলে,
–‘যাইফ ভাই নেই। আমি একাই।’
–‘আমার জন্য এক জগ ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আসো। পানির ভিতর আবার বিষ মিশিয়ে এনো না।’
শ্রাবণী প্রত্যুত্তর করে না। নীরব পদক্ষেপে এগিয়ে যার ফ্রিজের দিকে। পানি নিয়ে আসে। ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে অর্ধেক জগ পানি খেয়ে ফেলে পাবেল। শব্দ করে জগটা টেবিলের উপর রেখে বলল,
–‘আসার পথে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তোমার বাবার অবস্থা এখন বেশ ভালো। তুমি কি আমার সাথে বাসায় যাবে এখন? বাসায় একটা পার্টি করতে চাচ্ছি বন্ধুবান্ধব সব দাওয়াত করে। বাবা-মা গ্রাম থেকে শীঘ্রই চলে আসবে। তারা আসার আগেই করতে হবে। বাবা থাকলে অনেক বিপত্তি। তিনি মদ খাওয়া, নাচানাচি একদম এলাউ করবেন না।’

ডিভোর্সের বিষয়ে শ্রাবণী এখন কিছু বলতে চাচ্ছে না পাবেলকে। সেলিম হোসেন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলে তার সাথে কথা বলে তারপর পাবেলকে বলবে। ও মনে মনে চাচ্ছে এই উন্মাদ মানুষটার সাথে এটাই ওর শেষ দেখা হোক। একটা ক্ষীণ শ্বাস ফেলে শ্রাবণী বলল,
–‘বাবা আগে পুরোপুরি সুস্থ হোক। তারপর।’
–‘বাবা তো এখন সুস্থই। আমার বন্ধুরা তোমার হাতের রান্না খাবে নাকি। তুমি না গেলে হয়?’
–‘আমি এখন যেতে পারবো না।’
পাবেল জোর করলো না।‌ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বন বনানী আচ্ছন্ন করে অমাবস্যার রাত নামে। নিথর কাল অন্ধকার চারদিকে। আকাশে মেঘ ডাকছে থেকে থেকে। মেঘের কারণে আজ পৃথিবীটা আরো বেশি অন্ধকার হয়ে ওঠেছে। জোরালো ঝড় ওঠবে বোধ হয়। পাবেল‌‌ কি বাসায় ফিরবে না? না-কি আজ রাত এখানে থাকবে? শ্রাবণী চাচ্ছে না পাবেল থাকুক। একদমই চাচ্ছে না। পাবেলের সামনে বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। শ্রাবণী উঠে বারান্দায় চলে যায়। কিছুক্ষণ পর পাবেলও বারান্দায় যায়। কি চাচ্ছে পাবেল? সে নিজেও বোধ হয় জানে না সে কি চায়। শ্রাবণীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় পাবেল। শ্রাবণীর কপালে হাত দিয়ে বলে,
–‘জ্বরে তো শরীর এখনো পুড়ে যাচ্ছে শ্রাবণী । ওষুধ খাওনি তুমি?’
গিরগিটিটা আবার রঙ বদলিয়েছে। একদম ভালো মানুষ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর আবার হয়ত রং বদলাবে। তারপর কালকে মতন গলায় ছুরি ঠেকাবে। শ্রাবণী মিথ্যে বলে কথা সংক্ষেপ করতে,
–‘খেয়েছি ওষুধ।’
–‘ঝড় হবে বোধ হয়। দেখো কি ঠাণ্ডা বাতাস। ঠাণ্ডা বাতাসের ভিতর এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে জ্বর বাড়বে।’
পাবেল শ্রাবণীর হাত ধরে রুমের ভিতর নিয়ে যায়। শ্রাবণীর ভীষণ শীত শীত লাগছে। ও গায়ে বেগুনি রঙের একটা চাদর চাপায়। ডান কাঁধে ছুরির আঘাত। হাতটা এখনো নাড়াতে পারছে না। ভার হয়ে আছে। পাবেল রুমে এসে জানালা খুলে পর্দা গুলো সামান্য সরিয়ে দেয়। তারপর শ্রাবণীকে বলে,
–‘ঝড় বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে তোমার? জানালার পাশে বসে দেখো।’
শ্রাবণীর ঝড় বৃষ্টি ভালো লাগে না, আবার মন্দও লাগে না। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে ইচ্ছে করছে। পাবেলের এই দরদি আচরণে বিচলিত হলো না শ্রাবণী। আবার কি জানি মতলব করেছে। শ্রাবণী জানালার পাশে বসে রইল। পাবেলও গিয়ে বসলো শ্রাবণী গা ঘেঁষে ঘনিষ্ঠ হয়ে। মৃদু স্বরে ডাকে,
–‘শ্রাবণী।’
–‘হুঁ।’
–‘আজ আমাকে কেমন লাগছে?’
শ্রাবণী অমনোযোগী ভাবে বলে,
–‘ভালো লাগছে।’
–‘ভালো স্বামী মনে হচ্ছে তো?’
–‘হুঁ।’
–‘তুমি আমার কথা ঠিকঠাক ভাবে কানে না নিয়েই হ্যাঁ হুঁ বলে যাচ্ছো।’
এই বলে পাবেল রুম থেকে বের হয়ে যায়। শ্রাবণী সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে। বাসায় পাবেল আর ও ছাড়া কেউ নেই। পাবেল রান্নাঘরে কি করে? শ্রাবণী আজকাল কৌতূহলশূণ্য হয়ে যাচ্ছে। ওপাশের জানালাটা দিয়ে উঁকি দিলেই পরিষ্কার দেখা যায় রান্নাঘরটা। কিন্তু হচ্ছে হলো না। কিছু সময় পরে পাবেল আসলো। হাতে দুই কাপ চা। এক কাপ শ্রাবণীর দিকে বাড়ালো। শ্রাবণীর বাঁ হাত দিয়ে কাপটা ধরলো। বিচ্ছেদ হোক আর যা হোক, লোকটা সম্ভবত এই প্রথম এত ভালো আচরণ করছে; সাদরে গ্রহণ করা উচিত। শ্রাবণী চায়ের কাপে চুমুক দিলো।

–‘কেমন চা বানাই আমি?’

–‘জ্বর মুখে ঠিক বুঝতে পারছি না।’

–‘তুমি মিথ্যে বলেছো। ওষুধ খাওনি। ওষুধ না খেলে জ্বর কমবে কিভাবে?’

শ্রাবণী কিছু বলে না। পাবেল ফের বলে,
–‘দুপুরেও সম্ভবত রান্না করোনি। না খেয়ে আছো সারাদিন। অন্যের সাথে জেদ করে নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি?’

শ্রাবণী মনে মনে চমকে ওঠে। আসলেই তো। কার সাথে জেদ করছে ও? ও এত বোকা কেন? সত্যি অস্বীকার করে শ্রাবণী বলল,
–‘শরীর অসুস্থ ভীষণ তাই রান্না করেনি। কারো সাথে জেদ করে না।’

–‘আচ্ছা বৃষ্টি একটু কমেছে বোধ হয়। আমি তোমার যাইফ ভাইয়ের মত খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াতে পারবো না। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসি। আমিও ক্ষুধার্ত।’

শ্রাবণী বাঁধা ছিলো না। বেচারা একটু ভালোবাসা দেখাচ্ছে, দেখাক না। শ্রাবণী জানে এই ভালোবাসার স্থায়ীত্ব কাল অতি কম সময়। পাবেল ছাতা নিয়ে বের হয়েছিল। যাওয়ার সময় অল্প অল্প বৃষ্টি ছিলো। কিন্তু আসার সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির ঝাপটায় আধভেজা হয়ে বাসায় ফিরেছে। এবাসায় কাপড়চোপড় যা এনেছিল তা সকাল বেলা নিয়ে গেছে। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে শার্টটা খুলে ফেললো। শ্রাবণীকে শার্টটা দেখিয়ে বলল,
–‘এই শার্টটা কেমন বলো তো? আমার গায়ে কেমন লেগেছে?’

শ্রাবণী নীরস গলায় বলে,
–‘শার্টটা বিশ্রী। আপনার গায়েও বিশ্রী লেগেছে।’

–‘অনামিকা উপহার দিয়েছিল শার্টটা। ওর পছন্দ খারাপ। আমায় যত গুলো শার্ট দিয়েছে সব গুলো হলুদ, টিয়া কিংবা লাল রঙের। এগুলো ওর পছন্দের কালার ছিলো।’

অনামিকার সাথে পাবেলের সম্পর্ক ছিলো অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে বসে। তখনকার শার্ট এখনো এত ঠিকঠাক ভাবে গায়ে লাগার কথা না। পাবেল মিথ্যে বলছে। কেন মিথ্যে বলছে কে জানে। একটু পর পাবেল হেসে আবার বলল,
–‘আমি ভেবেছি অনামিকার কথা বললে তুমি জেলাস ফিল করবে। সেজন্য মিথ্যে বললাম। আসলে শার্টটা আমায় বাবা দিয়েছে। আমার পছন্দ হয়নি তাই রাখিনি। আমাদের রুমের চাবি হারিয়ে ফেলেছি। তাই আজ বাবার আলমারি থেকে এই শার্টটা পরলাম। আচ্ছা চলো খাবো। খাবারের প্যাকেট খুলে দেখো তো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে কি-না।’

শ্রাবণী প্যাকেট খুলে দেখে ঠিকঠাক আছে খাবার। পাবেল কি খাবারে বিষ মিশিয়ে এনেছে ‌নাকি? শ্রাবণীর মনে উদ্ভট প্রশ্ন জাগে। ও ডান হাত নাড়াতে পারছে না। খাবে কিভাবে? পাবেল চট করে যেন শ্রাবণী এই চিন্তাটা ধরে ফেলল। বলল,
–‘তোমার তো ডান হাতে ব্যথা। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

শ্রাবণী মনে মনে সামান্য বিস্মিত। পাবেলের মত নেশাগ্রস্ত মানুষের মতিগতির ঠিক থাকে না। যখন যা ইচ্ছে করে। শ্রাবণী খেতে চাচ্ছে না পাবেলের হাত থেকে। অরূচি হচ্ছে সাথে অস্বস্তিও। পাবেল নিজ হাতে শ্রাবণীকে খাইয়ে দিলো। শ্রাবণী একটু খেয়ে আর খেলো না। জ্বরের কারণে মুখের স্বাদ চলে গেছে। ওষুধ খাওয়ার পর মনে হলো জ্বরটা আরো বাড়ছে। পুরো শরীর কাঁপছে। বসে থাকতে পারছে না। পাবেল শ্রাবণীকে ধরে বিছানায় নিয়ে গেল। প্রচণ্ড শীত লাগছে শ্রাবণীর। পাবেল ওর গায়ে কম্বল দিয়ে দিলো। শ্রাবণীর মাথার কাছে বসে কপালে জলপট্টি দিয়ে দিলো। প্রায় অচেতন অবস্থা শ্রাবণীর। ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় কারণে আবহাওয়া ভীষণ শীতল। পাবেলেরও শীত লাগছে। ও শ্রাবণীর শরীর ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে শ্রাবণীকে নিজের বুকের ভিতর টেনে নিলো। জ্বরের ঘোরে বেহোঁশ শ্রাবণী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো পাবেলকে। শ্রাবণীর তপ্ত নিঃশ্বাস পাবেল নিজের গায়ে মাখে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে শীতটা আরো তীব্র করে দিচ্ছে। পাবেল জানালা বন্ধ‌ করে দেয়। চুমু খায় শ্রাবণীর ষদুষ্ণ ঠোঁটে। অধরের‌ ফাল্গু ধারার অনন্ত স্রোতে ভেসে যায়।
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-২২)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
একটু বেলা করে ঘুম ভাঙে শ্রাবণীর। চোখ মেলেই প্রথমে ঘড়ির দিকে তাকায়। পৌনে দশটা বাজে। চোখে এখনো ঘুমের তৃষ্ণা। কিছুটা সুস্থ বোধ করছে। গায়ের জ্বরটা ছেড়ে দিয়েছে। হাতের ব্যথাটাও কমেছে। রুমে ড্রেসিং টেবিল নেই। দেয়ালে বড় সাইজের একটা আয়না টাঙানো আছে। পাবেল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট গায়ে দিচ্ছে। তদ্রা জড়ানো চোখে পাবেলের দিকে তাকায় শ্রাবণী। এই মুহূর্তে শ্রাবণীর চেহারা ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। গভীর দিঘির টলমলে স্বচ্ছ পানির মতন স্নিগ্ধ কিংবা শীতের কুয়াশা মোড়ানো কোনো এক ভোরের মতন স্নিগ্ধ। পাবেল হাতের কব্জিতে ঘড়ি পরতে পরতে খাটের দিকে এগিয়ে আসে। শ্রাবণী আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে উঠে বসে। পাবেলের মতলবটা এখনো পরিষ্কার না। সামান্য কৌতূহল কাজ করছে শ্রাবণীর মনে এনিয়ে। পাবেল দ্বৈত সত্ত্বার মানুষ, কেমন রহস্যময়, বোধগম্য নয় দুর্বোধ্য। কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক বরং না হওয়া যেন অস্বাভাবিক। হেঁয়ালিপূর্ণ গলায় শ্রাবণী জিজ্ঞাসা করে,
–‘হঠাৎ আবার এত ভালো আচরণের কারণ? আজ গলায় ছুরি ধরবেন নাকি আজ?’
শ্রাবণী যেন কৌতুক বলেছে। পাবেল সেরকম ভাবেই হেসে বলল,
–‘আমার হঠাৎ মনে হলো আমি তোমার সাথে খুবই খারাপ আচরণ করে ফেলেছি। আর বাসায় গিয়ে তোমায় মিস করছিলাম। তোমার রান্না মিস করছিলাম। এইটুকু বয়সে তুমি এত দারুণ রাঁধো। কাপড়ও খুব ভালো ইস্ত্রি করো। আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো কালকে আমি কোনো নেশা করিনি। কিন্তু নেশা না করে আমি থাকতে পারিনা। পাগল হয়ে যাই।’
রান্নায় না হয় ভালো হওয়া, মন্দ হওয়া ব্যাপার থাকে। কাপড় ইস্ত্রি করায়ও ভালো-মন্দ ব্যাপার আছে? কি জানি। কেমন অস্থির শোনালো পাবেলের গলা। এইটুকু বলেই চলে গেল। নেশার তেষ্টা পেয়েছে বোধ‌ হয় তার। নেশায় আসক্ত মানুষ দুইদিন ভাত না খেয়ে থাকতে কিন্তু নেশা না করে থাকতে পারে না। শ্রাবণী ওসব নিয়ে ভাবলো না। ‌বিছানা ছেড়ে ওঠে ফ্রেশ হয়। দু’দিন পর দুইজনের চলার পথ দুই দিকে বাঁক নিবে। অত ভেবে কি হবে?

শ্রাবণীর দুই ফুফু আজ চলে যাবে। সেলিনা চৌধুরী আরো কয়েকদিন থাকবেন। সেলিম হোসেন এখন মোটামুটি সুস্থ। দুই-তিন দিন পরই বাসায় নিয়ে আসবে তাকে। তাছাড়া ঘুমানোর জায়গায় স্বল্পতা। গাদাগাদি করে মেঝেতে ঘুমোতে হয়। এপাশ-ওপাশ করাও কষ্টকর। সেলিনা চৌধুরী যে বাজার সদাই করে দিয়েছিল সেগুলোও ফুরিয়ে গেছে। ওদিকে পারভীন বেগমও গজগজ করছেন। এখন আবার বাজার করার টাকা কোথায় পাবে? সব মিলে এক প্রকার রাগ করেই তারা চলে যাচ্ছেন। তারা চলে যাওয়ার পর শ্রাবণী রেডি হলো। হাসপাতালে যাবে ও। যাইফ এখনো ঘুমাচ্ছে। কাল থেকে শ্রাবণীর মনে হচ্ছে যাইফ ওকে এড়িয়ে চলছে। হঠাৎ যাইফ কেন এড়িয়ে চলছে ওকে? পাবেল কি কিছু বলেছে যাইফকে? দরজা খোলা রেখেই ঘুমাচ্ছে যাইফ। শ্রাবণী কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে যাইফকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে কেমন সংকোচ হলো। সংকোচ কাটাতে ব্যর্থ হয়ে অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। ও হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে সেটাও ভুলে গেল। হুট করে যাইফ ওকে এড়িয়ে চলছে বিষয়টা নিয়ে প্রচণ্ড বিচলিত হয়ে পড়লো। শ্রাবণী আবার কিছুক্ষণ পর যাইফের রুমের দিকে গেল। এবার আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে সরাসরি রুমের ভিতরে ঢুকে পড়লো। যাইফকে ঘুম থেকে তুলে প্রশ্ন করল,
–‘আপনি আমায় এড়িয়ে চলছেন কেন?’
এভাবে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া ঘুম ভাঙার পর; এমন প্রশ্ন শুনে যাইফ নিদ্রাচ্ছন্ন চোখে কেবল ভ্রু কুঁচকে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে রইল। মিনিট দুয়েক ওভাবে তাকিয়ে থাকার পর আবার চোখ বুজলো। শ্রাবণী আবার বলল,
–‘আমি আপনায় কিছু জিজ্ঞেস করছি যাইফ ভাই। আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন না?’
যাইফ চোখ না মেলেই বিরক্ত গলায় বলল,
–‘আরে শ্রাবণী এই সাতসকালে কোত্থেকে এলি তুই?’
–‘এখন সাতসকাল? বেলা এগারোটা বেজে গেছে।’
যাইফ এক লাফে ওঠে বসে। চোখ-মুখ থেকে ঘুম ঘুম ভাব নিমেষেই চলে গেল। চমকানো গলায় বলে,
–‘সাড়ে বারোটায় আমার বাস। সাড়ে দশটার এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম মোবাইলে। এলার্ম কি বাজেনি?’
–‘সাড়ে বারোটায় বাস। এখনো দেড় ঘন্টা বাকি। এমন তাড়াহুড়ো করছেন কেন?’
–‘ব্যাগ গোছাতে হবে। রেডি হতে হবে। বাসস্টপে যেতেও তো সময় লাগবে। আরেকটু কাজ আছে।’
–‘ফুফু তো বলল কয়েকদিন পরে যাবে।’
–‘আমার আজই যেতে হবে।’
শ্রাবণী একটু থেমে থেকে বলল,
–‘রেডি হতে, ব্যাগ গোছাতে বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না। আর বাসস্টপে যেতে দশ মিনিট লাগবে বড়োজোড়। আপনি এখন আবার আমায় এড়িয়ে যেতে তাড়াহুড়ো দেখাচ্ছেন।’
যাইফের মুখের ভঙ্গি হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেল। তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
–‘তোকে এড়িয়ে যাওয়া কি শ্রেয় নয়?’
শ্রাবণী কিছু বলার সুযোগ পেল না। যাইফ ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বের হলে শ্রাবণী জিজ্ঞেস করল,
–‘আমাকে এড়িয়ে যাওয়া কেন শ্রেয়?’
যাইফ স্থির হয়ে শ্রাবণীর মুখোমুখি বসলো। অনেকক্ষণ ধরে নীরব! কি বলবে তা মনে মনে গোছাতে লাগলো বোধ হয়। কিছু সময় পর বলতে শুরু করল,
–‘সম্পর্কে আমরা কাজিন হলেও আমাদের সাথে একদমই পরিচয়, যোগাযোগ কিছুই ছিলো না। পাঁচ বছরেও একবার এখানে আসা হতো না আমার। আম্মু বছরান্তে আসতো। তারপর সে বাসায় গিয়ে তোদের কথা বলত। তোদের ব্যাপারে আম্মুর থেকে যতটুকু শুনেছি ততটুকুই। তুই যখন ক্লাস ফাইভে পড়িস তখন তোকে দেখেছিলাম এরপর একদম বিয়ের সময় দেখা। তোর বিয়ের সময় তোর সাথে যখন দেখা হলো তুই কেমন সহজেই তোর সব দুঃখের কথা আমায় বলে ফেললি। বিষয়টা আমায় মুগ্ধ করলো। আমার সাথে তোর তেমন কোনো পরিচয় ছিলো না, চেনাজানা ছিলো না। এত স্বল্প পরিচয়ে কাউকে নিজের মনের সমস্ত কথা এভাবে বলে ফেলা যায় তোকে না দেখলে জানতাম না। তোর কথা গুলো শুনে তোর জন্য আমার ভীষণ সহানুভূতি হলো। তোর অসহায়ত্ব, একাকিত্ব, কাউকে কিছু বলতে না পারার যন্ত্রণা গুলো ওই মুহূর্তে ঠিক তোর মত করেই আমি অনুভব করলাম। আমার সেই অনুভব, সহানুভূতি থেকেই এ পর্যন্ত আমি তোকে মেন্টাল সাপোর্ট দিয়ে গেছি। ছোটবেলা থেকে অন্যায়, অত্যাচার সহ্য করতে করতে তুই কেমন পাথর হয়ে গিয়েছিলি। আমি তোকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বললাম। এসব শুধু তোর ভালোর জন্য বলেছি। এসবে আমার কোনো স্বার্থ নেই। তোর প্রতি অন্য কোনো অনুভূতি নেই আমার। তুই বলেছিলি পৃথিবীতে তোর কথা শোনার মতন কেউ নেই। আমি কেবল তোর কথা শোনার সঙ্গী হলাম।’

যাইফ থামলো। শ্রাবণী বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘অন্য কোনো অনুভূতির কথা কেন এসেছে হঠাৎ?’
–‘দেখ শ্রাবণী নাটক করবি না। তোর কাঁধে ছুরির আঘাত কেন? রাতে ছাদে আমার সাথে কথা বলেছিলি সেজন্য না?’

শ্রাবণী প্রচণ্ড চমকে তাকায়। যাইফ একটু থেমে আবার বলে,
–‘তোর হাজবেন্ড যদি তোকে ভালোবাসত, তোকে ভালো রাখতো, তোর প্রতি মনোযোগী হতো তাহলে তো তোর কোনো দুঃখ থাকতো না। আর দুঃখের আলাপ করার জন্যও মানুষ খুঁজতে হতো না।’

শ্রাবণী গলা ছলছল করছে। ও কেঁদে ফেলল,
–‘আপনি আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ যাইফ ভাই। কেবল ভালোবাসার মানুষই প্রিয় মানুষ হয় না। আগুনে দগ্ধ হয়ে ছটফট করা মানুষটার গায়ে যে এক বালতি বরফ শীতল পানি ঢেলে দেয়; সে ওই মুহূর্তে দগ্ধ হওয়া মানুষটার অতি প্রিয় হয়ে যায়। তখন প্রিয় হতে প্রেম-ভালোবাসা কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক লাগে না। আপনিও আমার সেরকম প্রিয়। আমার চারপাশের মানুষ গুলো যখন আমাকে যন্ত্রণা আর আঘাতে প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত করে তখন আপনি আমার সেই ক্ষত গুলোতে প্রলেপ দেন। আমার খানিক আরাম হয়। এমন একজন মানুষ প্রিয় হতে প্রেম, ভালোবাসা বা অন্য কোনো অনুভূতির দরকার হয় না বিশ্বাস করুন। যে মানুষটি আমায় নামে মাত্র বিয়ে করেছে। না আমায় ভালবেসেছে, না আমায় ভালো রেখেছে। আমাকে অন্য কারো সাথে দেখে সে আমায় ছুরি দিয়ে আঘাত কেন করবে?’

শ্রাবণীর চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। যাইফ ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল,
–‘তোর আর আমার ভিতরকার সম্পর্ক কি সেটা শুধু আমরা দু’জনই জানি। অন্য কেউ তো জানে না। অন্য কারো ভুল বোঝা স্বাভাবিক।’

শ্রাবণী চিৎকার করে ওঠল,
–‘আমার প্রতি যার মনে কোনো আবেগ, অনুভূতি কিচ্ছু নেই। যে নিজের মত যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। আমাকে ভুল বোঝার অধিকার তার নেই। যে আমাকে কখনো সঠিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করেনি, সে কেন আমায় ভুল বুঝবে?’

যাইফ এসে শ্রাবণীর পাশে বসলো। কোমল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘কান্না বন্ধ কর। আমার জন্য তোদের ভিতর ঝামেলা হয়েছে এটা বুঝতে পেরে আমার কেমন অপরাধ বোধ হয়েছিল সাথে অস্বস্তিও। সেজন্য আমি তোকে এড়িয়ে গেছি। আমি শুধু চাচ্ছি তুই ভালো থাক। আমার বেরুতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

–‘আপনি কি আমার সাথে আর কখনো কথা বলবেন না যাইফ ভাই?’

যাইফ হেসে বলল,
–‘বলবো না কেন? অবশ্যই বলবো।’

যাইফ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। শ্রাবণী রুমেই বসে রইল। ওর চোখ দুটো বার বার ঝাপসা হয়ে আসছে।
(চলবে)