প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
411

প্রিয় শ্রাবণী পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
চারতলা এই ভবনটা জুড়ে নিগূঢ় নৈঃশব্দ্যতা। ইলেকট্রিসিটিও চলে গেল হঠাৎ। এখন নীরবতা সঙ্গে অন্ধকার। কেবল শ্রাবণীর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সে মেঝেতে বসে আছে বিধ্বস্ত চেহারায়। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা দমকা বাতাসে তার লম্বা চুল গুলো বার বার মুখে এসে পড়ছে। অবাধ্য চুলের যন্ত্রণা। অন্যসময় হলে বিরক্ত হয়ে চুল গুলো শক্ত করে খোঁপা করে রাখত। কিন্তু আজ সেদিকে খেয়াল নেই। এত বড়ো বাড়িতে ও ছাড়া আর একটি প্রাণীও নেই, ইলেকট্রিসিটিও নেই। ওর নিশ্চয়ই ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে শ্রাবণী ভয় পাচ্ছে না। অতি দুশ্চিন্তার ভিতর থাকলে মানুষের মনে বোধ হয় ভয় কাজ করার সুযোগ পায় না। ঝকঝকে জ্যোৎস্না রাত। কয়েক খণ্ড আলো এসে মেঝেতে পড়ে। সেই আবছা আলোতে শ্রাবণীর মুখ অস্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। তার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। থেকে থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়াচ্ছে। কেন কাঁদছে ও? পাবেলের জন্য? না-কি পাবেলের কিছু হলে সেই দোষ ওর ঘাড়ে পড়বে সেই ভয়ে? কান্নার কারণ শ্রাবণী নিজেও ধরতে পারলো না। শুধু বুঝতে পারলো এই মুহূর্তে ওর কান্না করা দরকার। মন হালকা হবে। পাবেলের জন্য হয়ত মনের কোনো এক কোণে খানিক মায়া, ভালোবাসা জমেছে। যা শ্রাবণী টেরও পায়নি। মানুষের মন বিচিত্র। ভালোবাসা আর মায়ার ক্ষেত্রে সে ভালোমন্দ বাছবিচার করে না।

শ্রাবণী মেঝে থেকে ওঠে দাঁড়ায়। সাব্বির বলেছিল, পাবেলের অবস্থা খারাপ।‌ কতটা খারাপ? সে কি বাঁচবে না? শ্রাবণীর অন্তরাত্মা ভয়াবহ ভাবে কেঁপে ওঠে। কয়েক মুহুর্তের জন্য হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। অন্ধকার হাতড়ে ও নিজের রুমের দিকে যায়। ইলেকট্রিসিটি আসেনি এখনো। মোম জ্বেলে দেয়। পাবেল এক্সিডেন্ট করেছে নাকি যাইফের সাথে তার মারামারি হয়েছে? ফোনটা হাতে নিয়ে যাইফের নম্বরে ডায়েল করল। এখনো বন্ধ বলছে। সেলিনা চৌধুরীর কাছে আবার ফোন দিলো। দুই বার রিং হওয়ার পরই তিনি ফোন ধরলেন। তদ্রা জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
–‘শ্রাবণী এত রাতে ফোন দিয়েছিস কেন? কোনো বিপদাপদ হয়েছে নাকি?’

–‘যাইফ ভাইয়ের ফোন বন্ধ কেন? ভাইয়া বাসার ফিরেছে? ফিরলে তার কাছে ফোনটা দেও দ্রুত।’

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলল শ্রাবণী। গলা ভীষণ ভার আর ক্লান্ত শোনাচ্ছে। সেলিনা চৌধুরী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
–‘কি ব্যাপার বল তো? যাইফ তো কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরেছে। ওর ফোনে বোধ হয় চার্জ নেই।’

শ্রাবণী তীব্র অনুরোধ করে বলল,
–‘ফোনটা একটু যাইফ ভাইয়ের কাছে দেও।’

সেলিনা চৌধুরী বার বার জিজ্ঞেস করছেন,
–‘কি হয়েছে সেটা বল? কোনো ঝামেলা হয়েছে?’

শ্রাবণী অস্থির গলায় বলল,
–‘এত কথা জিজ্ঞেস করো না ফুফু। ফোনটা দেও দ্রুত। তুমি বুঝতে পারছো না তাকে আমার জরুরি দরকার?’

সেলিনা চৌধুরী আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। তিনি ছোট্ট করে বললেন,
–‘আচ্ছা দিচ্ছি।’

যাইফ সবে গোসল সেরে বের হয়েছে। এত রাতে সেলিনা চৌধুরীকে ফোন হাতে দেখে খানিক চমকালো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
–‘কি হয়েছে?’

–‘শ্রাবণী তোর সাথে কথা বলবে।’

যাইফ টিশার্ট গায়ে দিতে দিতে বিরক্ত মুখে বলল,
–‘ওর সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ফোন রাখো।’

ফোনের ওপাশ থেকে শ্রাবণী স্পষ্ট শুনতে পেল যাইফের কথা। ও দুঃখ পেল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। সেলিনা চৌধুরী যাইফকে চোখ গরম দিয়ে বলল,
–‘এভাবে বলছিস কেন তুই? সমস্যা কি?’

যাইফ রেগে বলল,
–‘তুমি ওর সাথে আমায় দেখা করতে বললে কেন? ও আস্ত একটা ফালতু।’

সেলিনা চৌধুরী বিস্মিত হয়ে বললেন,
–‘আশ্চর্য যাইফ! তুই এগুলো কি বলছিস?’

–‘ঠিকই বলছি। নিজের ইচ্ছায় একটা মাতাল, কাণ্ডজ্ঞানহীন, মূর্খের সাথে সংসার করছে। ওর প্রতি দরদ দেখানো বন্ধ করো তুমি। ও কারো দরদ, সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য না। ওর জন্য আজ আমাকে অপমান, অপদস্থ হতে হয়েছে। মা তুমি যদি ফের ওর সাথে যোগাযোগ করো তো খারাপ হবে। রাখো ফোন।’

সেলিনা চৌধুরী হতভম্ব। যাইফ সহজে এত রাগ করে না। ভীষণই ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। হঠাৎ কি এমন হলো? নিশ্চিত বড়ো কোনো ঝামেলা হয়েছে। শ্রাবণী নিচু স্বরে থেমে থেমে বলল,
–‘হ্যাঁ, আমি কারো দরদ সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য না। আপনারা আমার প্রতি অনেক সহানুভূতি দেখিয়েছেন সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।’

–‘শ্রাবণী কি হয়েছে বল তো? কে অপমান করেছে যাইফকে?’

–‘তোমার ছেলের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করো। আর তোমার ছেলে যদি আমার সাথে কথা বলতে না চায় তো তুমিই তাকে জিজ্ঞেস করো, সে পাবেলকে কেন মেরেছে?’

সেলিনা চৌধুরী আঁতকে ওঠলেন। যাইফ তো এরকম ধাঁচের ছেলেই না। তিনি অবিশ্বাস্য গলায় বললেন,
–‘যাইফ পাবেলকে মেরেছে? বলছিস কি এসব?’

সেলিনা চৌধুরী যাইফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–‘যাইফ, শ্রাবণী এসব কি বলছে?’

যাইফ সেলিনা চৌধুরীর হাত থেকে এবার ফোনটা নিলো। তীব্র চমকিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘আমি পাবেলকে মেরেছি? ওখানে যা হয়েছে সব মুখে মুখে। মারামারি কখন হলো? তুই মিথ্যা কেন বলছিস?’

–‘ওখানে বসে মারামারি হয়েছে তা তো আমি বলিনি। ওখান থেকে আসার পর পাবেল যখন আবার আপনার কাছে আবার গেছে তখন আপনি তাকে মেরেছেন। বাজেভাবে মেরেছেন। রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রেখেছেন। তার অবস্থা খারাপ।’

শ্রাবণীর গলায় ক্ষোভ। যাইফ বলল,
–‘পাবেলের সাথে আমার দ্বিতীয় বার আমার দেখা-ই হয়নি। মনগড়া কথাবার্তা বলিস না। পাবেলকে জিজ্ঞেস কর কি হয়েছে। ওরকম অমানুষের শত্রুর অভাব নেই। তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো সব জানতে পারবি। আমাকে কেন কল দিয়েছিস শুধু শুধু?’

–‘তাকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ আমার নেই। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম।’

–‘দ্রুত সুযোগ করে জিজ্ঞেস করে নে। নয়ত মরেটরে গেলে এই দোষ আমার ঘাড়ে পড়বে।’

যাইফ এই বলে চট করে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো। সেলিনা চৌধুরী উদগ্রীব হয়ে রইল কি হয়েছে শোনার জন্য। তিনি জিজ্ঞেস করতেই যাইফ বললেন,
–‘মা আমি তো শ্রাবণীর মতন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান না যে ওই মাতালটার অপমান হজম করবো। আমার বাপের অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, দাপট কোনটা ওদের চেয়ে কম আছে?’

সেলিনা চৌধুরী কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যাইফের গালে কষিয়ে কয়েকটা চড় মারবে,
–‘বাপের অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, দাপট আছে বলে তুই এখন অমানুষের মত আচরণ করবি? এ শিক্ষা তোকে দিয়েছি আমরা? তুই এরকম মানসিকতার কবে থেকে হলি?’

সেলিনা চৌধুরী একটু থেমে বলল,
–‘তোর কি মনে হয় পাবেলের বাপের মত তোর বাপও তোর অন্যায় প্রশ্রয় দিবে? তুই তাকে চিনিস না?’

–‘আশ্চর্য মা। আমি কি অমানুষের মত আচরণ করলাম? আমি কি অন্যায় করলাম? কেউ আমায় অপমান করবে আর আমি তাকে ছেড়ে দিবো?’

–‘হ্যাঁ তুই ছেড়ে দিবি। অপমানের জবাব দিয়ে কি তুই এখন মহৎ হয়ে গেছিস? তোর সাথে শ্রাবণী ছিলো। তোরা দুজন চিৎকার, চেঁচামেচি করেছিস আর লোকজন খারাপ ভেবেছে শ্রাবণীকে। শ্রাবণীর কথা ভেবে হলেও তোর ওখান থেকে চুপচাপ সরে আসা উচিত ছিলো।’

সেলিনা চৌধুরী একটা দম ফেললেন। আবার বললেন,
–‘তর্ক, ঝগড়া, মারামারিও লেবেল দেখে করতে হয়। পাবেলের মত একটা মাতাল, কাণ্ডজ্ঞানহীন, অসুস্থ মানসিকতার মানুষের সাথে কেন তর্কে গেলি? মানুষ তো তোকে পাবেলের মতই ভেবেছে।’

যাইফ সেলিনা চৌধুরীর দিকে এগিয়ে আসলো। তার হাত ধরে অনুতপ্ত হয়ে বলল,
–‘স্যরি মা। আমি এভাবে ভাবিনি, বুঝতে পারিনি।’

সেলিনা চৌধুরী আগের মতই শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘তোর সাথে পাবেলের দ্বিতীয় বার দেখা হয়েছিল? মারামারি হয়েছে? সত্যি বল।’

–‘সত্যি ওর সাথে আর দেখা হয়নি আমার।’

সেলিনা চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায়। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কি-না? মারামারি হলে নিশ্চয়ই দুই একটা আঘাত যাইফের গায়েও থাকবে। কিন্তু তা নেই।
–‘মা ওভাবে কি দেখছো? তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছো না? পাবেল হয়ত গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। শ্রাবণী জানেই না কিভাবে কি হয়েছে। না জেনেই আমার কাছে ফোন দিয়েছে।’

–‘আচ্ছা। শুয়ে পড়। রাত হয়েছে অনেক।’

সেলিনা চৌধুরী আলো নিভিয়ে চলে গেল।
_______________
শ্রাবণীর ঘুম হলো না। সারা রাত এপাশ ওপাশ করেছে শুধু। ওর মনটা ভয়ে চুপসে রইল। কোনো খাবার খবর আসে যদি? সাব্বিরের ফোন নম্বরটা অনেক চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারলো না। আর জয়নাল সাহেবের কাছে ফোন দেওয়ার মত অবস্থা নেই। ভোর হতে না হতেই সেলিম হোসেন এসে হাজির। রাতে শ্রাবণী তাকে আসতে বলেছিল। সেলিম হোসেন চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
–‘কোন হাসপাতালে আছে তা জানিস?’

–‘হুঁ।’

–‘তোর শ্বশুর শাশুড়ি হাসপাতালে বসে কোনো ঝামেলা করবে না তো আবার?’

–‘তো এখন কি করবো বাবা? যাবো না?’

–‘যাওয়া তো উচিত। চল।’

–‘তুমি খেয়ে এসেছো?’

–‘অত সকালে পারভীন বেগম আমার জন্য নাস্তা বানিয়েছে? এখন নাস্তা খাওয়ার দরকার নেই।’

হাসপাতালের গেটের সামনেই জয়নাল সাহেবের সাথে দেখা হয়ে যায়। তাকে খুব ব্যস্ত আর চিন্তিত দেখালো। তিনি শ্রাবণী আর সেলিম হোসেনকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে গেল। শ্রাবণী একবার ভাবলো কিছু জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সাহস হলো না। ও প্রাণপণে দোয়া করে যাচ্ছে সেলিম হোসেনকে যাতে অপমান না হতে হয়। বাপের অপমান কোনো সন্তানই সহ্য করতে পারে না। পাবেল মাথায় আঘাত পেয়েছে। কপালের কাছে থেঁতলে গেছে। দুই পায়ের মাংস থেঁতলে রক্ত বের হয়েছে ভীষণ। তবে ভাঙেনি। বুকে আঘাত পেয়েছে। কাজের মেয়ে আসমা এমন বর্ণনাই দিলো। পাবেলের সব আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে। শ্রাবণী কাউকে চিনে, কাউকে চিনে না। ফরিদা বেগমের চোখ দুটো আগুনের মত জ্বলে উঠল শ্রাবণীকে দেখে। কথা বলার মত অবস্থা নেই পাবেলের। অবস্থা থাকলেও হয়ত শ্রাবণী কথা বলার সুযোগ পেত না। কেউই গুরুত্ব দিচ্ছে না ওকে। অনেকক্ষণ করিডোরে বসে রইল। প্রায় ঘন্টা দুয়েক। সেলিম হোসেন বলল,
–‘কি করবি? বসে থাকবো?’

শ্রাবণী অন্যমনস্কভাবে বলল,
–‘জানি না কি করবো।’

–‘বাসায় যাবি? হাসপাতালে ভরা মানুষের ভিতর তোর শাশুড়ি আবার কি করে বসবে।’

সেলিম হোসেনের কথা উপেক্ষা করে শ্রাবণী বিকাল পর্যন্ত বসে রইল। ওর হাজবেন্ড অসুস্থ। যাই হোক হাসপাতালে থাকা ওর কর্তব্য‌। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরলো। আসমাও আসলো বাসায়। সেলিম হোসেন বললেন,
–‘শ্রাবণী আমি তাহলে চলে যাই? আবার আসবো।’

–‘রাতটা থাকো।’

সেলিম হোসেন থাকলো না। চলে গেল। হাসপাতালে যারা পাবেলকে দেখতে এসেছে তাদের ভিতর অনেকে রাতে ঘুমানোর জন্য বাসায় আসলো। অনেকে দূর থেকে এসেছে তাদের রাতে বাসায় ফেরা সম্ভব না। রাতটা থেকে হয়ত ভোরে চলে যাবে। আবার অনেকে আছে নিকটাত্মীয়। তারা হয়ত পাবেল সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যাবে না। ফরিদা বেগম আর জয়নাল সাহেব হাসপাতালে।তারা আসেনি। ফরিদা বেগম আসমাকে বলে দিয়েছে সবার জন্য রান্না করতে। কিন্তু আসমা বেচারি পেট ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়লো হঠাৎ। এইটুকু একটা মেয়ে পেট ব্যথা নিয়ে রান্না করবে? শ্রাবণী বলল,
–‘আসমা তুমি ঘুমোও। আমি সব কাজ করছি।’

শ্রাবণী সমস্ত কাজ করলো। রান্নাবান্না শেষে দেখল সাব্বিরও এসেছে। ও সাব্বিরকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
–‘পাবেল কি এক্সিডেন্ট করেছে নাকি কেউ মেরেছে?’

–‘এটা নিয়ে আমারও বেশ খটকা লাগছে। পাবেলকে যে অবস্থায় পেয়েছি তাতে স্পষ্ট যে এটা দূর্ঘটনা। বাইক নিয়ে পড়ে গেছে। বাইকটাও ভেঙেছে। কিন্তু পাবেল বলেছে কেউ ওকে মেরেছে। আমার তো মনে হয় মাথায় আঘাত পেয়ে হাবিজাবি বকছে।’
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৩৬)
ইসরাত জাহান তানজিলা
_____________________
মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে ভনভন করে। সাব্বির এখনো শ্রাবণীর মুখোমুখি বসে আছে। শ্রাবণী ঘন ঘন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে। মুখ বিষণ্ণ, মলিন তার। অনেকক্ষন চুপ করে থাকলো। এরপর চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল,
–‘আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত এটা এক্সিডেন্ট?’

সাব্বির দুই দণ্ড ভেবে বলল,
–‘হ্যাঁ। ও অতিরিক্ত ড্রাগ নেয়। বেপোরোয়া ভাবে গাড়ি চালায়।’

–‘তাহলে সে কেন বলল কেউ তাকে মেরেছে?’

–‘তা পাবেলই ভালো বলতে পারবে। এমনও হতে পারে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে ওর বাইকটাকে মেরে দিয়েছে। রাজনীতি করে শত্রুর অভাব নেই।’

সাব্বির একটু থেমে জিজ্ঞেস করল,
–‘আচ্ছা তোমাদের ভিতর সব ঠিকঠাক চলছে এখন?’

–‘কিরকম চলছে তা তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন। শুধু শুধু আমায় জিজ্ঞেস করছেন।’

সাব্বির সরল ভঙ্গিতে হাসলো। প্রশ্নটা শুধু শুধুই করেছে। আসলেই সে সব জানে।

–‘সাব্বির ভাইয়া সত্যি করে বলুন তো আপনার ভাইয়ের কখনো কয়টা মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে?’

–‘নিজের প্রেমের হিসেবই রাখতে পারি না। অন্যের হিসেব রাখি কিভাবে?’

শ্রাবণী বিস্মিত মুখে তাকিয়ে রইল। এরা তো সবাই-ই এক ধাঁচের। সাব্বির হেসে বলল,
–‘মজা করলাম। আমার নয় বছরের প্রেম। কয়েক মাস পরেই বিয়ে করবো।’

–‘আপনার ভাইয়ের অবস্থা এখন কেমন? কথা বলতে পারে?’

–‘তুমি তো হাসপাতালে গিয়েছিলে দেখোনি?’

–‘না।’

–‘কাল রাতে যে অবস্থায় পেয়েছি তাতে ভেবেছিলাম বাঁচবে না। এখন মোটামুটি আছে। তবে সেরে ওঠতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে।’

সাব্বির অনর্থক কথাবার্তা বলে চলছে। ওদিকে রাত অনেক হয়েছে। শ্রাবণীর ক্লান্ত লাগছে। বিশ্রাম দরকার। এলোক বোধ হয় বাচাল প্রকৃতির। হুট করে উঠে চলে গেলেও খারাপ দেখায়। সাব্বির নিজ থেকেই বলল,
–‘অনেক রাত হয়েছে। ঘুমানো উচিত। আর শ্রাবণী তোমাকে একটা কথা বলি?’

শ্রাবণী মনে মনে স্বস্তি পেল,
–‘হ্যাঁ বলুন।’

–‘পাবেল এবার সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলে তুমিও হোস্টেল ছেড়ে বাসায় চলে এসো। এখন তো ও তোমার লেখাপড়ার ব্যাপারে সাপোর্ট করছে। এখন সমস্যা কোথায়? ও এখন তোমার প্রয়োজন অনুভব করছে। বেচারাকে একটা সুযোগ তো দেওয়া উচিত তাই না?’

এসব নিয়ে শ্রাবণীর আজকাল আর কথা বলতে হয় না। তবুও বলল,
–‘সে কি সত্যিই আমার প্রয়োজন অনুভব করছে না-কি আমি তাকে ছাড়া ভালো আছি এটা দেখে হিংসা করছে? আমি তার কাছে ফিরে আসবো। আস্তে আস্তে তার প্রতি দুর্বল হয়ে যাবো তখন সে আবার বদলে যাবে। কই সে তো মেয়েদের সাথে মেলামেশা করা ছাড়েনি, সে তো নেশা করা ছাড়েনি। সবাই আমাকে তার কাছে ফিরে আসতে বলে, সুযোগ দিতে বলে। অথচ কেউ তার দোষ গুলো দেখছে না। তাকে শুধরাতে বলছে না। সবাই শুধু আমায়ই বলে যাচ্ছে। সবার চোখে আমি খারাপ। স্বামী রেখে হোস্টেলে গিয়ে থাকি।’

শ্রাবণীর গলা ভারি হয়ে আসলো। ওর চোখ দুটো ছলছল করছে। খানিক বাদেই যেন টপটপ করে জল গড়াবে। স্বল্প পরিচিত একটা মানুষের সামনে এভাবে কান্না করা লজ্জার ব্যাপার। শ্রাবণী কান্না চাপানোর চেষ্টা করে আবার বলল,
–‘আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই সমাজে স্বামী পরকিয়া করে বেড়ালেও মানুষ বউকে দোষ দেয়। বউ কেন স্বামীকে সামলে রাখতে পারলো না? এই যে আমি বাবার সাপোর্ট পেয়ে বাসা ছেড়ে হোস্টেলে গিয়ে ওঠেছি এতেই সবার চোখে খারাপ হয়ে গেলাম। যদি এই বাসায় থেকে দিনের পর দিন সমস্ত নির্যাতন সহ্য করে যেতাম। সামান্য প্রতিবাদটুকু না করতাম। তাহলেই এই সমাজের চোখে আমি ভীষণ ভালো হয়ে যেতাম। সবাই বলত, কি ধৈর্যশীল বউ। আমি সবে কলেজে পড়ি। বয়স অনেক কম হতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক বড়ো সাব্বির ভাই।’

শ্রাবণীর গলার প্রচণ্ড ক্ষোভ। সাব্বির বুঝতে পারেনি ওর কথার বিপরীতে শ্রাবণী এতসব বলবে। ও কিছুটা বিহ্বল হয়ে গেল। বলল,
–‘শ্রাবণী আমি ওঠছি তাহলে। খেয়ে ঘুমাবো। তুমি যা ভালো বুঝো তাই করো।’

শ্রাবণী হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো কেবল। সাব্বির চলে গেল তৎক্ষণাৎ। বেচারা কথা বলে সুবিধা করতে পারলো না। শ্রাবণী চোখ বুজে সোফার বসে রইল। জটিল এক গোলক ধাঁধায় আটকে গেছে ও।

সকাল হতে না হতেই বাসা জুড়ে হাউকাউ শুরু হয়। যারা যারা এসেছে প্রায় সবার সাথেই দুই একটা করে বাচ্চাকাচ্চা আছে। ফরিদা বেগম সকাল বেলা বলে পাঠিয়েছে হাসপাতালে রান্না করে দিয়ে আসতে। এরপর থেকে শ্রাবণীকে সকাল বিকাল হাসপাতালে রান্না করে নিয়ে যেতে হয়। এই নিয়ে চারদিন। এর ভিতর একদিনও পাবেলের সাথে কথা বলার কিংবা পাবেলের পাশে দুই দণ্ড বসার সুযোগ হয়নি। ফরিদা বেগম শক্ত মুখে বার বার বলেছে,
–‘পাবেলের ধারেকাছে এসো না তুমি। অনেক কষ্টে নিজের রাগ চাপিয়ে রেখেছি। আমার চাপিয়ে রাখা রাগ বাইরে বের করে আনার চেষ্টা করো না।‌ খুন করে ফেলবো আমি তোমায়। আমার একটাই সন্তান। আজ শুধু তোমার জন্য আমার ছেলের এই অবস্থা। আমি কতটা যন্ত্রণা ভোগ করছি তুমি বুঝতে পারছো?’

শ্রাবণী চুপ থাকে‌ নতমুখে। কোনো উত্তর দেয় না। আমরা কেউই কারো যন্ত্রণা বুঝতে চাই না। শ্রাবণীর বলতে ইচ্ছে করে,
–‘আপনার ছেলে নেশা করে গাড়ি চালিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে। আমার কি দোষ?’

কিন্তু বলতে পারে না। ঝামেলা বাড়াতে চায় না। ফরিদা বেগমকে ও এখন আর একদম সহ্য করতে পারেনা। দিনে দিনে তিক্ত হয়ে গেছে তার উপর। নিজের ছেলের অন্যায় তার চোখে পড়ে না। তিনি শুধু শ্রাবণীর দোষটাই দেখে। বাবা-মায়ের প্রশ্রয় পেয়েই পাবেল এরকম হয়েছে। এর জন্য দায়ী শুধু ফরিদা বেগম আর জয়নাল সাহেব।
_____________
পরন্ত বিকাল। শ্রাবণী ফ্যাকাশে মুখে হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে। প্রতিদিন এভাবে বসে থাকা ওর দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ও নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। হাসপাতালে থাকতে থাকতে ফরিদা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়লেন হঠাৎ। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাসায় যাবে। সাব্বির এবার শ্রাবণীকে হাসপাতালে থাকতে বলল। এনিয়ে শ্রাবণীর কোনো বিশেষ মতামত নেই। ও জানে ফরিদা বেগম পাবেলের পাশে ওকে থাকতে দিবে না। কারণ এর আগে ও নিজ থেকে একবার থাকার কথা বলেছিল। কিন্তু ফরিদা বেগম সোজাসুজি না করে দিলেন। এরপর আর বলেনি। সাব্বির শ্রাবণীকে ডেকে নিয়ে বলল,
–‘থেকে যাও শ্রাবণী। পাবেলের সাথে একটু কথাবার্তা বলো। তোমার শাশুড়ির ওপর রাগ করে লাভ নেই। কাকীমার স্বভাবই এরকম। পাবেল কালও তোমার কথা জিজ্ঞেস করলো। বেচারা এখনো ঠিকভাবে কথা বলতে পারছে না। পাবেলের প্রতি কি তোমার অনুভূতি নেই?’

শ্রাবণী অন্যমনস্কভাবে ভাবে বলল,
–‘জানি না।’

–‘এই যে তুমি রোজ রোজ এসে বসে থাকো। কেন আসো? কাকীমা কত কি বলে। তারপরও তো আসো।’

–‘আসা তো আমার কর্তব্য। আমার হাজবেন্ড এত অসুস্থ। আমি যদি না আসি তাহলে মানুষ তো আমায়..।’

–‘শুধু মানুষের কথার ভয়ে আর কর্তব্য পালন করতে আসো? মিথ্যা বলো না। পাবেল তোমায় থাকতে বলছে। ওর কথা রাখো দয়া করে।’

শ্রাবণী কথা রাখলো। ফরিদা বেগম আর জয়নাল সাহেব চলে গেলেন। সাব্বির শ্রাবণীর সাথে থেকে গেল। পাবেল চোখ বুজে সোজা হয়ে শুয়ে আছে। পায়ে হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ করা। শ্রাবণীর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালো। দীর্ঘ সময় শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। ম্লান, ক্লান্ত দৃষ্টি। মলিন মুখ। কেন জানি শ্রাবণীর বুকের ভিতর ধক করে উঠল। পাবেল ক্ষীণ স্বরে বলল,
–‘বসো।’

শ্রাবণী পাবেলের মাথার কাছে বসলো। কি বলবে বুঝে ওঠতে পারছে না। অনেকক্ষণ পর বলার মত কিছু একটা খুঁজে পেল,
–‘কেমন আছেন?’

হাসপাতালে বেডে এভাবে পড়ে থাকা মানুষটা নিশ্চয়ই ভালো নেই। বোকার মত প্রশ্ন করল শ্রাবণী। পাবেল কাতর গলায় বলল,
–‘আমি ভালো নেই শ্রাবণী। আমার কষ্ট হচ্ছে।‌ আমার যদি হাঁটার মত শক্তি থাকত তাহলে আমি পালিয়ে যেতাম এখান থেকে। আমি ড্রাগ না নিয়ে থাকতে পারি না। পাগল হয়ে যাই, দিশেহারা হয়ে যাই। সাব্বিরকে বললাম, বাবা-মাকে বললাম কেউ বুঝলো না। কিছু একটা করো শ্রাবণী। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি আর পারছি না। আমি আত্মহত্যা করবো।’

পাবেল অস্থির হয়ে উঠলো। উন্মাদের মত করতে লাগলো। হাত-পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলতে চাইল। শ্রাবণী কি করবে বুঝতে না পেরে সাব্বিরকে ডাকলো। বলল,
–‘উনি যা চাইছে এনে দেন।’

সাব্বির বিস্মিত হয়ে বলল,
–‘কি বলছো শ্রাবণী তুমি? তোমার মাথাটাও গেছে ওর মত? এই অবস্থায় নেশা করবে!’

–‘শুধু শুধু তাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কি?’

পাবেল বিরক্ত গলায় বলল,
–‘সাব্বির তুই এখান থেকে যা তো।’

সাব্বির কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। পাবেল শ্রাবণীকে আবার তার কাছে ডাকলো। তীব্র গলায় অনুরোধ করে বলল,
–‘আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু দিবে শ্রাবণী? আমি হাত নাড়াতে পারছি না। নয়ত তোমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকতাম অনেকক্ষণ।’

শ্রাবণীর বুকের ভিতর আবার ধক করে ওঠে। ও হ্যাঁ, না কিছু বলল না। পাবেল অনুনয় করে যাচ্ছে। শ্রাবণীর অস্বস্তি হচ্ছে, ভীষণ অস্বস্তি। ও এই অনুরোধ ঠেলতে পারলো না। জড়িয়ে ধরলো পাবেলকে। পাবেল ফিসফিস করে বলল,
–‘চুমু দিবে না?’

শ্রাবণী নিশ্চুপ। পাবেলের গলার স্বর হঠাৎ বদলে। চাপা গলায় বলল,
–‘আমি যদি সেদিন যাইফকে মারতাম তাহলে তুমি আমার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে তাই না? যাইফ যে ওর সাদা রঙের প্রাইভেট কারটা দিয়ে আমার বাইক ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। তুমি এখন ওর বিরুদ্ধে মামলা করবে না?
(চলবে)

প্রিয় শ্রাবণী (পর্ব-৩৭)
ইসরাত জাহান তানজিলা
______________________
শ্রাবণী স্তম্ভিত হয়ে গেল। পাবেলের বুক থেকে নিজের মুখখানা তুলে পরম আশ্চর্যান্বিত ভঙ্গিতে তাকালো। পাবেল কি সত্যি বলছে? কে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যা বলছে? সন্দিহান আর অবিশ্বাস্য মুখাবয়ব শ্রাবণীর। যাইফকে এতদিনে যতটুকু চিনিছে তাতে ওর মনে হচ্ছে না যাইফ এরকম একটা কুৎসিত কাজ করতে পারে। তবে যাইফ কফিশপে বসে হুট করে যেভাবে রেগে গিয়েছিল তাতে পাবেলের কথা পুরোপুরি অবিশ্বাসও করতে পারছে না। বিষয়টা সরাসরি যাইফকেই জিজ্ঞেস করা সমীচীন। কিন্তু যাইফের সেদিনের আচরণে‌ শ্রাবণী আহত হয়ে, দুঃখে পেয়েছে। তার সাথে ফের কথা বলার ইচ্ছা নেই। ও আস্ত একটা ফালতু- কথাটা শ্রাবণীর মনে বার বার নাড়া দেয়। শ্রাবণী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। পাবেল ওর দিকে তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। বলল,
–‘কি হলো শ্রাবণী? এখন তুমি কিছু বলছো না কেন?’

শ্রাবণীর সম্বিত ফিরে,
–‘আমি যাইফ ভাইকে জিজ্ঞেস করে…।’

–‘যাইফ যদি অস্বীকার করে? আচ্ছা আমার এই অবস্থা দেখে তোমার কি মোটেও খারাপ লাগছে না?’

–‘লাগছে।’

শ্রাবণী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। পাবেল চোখ বুজে। চিন্তামগ্ন চেহারা। কি যেন নিয়ে ভাবছে। একটু পর চোখ খুলে মৃদু স্বরে ডাকল,
–‘শ্রাবণী।’

শ্রাবণী নিচু গলায় আস্তে করে বলল,
–‘জি বলুন।’

–‘আমার উপর কি নিয়ে এত রাগ, অভিমান তোমার বলো তো?’

–‘আপনার উপর আমার কোনো রাগ, অভিমান নেই।’

পাবেল শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বড্ড আবেগপ্রবণ হয়ে বলে,
–‘আমি যদি তোমার জন্য সব ছেড়ে দেই..তুমি যা যা অপছন্দ করো। নেশার করার অভ্যাসটা একবারে ছাড়া যায় না। আস্তে আস্তে ছেড়ে দিবো। তাহলে কি তুমি আমার কাছে ফিরবে?’

শ্রাবণী কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। অনেকক্ষণ ভাবলো। তারপর অকপটে বলে ফেলল,
–‘আপনাকে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।’

শ্রাবণীর কথায় পাবেল বোধ হয় কষ্ট পেল। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–‘মানুষকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত। আমি চাইলে জোর করে তোমায় বাসায় আটকে রাখতে পারি। যা ইচ্ছে করতে পারি। কিন্তু আমি আর জোর করতে চাচ্ছি না। আমাদের বয়সের ব্যবধান অনেক। সেজন্য হয়ত তুমি আমায় পছন্দ করতে পারছো না। কিন্তু তোমার পাশে আমাকে বেশ ভালোই মানায়।’

পাবেলের কথার দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না শ্রাবণী। ওর মনোযোগ আটকে আছে যাইফের দিকে। সত্যি যাইফ করেছে এসব? শ্রাবণী হঠাৎ বলে ওঠল,
–‘আপনি মিথ্যা বলছেন।’

–‘কোনটা মিথ্যা?’

–‘যাইফ ভাই আপনার বাইক ধাক্কা দেয়নি।‌ তার এরকম করার কোনো কারণ নেই। আর সে সত্যি যদি এরকমটা করত তাহলে আপনি নিশ্চয়ই এভাবে চুপ করে থাকতেন না। এতদিনে তার দফারফা করে ছাড়তেন।’

পাবেল ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলল,
–‘কে বলেছে কারণ নেই? যাইফ তোমায় ভালোবাসে। এটাই সবচেয়ে বড়ো কারণ। আর তুমিও হয়ত তাকে পছন্দ করে। তোমাদের মাঝে কি চলছে আমি জানি না। তোমরা দুজন মিলে কি আমায় মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছো?’

পাবেলের এ ধরণের উদ্ভট কথা শ্রাবণীর সামান্য হাসি পেল। ও হাসলো। আনন্দ কিংবা খুশির হাসি না। হাসিতে জৌলুস নেই। বিড়বিড় করে বলল,
–‘সাব্বির ভাই বোধ হয় ঠিকই বলেছে। আপনার মাথাটা গেছে পুরোপুরি।’

–‘বিড়বিড় করে কি বলছো? গালি দিচ্ছো আমায়? আর কি যেন বলেছিলে তুমি? যাইফ একরকম করলে এতদিনে আমি ওর দফারফা করে ছাড়তাম? তোমার কি ধারণা আমি ওকে ছেড়ে দিবো? অপেক্ষা করছি শুধু। যেদিন ওর এই অবস্থা হবে সেদিনও কি তুমি এরকম নির্বিকার থাকবে? আমি জানি সেদিন তুমি চিৎকার করে কাঁদবে। কারণ তুমি তাকে…।’

–‘আমি তাকে ভালোও বাসি না। পছন্দও করি না।‌ আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই ভুলভাল বকছেন।’

–‘জীবনের চৌত্রিশটা বসন্ত পেরিয়ে এসে তোমার মত ষোলো-সতেরো বছর বয়সী মেয়ের কাছে ভুল-সঠিক শিখবো? আমি যা একবার চাই তা আদায় করেই ছাড়ি। আমার‌ প্রতি মনোযোগী হও। আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবে না তুমি।’

শক্ত গলায় কথা গুলো বলল পাবেল। এই এলেবেলে কথাবার্তা শুনতে ভালো লাগছে না শ্রাবণীর। ও কেবিন থেকে বের হয়ে যেতে চাইল। পাবেল ব্যাকুল হয়ে বলল,
–‘প্লিজ যেয়ো না। আমার একা থাকতে ভালো লাগছে না। আর কতদিন এভাবে থাকতে হবে জানি না।’

শ্রাবণী পাবেলের কথা না শুনে পা বাড়ায়।‌ পাবেল প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠে,
–‘তুমি কি চাচ্ছো হাসপাতালে বসে আমি চিৎকার করি?’

শ্রাবণী হতাশ হয়ে তাকায়। পাবেলের পাশে বসে। তার হালচাল ধরতে পারছে না।‌ কি চলছে পাবেলের মনে?
____________
এক মাস পর হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয় পাবেলকে। এই এক মাস শ্রাবণী বাসায়ই ছিলো। সামনে পরীক্ষা। হোস্টেল থেকে কিছু বই খাতা এনেছে। সুযোগ পেলে পড়ছে খানিক। শ্রাবণী সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত? নাকি সুযোগ দেওয়া উচিত আরেকবার? এসব নিয়ে ভাবতে গেলেই ওর মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায় একদম। কঠিন একটা গোলক ধাঁধায় আটকে গেছে শ্রাবণী। ও কিছুতেই বের হতে পারছে না এ গোলক ধাঁধা থেকে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পাবেল শুয়ে আছে।‌ এখন প্রায় সারাক্ষণই শুয়ে-বসে কাটায়। শ্রাবণীর কাছে এক কাপ চা চেয়েছিল। ও চা নিয়ে আসে। বেড সাইডের টেবিলটায় চায়ের কাপটা রাখে নিঃশব্দে। খাটের এক কোণে বসে পাবেলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–‘ক’দিন বাদে আমার পরীক্ষা।’

–‘হোস্টেলে চলে যেতে চাইছো তুমি?’

এই বলে পাবেল শ্রাবণীর দিকে এগিয়ে বসে কিছুটা। আচমকা জড়িয়ে ধরে শ্রাবণীকে ভীষণ শক্ত করে। এতটাই শক্ত যে ওর শ্বাসরোধ হয়ে আসে। ও ছটফট করতে থাকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য।‌ কিন্তু পেরে ওঠে না। পাবেল শ্রাবণীর কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ভারি গলায় বলে,
–‘চলে যাবে? আমার একা লাগবে ভীষণ।’

–‘ছাড়ুন।‌ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

পাবেল ছাড়ে না শ্রাবণীকে। ওর চিবুক ধরে মুখখানি উঁচু করে ঠোঁটে চুমু খায়। শ্রীবণীর মুখে কেবল বিরক্তি। এই বিরক্তির আড়ালে অন্য কোনো অনুভূতি আছে কি-না তা বুঝা যাচ্ছে না। এই লোক এত পাগলামি কেন‌ করছে? দরজার বাইরে কথার শব্দ পাওয়া গেল। কয়েক জন মিলে এগিয়ে আসছে রুমের দিকে। পাবেল শ্রাবণীকে ছেড়ে হতাশ গলায় বলল,
–‘আসার আর সময় পেলি না তোরা?’

পাবেলের বন্ধুরা এসেছে। চারজন ছেলে তিনজন মেয়ে। শ্রাবণীর মুখে অপ্রস্তুত ভাব। ও কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। পাবেলের এক বন্ধু বলল,
–‘কেন রে ভাই ডিস্টার্ব করলাম? শুনলাম হাসপাতালেও নাকি বউ নিয়ে ছিলি? সাব্বির সেদিন বলল।’

পাবেল‌ হেসে বলল,
–‘বউ পাশে থাকলে অসুখ অর্ধেক ভালো হয়ে যায়।’

সবাই আড্ডায় মজে গেল। শ্রাবণী এক ফাঁকে বের হয়ে যায় রুম থেকে। এদের কথাবার্তার ঠিক নেই। এখানে থাকলে ও অস্বস্তিতে জমে যাবে। পাবেলের বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর পাবেল শ্রাবণীকে রুমে ডেকে বলে,
–‘মেয়ে তিনটা আমার ফ্রেন্ড। বয়সে ছোট অবশ্য। তবুও‌ সম্পর্ক খুব ভালো। আবার ভেবো না আমার গার্লফ্রেন্ড। ছেড়ে দিয়েছি ওসব।’

শ্রাবণী কিছু বলল না। শুধু একটু হাসলো। তারপর ড্রসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে লাগলো। পাবেল বিছানা ছেড়ে ওঠে শ্রাবণীর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। শ্রাবণী আয়নায় পাবেলের প্রতিবিম্ব দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। পাবেল বলল,
–‘কতক্ষণ ধরে অযথা বসে আছো ড্রেসিং টেবিলের সামনে। ভয় পাচ্ছো? বিছানায় গেলে তোমায় গিলে খেয়ে ফেলবো?’

–‘না ভয় পাচ্ছি না। এমনিতেই বসে আছি। ভালো লাগছে না।’

–‘এক মাস ঠিক ভাবে ঘুমাতে পারিনি শ্রাবণী। আজকে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে খুব।’

শ্রাবণী এজন্যই এতক্ষণ বসে ছিলো। পাবেলের কাছে যেতে ইচ্ছা হয় না ওর। পাবেল শ্রাবণীর হাত ধরে টেনে উঠালো ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে। শ্রাবণী শক্ত হয়ে থাকলো।‌ পাবেল বলল,
–‘শ্রাবণী তুমি কি আমার আবেগ অনুভূতি গুলো এখনো বুঝতে পারছো না? এমন কেন করছো তুমি? রাত অনেক হয়েছে। চলো ঘুমাবে।’

দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকায় শ্রাবণী। সাড়ে বারোটা বেজেছে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। পুরো বাসা নীরব। পাবেল ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় শ্রাবণীর শরীর ঘেঁষে। ফিসফিস করে বলে,
–‘এত ছটফট কেন করছো শ্রাবণী?’

–‘আপনি মিথ্যা কেন বলেছেন?’

পাবেল জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকায়।‌ শ্রাবণী‌ বলে,
–‘যাইফ ভাই আপনার বাইক ধাক্কা দেয়নি।’

–‘তাহলে সত্যি কি? যাইফ বলেছে ও কিছু করেনি, কিছু জানে না। সেটাই সত্যি? সারাক্ষণ যাইফ, যাইফ..আমাকে ভালোলাগে না? যাইফ দেখতে সুন্দর, বয়স কম।‌ সেজন্য গলে গেছো ওর প্রতি?’

পাবেল হুংকার ছাড়লো। শ্রাবণীর মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। ও আগের মতই দৃঢ় গলায় বলল,
–‘প্রথমত যাইফ ভাই ড্রাইভিং জানে না। আর তার প্রাইভেট কারও নেই। সাদা রঙের একটা কার যাইফ ভাইয়ের বাপের ছিলো। সেটাই যাইফ ভাই মাঝে মাঝে নিয়ে বের হতো। গাড়ি ড্রাইভার চালাতো। কিন্তু মাস খানেক আগে কারটা বিক্রি করে দিয়েছে। আর এসব কথা যাইফ ভাই বলেনি। ফুফু বলেছে। আমি জানি ফুফু মিথ্যা বলেনি। তিনি কেন মিথ্যা বলবেন?’
(চলবে)