#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৬
অন্তরিক্ষ স্বচ্ছ।চারিদিকে মৃদু বাতাসের ঝাপটানি।একটু শীত শীত ভাব।শীতকাল প্রায় এসে পড়েছে।পিঠের উপর দিয়ে আঁচল টেনে সামনে আনলো প্রীতি।জানালার পর্দা গুলো মেলে দিলো।
পুরোনো কথাগুলো মনে পড়তেই বক্ষস্থললে তীব্র চিনচিনে ব্যথার নিদারুণ যন্ত্রনাময় অনুভূতি হলো।
সেদিন রাতে কান্না করেই কাটিয়ে দিলো প্রীতি।দুই তিনদিন আর কলেজেও যায়নি।আরমিন এসে দেখে গেছে প্রীতিকে।প্রথম প্রথম রূপক কল দিলে প্রীতি কথা বলতে চাইতোনা।এড়িয়ে চলতো রূপককে।রূপক যখন হাজেরা বেগমের ফোনে ফোন করে পাগল করে দিতো তখন হাজেরা বেগম এসে প্রীতিকে বকাবকি করতেন ফোন কেনো ধরেনা।
পরে প্রীতি নিজ থেকেই একদিন কল দিলো।রূপক ধরতে পারলোনা কাজে ব্যস্ত থাকায়।পরে বাসায় এসে রাতে কল দিয়েছিলো প্রীতিকে।ভিডিও কল দেওয়াতে প্রীতি লাইন কেটে দিয়ে অডিও কল দিলো।রূপক বারবার ভিডিও কল দিচ্ছে কিন্তু প্রীতি কেটে দিচ্ছে।শেষে অডিও কল রিসিভ করে রূপক উগ্রকণ্ঠে বলল,ভিডিও কল রিসিভ না করলে কল দেওয়ার দরকার নেই।এতদিন যেভাবে ছিলে কথা না বলে এখনও সেভাবেই থাকো।কোনো কথা বলতে হবেনা আমার সাথে।
প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভিডিও কল দিলো।রূপক সাথে সাথেই রিসিভ করলো।ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো এক জীর্ণশীর্ণ মলিন চেহারা।চোখ দুটো একেবারে গর্তে ঢুকে গেছে।গলার হাড়গুলো কেমন বেরিয়ে আছে।চোখমুখ ফ্যাকাশে লাগছে।থমকে গেলো রূপক।এ কোন প্রীতি?যেই প্রীতিকে বাংলাদেশে রেখে এসেছে সেই প্রীতির সাথে এর কোনো মিল নেই।যেনো সম্পুর্ণ আলাদা দুটি মানুষ
রূপককে নিজের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো প্রীতি।এজন্যই কথা বলতে চাইতোনা এতদিন।রূপক বিদেশ যাওয়ার পর থেকে সবসময় ভিডিও কলেই কথা বলতো।কখনো অডিও কলে কথা বলতে চাইতোনা।
প্রীতি আড়ষ্ট হয়ে বলল,কথা না বললে আমি লাইন কেটে দিচ্ছি।রূপক নিজেকে সংযত করে প্রীতিকে ধমকে উঠলো।
চেহারার এই হাল কেনো তোমার?ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করোনা।এমনি এমনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাও তুমি?একবার আয়নায় দাড়িয়ে এই তুমিটা আর চোখ বন্ধ করে আগের তুমিটাকে মিলিয়ে দেখো কতটা পরিবর্তন হয়েছে তোমার।
কথাটা প্রীতির খুব মনে লাগলো।একরাশ অভিমানের পাহাড় তৈরি হলো রূপকের প্রতি।অভিমান নিয়েই বলল,আমাকে ভালোলাগছেনা বলে দিলেই পারেন।চলে যাবো আমি।পছন্দমতো কাউকে বিয়ে করে নিয়ে আসবেন।
রূপক নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।ও কি বলেছে আর মেয়েটা কি বুঝেছে?কন্ঠস্বর নরম করে বলল,আমি কি একবারও বলেছি তোমাকে আমার এখন আর ভালোলাগেনা।আমি শুধু এটা বলেছি যে নিজের যত্ন নাও।আমি পাশে থাকলে এটাও তোমার করা লাগতোনা আমিই করতাম।আর আরেকটা বিয়ের কথা কেনো উঠছে?আল্লাহ আমাকে অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারিণী প্রিয়তমা দিয়েছেন।আমার আর বিয়ে করার প্রয়োজন পড়বেনা।
প্রীতির রাগ পানি হয়ে গেলেও উপরে উপরে রেগে থাকার ভান করে বলল,আপনার ইচ্ছে হলে আপনি বিয়ে করুন নয়তো যা ইচ্ছে করুন আমার কিছু যায় আসেনা।
রূপক প্রীতিকে ক্ষেপানোর জন্য বলল,সত্যিই আরেকটা বিয়ে করবো?দুজনে একসাথে থাকতে পারবে?
প্রীতি ছলছল চোখে তাকালো যা অপরপাশের মানবটি দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।রূপকের চোরা হাসি প্রীতির নজরে আসতেই মুহূর্তেই তেতে উঠলো প্রীতি।একবার শুধু সতীন নিয়ে আসুন এ বাড়িতে দুজনকেই চাপাতি দিয়ে টুকরো টুকরো করে বস্তা ভরে নদীতে ফেলবো।
রূপক ভয় পাওয়ার ভান করে শব্দ করে হেসে দিলো।
হাসি থামিয়ে নিষ্প্রভ কন্ঠে বলল,রূপকের জন্য তার প্রিয়তমা ব্যতীত অন্য নারী নিষিদ্ধ।
প্রীতি মাথা নুইয়ে ফেললো।রূপক কথা ঘুরানোর জন্য বলল,ঠিকঠাক খাবার খাবে।আর যেনো না শুনি তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছো।আমার ফোন যদি না ধরো তবে বাংলাদেশে আসলে তোমার কি হাল করবো আমি সেটা ভাবতেও পারবেনা তুমি।
প্রীতি চোখ বড় বড় করে বলল,কি করবেন মারবেন আমাকে?
রূপক মাথা নেড়ে না জানালো।নো মারামারি অনলি রোমান্স বলেই চোখ টিপ মারলো।প্রীতি লজ্জা পেয়ে ধ্যাত বলেই কল কেটে দিলো।
রূপক আবারও কল দিলো।প্রীতি ধরলোনা।আরো দুবার দিতেই তৃতীয় বারের সময় প্রীতি কল ধরলো।ভাবলো রূপককে সেদিনের সম্পুর্ন ঘটনা জানিয়ে দিবে।প্রীতি রূপককে জানিয়েছি কি জানায়নি সেটা ফারুখ বা রাজিব শেখ জানতে পারবেনা যদি রূপক বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করে।
প্রীতি রূপককে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানানোর জন্য বলল,আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।সেদিন কি হয়েছিলো সবটা আপনার জানা প্রয়োজন।
রূপক প্রীতিকে কথার মাঝপথে আটকে দিয়ে খাওয়াদাওয়া,শরীরের যত্ন নেওয়ার কথা বলে কল কেটে দিলো।তার নাকি ইমপরট্যান্ট কল এসেছে।
প্রীতি হতাশ হলোনা ভাবলো পরে বলা যাবে।
এরপরেও প্রীতি যতবার বলার চেষ্টা করেছে রূপক ততবারই এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা।
পুরোনো কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো প্রীতি।রান্নাঘরে ছুটলো সবার জন্য সন্ধ্যার চা বানাতে।
—————————————★
দিন তিনেক পর স্বপ্না আর ফারুখের বিয়ে।রাজিব শেখ বিয়ের কেনাকাটার জন্য ফারুখকে ঢাকায় পাঠালেন।ফারুখ সাথে করে এক বন্ধুকে নিয়ে গেছে।বাসে থাকাকালীন তার ফোন বেজে উঠলো।রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে রূপক শুভেচ্ছা জানালো।ফারুখ দুর্বোধ্য হাসলো।
রূপক জিজ্ঞেস করলো গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে,কোথাও যাচ্ছো নাকি?
উত্তরে ফারুখ মুচকি হেসে বলল,বিয়ের কেনাকাটার জন্য ঢাকাতে যাচ্ছি।
রূপক হেসে উঠে বলল,বেশ ভালো।নতুন জীবন সুখের হোক তোমাদের।
ফারুখ আবারও হাসলো।বলল,তুমিও আমার বোনের খেয়াল রেখো,আগলে রেখো।অবুঝ কিনা?
রূপক ফারুখকে আশ্বস্ত করে বলল,আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে সেইফ থাকবে।
কথোপকথন শেষ করে রূপক বাসার উদ্দেশ্যে হাটা ধরলো।প্রীতির জন্য আর মায়ের জন্য কিছু জিনিস কেনাকাটা করেছে।বিয়ের রাতে প্রীতিকে কিছুই দেওয়া হয়নি।পরেরদিন একটা রিং দিয়েছিলো যেটা প্রীতির আঙ্গুলের মাপের চেয়ে বড়।
এখন দুইজোড়া স্বর্ণের চুড়ি কিনেছে।একজোড়া মায়ের জন্য আরেক জোড়া প্রীতির জন্য।আকাশি আর সাদার মিশ্রণের একটা পাতলা শাড়ি ও নিয়েছে প্রীতির জন্য।যেটা শুধু মাত্র তার সামনেই পড়বে প্রীতি।কথাটা ভেবেই মুচকি হাসলো রূপক।
ফারুখের সাথে রূপকের সম্পর্ক দেশে থাকতেই ভালো হয়েছে।প্রথম দিকে রূপক ফারুখকে তেমন একটা পছন্দ করতোনা।পরে দুজনের মধ্যে এমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে যে এখন একে অপরকে তুমি বলে সম্বোধন করে।
রূপক যেদিন মেয়েগুলোকে উদ্ধার করেছে সেদিন ওর বারবার মনে হয়েছে চারজনের মাঝে একজন ওদেরকে সাহায্য করছে।যে সাহায্য করেছিলো তার পায়ে সেদিন একটা গুলি লাগে।পরেরদিন প্রীতি রাগ করে বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ায় রূপক যখন তাকে আনতে যায় সেদিন ফারুখের পায়েও একই রকম গুলি লাগার ক্ষত দেখতে পায়।
রূপকের সন্দেহ গভীর হয়।তখন কিছু না বলে প্রীতিকে মানাতেই ব্যস্ত ছিলো।সেদিন রাতে তরুণকে বিদায় দিয়ে রূপক ফারুখকে ফোন করে দেখা করতে বলল।প্রথমে ফারুখ হকচকিয়ে গেলেও পরোক্ষণে রূপকের সাথে দেখা করতে চলে আসে।
গভীর রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রূপক যখন ফারুখের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো ওর পায়ের এই ক্ষতটা কিভাবে হয়েছে?তখন ফারুখ আমতা আমতা করে বলল,কেটে গেছে।আর তুমি এত রাতে আমাকে এইকথা জিজ্ঞেস করতে ডেকে এনেছো?
রূপক তাচ্ছিল্য হেসে বলল,পুলিশকে শিখাচ্ছেন কোনটা কাটার ক্ষত আর কোনটা গুলি লাগার?
ফারুখ আর বাড়াবাড়ি করলোনা।কিছুক্ষণ চুপ থেকে লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,কি জানতে চাও বলো।
রূপক তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,নারী পাচারের সাথে কতদিন যাবত জড়িত আছেন?বাকি তিনজন কারা?কি নাম তাদের?
ফারুখ ধীরে সুস্থে সব বলতে লাগলো।
সেদিন ওখানে চারজনের মধ্যে আমি,রাজিব শেখ,রকি,আর যার মাধ্যমে মেয়েগুলোকে বিদেশে নিয়ে ব্যবসা করা হবে মানে যার কাছে বিক্রি করা হবে সে ছিলো।মিরন হায়দার।
রূপক বিস্মিত হলো সবার নাম শুনে।রকির কথা তরুণ জানালেও এতদিন সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলো।আজ রাজিব শেখের কথা শুলে বেশি অবাক হলো।
ফারুখ আবারও বলা শুরু করলো,রাজিব শেখের কিসের ব্যবসা ছিলো সেসবে আমার কোনো কালেই আগ্রহ ছিলোনা।প্রথমে পড়ালেখা পরবর্তীতে নিজের সহপাঠীদের নিয়ে আড্ডা দেওয়া এসবই চলছিলো আমার।উনি কখনো আমাকে ব্যবসার হাল ধরার কথাও বলেননি।গ্রামে একে একে মেয়েগুলো সব উধাও হয়ে যাচ্ছে অথচ কেউ এর হদিস পাচ্ছেনা।
একদিন রাজিব শেখকে আমি ফোনে কথা বলতে শুনে ফেলি।যা ছিলো নারী পাচার সম্পর্কিত।সেদিন জেনে গিয়েছিলাম উনার অপকর্মের কথা।তার কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছি যে তার পথের কাঁটা হবে তাকে উপড়ে ফেলতে দুবার ভাববেনা।তাই আমি সেদিন উনার মুখোমুখি হই।কৌশলে তার ব্যবসায় ঢুকি।উনি আমাকে প্রথমে ব্যবসায় নিতে নারাজ ছিলেন।বললেন,তোমার এখন আনন্দ করার বয়স তুমি এসবে এখন মাথা ঘামিওনা।আমি যে তার নারী পাচারের ব্যবসার কথা জেনে গিয়েছি সেটা বলে তাকে ব্ল্যাকমেইল করলাম।বললাম,আমিতো অন্যকিছু চাইনা।শুধু আপনার ব্যবসায় আমিও সামিল হতে চাই।আমাকে না নিলে সব ফাঁস হয়ে যাবে সেটা নিশ্চয়ই ভালো হবেনা।সেদিন উপায় না পেয়ে আমাকেও উনার সাথে জড়িত করেন।দিনদিন আমি নিজের কাজ দ্বারা উনার বিশ্বস্ত হয়ে উঠি।আমার লক্ষ্য ছিলো ওদের সাথে থেকে মেয়েগুলোকে রক্ষা করা।ওদের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ জোগার করা।তারপর সেগুলো পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা।তাই গতকাল রাতে আমি আড়ালে তোমাদেরকে সাহায্য করেছি।যাতে মেয়েগুলোকে মুক্ত করতে পারো।
রূপক সন্দিহান কন্ঠে বলল,আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো আপনি সব সত্যি বলছেন?
ফারুখ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,তুমি বুদ্ধিমান তাই বাকিটা আর বলার প্রয়োজন মনে করলাম না।তুমি নিজেই সব বুঝো।রূপক প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বলল,কিন্তু রাজিব শেখকে বাবা না বলে বারবার রাজিব শেখ বলে সম্বোধন করার কারণ কি?
ফারুখ বলল,সেটাও জানতে পারবে কোন একদিন।
প্রীতির কিডন্যাপ হওয়ার পরে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে রূপকের সাথে সেদিন ফারুখই কথা বলেছিলো।সেদিনের সম্পুর্ন ঘটনা রূপকের জানা আছে।তাই বারবার প্রীতি বলতে চাইলেও ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়।যাতে এসব বলতে গিয়ে প্রীতি আরো ভেঙে না পড়ে।
#চলবে………….
(ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।হ্যাপি রিডিং।)