প্রিয় হতে প্রিয়তর পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0
808

#প্রিয়_হতে_প্রিয়তর
#অন্তিম_পর্ব
#লেখিকাঃতাসনিম

জাহরা ফাহিমের রিসিপশন দুদিন পরে আয়োজন করা হলো যেন ফারাহ সেখানে উপস্থিত থাকতে পারে।অনেক হৈ হুল্লোড়ে ঝাঁক জমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠান শেষ হয়।রিসিপশনে লিজার বাবা মা উপস্থিত থাকায় নীল ও লিজার এঙ্গেজম্যান্টের তারিখ ঠিক করে ফেলে।

কিছুদিন পর নীল ও লিজারও বিয়ে হয়ে যায়।সবাই অনেক হাসিখুশি জীবন-যাপন করতে থাকে।কিন্তু এই ভালো সময়ের মধ্যেই হঠাৎ আবার জুবায়ের সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন,তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হলেও কোনো লাভ হয় না,সে এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে বহুদূরে চলে যায়।তখন জাবির তার মাকে আর মেহেরপুরের সে বাসায় একা থাকতে দেয়নি।

বহুবছর পর………….

জাহরা আর ফাহিমের দুই মেয়ে,তাদেরও পড়ালেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে,চার সদস্যের সুন্দর পরিবার তাদের।জাহরা আর এখন ফাহিমকে বুড়ো বলে খেপিয়ে দেয় না,বরং দুজন দুজনকে প্রচুর ভালোবাসে,কোনো ভেদাভেদ নেই তাদের মাঝে আছে শুধু ভালোবাসা।

লিজা আর নীল তাদেরকে নিয়ে একটু না বললেই নয়,ঝগড়া দিয়ে লিজা সম্পর্ক শুরু করলেও এখন নীল ছাড়া সে একপ্রকার অন্ধ বললেই চলে,তাদের একটি ছেলে,তারপর লিজা অসুস্থ হয়ে পড়লে ডক্টর বলেন সে আর বেবি নিতে পারবে না,তাই একজনকে নিয়েই নীল আর লিজার দাম্পত্য জীবন।

অস্ট্রেলিয়ায় অনেক বছর থাকার পর শাহিন দেশে ফিরে আসে,তখন তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, জাবিরের কাছে তাকে একবার ক্ষমা চাইতে হবে,প্রথমদিন সে যে ব্যবহারটা করেছিল সেটা ঠিক ছিল না,ফারাহ হয়তো কোনোদিন ক্ষমা করবে না,জাবিরের কাছে অন্তত ক্ষমা চেয়ে সে যদি ক্ষমা করে,তাহলে অন্তত নিজের প্রতি রাগটা কিছুটা হলেও কমবে,জাবিরের সাথে শাহিন যোগাযোগ করলে সে তাকে তাদের বাসায় ইনভাইট করে,তারপর সেখানে তার একসাথে কথাবার্তা বলে সবকিছু ঠিক করে নেয়,তারপর ফারীন আর জাওয়াদের জন্য রাখা গিফট টা শাহিন দিয়ে ওদের বলে যায় সে আবার অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে,সেখানেই সেটেল্ড শাহিন।

এখন অনেকে চলে গেছে বহুদূরে,আবার অনেক নতুন সদস্য এসেছে পরিবারে।আজ জাবির আর ফারাহর ছেলে জাওয়াদের বিয়ে ছিল,একবছর আগে ফারীনের বিয়ে হয়ে গেছে, এখন জাবির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর ঢাকা থাকবে না সে তার মেহেরপুরেই ফিরে যাবে,তার সকল দায়িত্ব-কর্তব্য আজ শেষ হয়েছে, এখন সে শুধু তার সহধর্মিণীর সাথে কোনো চিন্তা ছাড়া বাকি জীবন যাপন করবে।

কিছুদিনের মধ্যে জাবির আর ফারাহ মেহেরপুর চলে আসে।আসার আগে বাসাটা পরিস্কার করে রাখার জন্য বলে ছিল জাবির।অনেকদিন পর এখানে এসে ফারাহ চারদিকটা ঘুরে দেখছিল।এ বাসায় যতবারই আসে মনে হয় কোনো শান্তির জায়গায় চলে এসেছি।ওদের মেহেরপুর আসতে আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছিল, তাই তারা ডিনার করে,জাবিরের রুমে গেল।সেখানে গিয়ে জাবির ফারাহকে নিয়ে বারান্দায় গেল,দোলনাটাকে মেরামত করতে বলেছিল জাবির।সেখানে দুজন বসলো।জাবির ফারাহর হাতে হাত রেখে বললো,

“আজ আবার পূর্ণিমা, যেদিন তুমি প্রথম আমাকে বিয়ে করে এ বাসায় এসেছিলে সেদিনও পূর্ণিমা ছিল,এতোগুলো বছরে কতকিছু বদলে গেছে”

“হুমম,তুমি একজনের ছেলে থেকে বাবা হয়েছো,এখন বাবা থেকে শশুরও হয়ে গেছো অনেক কিছু বদলে গেছে ”

“এহহ,এমন করে বলছো যেন আমি একলাই বাবা,শশুর হয়ে গেছি,তুমি এখনো যুবতি রয়ে গেছো”

“তোমার চোখে তো আমি এখনো সেই যুবতি ফারাহই আছি,তাই না”

“হুমম তা ঠিক,একটা হুট করে নেয়া ডিসিশন আমাদের জীবনটাকে অন্যরকম করে দিয়েছে, সবাই বলে তাড়াহুড়োয় কোনো কাজ করা ভালো নয়,তবে তোমাকে হুট করে বিয়ে করাটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজ,যার কারণে আজ আমি একজন সফল ছেলে,স্বামী,বাবা হতে পেরেছি যদি সেদিন তুমি আমাকে সুইসাইড করা থেকে না আটকাতে তবে হয়তো আমার জীবনের পরিসর এতো বড় হতোই না, কবে আকাশের তারা হয়ে যেতাম”

“হুমমম,একটা সিক্রেট বলবো তোমাকে”

“হ্যা,আমাকে বলবে না তো কাকে বলবে”

“তোমাকে যেদিন আমি প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল, আর বিয়ের পর যখন তুমি বলতে পরিস্থিতির চাপে বিয়েটা করতে হয়েছে আমাদের তখন আমার বলতে ইচ্ছে করতো না আমি তোমাকে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছি,কারণ বিয়ের আগেই তুমি আমার প্রিয় ছিলে”

“আর এখন ‘প্রিয় হতে প্রিয়তর’ হয়ে গেছি তাইতো”

“হুমম তাই,ইউ নো জাবির তুমি অনেক বেশিই ভালো,শাহিনের রিজেকশনের পর যখন আমি লন্ডন ছিলাম এবং বাংলাদেশে আসার পরও আমি শুধু এটাই চাইতাম কেউ নিজেকে থেকে আমাকে পছন্দ করুক,আমাকে আগলে রাখুক সবসময়,সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বিশ্বাস যেটা তুমি আমাকে সবসময় করে এসেছো,এতোগুলো বছরে তুমি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছো যেগুলো হয়তো আমি শাহিনের সাথে থাকলে কখনোই পেতাম না,তাই এখন আমার ইচ্ছে করে শাহিনকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে আসি,আমার সাথে এরকম বিহেভিয়ার করার জন্য না হলে তো আমি লন্ডনও যেতাম না ওর পিছনেই পড়ে থাকতাম,তখন তোমাকে কোথায় পেতাম আমি”

“ভাগ্যে ছিলাম আমি তোমার তাই তুমি আমাকে পেয়েছো আমি তোমাকে পেয়েছি, তুমি আমার অগোছালো জীবনটাকে একদম গুছিয়ে পরিপাটি করে দিয়েছো”

“এ বাসায় আসার পর থেকে যেন মনে হচ্ছে আমাদের বাকি জীবনটা আরো বেশি সুন্দর হবে”

“হ্যা তা তো অবশ্যই, তোমার মনে আছে কিনা জানি না তবে আমি তোমাকে বিয়ের রাতে বলেছিলাম যখন আমরা বুড়ো-বুড়ি হয়ে যাবো তখন এখানে এসে থাকবো আমরা,এখন আর কোনো চিন্তা-ভাবনা করার আমাদের দরকার নেই এখন শুধু আমরা একে-অপরকে ভালোবেসে বাকি জীবনটা কাটাবো”

“হুমম,আচ্ছা চলো না দাদুর সেই বক্সটা দেখি আজকে আরেকবার,দাদাভাই কত সুন্দর করে আগলে রেখেছিলেন, আচ্ছা আমিও যদি দাদুর মতো আগে আল্লাহর কাছে চলে যায় তাহলে আমার প্রিয় জিনিসগুলোও তুমি এভাবে আগলে রাখবে”

“তোমার প্রিয় জিনিস তো আমি”

“তাহলে নিজেকেই আগলে রাখবে কথা দাও”

“কথা দিলাম,তবে আমি চাই আমরা যেন জীবনের শেষ মুহূর্তটাও যেন একসাথে কাটায়,শেষ নিঃশ্বাস একসাথে ত্যাগ করি,আর পরের জীবনেও যেন একসাথে থাকি”

ফারাহ মুচকি হেসে জাবিরের হাত ধরে দাদুর রুমের দিকে গেল, সেখানে গিয়ে জাবির আলমারি থেকে সেই বক্সটা বের করলো,তারপর একএক করে সবগুলো জিনিস ছুয়ে দেখলো ফারাহ,সবকিছু দেখে জাবির ওই রুমটায় তালা দিচ্ছিল,ফারাহ বললো

“ছাদে যাবে”

“এখন”

“হুমমম চলো না”

“তোমার বায়না করার অভ্যাস আজও গেলো না ”

“কখনো যাবেও না”

তারপর দুজনে ছাদে গেল, একটু পরেই বৃষ্টি পড়া শুরু হলো,জাবির বাসায় চলে আসতে চাইলেও ফারাহ আসতে দিলো না,দুজনে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজলো,বৃষ্টি কিছুটা কমে আসলে মৃদু বাতাস চারদিকে বয়ে যাচ্ছিল।জাবির বললো

“ফারাহ তুমিও আমার কাছে ‘প্রিয় হতে প্রিয়তর’ হয়ে উঠেছিলে সেদিনই যেদিন তোমাকে প্রথম আমি শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখি”

“ভালোবেসে আগলে রাখতে হবে সারাজীবন, এই রাতদুপুরের আবদারগুলো মিটিয়ে যেতে হবে,যতই বয়স বাড়ুক আমাদের ভলোবাসা যেন সবসময় এক থাকে”

“জি ম্যাডাম আপনি যা বলেন”

সমাপ্ত