প্রেমদ্বন্দ্ব পর্ব-০২

0
111

#প্রেমদ্বন্দ্ব_২
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

টীকা : [আর্ভিন নামে কোনো ব্যাক্তির অস্তিত্ব নেই গল্পে। আহাদ আলভীর অন্য স্বত্বাটিকে বুঝাতে নামটা ব্যবহার করা হয়েছে।]

অনন্যাকে একজন প্রফেশনাল ট্রেইন্ড ক্রাইসিস কাউন্সিলরের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন রশীদ সাহেব। তিনি ফোনে সবটা শোনার পর বলেছেন, Try to remove any weapons, medications, or other potentially harmful objects.ওর মধ্যে সুইসাইড টেন্ডেন্সি দেখা যাচ্ছে। যেকোনো সময় নিজের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। এমনকি অন্যেরও ক্ষতি করতেও ও দুবার ভাববে না।
তীব্র মাত্রার ডিপ্রেশন, হার, ব্যর্থতার ভার, সাথে প্রিয় ভাইকে হারানোর শোক, অতি মাত্রায় তার অনুপস্থিতি অনুভব করা, তাকে সারাক্ষণ কল্পনা করার দরুন সে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই রোগের প্রথম লক্ষ্মণ সেই ব্যক্তিকে অত্যধিক মাত্রায় অনুভব করা, তাকে কল্পনা করা। আর একসময় তারা কল্পনার জগতটাকে সত্যি মনে করে। তারা যাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে তাকে সর্বক্ষণ নিজের চারপাশে বিচরণ করতে দেখে। তার সাথে কল্পনায় আলাপচারিতাও ঘটে।
এর প্রতিকার হিসেবে টক থেরাপি একমাত্র সলিউশন। তবে তাকে অতিমাত্রায় চাপ সৃষ্টি করা যাবে না কোনোকিছুতেই। তিনি আরও বলেন, Listen to the person without judgment. সে যা বলে তা শোনার চেষ্টা করুন। তাকে বুঝান আপনার কাছে তার প্রায়োরিটি সবকিছুর আগে।
সেদিন অনন্যাকে আর্ভিনের সাথে করে মীর্জা বাড়িতে যেতে হয়েছিলো। তারপরের দিনগুলোতে ডিউটি কামাই করে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়েছে অনন্যাকে। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল না ঠিক কিন্তু এই ছমাসে একটা মায়া তো অবশ্যই তৈরি হয়েছে। যে মায়া ছেড়ে অন্যকিছু ভাবাটা অনন্যার জন্য কষ্টকর ছিল। নিজের মধ্যে প্রথম কোনো পুরুষের প্রতি টানটা অনন্যা তীব্রভাবে অনুভব করেছিল যখন আর্ভিনরূপী আহাদ গ্লাসের ভাঙা কাঁচে হাত ডুবিয়ে ফেলেছিল। সেই রক্তাক্ত হাতটা দেখে সে এমনভাবে আঁতকে উঠেছিল, ওই মর্গে পড়ে থাকা শতকোপের আঘাতে জর্জরিত লাশ দেখেও অনন্যা কখনো এতটা চমকায়নি। একটা আস্ত লাশ কাটাছেঁড়া করে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তা আবার জোড়াতালি দেয়া ডক্টর অনন্যা ইয়াসমিনের হাতজোড়া কাঁপছিলো গ্লাসের ভাঙা কাঁচে কেটে যাওয়া হাতটা ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়ার সময়। অনেক তর্কবিতর্ক, মতবিরোধ, মা ভাইয়ের সাথে শত কথা-কাটাকাটি, মনোমালিন্যর পর তাদের বিয়েটা হয়ে গেল শুক্রবারের অপরাহ্নে এসপি আহাদ আলভীর সাথে। ইতোমধ্যে গুঞ্জন উঠেছে এসপি সাহেব শারীরিক ভাবে অসুস্থ। তাই স্বয়ং এসএসপির কাছ থেকে লেটার এসেছে যাতে সে কিছুদিন রেস্টে থাকে। লেটার পেয়ে অনন্যা খুশি হলেও কর্মনিষ্ঠ এসপি আহাদ আলভী খুশি ছিল না। ছুটির ফাঁকে সুকৌশলে সে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো বন্ধু সাজিদের সাহায্যে। সাজিদও একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তার জুনিয়ার অফিসার। আহাদ আলভীর সাথে তার যতটা না ভাব ছিল তার চাইতে বেশি ভাব ছিল মেহযেব আর্ভিনের সাথে। তাই প্রিয় বন্ধুর খুনীদের শনাক্ত করার রাতদিন সে ছুটছে।
বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর ঘন্টাখানেকর মাথায় অনন্যা শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছে বাপের বাড়ির মায়া কাটিয়ে। বাবা মাকে কি বুঝিয়েছে কে জানে? মা খুব হাসিখুশি ছিল।
বিদায়বেলায় অঝোরে কেঁদে আহাদকে বলছিলো, ওকে কখনো কোনোকিছুর অভাব বুঝতে দেইনি। তুমি ওকে খুব যত্নে রেখো।
আহাদ অনন্যার দিকে চুপ করে চেয়েছিল। তবে আশ্বাস দিতে ভুলেনি।

মীর্জাবাড়িতে তাদের বাড়ির মতো অত মেহমান নেই। হালকাপাতলা যা আছে তারা অতি ঘনিষ্ঠ। জিহার বাবা আনোয়ার মীর্জা একাহাতে সবটা সামলাচ্ছেন। যদিও তিনিই এখন এই বাড়ির আসল কর্তা। আহাদের বাবা আকরাম মীর্জা নামকরা একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু এখন উনি অক্ষম বিধায় সব আনোয়ার মীর্জা সামলান। উনাদের একটা বড়সড় ঔষধ কোম্পানি আছে, এই কোম্পানির দরুন মানুষ উনাদের বেশি চেনে। আহাদ আর আর্ভিনের মধ্যে কেউই ব্যবসায়ের দিকে মনোযোগ দেয়নি।
তারা সবসময় দেশের জন্য কাজ করতে চেয়েছে ও করাপশনে বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছে। তার দরুন একজন প্রাণ হারিয়েছে অন্যজন মানসিক বিকারগস্ত। আনোয়ার মীর্জা এজন্য তাদের উপর বড়ই বিরক্ত। তবুও এখন যেহেতু বাড়িতে বউ এসেছে। সেই একমাত্র ভরসা।
ঘরোয়া বিয়ে ঘরোয়াভাবে মিটে গিয়েছে। অনেক আত্মীয়স্বজনকে জানানো হয়নি। আমেনা বেগম ঠিক করে রেখেছিলেন কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আহাদ সুস্থ হলে বড়সড় করে ওয়ালিমার আয়োজন করবেন।

অন্যদিনের মতো সেদিনও আহাদ আলভী থেকে মেহযেব আর্ভিনের মধ্যে রূপান্তর ঘটতে বেশি সময় লাগেনি। বরঞ্চ জীবনের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে নিজের প্রিয় ভাইয়ের অনুপস্থিত প্রচন্ডভাবে অনুভব করার দরুন তার মন আরও ভীষণ খারাপ ছিল। নিজের গায়ে শেরওয়ানি দেখে আচমকা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল সে। আমেনা বেগম যখন বললেন, তোর আজ বিয়ে হয়েছে, বউ ঘরে আছে।
তখন সে আরও ভীষণ ক্ষেপে যায়। ঘরে গিয়ে সে ভাঙচুর শুরু করে দিল। তার ক্ষোভের বিনিময়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা ভেঙেছিল, অন্ধকারে বসে দুলতে থাকা রকিং চেয়ারটা উল্টে পড়ে ছিল, সাজানো ঘরটা এলোমেলো হয়েছিল আর বাসর ঘর সাজানোর সব ফুলের জায়গা হয়েছিল মেঝেতে।
আহাদকে মেনে নিতে না পারায় মায়ের সাথে অনেক রুক্ষ ভাষায় কথা বলে ফেলেছিল অনন্যা। এই বাড়িতে আসার পর মায়ের কথা তার ভীষণ মনে পড়ছিলো। কষ্ট হচ্ছিলো এই ভেবে মায়ের জায়গায় সে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখলে উত্তরটা পেয়ে যেত কেন মা অমন করেছিল। সাথে সারাদিনের ক্লান্তি, চোখে ভর করা ঝিমুনির চোটে বিছানার একপাশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিলো সে। ভাঙচুর আর গর্জন তর্জনের শব্দ শুনে সে চোখ মেলার সাথে সাথে বিছানার উপর বধূবেশে তাকে দেখার পর আহাদের শরীরের মধ্যে বিরাজমান মেজর মেহযেব আর্ভিন দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেয়েছিলো। অনন্যা শোয়া থেকে উঠে তার দিকে এগোনোর আগেই কোথা হতে যোগাড় করা কাঁটাতার নিজের হাতে বিদ্ধ করে দিল সে। অনন্যা আঁতকে উঠলো। কিন্তু কাছে এগোনোর সাহস পায়নি। আর্ভিনের হাত থেকে তাজা রক্ত টপটপ করে মেঝেতে পড়ছিল সাথে অনন্যার চোখের জল। শত মিনতির পরও কাঁটাতারটা আর্ভিনের হাত থেকে ছাড়ানো যায়নি। যখন রকিং চেয়ারে বসে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো অনন্যা হাত থেকে কাঁটাতারটা খুলে নিয়ে, ব্যান্ডেজ করিয়ে দিয়েছিলো। তারপর তাকে বিছানায় এনে শুয়ে দিয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়েছিলো পাশে। সকালে যখন তার ঘুম ভাঙলো তখন আহাদ ডিউটিতে চলে গিয়েছে।

_____

কাউন্সিলরের সাথে শলাপরামর্শ করে করে অনন্যা ডিউটিতে গিয়েছিলো। দুটো লাশ ময়নাতদন্তের জন্য আনা হয়েছিলো। ময়নাতদন্তের পর সেগুলো রিপোর্ট তৈরির কাজে ল্যাবে ব্যস্ত ছিল সে। সেক্রেটারি এসে বলল,
– ম্যাডাম এসপি স্যার এসেছেন।
অনন্যা দেখলো পুলিশের ইউনিফর্ম পড়নে এসপি আহাদ আলভী আরও কয়েকজন অফিসারের সাথে ল্যাবে প্রবেশ করেছে। পড়নে রোদচশমা খুলে অনন্যার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
– জহর সিং আর নারায়ন সিংয়ের রিপোর্ট রেডি ?
অনন্যা মাথা দুলিয়ে রিপোর্ট বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– ইয়েস স্যার। ওরা দুজনেই মাদক ব্যবসায়ী। তাদের গায়ে যে ক্ষতগুলি পাওয়া গিয়েছে তা মাসখানেক আগের। চাপাতি দিয়ে কোপানোর আগে তাদের শরীরের মধ্যে একটা কেমিক্যাল প্রবেশ করানো হয়েছিলো। কেমিক্যালটার নাম ‘স্কোপোলামিন’। এটা সাড়ে তিন ফিট দূর থেকেও বাতাসের মাধ্যমে একজন মানুষকে আসক্ত করতে পারে। এই কেমিক্যালটা যখন শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে তখন মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। যে কারণে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে সামনে থাকা মানুষের নাচের পুতুলে পরিণত হয়।
যে চিরকুটটা পাওয়া গিয়েছে তাতে জহর সিং আর নারায়ন সিংয়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গিয়েছে।
আহাদ রিপোর্ট চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে বলল,
– তারমানে ওই কেমিক্যালটা দিয়ে তাদের বশ করার পর চিরকুটটা লেখানো হয়েছে!
অনন্যা বলল,
– এগজ্যাক্টলী।
সাজিদ বলল,
– কেমিক্যালটার কোনে উপকারীতা আছে যার কারণে ঔষধ কারখানায় এটা উৎপাদন বৈধ হতে পারে?
– না অফিসার। এটার কোনো উপকারীতা নেই। সাইড এফেক্টস বেশি। এন্ড অফকোর্স ইটস ইলিগ্যাল।
আহাদ বলল,
– তাড়াতাড়ি খোঁজ নে সাজিদ। আমাদের কারখানায়ও তল্লাশি চালাবি। লাইসেন্স নেই এমন কারখানায় সোজা সিল আর মাথাগুলোকে গরাদে ঢুকিয়ে দিবি। বাকিটা আমি দেখছি। থ্যাংকস ডক্টর অনন্যা। আমাদের আরও ইনফরমেশন দরকার পড়তে পারে। থ্যাংকস ফর কোঅপারেট। আসি।
রোদচশমাটা পুনরায় চোখে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে দলবলসমেত।
অনন্যা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সেক্রেটারি আবার এসে বলল,
– ম্যাডাম স্যার আপনার জন্য এসপি স্যার এটা পাঠিয়েছেন।
অনন্যা দেখলো একটা হটবক্স। খুলে দেখলো তাতে গরম খাবার। সমস্ত অভিমান এক লহমায় কেটে গেল তার। সাথে ছোট্ট একটা বার্তাও এল ফোনে।
– সরি অনা।
অনন্যা বার্তাটা দেখে হাসলো।

সন্ধ্যায় ডিউটি থেকে ফেরার পরপর আনোয়ার সাহেব জেরা করলো আহাদকে। বলল,
-শহরের নামীদামী তিনটা ফাইভ স্টার ভাতের হোটেল, চারটা ভ্রাম্যমান রেস্তোরাঁ, মাছের ফিশারি, দুটো ঔষধ কারখানায় সিল পড়েছে আজ। এ নিয়ে সবখানে আলাপ চলছে। আরেকটু ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল না?
আহাদ কাঠকাঠ গলায় আনেয়ার মীর্জাকে বলল,
– এটাই হওয়ার ছিল। মাস তিনেক আগে ওদের কাছে অফিশিয়ালি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তারপরও তারা সংশোধন হচ্ছে না দেখে সিল মারা হয়েছে। নামীদামী খাবার থেকে শুরু করে নিম্নমধ্যবিত্তের ভ্রাম্যমান দোকানগুলোও খাবারে প্রাণঘাতী কেমিক্যাল ফরমালিন, কার্বাইড, ইথোফেন, কীটনাশক, কাপড়ের রং মেশাচ্ছে, ফুড সেফটি ডিপার্টমেন্ট তাদের সতর্ক করেছিল, আমি জানতাম কাজ হবে না। ঠিকই হয়নি। দীর্ঘক্ষণ টাটকা থাকার জন্য মাছের গায়ে ফরমালিন ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে, সত্তরটা মাছকে পরীক্ষা করা হয়েছে, ওই সত্তরটা মাছের গায়ে ইনজেকশন পুশ করার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ঔষধ কারখানায় অবৈধ কেমিক্যাল মিশিয়ে ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে যা দিয়ে নানান অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। আর্ভিনের খুনের সাথে জড়িত থাকা সেই দুজন খুনীর লাশেও সেই কেমিক্যাল পাওয়া গিয়েছে। এইসব কিছু একটার সাথে অন্যটা জড়িত। প্রশাসন ওদের সুযোগ দিয়েছে বলে ওরা আইনকে খেলা মনে করছে। কিন্তু ওদের শেষ দেখে ছাড়বো আমি।
আনোয়ার মীর্জা বললেন,
– একজনকে হারিয়েছি। তোকে হারাতে চাইনা আমরা। আমি একা আর কতদিকে সামলাবো?
– আমি কোথায় হারাচ্ছি? আমি এই পোশাক কেন পড়েছি তা কি তোমরা জানো না? আমার ডিউটি আমি পালন করছি তাতে তোমাদের অসুবিধা কোথায়?
অনন্যা বলল,
– তুমি হাইপার হচ্ছো কেন?
আহাদ বলল,
– কাকা কি বলছে দেখছো না? ওরা অপরাধ করে যাবে আর আমি ওদের ছেড়ে দেব? ওদের শাস্তি না হলে আরও কীট ছড়াবে দেশের মধ্যে। যারা দুমুঠো ভাত খেয়ে বাঁচার লড়াই করছে, দেখা যাবে তারা ওই দুমুঠো ভাত খেয়েই পরের দিন মরে গেছে।
আনোয়ার মীর্জা বলল
– তোর জন্য আমার চিন্তা হয় তাই বলছিলাম। যাইহোক কাকার কথায় মন খারাপ করিস না। তোর লক্ষ্যে তুই সফল হ। আর্ভিনের খুনীদের দ্রুত শনাক্ত কর। আর এমন শাস্তি দে যাতে তা উদাহরণ হয়ে থাকে।
আহাদ গটগট পায়ে হেঁটে ঘরে চলে গেল। অনন্যা তার পিছুপিছু ঘরে যেতেই আহাদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। অনন্যা কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই আহাদও তাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল,
– সরি অনা। তোমাকে সময় দিতে পারছিনা। সব ঝামেলা মিটে যাক আমি তোমাকে অনেক সময় দেব। আমাকে আবারও বেরোতে হবে। এসএসপি স্যারের সাথে জরুরি মিটিং আছে।
অনন্যা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
– প্লিজ না না। তুমি তোমার মধ্যে থাকবে না আর কিছুক্ষণ পর।
– মানে?
অনন্যা মুখ তুলে তাকালো। বলল,
– রাতে তো তুমি বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারো না। তোমার শরীর খারাপ হয় তখন।
– তারপরও যেতে হবে।
অনন্যা জোর দিয়ে বলল,
– তুমি তোমার রিপোর্ট দেখেছ? সবকিছুতে বাড়াবাড়ি না করলে হয় না?
আহাদ তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
– অসুস্থতার বাহানা দিয়ে তো বসে থাকা যাবে না। তুমি চিন্তা করো না। আমি নিজেকে সামলে নেব।

________

জহর সিং আর নারায়ন সিংয়ের কোনো স্থায়ী বাড়ি নেই। তারা ব্যবসায়ের খাতিরে দেশের সব জেলায় ঘুরে বেড়ায়। তবে জানা গেছে তারা দু’জনই মায়ের পেটের ভাই। ভিকে মেডিসিন কোম্পানিতে স্কোপোলামিন কেমিক্যালটা দিয়ে একটা ঔষধ তৈরি হয়েছিল। যেটা একজন গবাদিপশুর খামারি কিনে নিয়ে গিয়েছিলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ওই খামারির নাম লস্কর সিং। তারমানে জহর সিং আর নারায়ণ সিংয়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু গত দুমাস যাবত সে পলাতক। তার দুইটা ছেলেমেয়ে। আর ছেলেটা হাই স্কুলে পড়ে। তার কাছ থেকে জানতে পেরেছি, দুমাস আগে লস্কর সিংয়ের সাথে পাঁচজন শহুরে লোক দেখা করতে গিয়েছিল। টাকা নিয়ে বেশ ঝামেলাও হয়েছিলো তাদের সাথে। আমি যাদের ছবি দেখিয়েছি তাদের কাউকে চেনেনা বলছে সে।
এসএসপি কামরুল হাসান বললেন,
– তারমানে জহর সিং, আর নারায়ন সিংকে যারা খুন করেছে তারাই লস্কর সিং’এর গুম হওয়ার জন্য দায়ী?
– ইয়েস স্যার।
কামরুল হাসান বলেন,
– আপনি নাও দেখতে পারেন কিন্তু আমি আরও একবার ভিডিওটা প্লে করতে চাই যেটাতে মেজর আর্ভিনকে খুন করা হচ্ছে।
ঠিক এই জায়গায় এসে চোটপাট দেখিয়ে কথা বলা এসপি আহাদ আলভী থমকে গিয়েছিলো। এসএসপি স্যার যখন ভিডিওটা প্লে করলেন জবরদস্ত আর্মি সেনার গায়ে পড়া চাপাতির কোপের শব্দ মস্তিষ্ক ঝালাপালা করে দিচ্ছিলো আহাদের। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছিলো। সামনের চেয়ারটা ধরে চোখ বুঁজে নিল সে। চোখ মেলতেই সাজিদ দেখলো তার চোখ দুটোতে রক্ত জমা শুরু করেছে। হাতের আর গলার রগগুলিও ফুলেফেঁপে উঠছে। শেষমেশ একটা কথা কানে এল,
– বিশ্বাসঘাতক।
আহাদ চট করে চোখ খুলে বলল,
– কাকে বিশ্বাসঘাতক বলছিলো?
ভিডিওটা অফ হয়ে যায়। গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান বলেন,
– আপনি আসার পূর্বে আমরা এটা নিয়েই ডিসকাস করছিলাম। মেজর আর্ভিন যাকে বিশ্বাসঘাতক বলছিলেন নিশ্চয়ই তিনি সেই লোকটাকে চিনে ফেলেছিলেন। হতে পারে সে উনার কাছের কেউ, যাকে উনি চিনতেন।
এসএসপি স্যার বললেন,
– এগজ্যাক্টলী। হতে পারে তা মেজর আর্ভিনের পরিচিত কেউ, যাকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। পরবর্তীতে সে মেজরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
আহাদ বলল,
– আমি আবারও শুনতে চাই।
এসএসপি স্যার তাকে আবারও শোনালো। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে আর্ভিন কথাটা বলেছিলো। তখন তার পুরো শরীর রক্তে রঞ্জিত। আহাদের ঠোঁট কেঁপে উঠলো। এই একটা স্মৃতি যেখানে সে তার ভাইকে শেষবার জীবিত দেখে। আর কোনো স্মৃতি তার কাছে নেই। তাও শেষ পর্যন্ত তার ভাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সবাই মিলে একজোট হয়ে যখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিওর শুরুর দিকে আর্ভিনের অক্ষত দেহ, মুখটা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো আহাদ। বাকিদের চোখ সেদিকে যাওয়ামাত্রই থমকে গিয়েছিলো। আহাদ পিছু ফিরে সবাইকে চেয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে চোখদুটো লুকোনোর জন্য বলল,
– সরি, আমি একটু আসছি।
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। তার রক্তজমাট চোখদুটো হতে প্রতিশোধের আগুন বিস্ফোরিত হচ্ছিলো তখন। ওয়াশরুমে ঢুকে দ্রুত মুখ পানির ঝাপটা দিতে দিতে তার চোখদুটো ঝাপসা হতে শুরু করলো। সেই ঝাপসা চোখের অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে উঠতে এসপি আহাদ আলভী থেকে মেজর আর্ভিনে রূপান্তরিত হতে বেশিক্ষণ সময় লাগেনি তার। অনন্যার ফোন পাওয়ামাত্রই সে ফোন তুলে কানে দিল। অনন্যা ওপাশ থেকে বলল,
– আহাদ শুনতে পাচ্ছেন? ওহ সরি সরি আর্ভিন প্লিজ বাড়ি ফিরে আসুন।
ফোনটা কেটে দিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল কাউকে না জানিয়ে। সেদিনের পর থেকে সবার মনে সন্দেহ ঢুকে গিয়েছিলো। কিন্তু কাজের প্রতি তার ডেডিকেশন দেখে এসএসপি স্যার আর অভিযোগ আনতে পারলেন না।
দিনের বেলায় কাজ নিয়ে ছোটাছুটিতে থাকায় আহাদের সাথে অনন্যার সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর তার ঘুমন্ত মুখের উপর ঝুঁকে একটা বাসি চুমু ছাড়া আর কোনো ধরাছোঁয়া হয়নি তাদের মধ্যে। অনন্যার কোনো বারণ, নিষেধ আবদার শোনার অবস্থায় নেই সে। একপা একপা করে সে এগিয়ে চলেছে আসল খুনীদের আস্তানায়। তার লক্ষ্যে।
অন্যদিকে তার কোনো ত্রুক্ষেপ নেই।
কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়লে অনন্যা ছাড়া তার দ্বিতীয় কোনো ভরসা নেই। অসুস্থ পাগলপ্রায় যে খোলসটা সে ধারণ করে, নিজের মধ্যে যে স্বত্বাটা সে লালন করে, সেই মৃত স্বত্বটার সাথে ধীরেধীরে একটা মজবুত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো অনন্যার। প্রথমদিকে তাকে দুচোখে সহ্য করতে না পারা মেহযেব আর্ভিনের কাছে ভাইয়ের বাগদত্তা হতে কাছের বন্ধু হয়ে উঠার গল্পটা একটু পাগলাটে মনে হলেও অনন্যার কাছে তা এক নতুন আবিষ্কার।
মেহযেব আর্ভিনের আতঙ্ক, বিরক্তি থেকে স্বস্তি আর শান্তি হয়ে উঠার গল্পটা একটু ব্যতিক্রম। আহাদ আলভী হতে মেহযেব আর্ভিনের রূপান্তর হওয়ার বিষয়টা অনন্যার কাছে আগে ভীষণ ভীতিকর হলেও এখন তা স্বাভাবিক। শত্রুমিত্র, প্রতিশোধ, খুনের বদলে খুন খেলায় মেতে উঠা আহাদ আলভীর সুস্থ মস্তিষ্কের কোথাও প্রেম, ভালোবাসার ঠাঁই না হলেও, অসুস্থ মস্তিষ্কটার পুরোটা জুড়েই অনন্যা ইয়াসমিন বাস করে।
অনন্যার সংস্পর্শে আসার পর জিনিস ভাঙচুর আর আত্মহননের চেষ্টা অনেকটা কমে এসেছিল আর্ভিনের। বিয়ের পরেরদিনও অনন্যাকে সহ্য করতে না পারলে, ধুরছাই করলে, প্রতারক বলে চেঁচামেচি করলে আমেনা বেগম তাকে বুঝালো, ওর সাথে আহাদের বিয়ে হয়নি। কারণ আহাদ ওকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। তাই তিনি অনাকে তার জন্য নিয়ে এসেছে বউ করে। কারণ অনার মতো ভালো মেয়ে হয় না। উনার এই বানানো গল্প যে মানসিক বিকারগস্ত আর্ভিন অকপটে বিশ্বাস করে নিয়েছিল তা দেখে উনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
তারপর ধীরেধীরে তাকে সঙ্গ দেয়া, হাসানো, কথায় কথায় শাসন করা, যত্ন করা, দেখভাল করা, অসুস্থ হলে উদ্বিগ্ন হওয়া মুখটাকে প্রতিশোধপরায়ন আহাদ আলভী ভালো না বাসলেও তার অসুস্থ স্বত্বা তথা মেজর মেহযেব আর্ভিনের মৃত স্বত্বাটা ভালোবেসে ফেলেছিল।
আমেনা বেগমের কাছে গচ্ছিত থাকা সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মটা আর টুপিটা পড়িয়ে দিয়ে অনন্যা তার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের পাশে হাত ঠেকিয়ে যখন স্যালুট দিল তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকা লোকটা আচমকা হেসে উঠেছিল। অনন্যাও হাসলো। মুগ্ধ হয়ে কাছ থেকে সুন্দর হাসিটা দেখতে দেখতে অজস্র চুম্বনে তার শুকনো ঠোঁট, উষ্ণ মুখ সিক্ত করে তুলেছিল। অনন্যারও এখন ডিমলাইটের আলো ছাড়া অন্যকিছু ভালো লাগেনা। আর্ভিনরূপীর দেখাদেখি সাদা পোশাকই পড়তে ভালো লাগে। ঝাল খাবার খেতে ইচ্ছে করে, একলা একা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে বসে রকিং চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে তার অনেকটা সময় পার করে দিতে ইচ্ছে করে।

মাঝখানে সে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লো। তীব্র মাথা ব্যাথার যন্ত্রণায় ভুগছিলো। টেস্ট করানোর পর জানতে পারলো আহাদের অসুস্থ স্বত্বার সাথে থাকতে থাকতে ওই জগতের সবকিছু বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সে। এভাবে চলতে থাকে সেও মানসিক রোগী হতে বেশি সময় লাগবে না। তাই বাবার পরামর্শে সে বাড়ি চলে গেল। রাতের বেলায় বাড়িতে আর্ভিনের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আর সেই সময়গুলো বাড়িতে পার করাটা একটা যুদ্ধের মতো ছিল অনন্যার জন্য। দুটো রাত কোনোমতে পার করার পর জিহার কাছে ফোন দিয়ে আহাদ কেমন আছে জিজ্ঞেস করতেই ফোনের ওপাশ থেকে আহাদের আর্তচিৎকার শুনতে পাচ্ছিলো অনন্যা। জিহা রুদ্ধকন্ঠে বলল,
– শক দেয়া হচ্ছে। ভাইয়া সুস্থ হলে এসো তুমি। অসুস্থ মানুষের সাথে থেকে অসুস্থ হয়ে লাভ আছে? রাখছি।
জিহার কথায় ক্ষোভ স্পষ্ট। অনন্যা বাবার কথা না শুনেই মীর্জা বাড়িতে চলে এসেছিলো তারপর। কাউন্সিলর ততক্ষণে চলে গিয়েছে। কাজের বুয়া বলল, ভাইজান এখন ঘুমোচ্ছে। আপনি আর কোথাও যাইয়েন না বৌরাণী। উনারে সামলাতে কষ্ট হয়। খালাম্মা কোমরে আঘাত পায়ছে কাল। ভাইজান ধাক্কা দিছিলো।
অনন্যাকে সবাই এড়িয়ে গেল। আমেনা বেগম কথা বললেন না। জাকিয়া বেগম দেখেও না দেখার ভান করে রান্নাঘরে চলে গেলেন, জিহা দেখাও দিল না। আকরাম মীর্জা বললেন,
– তোমার যা ভালো মনে হয় করো। ওকে ফিরে পাব এই আশা আর রাখিনা।
অনন্যা ঘরে গিয়ে দেখলো ঘরটা আগের মতো হয়ে গেছে। বরঞ্চ আগের চাইতেও জঘন্য। এলোমেলো হয়ে বিছানার উপর ঘুমিয়ে আছে নিজেকে আর্ভিন দাবি করা আহাদ। অনন্যা হাঁটমুড়ে বিছানার সামনে বসতেই চোখদুটো খুলে গেল অকস্মাৎ। একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে থাকা রক্তজমা চোখের কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে বিছানার চাদরে পড়লো টুপটাপ। অনন্যার গলা ধরে এল। সে দু-কান ধরে ঝরঝরে কেঁদে ফেলে বলল,
– সরি। আর কোথাও যাব না।

চলমান….