প্রেমদ্বন্ধ পর্ব-০৩

0
99

#প্রেমদ্বন্ধ_৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আর্ভিনের সমস্ত অভিযোগ অনন্যা চুপ করে শুনছিল। একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ এতটা হিংসুটে কি করে হতে পারে? তার মুখে “আহাদ” ডাকটা এতদিন ধরে আর্ভিনকে কষ্ট দিয়ে এসেছে ভেবেই অনন্যার হাসি পেল। নিজেই নিজেকে হিংসে করে চলেছে আহাদ আলভী। যে মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই, যার লাশটা অব্দি কেউ খুঁজে পায়নি সেই স্বত্বাটা অন্য সবার কাছে মৃত হলেও অনন্যার কাছে চিরজীবী হয়ে ধরা দিয়েছে। অনন্যাও কোনো একভাবে বিশ্বাস করা শুরু করেছে আর্ভিনের অস্তিত্ব আছে। সুস্থ আহাদ আলভীর কাছে চরম উপেক্ষিত হওয়ার পর, তার অসুস্থ রূপ আর্ভিনের কাছে প্রবল ভালোবাসায় ডুবে থাকার পর অনন্যার মধ্যে আহাদকে নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। সে আহাদকে সব রূপেই ভালোবাসবে এটাই নিয়ত করে হাতটা ধরেছিলো।
চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে আর্ভিনের সাথে মিশে অনেকক্ষণ বিছানায় পড়ে রইলো অনন্যা। আর্ভিনের গায়ে প্রচন্ড জ্বর। সে কড়াপড়া হাতের তালুতে চুমু খেয়ে আর্ভিনের বুকের উপর থুতনি ঠেকিয়ে বলল,
– আই মিসড ইউ এ লট মেজর স্যার।
আর্ভিন কিছু না বলে চুপ করে চেয়ে রইলো। অনন্যা আরেকটু উপরে উঠে তার গালে দুঠোঁট চেপে ধরে বলল,
– আপনি কথা না বললে আমি চলে যাব। আমি অনু অনু অনু বলে ডাকটা কত্ত মিস করেছি এই দু’দিনে।
আর্ভিন চোখ ঘুরিয়ে নিল। অনন্যা মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
– কথা না বললে আমি আবারও চলে যাব। অবহেলা আমার সহ্য হয় না। আপনি কথা না বললে আমি এই বাড়িতে থাকবো কেন? কেউ আমায় ভালোটালো বাসেনা।
বলেই সে ফোঁপাতে লাগলো। আর্ভিনের কোনো নড়চড় দেখে সে নেমে গেল তার বুকের উপর থেকে। ওড়নার কোণায় মুখ মুছে বিছানা থেকে নেমে যাবে তখনি তার হাতটা টেনে ধরলো আর্ভিন। অনন্যা ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করলো অনেকক্ষণ। আর্ভিন ছাড়লো না, কথাও বললো না। অনন্যা বসে থেকে কাঁদলো। অনেকক্ষণ পর আর্ভিন ওর হাত টেনে নিজের কাছে এনে হাতটা ছেড়ে দিল। তারপর কান্নামুখর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল,
– ড্রামাকুইন।
অনন্যা ফুঁপিয়ে উঠে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। আর্ভিনের কড়াপড়া হাতদুটো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পাশে শুইয়ে দিয়ে বলল,
– যদি ভুল করেও আর একবার ছেড়ে যাও ফিরে এসে আমায় আর পাবেনা।
অনন্যা কেঁদে উঠে দু’পাশে মাথা নাড়লো ঘনঘন। আর্ভিন হাসলো।

_______________

এসএসপি স্যার তার সমস্ত মেডিকেল রিপোর্ট সামনে রেখে বলল,
– এতবড় সত্যি এতদিন লুকিয়ে আপনি ভালো করেননি মিস্টার আলভী। একজন মানসিক রোগীকে কিছুতেই ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে রাখা যাবে না। অলরেডি অনেক লেট হয়ে গিয়েছে। বিষয়টা আমি খতিয়ে না দেখলে আপনি নিজ থেকে কখনো বলতেন না। ইটস ক্রাইম।
আহাদ সোজা দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনে গেল। শেষে বলল,
– আমি আপনাকে এখনি আমার মাথার টুপিটা খুলে দিয়ে দেব স্যার। আমার শেষ একটা রিকুয়েষ্ট যদি শুনতে চান।
কামরুল হাসান চেয়ারে বসে পড়ে বলল,
– বলুন। যদিও আপনি আমাদের জন্য রিস্ক। DID রোগে ভুগছেন। আপনার মধ্যে অন্য একটা স্বত্বা বিরাজমান। সরি মিস্টার আলভী। আমার খারাপ লাগছে আপনার মতো দায়িত্ববান অফিসারকে মাঝপথে হারিয়ে ফেলছি বলে। আয়েম সো সরি।
– আমার শেষ কথাটা শুনুন স্যার।
– ঠিক আছে বলুন।
আহাদ বলল,
– কাউন্সিলরের সাথে আমি কথা বলেছি নিজেই। তিনি বলেছেন ডিপ্রেশনের কারণে এই রোগটা দেখা যাচ্ছে। যদি ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারি তাহলে আমি সুস্থ হয়ে যাব। পুলিশ প্রশাসন যদি একজন ডেডিকেটেড অফিসারকে হারাতে না চায় তাহলে তাদের উচিত আমাকে একটিবার সুযোগ দেয়া। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমার দ্বারা কারো ক্ষতি হতে দেব না আমি। আর্ভিনের খুনী অব্দি পৌঁছে গেলে আমি নিজ দায়িত্বে এই টুপিটা আপনার হাতে তুলে দেব। স্যার প্লিজ আমি একটা সুযোগ চাই।
কামরুল হাসান বললেন,
– আপনি না থাকলেও আমরা মেজর মেহযেব আর্ভিনের খুনীদের খোঁজা বন্ধ করব না। উপর থেকে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে ইতোমধ্যে। উনি শুধু আপনার ভাই নন দেশের একজন সৈনিক। তার খুনীদের খুঁজে বের করা এখন আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ।
– আমিও সেই কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতে চাই স্যার। আমি ওকে আর কখনো ফিরে পাব না। ওর জীবদ্দশায় আমি ওর জন্য কিছু করিনি।
কিন্তু এখন এটুকু আমাকে করতে দিন। আমি প্রশাসনের কাছে আর্জি জানাচ্ছি। আমার ভাইয়ের জন্য না হোক দেশের একজন বীর সৈনিকের জন্য আমাকে এটুকু করতে দিন।
এসএসপি স্যার তার অনুরোধ ফেলতে পারেনি সেদিন। একজন পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধ নয়, একজন ভাইয়ের অনুরোধ। অনুমতি পেয়ে আহাদের চোখজোড়া কৃতজ্ঞতায় চকচক করে উঠেছিলো।

কফিহাউস থেকে বের হতেই আহাদের ফোনে অনন্যার কল এল। পাশে সাজিদ ছিল। সে বলল,
– ফোনটা রিসিভ কর। কি বলে দেখ। তুই অসুস্থ তাই ওর চিন্তা হয়। আজব তুই!
আহাদ বিরক্ত হয়ে বলল,
– আমি কি ছোট বাচ্চা যে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরবো। অনা নিজেরটা বুঝে। আমি কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি এটা বুঝার চেষ্টা করে না।
– আচ্ছা ফোনটা ধর।
আহাদ ফোনটা তুলে কর্কশ গলায় বলল,
– আজ সন্ধ্যায় ফিরতে পারব না অনা। কাজ আছে আমার।
অনন্যা বলল,
– কোথায় যাবে?
– পাহাড়ে যেতে হবে। ফোনে সব বলা যাচ্ছে না।
অনন্যা বলল
– তোমাকে একটা জরুরি কথা বলার আছে। প্লিজ সামনাসামনি বলতে চাই। প্লিজ দেখা করো আমার সাথে। জরুরি।
আহাদ একটু সাইডে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল,
– আমার পাশে এখন কেউ নেই। বলো কি বলতে চাও।
অনন্যা বলল,
– না না এভাবে নয়। সামনাসামনি বলতে চাই।
– ওকে। আটটায় আমি বাড়ি ফিরবো।
অনন্যা চেঁচিয়ে বলল,
– সন্ধ্যায় ঠিকই বাড়ি ফিরবে যখন চোখে আঁধার দেখবে। আমাকে এতটা অবহেলা করার কারণটা কি?
– আমি তোমাকে অবহেলা করছি ? আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে যাওয়াটা মোস্ট ইমপোর্টেন্ট। অনেকদিন সাধনা করে এই জায়গাটার খোঁজ পেয়েছি। প্লিজ অনা ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। তুমি কষ্ট পাচ্ছ এটা দেখতে আমারও ভালো লাগছেনা। আমি আজ সকালে মায়ের সাথেও কথা কাটাকাটি করে বের হয়েছি। আমাকে একটু সময় দাও।
অনন্যা ফোনটা কেটে দিল রাগে।
আজ চারটা লাশ ময়নাতদন্তের জন্য আনা হয়েছিলো। একটা লাশ পোস্টমর্টেম করার সময় লোকটার পেটে 64GB Micro SD Class Memory Card পেয়েছে সে। লাশটার কেস এক্সিডেন্টাল। যার দরুন এটি মর্গে আসা অন্যান্য লাশ গুলোর মতোই সাধারণ একটি লাশ। এটির দিকে প্রশাসনের বিশেষ কোনো নজর নেই। রিপোর্টের সাথে মেমোরি কার্ডটাও সংযুক্ত করতো সে। কিন্তু তার আগেই মর্গে একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায়। নামকরা হসপিটালের মর্গের সমস্ত সিকিউরিটির বেড়িবাঁধ ভেঙে সেই লাশটা চুরি হয়ে যায়। অনন্যা রিপোর্ট তৈরির কাজে সবেমাত্র হাত দিয়েছিলো। ঘটনাটা শুনে তার হাত পা কেঁপে উঠেছিলো। রিপোর্টটা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করে আহাদকে সমস্ত ঘটনাটা বলার জন্য ফোন দিয়েছিল সে। ডিএসপি সাজিদ তাকে জেরা করেছে লাশটার ব্যাপারে। সবকিছু বললেও মেমোরি কার্ডটার ব্যাপারে সব গোপন রেখেছে সে। পুলিশের প্রশ্ন শুনে সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে লাশটা তারাই চুরি করেছে যারা জানতো লোকটার পেটে মেমোরি কার্ডটা ছিল। ছোট্ট একটা মেমোরি কার্ড পানি দিয়ে গিলে ফেলা অতটাও কঠিন নয়। কিন্তু কেন লোকটা মেমোরি কার্ডটা গিলে ফেললো, এবং কেনই বা তাকে হত্যা করা হলো কোনোকিছুরই উত্তর পায়নি অনন্যা। তাছাড়া রক্তে স্কোপোলামিন কেমিক্যালটার উপস্থিতি লাশটাকে আরও বিশেষায়িত করেছে। ঘটনাটা শোনার পর আহাদ নিশ্চয়ই তার কাছে সবটা বিস্তারিত জানতে চাইবে কিন্তু অনন্যা দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মেমোরি কার্ডটাতে কি আছে তা স্বচক্ষে না দেখা অব্দি আহাদকেও কিছু বলবে না সে।
হাসপাতালে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিলো। সবার জেরার মুখে সে। এসপি আহাদ আলভীকে দেখেছে অনন্যা। এখন সে ব্যস্ত নেই? ঠিকই চলে এসেছে এখন। অথচ তার বেলায় যত্তসব বাহানা। একজন কনস্টেবল এসে বললেন
– ম্যাডাম এসপি স্যার আপনাকে ডাকছেন। আমার সাথে আসুন।
অনন্যা হাতের ঘড়িতে টাইম দেখে বলল,
– সরি। উনাকে বলে দিন আমার বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এসেছে।
কনস্টেবল উশখুশ করতে করতে বললেন,
– এসপি স্যার..
– সে যেইহোক। আমি এখন আর কাউকে কোনোকিছু বলতে পারব না। রিপোর্ট দেখলে সবার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
হনহনিয়ে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলো সে। এই মেমোরি কার্ডটা সুরক্ষিত জায়গায় রাখার পর সে চিন্তামুক্ত হতে পারবে।
বাড়ি ফিরে মেমোরি কার্ডটা নিরাপদ স্থানে রেখে গোসল নিল সে। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে আর্ভিনের জন্য স্যুপ বসালো। জাকিয়া বেগম আর আমেনা বেগমের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে স্যুপটা রাঁধছিলো আর সময় দেখছিলো।
আর্ভিন মাগরিবের আজানের আগে বাড়ি ফেরে। যদিও আহাদ আলভী সারাদিন বলে যায় তার রাতে কাজ আছে কিন্তু সন্ধ্যার পর চোখে অন্ধকার দেখলে বাড়ি ফেরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা তার। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম। মাগরিবের আজান পার হয়ে এশার আজানের সময় হয়ে গেলেও আহাদ বাড়ি ফিরলো না। অনন্যা ফোনের উপর ফোন দিচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছেনা। কোনো খোঁজখবর না পাওয়ায় সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।
এশার আজানের পরপর সাজিদ আর্ভিনকে নিয়ে এল। তার মাথায় একটা ব্যান্ডেজ। সাজিদ বলল,
– সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস বেশি চোট পায়নি।
অনন্যা তাকে ঘরে নিয়ে এল। তার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে আর্ভিন হেসে বলল,
– তোমাকে দেখতে মিষ্টি লাগছে অনু।
অনন্যা হেসে উঠলো তার কথায়। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
– স্যুপটা নিয়ে আসি।
স্যুপটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসে আর্ভিনকে খাওয়ালো সে। ঔষধ খাইয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
– কিছুক্ষণ ঘুমান। আমি ডেকে দেব আবার।
আর্ভিন ঘুমিয়ে পড়লো। অনন্যা তার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে মেমোরি কার্ডটা নিয়ে বসলো। ঠিকঠাক কাজ করবে কিনা কে জানে? তার ফোনে মেমোরিটা ইনসার্ট করার পর দেখলো প্লে লিস্টে অনেকগুলো ভিডিও। প্রথম ভিডিওটা ওপেন করার পর সে দেখলো নারকীয় একটা হত্যাকান্ড। যেখানে মেজর মেহযেব আর্ভিনকে নির্মমভাবে খুন করা হচ্ছে। ভিডিওটা মাঝপথে বন্ধ করে ঘুমন্ত আর্ভিনরূপী আহাদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো সে। সেদিন থেকে ডাক্তারের কথামতো নিজেকে পুরোপুরি সেই জগতের বাসিন্দা মনে করতে শুরু করেছে অনন্যা, যেই জগতে আর্ভিন বেঁচে আছে আহাদ হয়ে। প্লেলিস্টে শুধু একটি ভিডিও নয়। পরপর নয়টি ভিডিও ছিল। আর সেই ভিডিওগুলি দেখার পর মেহযেব আর্ভিনের খুনী কে সেটা বুঝতে দেরী হয়নি অনন্যার। কিন্তু ততদিনে সে তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে।

চলমান…