#প্রেমদ্বন্দ্ব_৬
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
মুখোশের আড়ালে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী আফসার উদ্দিন, ভিকে মেডিসিন কোম্পানির সিইও বখতিয়ার সাঈদি, অস্ত্র ব্যবসায়ী প্রীতম চক্রবর্তী, আরও একদল ভাড়াটে গুন্ডা যাদের মধ্যে জহর সিং, নায়ায়ন সিং ছিল। নয়টা ছোট ছোট ভিডিওর ক্লিপ ছিল যেগুলোর সাধারণত মেহযেব আর্ভিনের রেকর্ডিং ভিডিও ছিল। সবগুলো ভিডিওতে তিনি জীবিত। সমস্ত প্রমাণ, এভিডেন্স, রিপোর্ট, ফোনকলের রিপোর্ট, ফোন রেকর্ডিং,খুনীদের আস্তানা ভিডিও আকারে ধারণ করে রেখেছিলেন উনি এসপি আহাদ আলভীর কাছে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু তার আগেই উনার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে পাহাড়ি উপত্যকার একটা নির্জন স্থানে উনাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সেই কেমিক্যালটা ব্যবহার করে যেটা দিয়ে একজন সুস্থ সবল মানুষকে হাতের পুতুলের মতো নাচানো যায়।
খুনের সেই ভিডিওটিতে আহাদ দেখলো একজন বীর সৈনিক কিভাবে কেমিক্যালের জাল ভেদ করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে গিয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। সবটা দেখার পর প্রতিশোধের স্পৃহায় গায়ের রক্ত ফুটছিলো টগবগ করে ফুটছিলো তার। ডিআইডি রোগের দরুন রক্ত জমে যাওয়া চোখদুটোও জানান দিচ্ছিলো প্রতিশোধ আর খুন কিভাবে মাথায় চেপে বসেছিলো তার।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় জিহা পথ আটকে বলল,
– এখন কোথায় যাচ্ছ ভাইয়া? ভাবি কোথায়?
আহাদ তার সরল মুখটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– আসবে। কাকা কোথায়?
– যেখানে থাকে সেখানেই। ফোন করেছিল কিছুক্ষণ আগে। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। ভাবির কোনো খোঁজ পেয়েছ কিনা।
– পেয়েছি। ওকে নিয়ে ফিরবো। তোকে মেসেজে সব বলব। আসি। আর হ্যা এই মেমোরি কার্ডের কথা যেন কেউ না জানে।
জিহা মাথা দুলিয়ে বলল,
– আচ্ছা।
আহাদ বেরিয়ে গেল। জিহা তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো।
অপহরণকারীর হাত থেকে অনন্যা পালিয়েছিলো। পালানোটা সহজ না হলেও দীর্ঘদিন ধরে কেমিক্যাল নিয়ে জানাশোনার প্রেক্ষিতে কাজটা তার জন্য তুলনামূলক সহজ ছিল।
অনন্যাকে যে ঘরে বন্দি করা হয়েছিল সেটাতে অনেকগুলো বস্তা। কিসের বস্তা সেগুলো আন্দাজ করতে পারলো না সে। সাথে অসংখ্য মদের বোতল। কেরোসিন তেলের বোতলের পাশাপাশি অনেকগুলো কেমিক্যালের বোতলও দেখা যাচ্ছিলো। তার জ্ঞান ফেরার পর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মুখোশধারীর একজন বলল,
– তাড়াতাড়ি বল মেমোরিটা কোথায় রেখেছিস? ঘরে রেখেছিস নাকি অন্য কোথাও?
অনন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– খুন করে ফেললেও বলব না। আমি তোদের সব কটাকে খুন করব জানোয়ার। বলেই থুতু ছুঁড়লো।
গালে বিরাট একটা চড় এসে পড়লো তক্ষুণি। চেয়ার সহ ঢলে পড়লো অনন্যা। তারপর পুনরায় অজ্ঞান হয়ে গেল। তার ঘন্টাখানেকের মধ্যে তার জ্ঞান ফিরলো না আর। এতে ভাড়াটে গুন্ডাগুলো ভয় পেয়ে গেল। অনেক চেষ্টার পরও যখন তার জ্ঞান ফিরলো না তখন উপরি মহলের আদেশে তার হাত পা খুলে দিয়ে তাকে মেঝেতে শুয়ে গায়ে পানি ঢালা হলো। অনন্যার জ্ঞান ফিরে এলেও সে চোখ খুলতে পারলো না তীব্র ব্যাথায়। নড়তেচড়তে পারলো না। তার পেট বরাবর লাথি মেরে লোকগুলো বলল,
– এই **গী ওঠ। ঘুমানোর জন্য তোকে আনা হয়নাই।
অনন্যা তারপরও চোখ মেললো না। একটা বিশেষ কেমিক্যালের বোতল নিয়ে নতুন দু’জন লোক কক্ষটাতে প্রবেশ করলো। নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করে অনন্যাকে একা রেখে বেরিয়ে গেল। অনন্যা সেই সুযোগে উঠে পড়লো ধীরেধীরে। কক্ষটা বিশাল। চারপাশে চোখ বুলাতেই সে বুঝতে পারলো নানান অপকর্ম সংঘটিত হয় এখানে। একপাশে স্যাঁতসেঁতে মেঝে, চারপাশে বেশ পুরোনো ইটের দেয়াল। দেয়ালে আঁকা কঙ্কালের ছবি। জঘন্যভাবে কুপিয়ে রাখা একটা কয়েকটা ভয়ংকর পুতুলের অবয়ব। ঝং ধরা অস্ত্রের বাহার। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার জন্য ব্যবহার করা লাঠি, টর্চলাইট। জুতোর ফসফস শব্দ কানে আসতেই সে আবারও চোখ বন্ধ করে নিল। জুতোর শব্দটা কাছাকাছি এসে আবারও মিলিয়ে গেল। লোহার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল তারা। দরজাটা বন্ধ করার সময় অদ্ভুত শব্দ করে। কান ঝালাপালা করে দেয়। অনন্যার মনে হলো তার কানবন্ধ হয়ে গিয়েছে। দেয়ালের অদ্ভুত পেইন্টিং, পুতুল আর কঙ্কালের ছবিগুলো দেখে তার গা শিউরে উঠেছিল তখন। টলতে টলতে চেয়ারটা ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। লাঠির আঘাতে তার সারাশরীর ব্যাথায় টনটন করছে। ঠোঁট, মুখ, কপাল ফুলে গিয়েছে। নাক বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। মুখে অসংখ্য আঁচড়ের জ্বলুনি অনুভব হচ্ছে। ধীরেধীরে সাজিয়ে রাখা কেমিক্যালের বোতলগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে। স্কোপোলামিন, ক্লোরোফর্ম, ও জি-কেটামিন কেমিক্যালের বোতল। স্কোপোলামিন অবৈধ হলেও, ক্লোরোফর্ম এবং জি-কেটামিন অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত হয় অনেক সময়। অজ্ঞান পার্টির হাতে খুন হওয়া অসংখ্য মানুষের দেহে এই কেমিক্যাল গুলো অনেকবার শনাক্ত করেছিলো সে। এরা নিশ্চয়ই এইসব তাদের কুকর্মে ব্যবহার করার জন্য এখানে এনেছে। আন্দাজ করে দেখলো প্রায় পঞ্চাশেরও অধিক বোতল রাখা। ক্লোরোফর্মের বোতলটা হাতে নিয়ে দুর্বল হাতে সবেমাত্র খোলার চেষ্টা করেছিলো অনন্যা। তারমধ্যে দরজা ঠেলে একজন দীর্ঘদেহী ভয়ংকর চেহারার লোক ঢুকে এল। অনন্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পালিয়ে যাবে ভেবে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে এল ধরার জন্য। অন্যন্যা আশপাশ কিছু না ভেবে লোকটার মুখ বরাবর কেমিক্যাল ছিটকে দিল। লোকটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। অনন্যা নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছিলো। লোকটা দেয়াল ধরে ধসে পড়তে পড়তে মেঝেতে শুয়ে গেল। ওপাশ থেকে দরজা ধাক্কানোর শব্দ ভেসে আসছে। অনন্যা এককোণায় পড়ে থাকা তার ওড়না কুড়িয়ে নিয়ে নিজের নাক বেঁধে নিয়ে স্কোপালামিন, ক্লোরোফর্ম, জি-কেটামিন কেমিক্যাল দরজার নীচে ঢেলে দিয়ে দূরে সরে এসে ঘনঘন শ্বাস টানতে টানতে নিজেও অজ্ঞান হয়ে পড়লো। চোখদুটো বন্ধ হওয়ার সময় দেয়ালে ঘেঁসে ধসে পড়া লোকটার হাতের অস্ত্রের দিকে চোখদুটো আটকে গিয়েছিলো তার। আর সরাসরি কেমিক্যালের ঘ্রাণ তার নাকে না লাগায় দ্রুত জ্ঞান ফিরে এসেছিলো তার। জ্ঞান ফেরার পর লোকটার হাত থেকে ভারী Browning Hi Power গানটা হাতে তুলে নিল সে। বাংলাদেশ আর্মির ইনফ্যান্ট্রি ওয়েপনের মধ্যে এটি একটি যা এরা অবৈধভাবে ব্যবহার করে। লোকটার গায়ে পড়া সেফটি জ্যাকেটটা খুলে নিয়ে ধীরেধীরে দরজা খুলে বেরিয়ে এল সে। সাথে সাথে চোখে পড়লো মেঝেতে লুটিয়ে পড়া লোকগুলোকে। দরজা খোলার শব্দ শুনে দুটো লোক ছুটে এসেছিলো। অনন্যার হাতে পিস্তল দেখে দ্রুত পিছিয়ে গেল। অদক্ষ হাতে পিস্তল ধরেছে একজন দৌড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল তাকে। অনন্যা ভয়ের চোটে ভুলবশত ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলেছিল, আর সেখানে মরে গেল লোকটা। নিজের পালানোর পথ খুঁজে বের করতেও খুব কষ্ট হয়নি তার। ভিডিওতে দেখা লোকগুলোর একজনের উপস্থিতিও সেখানে না দেখে অনন্যা বুঝে গিয়েছিলো এরা সবাই ভাড়া করা গুন্ডা। অনন্যা বেরিয়ে এল সেই বন্দিশালা থেকে, কিন্তু বেরিয়ে আসার পর চোখে অন্ধকার দেখলো সে। জায়গাটা তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। একটা ঝোপের কাছে এসে ভোরের সূর্য দেখতে দেখতে ঝোপের পাশেই লুটিয়ে পড়লো সে।
মথুয়া সুরঙ্গ নামক কোনো সুরঙ্গই পুলিশ বাহিনী খুঁজে বের করতে পারেনি। এমন কোনো সুরঙ্গের কথা আজ পর্যন্ত কেউই জানেনা। অনন্যাকে যেখানে রাখা হয়েছিলো সেই জায়গাটা কোনো সুরঙ্গ নয়। একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। মথুয়া সুরঙ্গের আসলে একটা মৃত্যুফাঁদ আহাদ আলভীর জন্য। তাকে খুন করতে পারলেই মেমোরি কার্ডের আর প্রয়োজন হতো না। যদিও তাকে খুন করার চক্রান্ত অনেক আগে থেকেই সাজানো হয়েছিলো কিন্তু কিছুতেই তারা সুযোগ পাচ্ছিলো না। অনন্যার খোঁজ না পাওয়ায় মথুয়া সুরঙ্গের কথা ধামাচাপা পড়ে গেল। এসএসপি কামরুল হাসান নিশ্চিত করলেন, ওখানে অনন্যা ইয়াসমিন নেই।
অনন্যাকে খোঁজার পাশাপাশি এসপি আহাদ আলভী একটা সুন্দর ছক কষেছিলো খুনীদেরকে আইনের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। কিন্তু অনন্যার জন্য এগোতে পারছিল না সে। তার হাতে মেমোরি কার্ডটা চলে এসেছে জানতে পারলেই অনন্যাকে সরিয়ে ফেলতে তারা দু’বার ভাববে না। ভাইকে সে হারিয়েছে, কিন্তু অনন্যাকে সে কোনোকিছুর বিনিময়ে হারাতে পারবে না। বিয়ের পর থেকে অনন্যাকে সে তেমন করে সময় দিতে পারেনি ঠিক কিন্তু তার ভালোবাসায় একফোঁটাও কমতি নেই। অনন্যা জানতেই পারলো না এসপি আহাদ আলভী শুধু দায়িত্ব পালন নয় ভালোবাসতেও জানে। একথা জানার আগেই অনন্যা হারিয়ে যাবে, এমনটা সে ভাবতেও পারছিল না কিছুতেই। নিয়তি নিশ্চয়ই এতটাও নিষ্ঠুর হবে না তার সাথে? আর কত হারাবে সে?
অনন্যার নিখোঁজের প্রায় পাঁচদিনের মাথায় এসএসসি কামরুল হাসানের ভবনে আহাদ সমস্ত প্রমাণ খোলাসা করে দিল। একের পর এক সব প্রামাণ্য চিত্র। সেনা কর্মকর্তা মেজর মেহযেব আর্ভিনের মুখের জবানবন্দি, সব রেকর্ডিং, ভিডিও কামরুল হাসানের সামনে তুলো ধরলো আহাদ। তার পেছনে দাঁড়িয়েছিলো ডিএসপি সাজিদ। আর সামনে এসএসপি কামরুল হাসান। স্ক্রিনে ভেসে উঠা ডিএসপি সাজিদের ছবি দেখে সাজিদ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আহাদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখে “বিশ্বাসঘাতক” কথাটা বলে উঠামাত্রই সাজিদ আচমকা হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে পায়চারি করলো। আহাদ তার দুঃসাহস দেখে এসএসপি কামরুল হাসানের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তিনিও হাসছেন। আহাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেল। পিস্তল বের করে সাজিদের দিকে গুলি ঠেকাতেই দরজা খুলে একজন কক্ষে প্রবেশ করে তার দিকে গুলি তাক করে বলল,
– সবখানে সেয়ানাগিরি চলেনা ভাইপো।
আহাদ দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেল আনোয়ার মীর্জাকে দেখে।
চলমান….