প্রেমপ্রদীপ পর্ব-০২

0
5777

#প্রেমপ্রদীপ
part–2
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

চারপাশ অন্ধকার দেখছে রোদেলা। বমি করার ফলে আরো দুর্বল লাগছে নিজেকে। এম্নিতেই সে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত! চোখ দিয়ে আপনা-আপনি পানি ঝড়ছে। মাথা ঘুরছে তার। এই বুঝে জ্ঞান হারাবে সে৷

রোদেলা বহু কষ্টে দু কদম আগায়। বাস-গাড়ীর আওয়াজে মাথা দপদপ করছে। হুট করে মাথা আবারো চক্কর দিয়ে উঠলো।পা গিয়ে বাজলো ইটের সাথে। সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে গেলে আচমকা কেউ একজন এসে তাকে ধরে ফেলে। ফলে শেষ রক্ষা পেল সে। রোদেলা পিটপিট করে রক্ষাকারীর দিকে তাকালো। আচমকা চমকে উঠে একটু জোড়েই বলে, রিশাদ!!!

রিশাদ তাকে ধরে আছে। রোদেলা ছিটকে সরে আসতে চাইলে আবারো হোচট খায় ।ফলে সামনের দিকে ঝুকে পড়ে। যার জন্য সে রিশাদের গায়ে গিয়ে পড়ে।

রিশাদ রোদেলাকে প্রশ্ন করে, তোমার কি খুব খারাপ লাগছে?

–হু।

–বাসায় যাবে?

–হু।

–কি হয়েছে তোমার? অসুস্থ নাকি?

রোদেলা কিছু বলছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আসলে সে কোন কথা বলার মানসিকতার মধ্যে নেই এই মূহুর্তে। কষ্টে বুকটা জ্বলে যাচ্ছে৷ আবেগের সাথে তার পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিল সাত বছর আগে। বিয়ের দু’বছরের মাথায় তাদের ছেলে সমুদ্র জন্ম নেয়। এখন সমুদ্রের বয়স পাচ বছর তিন মাস৷ আবেগের সন্তানের মা হওয়ার পর আবেগ কিভাবে তাকে সন্দেহ করতে পারলো?

রিশাদ রোদেলার কপালে হাত রাখল। রোদেলা চমকে উঠে।

–জ্বর এসেছে?

–নাহ। আমি বাসায় যাব।

–চল। তোমাকে নামিয়ে দেই৷

–আমার বাসায় যাব৷

–মানে?

–আমার বাবার বাসায় যাব৷ (আমতাআমতা করে)

–ও।

–একটা সিএনজি করে দিতে পারবে তুমি?

–অবশ্যই।

রিশাদ নিজে থেকে রোদেলাকে সিএনজি ঠিক করে দিল এবং নিজেও রোদেলার সাথে সিএনজি তে বসে পড়ে৷

এই ঘটনা আবেগের বাসার কাছাকাছি ঘটেছে। যেহুতু আবেগ বাইরে বেরিয়েছিল। তাই দুভাগ্যক্রমে এই দৃশ্য তার চোখ এড়ায় না। তবে আবেগ পুরাপুরি ঘটনা নিজ চোখে দেখেনি। দেখেছে অর্ধেকটা। আবেগ প্রথমে হতভম্ব হয়। পরে প্রচুন্ড পরিমাণে রেগে যায় রোদেলার উপর। রোদেলার উপর তার ক্ষোভ আরো বেড়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্যটা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কিছুটা!

আবেগ রাগে থরথর করে কাপছে। তার মনে হচ্ছে সমগ্র দুনিয়ায় আগুন জ্বালিয়ে সব শেষ করে দিতে। তার ও চোখের কোনে পানি এসে জমলো। আবেগ বিড়বিড় করে বলতে থাকে, শুধুমাত্র একবার তোমাকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম! দশ মিনিট ও হয় নি তার আগেই তুমি অন্য কারো হাত ধরে চলে গেলে। আর সেই তুমি তোমার উপর বিশ্বাস রাখতে বলো। এখন তো আমার নিজের উপরই রাগ লাগছে। কেন তোমাকে এতো ভালোবাসতে গেলাম। কি দরকার ছিল নিজের সবটা দিয়ে তোমাকে সুখে রাখার বৃথা চেষ্টা করার। দিন শেষে কি করলে তুমি? আমার কাধে ছুড়ি আঘাত হেনে আমাকে সবদিক দিয়ে নিঃস করে চলে গেলে। নিজের উপর ঘৃণা লাগছে যে তোমার মতো দুশ্চরিত্রা মেয়েকে আমি ভালোবাসি!!!

আবেগ নিজের বাসার দিকে হাটা ধরল। মা ঠিকই বলেন, রোদেলা কোন দিনই তাকে ভালোবাসেনি। আবেগ বুঝে পাচ্ছে না রোদেলা কিভাবে পারল রিশাদের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে! তাও এই মাঝরাস্তায়৷ এতো লোকের সামনে!

★★★

রোদেলা তার বাবার বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে। রিশাদ তাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সে পনের মিনিটের বেশি হবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় গিয়ে কি বলবে মা-বাবা কে? তাকে তার স্বামী বাসা থেকে বের করে দিয়েছে? রোদেলা কেদে দিল। রোদেলার বাবা তার বিয়ের দিন একটা কথা বলেছিল তাহলো, বিয়ের পর মেয়েদের বাড়ি তার স্বামীর বাসাটাই হয়। মেয়ে বিয়ের পর বাবার বাড়ির অথিতি। স্বামী বাসা থেকে মেয়েদের লাশ বের হয় সারাজীবনের জন্য। রোদেলা ও এক কাপড়ে লাশ হয়েই বের হয়ে এসেছে৷ তফাত টা হলো সে জীবিত লাশ। এই যা!

রোদেলা বাসার বেল বাজল। মিনিট খানেক পর রোদেলার মা ফাতেমা বেগম গেট খুললেন। গেট খুলতেই অসময়ে মেয়েকে দেখে সে ঘাবড়ে যায়৷ একটা সময় আসে যখন নিজের মেয়ে বাসায় আসলে চিন্তা হয়। মেয়ের সংসারে সব ঠিক আছে তো?

রোদেলা বাসার ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফাতেমা জিজ্ঞেস করে, নানাভাই কোথায়? আর জামাই কই? একা কেন এলি?

রোদেলা শান্তসুরে বলে, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিতে পারবে মা?

— তুই বস আমি পানি আনছি৷

রোদেলা সোফায় বসে পড়ে। তার মা পানি আনতে গেলেন। রোদেলা ঠান্ডা পানি খায়। ফ্রিজে ঠান্ডা পানি আছে কি? তিনি ফ্রিজ খুলে দেখলেন এক বোতল পানি আছে। নিশ্চয়ই অথৈ রেখেছে। ফাতেমা বেগম গ্লাসে পানি ঢেলে মেয়ের কাছে গেলেন৷ মেয়েটার মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে৷

মা পানি আনতেই রোদেলা মাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয় হাউমাউ করে। ফাতেমা কিছুই বুঝতে পারছে না৷ কি হয়েছে তার মেয়ের? সে হতবিহ্বল হয়ে মেয়ের কান্নারত চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। এর আগেও রোদেলা বহু বার কেদেছে। বিয়ের পর ই বেশি কেদেছে তার মেয়ে৷ শ্বাশুড়ির সাথে ঝামেলা লেগেই থাকে রোদেলার! কিন্তু এভাবে তো কোন দিন কাদেনি। জামাইয়ের কিছু হলো নাকি? এক্সিডেন্ট? ছিঃ ছিঃ! কি ভাবছে সে।

তিনি রোদেলাকে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে রে? জামাই ঠিক আছে? কিছু হয়েছে তোদের মধ্যে? জামাই সুস্থ আছে তো?

রোদেলার বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। মা কোন কারন ছাড়াই আবেগকে খুব স্নেহ করে৷ মাকে কি বলবে সে?

ফাতেমা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আগে প্রতিদিন ঘুমুতে যাওয়ার আগে সে মেয়ের রুমে গিয়ে গল্প-গুজব করতেন। তখন রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন ঠিক এইভাবে।

মায়ের স্পর্শ পেয়ে রোদেলা আরো ভেঙে পড়ল। এবার শব্দ করেই কেদে দিল সে৷ বুকের ভেতর পাহাড় সমান কষ্ট।এখন মনে হচ্ছে এভাবে চলে আসা ঠিক হয় নি।

ফাতেমা বেগম পুনরায় মেয়েকে প্রশ্ন করে, অফিস থেকে সোজা এখানে এসেছিস?

–হু।

–আজকে থাকবি?

–হু।

ফাতেমা বেগম মেয়ের পাশে বসে পড়েন এবং বলল, কালকে তো শুক্রবার। জামাইকে তোকে নিতে আসতে বল। সকাল সকাল আসতে বলিস।দুধচিতই ভিজাব। দুপুরে এখানে খাবে।

রোদেলা মায়ের দিকে তাকিয়ে করুন গলায় বলে, আবেগ আর কোন দিন আমাকে নিতে আসবেনা৷

ফাতেমা বেগম বিষ্ফরিত চোখে রোদেলার দিকে তাকালো। মেয়েটা কি বললো কিছুই তা বোধগম্য হচ্ছে না।

★★★

সমুদ্র ফুপির রুমে বসে আছে। চোখ দিয়ে পানি টপটপ করে পড়ছে তার। সে সারা বাসায় মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷ কিন্তু আম্মু এখনো আসেনি৷ আজকে কি অফিসে খুব কাজ আম্মুর? নাকি আম্মু তার কথা ভুলে গেছে? খুব চিন্তা হচ্ছে সমুদ্রের। আম্মু তো কোন দিন এত দেরি করেনা। আজকে কেন এখনো আসছে না। মাকে ছাড়া তার কিছুই ভালো লাগছে না। খিদাও পেয়েছে সমুদ্রের। আম্মু প্রতিদিন বিকেলে অফিস থেকে এসে তাকে নাস্তা বানিয়ে খাওয়ায়। আজকে সে নাস্তা খায় নি তাই খিদা লেগেছে প্রচন্ড। দুপুরে ফুপি ভাত খাইয়ে দিয়েছিল। এরপরে আর কিছু খায় নি সে। বাসায় সম্ভবত আজকে কিছু হয়েছে। বাবা খুব রেগে আছে। তাকে একবার অনেক জোড়ে ধমক ও দিয়েছে। সমুদ্র ভয় পেয়েছে খুব। দাদিও তাকে এক-দুই বার বকা দিয়েছে। মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে কেউ কোন উত্তর দিচ্ছে না।

সমুদ্র বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে পড়ল। বিছানার এক কোণায় তার একটা খেলনা গাড়ি পড়ে ছিল। সে গাড়িটা হাতে নিল। কিন্তু খেলতে মন চাচ্ছে না তার। আম্মুকে সারা দিন ধরে দেখেনি সে। আর ভালো লাগছে না। কোন দিন এতোক্ষণ মাকে ছাড়া থাকেনি সমুদ্র। মা সবসময় বিকেলের মধ্যেই বাসায় ফিরে আসে। আজকে রাত হয়ে গেল তবুও আসছে না।

সমুদ্র মনে মনে বলে, আম্মু একবার আসলেই বাবার রাগ পড়ে যাবে। আম্মু থাকলে বাবা কোন দিন রাগ করে থাকতে পারে না! কিন্তু আম্মু কই? আসছে না কেন এখনো? তার যে আম্মুকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মায়ের কি কষ্ট হচ্ছে না তার জন্য?

এতোক্ষনে আম্মু তাকে রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়৷ অথচ আজকে সে এতো রাতেও মাকে ছাড়া জেগে আছে একলা ৷

চলবে৷