প্রেমপ্রদীপ পর্ব-০৩

0
4499

#প্রেমপ্রদীপ
part–3
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

–ওই বেয়াদব মেয়েটার জন্য তুই কাদছিস আবেগ? ওই মেয়ে হলো খারাপ স্বভাবের মেয়ে। এইসব মেয়েরা পুরুষ,,,,

–আম্মা চুপ করো তো ভালো লাগছে না আমার৷

জাবেদা খাতুন ছেলের পাশে বসে বলল, দেখ, রোদেলার তোর জন্য কোন মায়াই নেই। কি সুন্দর নাচতে নাচতে চলে গেল। ও আসলে লোভী একটা মেয়ে।

আবেগ মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকালো।

জাবেদা খাতুন নরম গলায় বলে, রোদেলার অফিসের কলিগের সাথে তোর কথা হয়েছিল না?

–হুম।

— মেয়েটা কি বলছিলো শুনেছিস তো?

–হ্যা৷

— কি বলেছে ও?

আবেগ নির্লিপ্ত গলায় বলে, রোদেলা সিংগেল মাদার!

— দেখছিস! স্বামী থাকতেও ওই মেয়ে স্বামীর পরিচয় লুকালো। কেন লুকাবে ও? আরো কতো বিবাহিত মেয়েই তো চাকরি করে কই অন্যদের তো দেখলাম বিবাহিত হয়েও সিংগেল দাবী করতে? দেখেছিস কোন দিন? তোদের হাসপাতালে কোন লেডি ডাক্তার এরকম করে?

–নাহ।

–তোর বউ করছে এমন! তাইলে বুঝ রোদেলা কোন ধরনের মেয়ে। এইসব মেয়েদেরকে সমাজ সম্মান করে না বাবা। রোদেলাকে ভুলে যা রে আব্বা।

আবেগ মায়ের কথা শুনে বেশ মনোক্ষুণ্ণ হলো। তার খুব করে কাদতে মন চাচ্ছে। কিন্তু ওই যে প্রবাদ আছে পুরুষরা কাদে না —তাই তো প্রানখুলে কাদতে পারছে না সে৷ বুকের মধ্যে হাজারো ব্যথা এবং রোদেলার প্রতি অভিমান চাপা দিয়ে রাখছে৷ রোদেলা কেন এমন করেছে? অফিসে সবাইকে মিথ্যা বলেছে কেন? আর ওই দিন রিশাদের সাথ্ব হোটেলে যাওয়া সব তো সে নিজ চোখে দেখেছে তাহলে কিভাবে রোদেলাকে বিশ্বাস করবে সে?

কথায় আছে, ভালোবাসার মানুষকে বিশ্বাস করতে হয় কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস নয়। তাইতো আবেগ ও রোদেলাকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

জাবেদা খাতুন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, বাবা তুই কোন চিন্তা করিস না। ভুলে যা ওই মেয়েকে। আমি তোকে রোদেলার চেয়েও ভালো দেখে একটা বউ এনে দিব। তুই কষ্ট পাস না।

আবেগ মায়ের দিকে কড়া চোখে তাকালো। জাবেদা খাতুন দমে গেলেন। উনি আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু আবেগের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললেন না।

ছেলের রুম ছেড়ে বের হলেন। আজকে তিনি খুব খুশি। অবশেষে আপদ বিদায় করতে পেরেছেন। না না সে বিদায় করেনি বরং আপদ নিজ থেকেই চলে গেছে৷

আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব। তিনি তো ভাবতেও পারেনি আবেগের বিয়ে ভাঙ্গবে। তাও বিয়ের সাত বছর পর। জাবেদা খাতুন এটা ভেবেই কুল পাচ্ছে না রোদেলা অফিসে মিথ্যা কেন বলেছে? সে তো আবেগকে ভালোবাসে তাইলে মিথ্যা কেন বলেছে?

সে মেয়ের রুমে গেলেন। সমুদ্র শুয়ে ছিল। দাদিকে দেখে উঠে বসে বলে, দিদুন আম্মু কি এসেছে?

জাবেদা খাতুন খুব আগ্রহ নিয়ে বলে, না রে বাছা। তোর আম্মু আসে নি৷

সমুদ্র চিন্তিত গলায় বলে, কখন আসবে?

জাবেদা খাতুন প্রশ্নের উত্তরে বলে, আর আসবে না তোর মা৷

সমুদ্র দাদির দিকে তাকিয়ে থাকে হা করে। মা আসবে না এর মানে কি?

জাবেদা খাতুন নিজে থেকেই বলে, আমরা তোর মায়ের কেউ হই না জন্য আজকে থেকে সে আর আমাদের সাথে থাকবে না। তোর মা তোকে আর ভালোবাসে না জন্য তোর কাছে আসবে না। বুঝলি না? তোকে রেখে তোর মা অনেক দূরে চলে যাবে। তুই হচ্ছিস তোর মায়ের উটকো ঝামেলা তাই ফেলে রেখে চলে গেছে তোর মা তোকে।

সমুদ্র চোখ-মুখ লাল করে কেদে দিয়ে বলে, আম্মু আমাকে অনেক আদর করে৷। আমাকে রেখে ও যাবে না কোথাও।

জাবেদা খাতুন মুচকি হেসে বলে, তুই আর তোর বাপ দুইটাই ছাগল হইছিস! তোর মা তোর চেয়ে তার চাকরিকে বেশি ভালোবাসে। বুঝলি? এইজন্য তোকে রেখে প্রতিদিন অফিস যায়। আগে তোকে ভালোবাসত জন্য তোকে নিয়ে থাকত। এখন আর তোকে ভালোবাসে না জন্য তোকে রেখে চলে গেছে।

সমুদ্রের দাদির কথা শুনে মায়ের উপর রাগ হচ্ছে। কেন সে আসছে না এখনো? আসলেই কি মা তাকে তার ভালোবাসে না? এজন্য তাকে রেখে প্রতিদিন অফিসে যায় আর বিকেলে ফিরত? সমুদ্র ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে দেয়।

★★★

রোদেলা বিছানায় শুয়ে আছে৷ কিছুক্ষন আগেই অথৈ রাতের খাবার দিয়ে গেছে। রোদেলা তা ছুয়েও দেখেনি। ভাই আর বাবা ব্যবসার কাজে সিলেট গেছে। রোদেলা পেটে হাত রেখে সমুদ্রের কথা ভাবছিল। ছেলেটার না জানি কি অবস্থা। রাতে একা ঘুমুতে পারেনা। একা বাথরুমে যেতে পারেনা। বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিতে হয়। রোদেলা আবার রাতে সমুদ্র কে পানি খাওয়ানোর সময় পানি ওভেনে ত্রিশ সেকেন্ড উষ্ণ গরম করে খাওয়ায়। সমুদ্রের একটুতেই ঠান্ডা-সর্দি, জ্বর হয়।

রোদেলা উঠে বসল। সে মোবাইল বের করে আবেগকে কল দিল। কিন্তু বিরক্তিকর কন্ঠে একজন বলে উঠে, দুঃখিত এই মূহুর্তে আপনি যেই নাম্বারে কল করছেন তা বন্ধ আছে। সর‍্যি দি নাম্বার ইউ আর ডাইলিং ইজ সুইচ অফ নাও । রোদেলা চোখের পানি ফেলল।

আবেগের সাথে তার কখনো বড়সড় ঝগড়া হত না। কিন্তু দুই মাস ধরে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। রোদেলা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে চাকরি করে। ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে পড়াশোনা করায় ইংরেজি স্পোকিং এ বেশ পটু রোদেলা। কাজ-কর্মে ও স্মার্ট। এজন্য ব্যাংকক এ পোস্টিং এর ওফার এসেছে তার। প্রোমোশন পেয়েছে সে। কিন্তু আবেগ রাজী না। সে চায় না রোদেলা বিদেশে যাক। সংসার ফেলে চাকরি করুক।

রোদেলা আবেগ সমুদ্র সহ যাওয়ার ব্যবস্থা করছিল। কিন্তু আবেগ তাও রাজী না। সে নাকি বাবা-মা ছেড়ে বাইরে যাবে না। বউদের সাহায্যে যেতে হবে, বউয়ের অফিসের কোয়াটারে থাকতে হবে জন্য আরো জেদ চেপে ধরে যে যাবে না। এই নিয়ে তাদের মধ্যে সমস্যা চলছিল। রোদেলা এতো সুন্দর একটা ব্রাইট ফিউচার নষ্ট করতে চায় না। সমুদ্রের লাইফ টা কতো সুন্দর হবে বিদেশে গেলে। কিন্তু আবেগ রাজী না। সেই সাথে তো আবেগের মা আছেই আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করার জন্য।

আবেগকে একটু একটু কনভিন্স করছিল রোদেলা কিন্তু তার মধ্যে হুট করে আবেগ কেন যেন তাকে আর রিশাদকে নিয়ে সন্দেহ করা শুরু করল। তাদের অফিস থেকে তিনজন প্রোমোশন পেয়েছে। রোদেলা, রিশাদ আর আরো একজন।

একটা পর্যায়ে রোদেলা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে সে আর সমুদ্র যাবে। আবেগ দেশেই থাকবে। কিন্তু এরই মাঝে আবেগ তাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। তারপর কালকে কথা নাই বার্তা নাই ডিভোর্স পেপার হাতে ধরিয়ে দিল।

রোদেলা হতাশার নিশ্বাস ফেলে। মেয়েরা এতো অসহায় কেন? আজকে তার জায়গায় আবেগ থাকলে তাকে সব ছেড়ে আবেগের সাথে যেতে হত। কিন্তু আবেগের জায়গায় সে হওয়ার তাকে সকলে মিলে চাকরি না করার উপদেশ দিচ্ছে। এমন কি তার নিজের মা ও একই সুরে গান গাচ্ছে।

রোদেলা এক গ্লাস পানি খেল। তারপর বারান্দায় গেল। জানুয়ারি মাস। শীত ভালোই পড়েছে। বারান্দায় খুব ঠান্ডা লাগছে তার। তবুও দাঁড়িয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে। আবেগকে সে খুব করে ভালোবেসে ফেলেছে। আবেগের মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও আবেগ তাকে দেখেই বিয়ে করতে চাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।

আবেগের বাবা ইমতিয়াজ রহমান রোদেলার বাবার ভার্সিটির বন্ধু। সেই সুবাদে ইমতিয়াজ রহমান রোদেলার জন্য তার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল। রোদেলার বাবা তালুকদার সাহেব ছেলেকে বাসায় আসতে বলেন। যেহুতু ছেলে ডাক্তার। তাই সবাই মোটামুটি রাজী হয়েই ছিল।

এক শুক্রবারে আবেগ সহ ইমতিয়াজ সাহেব রোদেলাকে দেখতে আসেন। রোদেলা সেদিন গোলাপি রঙের শাড়ি পড়েছিল। এর আগে কোন দিন রোদেলাকে এভাবে পাত্রপক্ষ দেখতে আসেনি। তখন রোদেলা অনার্স লাস্ট ইয়ারে ছিল।

আবেগ এক দেখায় রোদেলাকে পছন্দ করে ফেলে। ইমতিয়াজ রহমান পারলে সেদিন ই ছেলের বিয়ে করিয়ে দিতেন।

রোদেলার ও আবেগকে ভালো লেগেছিল। একাকী কথা বলা থেকে শুরু করে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান সবই হয়েছিল।

আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এর পরের শুক্রবারই তার আর আবেগের ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয়ে যায়। আবেগ নাকি রোদেলাকে খুবই পছন্দ করেছে। দেরি করতে চাচ্ছিল না। ফোনে পাচ বারের মতো কথা হয়েছিল আবেগের সাথে। সাত দিনে পাচ বার!

বিয়ের পর খুব মধুর সময় কেটেছিল। আবেগের ভালোবাসা দেখে রোদেলাও আবেগের ভালোবাসায় মশগুল হয়।

এসব পুরোনো কথা ভেবে চোখে জল আসল রোদেলার। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। দরকার হলে একাই ব্যাংকক যাবে। তার সন্তান দুটোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার জন্য হলেও আবেগকে রেখেই যাবে। আবেগ তখন হারে হারে টের পাবে রোদেলার শূন্যতা!

হুট করে ফোন বেজে উঠে। রোদেলা বড়ই আশা করছিল আবেগ ফোন করেছে। সে ঠিক করে নেয় আবেগ যদি ক্ষমা চায় বা বাসায় ফিরতে বলে তবে এই মূহুর্তে রওনা হবে। কিন্তু রোদেলার আশায় পানি ফেলে দিল আবেগ। ক্ষমা চাওয়া তো দূরে থাক কলটাও আবেগের ছিল না। কল দিয়েছে রিশাদ।

রোদেলা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলটা ধরল। রিশাদের সাথে টুকটাক কথা হচ্ছে তার৷ সাধারণ কথা-বার্তা যাকে বলে।

★★★

আবেগ রাতে ভাত খায় নি। সে রুমে এসে ফোন হাতে নিল। ফোনটা বন্ধ ছিল তাই ফোন অন করেই ডায়াল লিস্টে রোদেলার নাম দেখে মনে প্রশান্তি বয়ে গেল। সে দ্রুত রোদেলাকে কল লাগায় কিন্তু ফোন ওয়েটিং এ৷

আবেগের কপালে রগ ফুলতে লাগলো। সে ফোন কেটে দিয়ে বসে পড়ে।

তারপর কি মনে করে যেন রিশাদকে কল লাগায়। রিশাদের ফো ও ওয়েটিং এ। আবেগ মনে মনে বলে, এটা কি কাকতালীয় ঘটনা? নাকি আমার মনের ভুল? যেটাই হোক না কেন? রোদেলা আর আমার নেই। হারিয়ে গেছে আমার থেকে!

এমন সময় জাবেদা খাতুন এসে বলে, তোর ছেলে তো কান্নাকাটি লাগাইছে আম্মু যাব আম্মু যাব বলে। খাচ্ছেও না। কিছু কর৷

আবেগ বিরক্ত হয়ে গেল এবং বলল, বল যে ওর মা নাই।

চলবে।