প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব-১৪+১৫+১৬+১৭

0
202

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৪

“আমি দেখেছি উনাকে। উনার পাগলামি দেখেছি। উনার ক্রোধ দেখি। উনার রাগ, জেদ, চোখের চাহনি, কোনো কিছুর পরোয়া না করা সবটা দেখেছি। আর এমন অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী যেন কোনো র*ক্তের সমুদ্রে স্নান করা কোনো নারী! উনার চোখের চাহনি সামনের যে কাউকে ঘ্রাস করে দিতে সক্ষম। উনার ক্রোধের আগুনে সব ছারখার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সত্যিই ডেভিল কুইন হিসেবে যোগ্য উনি তা প্রমাণ করেছেন প্রথম সাক্ষাতেই।”

রোজির কথাটা শেষ হওয়ামাত্র সকলের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেল। এবার মিলেছে তাদের রাজ্যের রানীর দেখা। সকলে স্বস্তি অনুভব করল। এরিক খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি কুইনের হাতে ওই চিহ্নটা পেয়েছো?”

“হ্যাঁ। আমাদের ডেভিল ক্রাউনের চিহ্ন আমি দেখে নিয়েছিলাম কৌশলেই। আর ডেভিল কুইনকে সেদিন হসপিটালে বাঁচিয়ে নিয়েছিলাম আমি। নয়ত ডক্টর যদি একবার র*ক্ত পরীক্ষা করত। তাহলে প্রমাণ হয়ে যেতো যে উনি মানুষ নন। এই খবরটা ছড়িয়ে গেলে বিপদ হয়ে যেতো। তাই তো ডক্টরের হাতে র*ক্তের স্যাম্পল দেখার সাথেই আমিও ডক্টরের পিছু নিই আর উনাকে মে*রে ফেলি। কাজটা আমি এমনভাবে করেছি যেন কেউ বুঝতে না পারে।”

“ওয়েল ডান রোজি।”

রোজি হাসে। আর প্রতিত্তোরে কাঠ কাঠ গলায় বলে,
“এটা আমার কাজ। আমার কর্তব্য। ডেভিল কুইনকে আমাদের সিংহাসনে বসানো আমার দায়িত্ব। আর উনার পর ওই সিংহাসন তো আমিই পাব। উনার শক্তি আমি পাব। সো আমাকে এর জন্য ওয়েল ডান দেওয়ার কোনো দরকার নেই এরিক।”

এরিকের রাগ হলো। তবে ডেভিল মানে শয়*তান। এর মানে হচ্ছে দুনিয়ার সবথেকে বেশি স্বার্থপর, হিংসা, মিথ্যা, ছলনা থাকবে এই সত্ত্বার মাঝে। এরিক নিজেও এমন। এমনকি এই পুরো ডেভিল কিংডম শুধু এবং শুধু স্বার্থ, মিথ্যা, ছলনা ছাড়া কিছুই বোঝে না। তারা বোঝে শুধু ধ্বংস! তাই নিজের রাগ নিবারণ করে এরিক বলল,
“যেহেতু খোঁজ পাওয়া গেছে সেহেতু এখন আমাদের গিয়ে কুইনকে নিয়ে আসা উচিত? কি বলো?”

“না উচিত নয়।”
কক্ষে প্রবেশ করে রোজির বাবা। যিনি রাজ্যের দেখাশোনা করছেন। তিনি বলেন,
“তোমরা হয়ত ভুলে যাচ্ছো যাকে আমরা ডেভিল কুইনে রুপান্তর করতে যাচ্ছি সে একজন ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। কুইন মাধুর্য এবং কিং অনুভবের মেয়ে। অনুভবের ভুলে ঐশ্বর্যের জন্মই এভাবে হয়েছে। তবে তার পরিচয় পাল্টাইনি এখনো। ঐশ্বর্যকে আমরা কুইন বানাতে চেয়েছি। কিন্তু সে ডেভিল কুইন নয়। শুধু তার মধ্যে ডেভিল কুইন হওয়ার ক্ষমতা আছে, সেই শক্তি ওর মাঝে বিরাজমান। তবে তার মাঝে সেই সত্ত্বা রয়েছে যা নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে। এখনো ঐশ্বর্যকে সাধারণ ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস বানানোর সেই শঙ্কা রয়েছে। আর রোজি, তুমি কি ঐশ্বর্যের মাঝে এমন কিছু দেখেছো? যেটা দেখে মনে হয়েছে যে এমনটা শুধু মানুষ বা ভ্যাম্পায়ার করতে পারে? বা এমন কোনো অনুভূতি কি ওর মাঝে রয়েছে যা আমাদের মতো ডেভিলের মাঝে থাকা উচিত না?”

রোজি থমকে গেল। কিছু একটা ভেবে উত্তরে বলল,
“হ্যাঁ আমি দেখেছি। বর্তমানে আমি একটা পরিবারের সাথে থাকছি। যেই পরিবারের মানুষজনকে আমি নিজের কন্ট্রোলে করে নিয়েছে। তারা সম্মোহন হয়ে আছে। আর কাকতালীয় ভাবে ওরা যাদের সাথে তাদের মেয়ে মানে রোজ বর্তমানে যেটা আমি! আমার সাথে যার বিয়ে ঠিক করছে ঠিক তাকেই আমাদের ডেভিল কুইন ভালোবাসে। আর ওই প্রেম নামের লোকটার প্রতি পাগলামি দেখে আমি জাস্ট অবাক হয়ে গেছি। এই ভালোবাসা, এই পাগলামি, এই অনুভূতি আমাদের জন্য নয়। কিন্তু আমাদের ডেভিল কুইনের মাঝে সেই অনুভূতি কাজ করে!”

রোজির বাবা এবার টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন,
“ইয়েস! দ্যাটস দ্যা পয়েন্ট! তার মানে ঐশ্বর্যের মাঝে এখনো সেই শঙ্কা আছে। আর সেটা প্রগাঢ় হচ্ছে। একবার যদি ডেভিল কুইনের বিয়ে হয় মানুষ বা ভ্যাম্পায়ারের সাথে তখন আমাদের হাতে কিছু থাকবে না।”

“সেটা আমি হতে দেব না বাবা। ডেভিল কুইনকে এই রাজ্যের সিংহাসনে বসতে হবে। আর তার জন্য আমাকে যদি ওই প্রেমের সাথে বিয়েতে রাজি হতে হয় তাহলে আমি সেটাই হবো।”

নিঝুম রাত। আকাশে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে মাঝেমধ্যে আলোকিত হচ্ছে পরিবেশ। প্রেমের অফিস গার্ডেনের ঠিক মাঝখানে কংক্রিটের রাস্তায় বসে আছে ঐশ্বর্য। উথাল-পাতাল হাওয়া বইছে চারিদিকে। সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। সেই হাওয়ার সাথে দুলছে ঐশ্বর্যের চুল। এলোমেলো চুল নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই ঐশ্বর্যের। মুখটা আকাশের দিকে করে তাকিয়ে দেখে বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে ব্যস্ত সে। মুখটা ভার তার।
“মি. আনস্মাইলিং! জীবনে প্রথমবার কারোর জন্য অনুভব করেছি। তাকে পাওয়ার জন্য নিজের পাগলামির সীমানা অতিক্রম করেছি। তারপরেও কি আপনাকে পাব না?”

ভার গলায় কথাগুলো বলে থামলো ঐশ্বর্য। হঠাৎ করেই জোরেসোরে আকাশ ডেকে উঠল। হেলদোল হলো না ঐশ্বর্যের। চোখ বন্ধ করলো সে। কারো কন্ঠে আবারও চোখ মেলে তাকালো।
“ম্যাম, আপনার এতো রাতে বাহিরে থাকা ঠিক নয়। আর স্যার বলেছে আপনাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে। রাত প্রায় একটা বেজে যাচ্ছে। আর বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। আমি আপনার জন্য গাড়ি ডাকি?”

“কোনো দরকার নেই। আমি এখানেই থাকব। আপনার স্যারকে দেখাতে হবে আমি যা বলি সেটাই করি।”

“কিন্তু অনেক বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। আপনি অন্তত গ্যারেজে যান।”

ঐশ্বর্যের মেজাজ চটে গেল এবার। কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিক্ষিপ্তভাবে বলল,
“যাব না আমি। এখানেই থাকব। আসুক বৃষ্টি। সারারাত হক বৃষ্টিতে। তাও আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।”

ঐশ্বর্যের দৃষ্টি বরাবরই ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো। আর ওর কথার ধরণ শুনলে যে কারো হৃদয় কেঁপে উঠবে। ওয়াচম্যান কিছু বলল না আর। সাহস পেল না। বরং ঢক গিলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। ওয়াচম্যান যাওয়ার সাথে সাথে নিজের হাঁটু উঁচু করে হাঁটুতে হাত রেখে মাথা লাগিয়ে নিয়ে নিচু হয়ে বসে থাকল ঐশ্বর্য। সে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে কোথাও যাবেনা আজ!

হাতে পৃষ্ঠে পানির ফোঁটা পড়তেই হুঁশ এলো ঐশ্বর্যের। মাথা উঠিয়ে তাকালো সে আকাশের দিকে। সাথে সাথে তার মুখে এসে পড়ল বৃষ্টির পানি। ঐশ্বর্য শান্ত হয়ে বসে রইল। ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল। শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি! ঐশ্বর্য চোখ বন্ধ করে রইল। বৃষ্টির প্রত্যেকটা ফোঁটাই ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। পুরোপুরি ভিজে যাচ্ছে সে। হঠাৎ একসময় সে অনুভব করল তাকে আর বৃষ্টি ছুঁতে পারছে না। ধীরে ধীরে চক্ষুদ্বয় মেলে তাকালো ঐশ্বর্য। তার মাথায় ওপরে ইয়া বড় একটা ছাতা। ছাতার মালিক কে? দেখার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু তাকালো সে। অতঃপর বাকহারা হয়ে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল ব্যক্তিটির দিকে।

“এই হার হিম করা শীতের মাঝে রাতের বেলা বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগছে তোমার?”

ঐশ্বর্যের ধ্যান ভাঙ্গে। তার সামনে স্বয়ং প্রেম দাঁড়িয়ে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল সে। আসলেই অনেক ঠান্ডা। ঐশ্বর্য কাক ভেজা হয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। সাধারণত ঠান্ডা ভ্যাম্পায়াদের প্রিয় হয়। তবে ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। তার ঠান্ডা লাগলে জ্বর আছে। তাও প্রচন্ড জ্বর। কারণ সে র*ক্ত পান করতে পছন্দ করে না। র*ক্তের প্রতি আগ্রহ কম তার। ঐশ্বর্য গরম আর আগুন জিনিসটা বড্ড ভালোবাসে। কেন সে জানে না! কাঁপতে কাঁপতে ঐশ্বর্য বলে,
“আ…আপনি না বাড়িতে চ…চলে গিয়েছিলেন?”

“বাড়িতে গিয়ে শান্তি দিলে কোথায় তুমি? তোমাকে রেখে যেতে মন চাইছিল না। তাও যখন গেলাম। তখন শান্তিতে নিজের বেডে অবধি বসতে পারিনি। তাই আবারও আসতে। এসে অবাক হয়েছি তুমি এখনো এখানে। তাও বৃষ্টিতে? তুমি কি পাগল?”

“সারাদিন তো পাগল বলেই সম্মোধন করেন। এখন আবার জানতে চাইছেন আমি পাগল কিনা? আপনিই বলুন আমি কি?”

“চলো তোমায় বাড়িতে রেখে আসব!”

ঐশ্বর্য এবারও নারাজ। মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়িয়ে বলে,
“যতক্ষণ না আপনি আমার কথা শুনছেন আমি আপনার কথা শুনছি না। আপনি চলে যান না বাড়িতে! আমার জন্য ভাবতে হবেনা আপনাকে।”

“জেদ করার কোনো মানে হয় না। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! তোমার ঠান্ডা লাগবে। অলরেডি লেগেছে! তুমি যে হারে কাঁপছো!”

ঐশ্বর্য কিছু বলার ক্ষমতা পাচ্ছে না। ঠান্ডায় তার হাত-পা অসার হয়ে আসছে। তবুও নিজের ওপর জোর খাটিয়ে বলল,
“আ…আমি কিছু বুঝতে চাই…”

পুরোটা বলতে পারল না ঐশ্বর্য। ঢলে পড়ল প্রেমের বুকে। শক্তি নেই আর তার মাঝে। চোখ দুটোও বুঁজে আসছে তার। তাই জোর করে চোখ মেলে রাখলো না আর। চোখ বুঁজে শান্ত হয়ে পড়ল সে।

“তোমাদের বলেছিলাম আমি ঐশ্বর্যের ওপর নজর রাখতে। ও কখন কি করে কাউকে কিচ্ছু বলেনা না। তোমরা নজর রাখা সত্ত্বেও কি করে বেরিয়ে গেল মেয়েটা?”

ধমকে উঠে কথাগুলো ইনায়া আর সানিয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠে চিন্তিত হয়ে পড়ল মাধুর্য। তার মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ঐশ্বর্যকে পাওয়া যাচ্ছে না। একা একা বাড়ি থেকে লুকিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে চিন্তিত মাধুর্য। অন্যদিকে অনুভব ভ্যাম্পায়ার কিংডমে রয়েছে। তাই মাধুর্য তাকেও খবর দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মেয়ের খোঁজ না পেয়ে। এবার সে বিড়বিড় করে বলল,
“বাহিরে এতো জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। জানি না মেয়েটা কোথায়! ফোনটাও রেখে গিয়েছে। ওর শরীর ঠিক নেই আর বাহিরে চলে গিয়েছে। আর কত চিন্তায় ফেলবে মেয়েটা জানি না!”

মাধুর্য দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতেই তাদের সদর দরজায় কলিংবেল বাজলো। মাধুর্য তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়াল। দ্রুত এগিয়ে গেল। তার ধারণা ঐশ্বর্য এসেছে। দরজা খুলেই ঐশ্বর্যকে ঝাড়বে বলে ঠিক করল সে। সেই অনুযায়ী দরজা খুলে কিছু বলতেই হতভম্ব হয়ে রইল সে। তার সামনে একটা যুবক। তার কোলে ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্যের কোনো হুঁশ নেই, জ্ঞান নেই। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল মাধুর্য। তাড়াহুড়ো করে ঐশ্বর্যের কাছে এগিয়ে যেতেই প্রেম বলে উঠল,
“ওর ঠান্ডা লেগেছে। বৃষ্টিতে ভিজেছে অনেকক্ষণ।”

“ওকে ভেতরে নিয়ে এসো। ওর ঘরে। তাড়াতাড়ি!”

প্রেম আর কথা বাড়ালো না। দ্রুত ঐশ্বর্যকে তার ঘরে নিয়ে এলো। মাধুর্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঐশ্বর্যকে নিয়ে।

চোখ আধো আধো খুলে তাকানোর চেষ্টা করল ঐশ্বর্য। আশেপাশে ড্রিম লাইটের আলোয় ঝাপসা লাগছে সব। কষ্ট করে পাশ ফিরতেই অনুভূত হলো এক ব্যক্তিত্বের। তার হাতের সাথে কারো হাত লাগতেই মাথা উঠিয়ে তাকানোর চেষ্টা করে ঐশ্বর্য। তারপর ব্যক্তিটির পরিচয় বুঝে মুচকি হাসল। প্রেম বসে ছিল পাশেই। ঐশ্বর্যের হাসি চোখ এড়ালো না তার। চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
“তোমার জ্ঞান ফিরেছে? তাহলে আমি যাচ্ছি!”

উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না প্রেম। ঐশ্বর্য যে সযত্নে ধরে রেখেছে তার হাত। ঐশ্বর্য মিনমিন করে মিনতি করে বলল,
“একটু কাছে বসে থাকুন না প্লিজ!”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৫

ঐশ্বর্যের মিনতি ফেলতে পারল না প্রেম। তবে মুখে কিছু না বলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। ঐশ্বর্য দুর্বল ভঙ্গিতে পিটপিট করে তাকিয়ে রয়েছে। এই চাহনি আর এই মিনতি ফেললে যেন প্রেম আফসোসে মরে যাবে। মৃদু কাঁপছে সে। কারণটা হয়ত ঐশ্বর্যের হাতের ঠান্ডা স্পর্শ। সব অনুভূতির সীমা অতিক্রম করে ঐশ্বর্যের হাত ছাড়ালো প্রেম। ঐশ্বর্যের মুখ পরক্ষণেই ভার হয়ে এলো। প্রেম দুই ধাপ এগিয়ে গেল ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। ঐশ্বর্য বুঝে গেল প্রেমের কাছে অনুরোধ করা বৃথা! তবে সে আশ্চর্য নিজের প্রতি! যে ঐশ্বর্য সারাজীবন শুধু হুকুম আর আদেশ চালিয়েছে। সবার ওপর ছুরি ঘুরিয়েছে সেই ঐশ্বর্য আজ একটা পুরুষের কাছে হার মেনেছে। বিষণ্ণ মনে অন্যদিকে ফিরতেই হঠাৎ প্রেমকে ফিরে আসতে দেখে পুলকিত নয়নে চাইলো সে। সেই নজর এড়ালো না প্রেমের। মেয়েটা এমন কেন? অল্পতেই তার মুখে রাশি রাশি খুশি ফুটে ওঠে। আজ যেন এই খুশি দেখার জন্য হলেও হয়ত এখানে কিছুক্ষণের জন্য থেকে যাবে!

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ঐশ্বর্যের পাশের চেয়ারে বসল প্রেম। বরাবরের মতো গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
“লাভটা কি হলো? এই কনকনে ঠান্ডায় বৃষ্টিতে ভিজে শুধু নিজেরই ক্ষতি করলে।”

“লাভ ক্ষতির হিসেব যদি ধরে থাকেন তবে বলব কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার সঙ্গ পাচ্ছি। এটাই আমার লাভ। এখন যদি আমি সুস্থ থাকতাম তাহলে কি আমার কথা রাখতেন? আমি জানি রাখতেন না। রাগ দেখিয়ে হয়ত চলে যেতেন। সাথে আমি যে পাগল, আমার কমন সেন্স নেই ইত্যাদি ইত্যাদি জ্ঞান দিয়ে চলে যেতেন।”

প্রেম এর উত্তরে কি বলবে তা খুঁজে পেল না। তাও আগের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল,
“আমার এতটুকু সঙ্গ পেয়ে তুমি কি পাবে?”

“মানসিক শান্তি, একটা অদ্ভুত ভালো লাগা, এতটুকু সময়ে আমার সর্বোচ্চ সুখ পাওয়া হবে। এতটুকু বলে নিজেকে শান্তনা দেওয়া হবে যে আপনি আমার জন্য একটু হলেও ভাবেন। আমি জানি, আপনি সব মানুষের জন্যই হয়ত এতোটাই ভাবেন। আপনার মতো ভালো মানুষ পাওয়া আজকাল ভাগ্যের ব্যাপার। সেক্ষেত্রে আপনার দেখা পেয়ে নিজেকে লাকি মনে করতে পারি। আপনাকে পাই বা না পাই তবুও যতটুকু সময় আপনি আমাকে দিয়েছেন ততটুকু সময় নিয়ে না হয় স্মৃতি হয়ে থাকলো!”

প্রেম এবার কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকায়। মেয়েটার হলো কি? আজকে হঠাৎ এমন কথাবার্তা বলছে কেন? প্রেমের বুঝতে সময় লাগল যে তার সামনে থাকা মেয়েটা আদেও ঐশ্বর্য কিনা! প্রেমকে এভাবে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঐশ্বর্য দুর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আমি আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি না? অনেক ডিস্টার্ব করেছি আবার অনেক ক্ষতি করেছি আপনার!”

“তা তো একটু জ্বালিয়েছো বটে। হঠাৎ এই প্রশ্ন করছো?”

“ভাবছি, আপনাকে আর বিরক্ত করব না। এতোদিন সবসময় চেয়েছি কিভাবে আপনার এটেনশন পাব। বাট পাইনি। হয়ত পাবোও না। তার থেকে আপনাকে বিরক্ত এভাবে বিরক্ত না করাই ভালো কি বলেন?”

প্রেম খানিকটা চমকে তাকালো। ঐশ্বর্য অদ্ভুত হেঁসে তাকিয়ে আছে। আজ কি হলো তার? হঠাৎ এমন কথাবার্তা যেন মানায় না ঐশ্বর্যের মুখে। তবুও প্রেম নিজেকে আগের মতো শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,
“হঠাৎ মাথায় এই সুবুদ্ধি কোথা থেকে এলো?”

“কেন? আপনার কি মনে হয়? আমার মাথায় শুধু কুবুদ্ধি থাকে?”

প্রেম একটু ভাবুক হওয়ার ভঙ্গি করে বলে,
“হুমম সেটা তো ভেবেছিলাম। কিন্তু তোমার মাথায় দেখি সুবুদ্ধিও আছে!”

“হয়তবা সেটা আপনার দৌলতেই পেয়েছি।”

প্রেম আর প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। ঐশ্বর্যের দিকে একটু ঝুঁকতেই জড়োসড়ো হলো ঐশ্বর্য। গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইল প্রেমের দিকে। প্রেম হাত বাড়িয়ে ঐশ্বর্যের কপালে হাত ছোঁয়ালো। সাথে সাথে কম্পন ধরে গেল ঐশ্বর্যের সারা শরীরে। চোখ বন্ধ করে নিল সে। অন্তর কাঁপতে লাগল। প্রেম মুখ ফ্যাকাশে করে বলল,
“জ্বর এখনো রয়েছে। কিন্তু আগের থেকে কমেছে।”

“তা তো কমবেই। মায়ের সেবা পেয়েছে। মাকে অশান্তি দিলে তো তার শান্তি হয়।”

মাধুর্যের কড়া কন্ঠে দরজার দিকে চেয়ে তাকায় ঐশ্বর্য। সেই সাথে প্রেমও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ঐশ্বর্য জানে এখন তার মা তাকে ভারি ভারি কথা শোনাবে। ঐশ্বর্যের কাছে এসে মাধুর্য বসে পড়ল। হাতে রুমাল আর পানির বাটি। রুমাল পানিতে ভিজিয়ে ঐশ্বর্যের মাথায় রুমালটা দিয়ে মাধুর্য ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“আমাকে অশান্তি না দিলে তোমার তো শান্তি হয় না তাই না? এই অসুস্থ শরীর নিয়ে রাতের বেলায় সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে কেন গিয়েছিলে বাহিরে? আমি তোমাকে বাহিরে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তাও কেন গিয়েছিলে? আমার একটা কথাও কি শুনবে না তুমি? এটা কি প্রতিজ্ঞা করে রেখেছো?”

ঐশ্বর্য কিছু বলল না। শুধু প্রেমের দিকে তাকালো। শুধুমাত্র এই ব্যক্তিটার টানে সে ছুটে গিয়েছিল। মাধুর্য আবারও বলতে শুরু করে,
“বলো কেন বাহিরে গিয়েছিলে? আজকে যদি প্রেম তোমাকে বাড়ি অবধি না নিয়ে আসতো তাহলে কি হতো তোমার ভেবে দেখেছো?”

এবার ফট করে ঐশ্বর্য নির্বিকার হয়ে উত্তর দিল,
“উনাকে তো নিয়ে আসতেই হতো মা। নয়ত উনি কোথায় যেতেন?”

এবার ভ্রুযুগল কুঁচকে চেয়ে রইল মাধুর্য। সন্দেহি হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মানে? তোমরা কি আগের থেকে চেনো দুজন দুজনকে?”

“হ্যাঁ। আমরা আগের থেকে চিনি দুজন দুজনকে। ঐশ্বর্যের যখন এক্সিডেন্ট আই মিন ওর মাথায় আঘাত লাগে আমি তখন ওকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার একটা রিকুয়েষ্ট আছে আপনার কাছে! আপনার মেয়ে অনেকটা জেদি। আর এভাবে এতো রাতে বের হওয়া ওর জন্য সেফ নয় এটা ওকে বোঝাবেন। আমি যদি আজকে না আসতাম তাহলে কি হতো আমি জানি না। তাই ওকে সাবধান করবেন।”

“থ্যাংক ইউ প্রেম। আই নো তোমাকে থ্যাংকস দিলে ছোট করা হবে। বাট থ্যাংকস বলা ছাড়া আর কিছু পাচ্ছি না। আমার মেয়েটা কারো কথা শোনেনা এটা হয়ত এতোক্ষণে বুঝে গেছো। আগের বার তোমার সাথে দেখা হয়নি। বাট আজকে দেখা হয়ে গেল। দুইবার ঐশ্বর্যকে বাঁচিয়েছো তুমি। যদি তোমার কখনো আমার হেল্প লাগে অবশ্যই বলবে।”

প্রেম নম্র সুরে বলে,
“এটা আমার দায়িত্ব ছিল। আমি এখন আসছি। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আমার মনে হয় এখন যাওয়া দরকার। নয়ত মা টেনশন করবে।”

মাধুর্য আর মানা করল না। রাত প্রায় তিনটে ছুঁইছুঁই। এবার সত্যিই প্রেমের বাড়ি যাওয়া দরকার। কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছিল সে। যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল প্রেম। ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল,
“টেক কেয়ার!”

আর তাকালো না প্রেম। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। হয়ত ঐশ্বর্যের ওই মারাত্মক চোখের চাহনি ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হতো প্রেম। সেকারণেই আর তাকায় নি। তাছাড়া ঐশ্বর্য তো বলল সে আর এভাবে ডিস্টার্ব করবে না প্রেমকে। এর মানে হতে পারে এটাই তাদের শেষ দেখা!

মাধুর্য এগিয়ে দিতে যায় প্রেমকে। ঐশ্বর্য অন্যদিক ফিরে নিজের কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকে। সবকিছু গোলমেলে লাগছে। মনে হচ্ছে মানুষটার মন পাবে না সে। সে অন্যকারো হতে চাইছে। এর মাঝে ঐশ্বর্যের স্থান কোথায়? নেই কোথাও নেই! তার ওপর কয়েকদিনের মাঝে সে ভুলে গিয়েছিল সে একজন ভ্যাম্পায়ার। শুধু তাই নয় সে ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। তার একটা সাধারণ মানুষের স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। প্রেম যদি কখনো জানে সে ভ্যাম্পায়ার কখনো তাকে মানবে না। তার থেকে কি সরে আসা উচিত না? এসব ভেবে ঐশ্বর্য দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

“আমি ভুল ব্যক্তির দিকে হাত বাড়িয়েছি। যার সঙ্গে আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আমি আর সে আলাদা। সে মানুষ। অ্যা গুড পারসন। আর আমি মানুষও না আবার ভালোও না। দুনিয়ার সব খারাপ যেন আমার মধ্যেই লুকায়িত মনে হয়। কেন এমন মনে হয়?”

চোখের কার্নিশ বেয়ে আচমকা টুপ করে অশ্রু পড়ল। বালিশে পড়ল অশ্রুকণা। চোখমুখ খিঁচে কেঁদে ফেলল সে। গুমরে কাঁদার শব্দ হতেই এলিনার কন্ঠস্বরে কিছুটা চমকে তাকালো ঐশ্বর্য। নিজের প্রচেষ্টায় উঠে বসল সে এলিনাকে দেখে। এলিনা দরজার কাছে হা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিস্ময় যেন দুচোখ থেকে যাচ্ছেই না। ঐশ্বর্য এলিনার এমন ভঙ্গি দেখে গমগমে আওয়াজে বলল,
“কি হলো? এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভূত দেখেছো নাকি?”

“তার থেকেও বেশি কিছু দেখেছি।”

“কি দেখেছো?”

হুড়মুড় করে ঐশ্বর্যের কাছে এসে ধপ করে বসে এলিনা। ঐশ্বর্যের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,
“এটা কি তুমি প্রিন্সেস? তুমি কাঁদছো?”

“কেন? কাউকে কাঁদতে প্রথমবার দেখলে?”

এলিনা বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে,
“তোমাকে আমি জীবনে প্রথম কাঁদতে দেখলাম। তোমাকে জন্ম থেকে দেখছি আমি প্রিন্সেস। তোমার জন্মের সময়ও তোমায় কাঁদতে দেখা যায়নি। ডক্টর ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যে তোমার মতো একটা বেবি কি করে না কেঁদে সুস্থ থাকতে পারে? তারপর তোমাকে ছোট থেকেও কাঁদতে দেখিনি। শুধু রাগতে দেখেছি আর অদ্ভুত ভাবে হাসতে। সেই তুমি কাঁদছো? কেন? এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?”

এবার ঐশ্বর্য খেয়াল করে ব্যাপারটা। সত্যিই তো! সে কাঁদছে! চোখের অশ্রু মুছে সে বলল,
“আমি নিজে নিজেকে কষ্ট দিয়েছি। আমার নিজের পরিচয় আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আমি যাকে ভালোবাসি এই পরিচয়ের জন্য তার আর আমার মাঝে কোনোরকম বন্ধন তৈরি করতে পারে না।”

“কেন হতে পারে না? কেন এই পরিচয় তোমার ভালোবাসায় বাঁধা হবে?”

ঐশ্বর্য এবার এলিনার দিকে হতবাক চাহনি নিয়ে তাকায়। এলিনা বলতে শুরু করে,
“মানুষ সবথেকে শ্রেষ্ঠ জীব। আমার ভ্যাম্পায়ার কিংডমে একজন আছে যে মানুষকে বিয়ে করেছে আর ভালোবেসেছে। এতে পরিচয় কোনো বাঁধা দেয় না। ভালোবাসা তোমার থাকবে প্রিন্সেস। তুমি যদি সত্যি তাকে ভালোবাসো তাহলে এই পরিচয় সেখানে বাঁধা হবে না।”
ঐশ্বর্য এবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোনোকিছু গভীরভাবে ভাবতে থাকে সে।

বাড়িতে এসেই নিজের হাতে থাকা ঘড়ি আর গায়ে থাকা ব্লেজার ছুঁড়ে ফেলে দিল প্রেম। মেজাজ চড়ে গেছে তার। আজকে সে পরিকল্পনা করে এসেছিল যে পরিবারের সবাইকে বলবে যে সে এখন বিয়ে করতে পারবে না। তার মত নেই। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াল তার বাবা। তার বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিল বিয়ের কথাবার্তা হয়ে গেছে আর এক সপ্তাহ পর বিয়ের আয়োজন শুরু করা হবে। আর রোজের ফ্যামিলির সাথে বিজনেস ডিলিং এর কারণে বিয়েতে না করতে পারবে না প্রেম। সবকিছু বিগড়ে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আর ঐশ্বর্য? সে কি সত্যিই এবার থেকে আর দেখা দেবে না?

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৬

সকালে ব্রেকফাস্ট করতে বসে নিজের মেয়েকে না দেখতে পেয়ে কিছুটা ক্ষীণ দৃষ্টিতে মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“হোয়ার ইজ মাই প্রিন্সেস? আজকে খেতেও নামল না। ও বাড়িতে আছে তো?”

“আছে তো। আপনি তো একটু আগেই এলেন। আপনার মেয়ে সারারাত ধরে যে কান্ড করেছে তাই হয়ত আর এনার্জি নেই নিচে আসার মতো?”

ঝাঁঝালো কন্ঠে অনুভবের উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুঁড়ে দিল মাধুর্য। তার চোখেমুখ এখনো ভার। মুখে কঠোরতা বিরাজমান। অনুভবের বুঝতে সময় লাগল না যে ঐশ্বর্য নিশ্চয় আবারও কোনো কান্ড করেছে। অনুভব গলা খাঁকারি দিয়ে চেয়ার নিয়ে মাধুর্যের কাছে এসে বসে তার হাতের ওপর হাত রাখতেই চোখ রাঙিয়ে তাকালো মাধুর্য। অনুভব ভয় পাওয়ার ভাব ধরে বলল,
“এইভাবে তাকিয়ো না। আজকাল মেয়ের থেকে এই ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকানো শিখছো নাকি? আমি এমনিই তোমাকে ভয় পাই। বর বউকে ভয় পায় না এমন বর আর কয়টা আছে বলো?”

মাধুর্য কিছু বলল না। আগের মতোই অনুভবের প্লেটে স্যান্ডউইচ দিয়ে নিজে প্লেটেও খাবার তুলে নিল। অনুভব নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কি করেছে আবার ঐশ্বর্য?”

“আপনার আর আপনার মেয়ের কাজ কি? সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে যাওয়া! সেটাই করেছে। কাল ওই অবস্থায় রাতে বাহিরে লুকিয়ে বেরিয়ে গেছিল। প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি হয়েছে সেখানে ভিজে একেবারে নিজের শরীর দুর্বল করে ফেলেছে।”

এবার খানিকটা চিন্তার ভাঁজ পড়ল অনুভবের কপালে।
“হোয়াট? এতো কিছু হয়েছে আমাকে জানাও নি কেন মাধুর্য? এখন কেমন আছে ঐশ্বর্য?”

“ভালো আছে। জ্বর কমেছে। আপনি ব্যস্ত ছিলেন। তাই ভাবলাম টেনশন দেওয়া উচিত হবেনা। তাই জানাই নি।”

খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অনুভব। বিড়বিড় করে বলল,
“আগে মেয়েটাকে দেখে আসি।”

বড় ডাইনিং রুমের মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি। মাঝখানে সিঁড়ি দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। অনুভব ঐশ্বর্যের রুমের দিকে যেতে উদ্যত হতেই কারো উচ্ছ্বসিত কন্ঠ ভেসে এলো।
“তোমাকে কোথাও যেতে হবেনা বাবা। ইউর প্রিন্সেস ইজ হেয়ার!”

সিঁড়ির ওপরে তাকায় মাধুর্য ও অনুভব। ঐশ্বর্য নিজে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখমুখ অসুস্থতার কারণে শুকনো লাগলেও মুখে হাসি বজায় রেখেছে সে। চোখের পলকে নিজের শক্তি দ্বারা খাবারের টেবিলের সামনে উপস্থিত হলো ঐশ্বর্য। অনুভবের মুখে প্রসারিত হাসি ফোটে মেয়েকে এখন সুস্থ দেখে।
“এইতো! আমার মেয়ে একদম ফিট অ্যান্ড ফাইন। এম আই রাইট?”

“ইয়াপ। ভ্যাম্পায়ার কিং অনুভবের একমাত্র মেয়ে আমি। ফিট না হয়ে কি করে থাকি?”

খাবারের টেবিলে হাত রেখে স্টাইলে দাঁড়িয়ে বলল ঐশ্বর্য। অনুভব এবার খাবার টেবিলের সামনে বসে পড়ল। সাথে বসল ঐশ্বর্য। মাধুর্য আগের মতোই ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ ভালো হওয়ার সাথেই এখন লাফালাফি শুরু করবে। এটাই তো তোমার কাজ। একটা কথা শুনে রাখো। যখন তখন বাহিরে যেতে আমি দেব না।”

ঐশ্বর্য শুধু মাধুর্যের কথায় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। মাধুর্য ঐশ্বর্যকে খাবার এগিয়ে দেয়। অনুভব তাড়াহুড়ো করে স্যান্ডউইচ মুখে দিয়ে বলে,
“আই এম লেট! আজকে অনেক বড় ডিল রয়েছে। সময়মতো সেখানে পৌঁছাতে হবে মিটিং এর জন্য। টাইম মেইনটেইন করতে হবে। আফটার অল ‘দ্যা শেখ ইন্ডাস্ট্রি’ এর সাথে ডিল বলে কথা। সেটা ফুলফিল করা প্রয়োজন।”

মুখে জুসের গ্লাস নিয়ে বসে ছিল ঐশ্বর্য। অনুভবের কথাতে এতো কাজ না দিলেও আচমকা গ্লাস ঠাস করে টেবিলে রেখে প্রচন্ড আগ্রহ সহিত বলল,
“হোয়াট? বাবা তুমি ইন্ডাস্ট্রির নাম কি বললে?”

“দ্যা শেখ ইন্ডাস্ট্রি! যার প্রজেক্ট এর নমুনা দেখতে যাচ্ছি আজকে। প্রেজেন্টেশন ভালো লাগলে ডিল ফাইনাল করা হবে। আই থিংক এটা বেস্ট প্রজেক্ট হবে। কারণ এটার পেছনে তারা অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছে। আর ডিল ক্যানসেল করার সুযোগ ওরা দেবে না। কারণ ডিল ক্যানসেল হলে তারা দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।”

গভীর ভাবনায় পড়ল ঐশ্বর্য। টেবিলের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে থেকে যেন গভীর ধ্যানে বসেছে সে। মাধুর্য তা খেয়াল করে বলল,
“কি হলো? খাওয়া বাদ দিয়ে কি ভাবতে শুরু করেছো?”

ঐশ্বর্য এবার মাথা ঝাঁকায়। হাতে জুসের গ্লাসটা নিয়ে অনুভবকে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
“বাবা, তোমার যদি কোনো প্রবলেম না থাকে তাহলে এই ডিলটা আমি করতে পারি?”

ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকায় অনুভব। সঙ্গে মাধুর্যও! তাদের দুজনের এমন চাহনি দেখে ঐশ্বর্য নিজেও অবাক হয়ে বলে,
“কি হয়েছে? এভাবে দেখছো কেন আমাকে? আমি জাস্ট ডিল করতে যেতে চেয়েছি। বাবা সারাদিন এতো বিজি থাকে যে নিজের রেস্ট নেওয়ার সময় পায় না। আর বাড়িতে ভালো লাগছে না একদম। আই ওয়ান্ট গো! প্লিজ বাবা!”

মাধুর্য মানা করবার আগেই অনুভব কিছু ভেবে বলল,
“জীবনে প্রথম তুমি আমার কাজে হেল্প করতে চাইলে আর আমি না কিভাবে করতে পারি? অভিয়েসলি তুমি যাবে আমার বদলে! তাহলে সিনহা কোম্পানির বর্তমান বস হচ্ছে ঐশ্বর্য সিনহা!”
ঐশ্বর্য হাসে। সেই হাসিটা অন্যরকম ছিল! সেই হাসির পেছনের কারণ কারোর জানা ছিল না!

অফিসে বারংবার নিজের প্রেজেন্টেশন দেখে চলেছে প্রেম। মনে কাজ করছে ভীষণ অস্থিরতা। এতো বড় ডিল এই প্রথম সে করছে। এতোদিন তার বাবা করে এসেছে। আজকে একটা বিগ ডিল ফাইনাল হবে। সেটা করতে পারতে কোটি কোটি টাকা লাভ আর ফাইনাল হলে কোটি কোটি টাকা লস। প্রেমের পিএ হৃদয় প্রেমের এমন অস্থিরতা দেখে শান্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“স্যার, আপনি কেন এতো টেনশন করছেন? জাস্ট রিল্যাক্স। আপনি প্রজেক্ট করেছেন আর সেটা রিজেক্ট করেছে এমন কেউ আছে? এবারও সিনহা কোম্পানির বস রিজেক্ট করার সুযোগই পাবে না।”

“আই ডোন্ট নো এনিথিং! স্যার অনুভব সিনহার কথা শুনেছিলাম আমি। উনি নাকি বেস্ট টা চয়েস করেন। জহুরির চোখ নাকি উনার। যদি উনি আসতেন তাহলে সব ঠিক ছিল। কারণ আমি জানি আমদের কোম্পানি বেস্ট টাই দেবে। বাট কিছুক্ষণ আগে ওই কোম্পানির বসের পিএ কল করে বলেছে উনি আসবেন না আজকে। উনার একমাত্র মেয়ে আসছেন ডিল ফাইনাল করতে। আমি তো উনার মেয়ের নাম অবধি জানি না।”

হৃদয় তবুও বলল,
“নো প্রবলেম। আমরা কোনো ত্রুটি রাখব না। আর ডিলটা ফাইনাল হবে!”

“আই থিংক সো, হৃদয়!”

অফিসের প্রজেক্টর রুমে বসে আছে সকলে। প্রেম অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছে ক্লায়েন্টের। সকাল ১০ টায় মিটিং শুরু হওয়ার কথা। ৯ টা বেজে ৫৫ মিনিট এখন। তবুও তাদের আসবার নাম গন্ধও নেই। প্রেম বিরক্ত। সে ৩০ মিনিট ধরে অপেক্ষা করে যাচ্ছে। মনে হয় না টাইমলি এই সিনহা কোম্পানির বস আসতে পারবে! বিরক্তির সাথে ‘চ’ এর ন্যায় শব্দ করতেই গাড়ির হর্ন বাজলো। চমকে উঠে হৃদয়ের দিকে তাকালো প্রেম। হৃদয় ছুটল তাদের রিসিভ করতে।

৯ টা বেজে ৫৯ মিনিট। প্রজেক্টর রুমের দরজা খুলল হৃদয়। আর বলল,
“ওয়েলকাম টু আওয়ার অফিস ম্যাম!”

প্রেম প্রজেক্টরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল। হৃদয়ের কন্ঠে চেয়ার ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়াল সে ক্লায়েন্টকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে। রুমে প্রবেশ করল এক নারী। চিরচেনা মুখটা দেখে ফ্যাকাশে হয়ে এলো প্রেমের চেহারা। ফ্যাকাশে প্রলেপ ছড়িয়ে পড়ল মুখে। সে যত কাছে আসতে থাকল গলা শুঁকিয়ে এলো প্রেমের। হাই হিল সাথে ফর্মাল ড্রেসআপ তার। খোলা চুল স্ট্রেইট করা। কানে বড় রিং আর হাতে চেইনের ঘড়ি। গায়ে কোট জড়ানোর। ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক! আর সে যে অসম্ভব রূপবতী সেটা প্রেমের জানা। কোনোরকমে ঢক গিলে বলল,
“তুমি?”

“ইয়েস মি. শেখ আনন প্রেম। হাই আই এম ঐশ্বর্য সিনহা। দ্যা ডটার ওফ অনুভব সিনহা। অ্যান্ড আই থিংক আমি একদম সঠিক টাইমে এসেছি?”

বলেই ফর্মাল ভাবে হাত বাড়িয়ে দিল ঐশ্বর্য। সাথে রয়েছে তার বাঁকা হাসি। প্রেম হতভম্ব। ঘড়ি দেখে নেয় সে। রাইট ১০ টা বাজে। কাঁপা কাঁপা হাতে ঐশ্বর্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলে,
“তুমি ডিল করতে এসেছো?”

“হোয়াই নট? আমি ডিল করতে পারি না ভেবেছেন নাকি? অ্যান্ড ইট অ্যা অফিশিয়াল প্লেস। সো প্লিজ বিহেব লাইক অ্যা ডিলার।”

ঐশ্বর্যের কথায় সামলে নেয় প্রেম নিজেকে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“ইয়েস। আই এম সরি। প্লিজ সিট।”

ঐশ্বর্য নির্ধারিত সিটে বসে পড়ে পায়ে পা তুলে। কিন্তু প্রেম ঠিক কমফোর্ট ফিল করছে না। উশখুশ করছে। এই মেয়ে এখানে আসবে তার ধারণার বাহিরে ছিল! না জানি এখন সে ডিল ফাইনাল করবে কিনা! সবকিছু মিলিয়ে মিটিং শুরু হয়। প্রেম নিজের বেস্ট টা দেখায়। প্রেজেন্টেশন দেখায়। সবকিছু ছিল মুগ্ধ করার মতো। ঐশ্বর্যের পিএ থেকে শুরু করে কারোর কোনো কমপ্লেন করার সুযোগ দেয়নি প্রেম। সকলের প্রশংসা শুনেছে কিন্তু ঐশ্বর্য ছিল নির্বিকার! চুপচাপ সিটে বসে ছিল সে আর কাজের সময় কথা বলেছে। কাজের কথা বলাই আরো হতবাক প্রেম। ঐশ্বর্য খুব একটা ভার্সিটি না গেলে ব্যবসা বিভাগ থেকে পড়াশোনা করে মোটামুটি ধারণা এসেছে তার। তাছাড়া তার বাবার সাথে বেশ কয়েকবার মিটিং এ গেছে সে। সব মিলিয়ে ধারণা নিয়ে সে আজ মিটিং করেছে।

অবশেষে মিটিং শেষ। সবার মুখে খুশি। সিনহা কোম্পানি থেকে সকলে মুগ্ধ। সবার ধারণা ডিল ফাইনাল। সকলের নজর ঐশ্বর্যের দিকে। ঐশ্বর্যের নজর টেবিলের দিকে। টেবিল থেকে ফাইল তুলে ঐশ্বর্য একটা বড় শ্বাস ফেলে বলে,
“সরি মি. শেখ, আমি এই ডিল আপনার সঙ্গে করছি না।”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৭

সকলে হতবিহ্বল হয়ে চাইলো ঐশ্বর্যের দিকে। ঐশ্বর্যের মাঝে নেই কোনো হেলদোল। সে আগের মতোই গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছে। প্রেম বেশ কিছুক্ষণ পাথরের মতো চুপচাপ বসে ছিল। তার পায়ের নিচ থেকে যেন সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে করে। তিল তিল করে গড়ে তোলা তার বাবার এই কোম্পানি ঐশ্বর্যের এই না বলাতে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে সেটা কি ঐশ্বর্য জানে না? টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে কাঁচের টেবিলে হাত দিয়ে বেশ জোরে আঘাত করে প্রেম চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
“হোয়াট ডু ইউ মিন? ডিল করছেন না মানে?”

“দ্যাটস ভেরি সিম্পল মি. শেখ। আপনার প্রজেক্ট আমরা রিজেক্ট করছি। কারণ আপনার প্রজেক্ট আমার পছন্দ হয়নি।”

প্রেমে মন বিষিয়ে উঠল। রাগ তড়তড় করে বাড়তে থাকলো। হনহনিয়ে ঐশ্বর্যের দিকে এগিয়ে এসে আচমকা সকলের সামনে ঐশ্বর্যের হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো প্রেম। ঐশ্বর্য কিছুটা চমকে প্রেমের চোখে চোখ রাখলো। প্রেমের চোখে স্পষ্ট ভয় এবং রাগ। ক্ষোভে ভর্তি কন্ঠে বলল,
“শাট আপ! তুমি এটা ইচ্ছে করে করছো তাই না? তুমি তো বলেছিলে আমাকে একা ছেড়ে দেবে। তাহলে কেন এমন করছো? কেন আমার পেছনে পড়েছো? আমার কোম্পানির পেছনেও পড়েছো? হুয়াই? কেন করছো এসব?”

“এক্সকিউজ মি, মি. শেখ! বিহেব ইউর সেল্ফ। ডোন্ট ফরগোট দ্যাট, যেই ঐশ্বর্য আপনাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছে সেটা অন্য ঐশ্বর্য ছিল। আর আমি বিজনেস ডিল করতে এসেছি এখানে।”

নিজের হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে ফুঁসে বলল ঐশ্বর্য। প্রেম তবুও নিজেকে শান্ত করতে পারল না। করতে পারার কথাও না। তার মস্তিষ্কের সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।
“তুমি খুব ভালো করে জানো যে এই প্রজেক্টে ঠিক কত টাকা আর কত শ্রম ব্যায় হয়েছে। সব জেনেশুনে করছো এমন। রিভেঞ্জ নিতে চাইছো?”

“আপনি কেন রিভেঞ্জ নিতে যাব তাও ছোটখাটো ব্যাপারে? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”

কথাটা বলে রেগে এগিয়ে এলো ঐশ্বর্য। আচমকা পা স্লিপ করল তার। প্রেমের সামনে পড়তে নিলে নিজেকে সামলাতে প্রেমের গলা জড়িয়ে ধরল সে। প্রেম নিজেও মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়ল। ঐশ্বর্য নিজের মুখ প্রেমের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আপনার ধারণা ঠিকই রয়েছে। ইউ আর ভেরি ইন্টেলিজেন্ট পারসন। আমার কাছে যেমন সবথেকে প্রিয় আপনি ঠিক তেমনই আপনার কাছে সবথেকে প্রিয় আপনার কাজ। এবার বুঝবেন প্রিয় জিনিস হারালে কেমন লাগে!”

প্রেমের থেকে সরে দাঁড়াল ঐশ্বর্য। প্রেম হতবাক এবং বাকশূন্য হয়ে চেয়ে রয়েছে। কথা বলার মতো সামান্যতম শক্তিও নেই। ঐশ্বর্য প্রেমের দিকে কটাক্ষ করে তাকায়। আর বলে,
“আই এম সরি। অ্যান্ড এক্সকিউজ মি!”

ঐশ্বর্য দ্রুত বেরিয়ে এলো রুম থেকে। প্রেম সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। চোখের পলক পড়ল না তার। নিজেকে তার কেমন যেন দিশেহারা লাগছে!

নিজের ঘরে বসে ভায়োলেনে সুর তোলার চেষ্টা করছিল ঐশ্বর্য। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছিল সে। বিকেল বেলা পর্দা টানিয়ে রাখা জানালা দিয়ে বেশ বাতাস আসছিল। পর্দাগুলো নিজের ইচ্ছেমতো উড়ছিল। সেই সাথে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল ঐশ্বর্যের মন। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে যখন ভায়োলেন রেখে জানালার দিকে তাকালো তখন কারো কন্ঠে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকালো সে।
“আমি সুর তুলে দেব?”

ঐশ্বর্য হালকা হেঁসে বলে,
“বাবা তুমি? এসো না! তোমার ভায়োলেন। তুমিই তো সুর তুলবে!”

“বাবাহ, আজকাল আমার মেয়েটাকেও সুর তুলতে দেখি। হোয়াট হ্যাপেন? তার মনে কি কেউ প্রেমের সুর জাগিয়েছে?”

ঐশ্বর্য মাথা নিচু করে অনুভবের কথায়। অনুভব এসে তার মেয়ের পাশে আস্তে করে বসে। এগিয়ে নেয় নিজের হাতে ভায়োলেন। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ভায়োলেন বাজাতে শুরু করে বলে,
“মনোযোগ দিয়ে শোনো!”

অনুভবের তোলা সুর সত্যিই অন্যরকম মনোমুগ্ধকর। মনটাকে শান্ত করে ফেলে এই সুর। ঐশ্বর্য চোখ বন্ধ করে ফেলে আবেশে।
“শেখ ইন্ডাস্ট্রির প্রজেক্ট হঠাৎ ক্যানসেল করেছো কেন?”

এবার চোখ মেলে তাকায় ঐশ্বর্য। অনুভব ঐশ্বর্যের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তবা প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করছে। ঐশ্বর্য আমতা আমতা করে বলে,
“প্রজেক্ট খুব একটা পছন্দের ছিল না বাবা।”

“মিথ্যা বলছো ঐশ্বর্য। কেন বলো মিথ্যে? ওই কোম্পানিটা এমনই যে তাদের প্রজেক্ট ফেলার সুযোগই কেউ পায় না। তুমি কেন রিজেক্ট করলে? সঠিক কারণ বলো!”

ঐশ্বর্য চুপ করে থাকে। তার নিরবতা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে অনুভব। ঐশ্বর্য সবসময় স্ট্রেটকাট কথা বলার মেয়ে। হঠাৎ তার চুপ থাকাটা যেন অদ্ভুত ঠেকছে অনুভবের কাছে। সে একটু শক্ত কন্ঠে বলে,
“দরকার হলে আমি আবার নিজে গিয়ে প্রেজেন্টেশন দেখব আর মিটিং করব। যদি তুমি কারণ না বলো তাহলে!”

“না বাবা প্লিজ! এই ডিলটা এখন করবে না তুমি। করতে চাইলে কয়েকদিন পর করবে প্লিজ! এখন নয়। কারণটা জানতে চেও না। এখন সেটা বলতে পারব না।”

অনুভব আর কিছু বলল না।
“এজ ইউর উইশ!”
ভায়োলেন রেখে উঠে চলে গেল সে। ঐশ্বর্য বসে রইল। তার মনে কোথাও থেকে অভিমান নাক অনুভূতিরও উপদ্রব হয়েছে। সেখান থেকেই আজ এই কাজটা করেছে ঐশ্বর্য। সে জানে প্রেমের অনেক বড় লস করিয়ে দিয়েছে সে। তবে সেটা কয়েকদিনের জন্যই। ঐশ্বর্য কিছু একটা ভেবে ক্ষীণ হাসে।
“এবার আমি আপনার কাছে যাব না শেখ আনন প্রেম। আপনি আমার কাছে আসবেন। বার বার আসতে বাধ্য হবেন।”

শীতল পরিবেশ। চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস বইছে। বারান্দার থাই দরজা খোলা থাকায় বাতাস ঐশ্বর্যের ঘর অবধি আসছিল। বাড়িতে ভালো লাগছিল না ঐশ্বর্যের। তাই ভেবেছিল বাহিরে যাবে। তাই রেডি হচ্ছিল সে। ঠান্ডা বাতাস অনুভব করাতে বারান্দার দিকে তাকালো সে। দরজা বন্ধ করা প্রয়োজন। এই ভেবে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। দরজার কাছে গিয়ে বন্ধ করার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে দেখা গেল নিচে কারো অস্পষ্ট ছায়া। দৃষ্টি ভালো করে দিতেই স্পষ্ট হলো মানুষটা। প্রেম এসেছে। ঝড়ো হাওয়ার মাঝে নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। তবে তার নজর ঐশ্বর্যের রুমের দিকেই। যেকোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে। ঐশ্বর্য মুচকি হাসলো।
“অবশেষে সেই সময় এসে গেল! আপনি আমার কাছে এসেছেন! হয়ত বাধ্য হয়ে এসেছেন। তবে এসেছেন তো!”
ঐশ্বর্য আর বিলম্ব না করে ছুটে গেল নিচের দিকে।

ঐশ্বর্য বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছে প্রেম। নিজেকে প্রস্তুত করছে সে। ঐশ্বর্যকে যেভাবেই হক এই ডিলে রাজি করাতে হবে। ভালো করে কথা বলতে হবে। তাও যদি সে রাজি হয়! কারণ প্রেম বাবাকে কখনো এ কথা বলতে পারবে না যে প্রজেক্ট ক্যানসেল হয়ে গেছে। এই মুখ নিয়ে বাড়িও ফিরতে পারবে না সে। তাই শেষবারের মতো ঐশ্বর্যের সাথে বোঝাপড়া করতে এসেছে।

“কি ব্যাপার? দ্যা গ্রেট শেখ আনন প্রেম আমার বাড়ির বাগানে চোরের মতো কি করছে?”

ঐশ্বর্যকে এই সময় এখানে আশা করেনি প্রেম। হকচকিয়ে পিছু ফিরে তাকায় সে।
“তু…তুমি?”

“কেন? আমার বাড়িতে আমি থাকব না তো কে থাকবে? আপনার উডবি রোজ?”

প্রেম রেগেমেগে বলে,
“কিপ ইউর মাউথ শাট! আমি তোমার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি।”

“ও মাই গড! যে লোক আমার থেকে সবসময় পালাতে চাইতো। সেই লোক নিজের থেকে ছুটে এসেছে আমার সঙ্গে কথা বলতে! ভাবা যায়?”

“তুমি খুব ভালো করে জানো আমি কেন এখানে এসেছি। কেন রিভেঞ্জ নিচ্ছো? প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! এই ডিল আমার কোম্পানির জন্য অনেক জরুরি।”

ঐশ্বর্য দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। আর মলিন মুখে বলে,
“আপনি আমাকে বুঝেছেন? আপনি বুঝেছেন যে আপনি আমার জন্য কতটা জরুরি?”

চলবে…