প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব-১৮+১৯+২০+২১

0
197

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৮

“তোমার জায়গা আর আমার জায়গা এক নয় ঐশ্বর্য। তুমি নিজের অনুভূতি দিয়ে আমার কাজকে বিচার করছো। আমার কাজ হারালে আমাদের পথে বসতে হবে। এক্ষেত্রে তোমার আর আমার জায়গা এক নয়।”

কঠোর ভাবে জবাব দেয় প্রেম। তবে ঐশ্বর্য নিজের সিদ্ধান্তে অটল।
“আই লাভ ইউ মি. আনস্মাইলিং!”

প্রেম দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। এই মেয়েকে কোনো কিছুতে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে ঐশ্বর্যের একটু আগে বলা কয়েকটি ওয়ার্ড তার শক্তি কেন জানি না শুষে নিয়েছে। প্রতিত্তোরে কিছু বলার শক্তিটুকু জুগিয়ে উঠতে পারছে না। সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“তুমি আমার প্রজেক্ট কেন রিজেক্ট করেছো সেটার কারণ তুমি সবার সামনে বলতে পারো নি। কোনো ভ্যালিড রিজন দেখাও নি। আর কারণ ছাড়া প্রজেক্ট রিজেক্ট করা উচিত না।”

“কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত সেটা দেখে ঐশ্বর্য কাজ করে না। ঐশ্বর্যের মন আর মস্তিষ্ক যেই কথা বলে সেটাই করে। এসব উচিতের কাজ আপনার মতো গুড পারসনের জেনে নেওয়া উচিত। আমার মতো ব্যাড গার্ল যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।”

“তার মানে তুমি কোনো মতেই আমার প্রজেক্ট কনফার্ম করবে না?”

“নেভার এভার!”

প্রেম এবার অগ্নিশর্মা হয়ে বলে,
“কি চাইছো কি তুমি?”

“আপনার অসহায়ত্ব দেখতে।”

প্রেম আর কিছু বলে না। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকে। অতঃকর কিছুক্ষণ নিরব থেকে প্রশ্ন করে,
“এতো নিষ্ঠুরতা কি করে দেখাও?”

ঐশ্বর্য হাসে। কিছুটা শব্দ করেই হাসে। হাসি থামিয়ে অদ্ভুত মোহনীয় গলায় বলল,
“নিষ্ঠুরতা তো আমার জন্মের স্বভাব। এটা কখনো যাবেনা। আপনার জন্য হয়ত একটু হলেও মনে মায়া আনতাম। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। আমি তো এমনিই নিষ্ঠুর। কিন্তু আপনি তো ভালো মানুষ। তবে আপনি কেন পাথর? আমার প্রতি এমন নির্বিকার কেন?”

“মাঝে মাঝে নির্বিকার হতে হয়। নিজের জন্য নয় নিজেরই আপনজনের জন্য। না চাওয়া সত্ত্বেও তা করতে হয় যার জন্য আমি রাজি নই। তোমার জীবনে হয়ত এমন বাধ্যবাধকতা নেই বা মানো না। কিন্তু আমাকে মানতে হয়।”

“যেটা আপনার ইচ্ছেতে হয় না সেটাতে কেন সায় দেয় মি. আনস্মাইলিং?”

প্রেম স্মিত হেসে বলে,
“কেন জানি না তাদের খুশি দেখতে ভালো লাগে। লেট ইট গো! আমি যাচ্ছি। গুড লাক ফর ইউ!”

ঐশ্বর্য কিছু বলে না আর। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রেম ফিরে যাচ্ছে। এলোমেলো তার চলন। ঐশ্বর্যের ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার তৈরি করা স্বপ্ন রাজ্য যেটা সে কল্পনায় প্রেমের সঙ্গে সাজিয়েছিল।

রাত প্রায় বারোটা বাজছে। শুনশান রাতে গাছের পাতাগুলোর শব্দ আর বাতাসের শনশন শব্দ চারিদিকে উন্মাদনা সৃষ্টি করছে। তীব্র বাতাসে উড়ে উড়ে উঠছে জানালায় থাকা পর্দাগুলো। ঐশ্বর্য উপুড় হয়ে শুয়ে এক ধ্যানে জানালা দিয়ে বাহিরের বিশাল আকাশের দিকের তাকিয়ে আছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। শীতের মাঝে ঘনঘন বর্ষা এই সময়টাকে অন্যরকম করে দিচ্ছে। ঐশ্বর্য গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছে।

বাতাসে গা শিরশিরে অনুভূতি দিলে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ঐশ্বর্য। বিরক্তির রেশ টেনে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা লাগিয়ে দিতে যায় সে। এরই মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পর্দা এক ঝটকায় টানতেই বাহিরের সদর দরজায় কারো অবয়ব দেখে ভ্রূকুটি কুঁচকে ফেলে ঐশ্বর্য। ভালো করে লক্ষ্য করে সে। তার পক্ষে অন্ধকার জায়গা ভালো করে দেখে ফেলা অসম্ভব কিছুই নয়। চকিতে বলে ওঠে,
“প্রেম! এখনো এখানেই রয়েছেন?”

নিজের শক্তি প্রয়োগ করে হুট করেই দ্রুত গতিতে বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে পৌঁছে ঐশ্বর্য। আশেপাশে কোনো ওয়াচম্যান নেই। বৃষ্টির কারণে হয়ত গ্যারেজে গিয়েছে। ঐশ্বর্যের হাতে ছাতা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে আকাশ গুড়গুড় শব্দ করছে। আশেপাশের পরিবেশ অন্যরকমভাবে যেন উল্লাসিত হয়ে পড়েছে। প্রেমের গাড়ি সামনেই দাঁড় করানো। অথচ প্রেম এখনো বাড়ি যায়নি। বা গাড়িতে গিয়েও বসেনি। সমানে ভিজে যাচ্ছে তাতে যেন প্রেমের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

চাবি দিয়ে দরজা খুলল ঐশ্বর্য। ক্যাচক্যাচ শব্দ হলো। তবুও যেন প্রেমের কোনো খেয়াল নেই। সে হারিয়ে গেছে যেন অন্য জগতে। বাহিরে এলো ঐশ্বর্য। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল প্রেম কাকভেজা হয়ে গিয়েছে একেবারে। দ্রুত এগিয়ে এসে হাত উঁচু করে ছাতা ধরল সে। তবুও কোনোরকম হেলদোল নেই প্রেমের। সে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে। ঐশ্বর্যের কপালে চিন্তার রেশ ফুটে ওঠে। সে বলে ওঠে,
“আপনি এখনো এখানে বৃষ্টির মধ্যে কি করছেন? বাড়িতে যান নি কেন?”

প্রেম এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ঐশ্বর্যের পানে। তার দৃষ্টি পলকহীন। মুখটা ফ্যাকাশে। প্রেমের চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। যা দেখে বেশ খানিকটা ভড়কে যায় ঐশ্বর্য। প্রেম শুধু চেয়েই থাকে তার দিকে। কোনো শব্দ মুখ থেকে বের করে না। ঐশ্বর্য কাতর গলায় বলে,
“আপনি তো অনেকটা ভিজে গেছেন। শরীর খারাপ করবে আপনার। বাড়ি যান।”

“কোন মুখে বাড়ি যাব? বাড়িতে যাওয়ামাত্র বাবা জিজ্ঞেস করবে ডিলের কি হলো? তখন আমি উত্তর দেব?”

রোবটের ন্যায় বলে ওঠে প্রেম। ঐশ্বর্যের অন্তর কেঁপে ওঠে। প্রেম পিছুপা হতে চেয়ে তার এলোমেলো পায়ের ধাপ দেখে বুঝে যায় সে নিজের মাঝে নেই। প্রেম পড়ে যেতে নিলে তার হাত ধরে ফেলে ঐশ্বর্য। প্রেম পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়। তার মাথা ঘুরছে। চারিদিকটা ঘোলাটে দেখছে। ঐশ্বর্যকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না সে। ঐশ্বর্য চিন্তিত সুরে বলে,
“আমি তো আমার বাবাকে বলেই দিয়েছি কালকের মধ্যে যেন আবার মিটিং করে আপনাদের কোম্পানির সাথে। আমি তো শুধু দেখাতে চেয়েছিলাম নিজের প্রিয় জিনিস হারিয়ে ফেললে ঠিক কেমন লাগে। আমি আপনার এমন অবস্থা দেখতে চাইনি।”

ঐশ্বর্যের সব কথা প্রেমের কানে পৌঁছায় না। ও নিজের মাঝেই নেই। ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারছে না। ঐশ্বর্য হাত ধরে রেখেছে প্রেমের ভিজে হাত। প্রেমের এমন অবস্থা দেখে সে অসহায় নয়নে চেয়ে বলল,
“আপনার অবস্থা ভালো নয়। আগে আমার বাড়ি চলুন। ভিজে শরীরে থাকলে আরো প্রবলেম হয়ে যাবে। পরে নিজের বাড়ি যাবেন।”

কোনো জবাবই দিল না প্রেম। শুধু ঢুলতে থাকল। ঐশ্বর্য প্রেমের হাত নিজের বাম কাঁধে রেখে প্রেমকে নিজের কাছে টেনে নেয়। প্রেমকে একহাত দিয়ে বেশ কষ্ট করে ধরে বলে,
“উফফ… এতো মোটা হতে কে বলেছে? ধরে নিয়ে যাব কি করে এখন?”

প্রেম সরে আসতে চাইলেও পারে না। সারাদিন না কিছু মুখে দেয়নি সে। পানি অবধি না। সবশেষে এমন দুর্বল অবস্থায় বৃষ্টিতে ভিজে নাজেহাল অবস্থায় সে। অনেক কষ্ট করে প্রেমের বলিষ্ঠ দেহের সমেত বেশ চোরের মতো লুকিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করল ঐশ্বর্য। অতঃপর প্রেমকে বেডে শুইয়ে দিল সে। প্রেম নিভু নিভু চোখে চারিদিক দেখছে। কথা বলার মতো জোর নেই মুখে। ঐশ্বর্য রুম থেকে বেরিয়ে আশপাশটা দেখে নিল ভালো করে। হঠাৎ করে সে গোল গোল করে তাকালো এলিনার দিকে। এলিনা বিপরীত করিডোরে হাতে খাবার নিয়ে ঐশ্বর্যের ঘরের দিকে আসছে। এলিনা ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। মাধুর্য ও অনুভব ভ্যাম্পায়ার কিংডমে গেছে। এখন এলিনাকে কি করে ম্যানেজ করবে সে? ঢক গিলে তাড়াহুড়ো করে দরজা লাগিয়ে দেয় ঐশ্বর্য। বড় বড় শ্বাস ফেলে প্রেমের দিকে তাকায়। প্রেম মৃদু কাঁপছে। হয়তবা ঠান্ডায়! পরনে এখনো ভিজে জামাকাপড়। ঐশ্বর্যের দৃষ্টি মলিন হয়ে আসে।

হাতে টাওয়াল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রেমের পাশে বসল। বেশ মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকালো মানুষটার দিকে। চুল ভিজে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। কপালে এক হয়ে আছে চুল। মুখমন্ডলে পানির একেকটা বিন্দু চিকচিক করছে। চাপ দাড়িতেও পানির বিন্দু লেগে রয়েছে। কাপড় গায়ের সাথে লেগে গেছে। দেরি না করে বেশ আদুরে ভঙ্গিতে প্রেমের চুলে টাওয়াল রাখে ঐশ্বর্য। আস্তে আস্তে করে মুছতে থাকে প্রেমের চুল। তারপর তার মুখ আস্তে করে মুছে দিয়ে নিজমনে বলে,
“জানেন, কোনোদিন এভাবে কারো সেবা করিনি। আজকে হঠাৎ করছি। আর করে এক অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছি। যেন এটা যদি সারাজীবন করতে পারি তাহলে এর থেকে বেশি আনন্দের যেন আমার কাছে কিছুই নেই।”

ঐশ্বর্য থামে। আবারও বলে,
“আপনি অত্যন্ত মোহনীয় একজন ব্যক্তি প্রেম। যার মোহতে ডুবে গেলে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না। যাকে না ভালোবেসে থাকা যাবেনা!”

এবার ভিজে জামাকাপড়ের দিকে চোখ যায় ঐশ্বর্যের। তিক্ত সুরে বলে,
“উহু, এখন এই জামাকাপড় কি করে কি করব? আপনার তো ঠান্ডা লাগবে।”

তারপর ঐশ্বর্যের খেয়ালে আসে প্রেমের হুঁশ নেই। সে নিজের কপাল চাপড়ে বলে,
“আমি কার সঙ্গে কথা বলছি? আমি তো পাগল হয়ে গেছি!”

তখনি দরজায় টোকা পড়তেই ঢক গিলে দরজার দিকে তাকালো ঐশ্বর্য। ভয়াতুর দৃষ্টিতে তাকালো। এলিনা বাহির থেকে বলল,
“প্রিন্সেস! তোমার খাবার নিয়ে এসেছি।”

ঐশ্বর্য জবাব দিলো না। চুপটি করে রইল। জবাব না পেয়ে আবারও দরজায় কড়া নাড়ে এলিনা। তবুও জবাব দেয় না ঐশ্বর্য। আবারও দরজায় জোরে কড়া নাড়তেই ঐশ্বর্য গলা খাঁকারি দিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠ করার চেষ্টা করে বলে,
“ওহ হো এলিনা! ঘুমোচ্ছি আমি। ডোন্ট ডিস্টার্ব অ্যান্ড গো!”

“কিন্তু ডিনার করলে না যে!”

“একদিন না খেলে কেউ মরে যায় না। ঘুম আমার জন্য এখন বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। যাও তো এখন।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

পায়ের ধাপ ফেলার তীব্র শব্দ পেলো ঐশ্বর্য। এর মানে এলিনা চলে যাচ্ছে। হাফ ছেড়ে নিশ্বাস ফেলল ঐশ্বর্য। অতঃপর গাঢ় দৃষ্টিতে প্রেমের দিকে তাকালো।
“আপনার জন্য মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে।”

বেশ সাহস নিয়ে এবার প্রেমের গায়ের শার্টের বোতামের দিকে হাত বাড়ালো ঐশ্বর্য। কি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! নিশ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছে। তবুও একটা বোতাম খুলল ঐশ্বর্য। তারপর দ্বিতীয় বোতাম খুলতেই নিজের চোখ চেপে ধরল ঐশ্বর্য। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল সে। এতোক্ষণ যেন শ্বাস নিতে পারছিল না। চোখ চেপে তাড়াতাড়ি বাহিরে চলে এলো সে।
“আমার দ্বারা হবেনা।”

ঐশ্বর্য তার বাবার একটা টিশার্ট আর প্যান্ট নিয়ে এলো। একজন স্টাফের হাতে তুলে দিয়ে শ্বাসিয়ে বলল,
“ভেতরে একজন শুয়ে রয়েছে তাকে চেঞ্জ করিয়ে দাও।”

স্টাফ মাথা নিচু করে নেড়ে ঐশ্বর্যের রুমের দিকে পা বাড়াতে গেলেই ঐশ্বর্য শ্বাসিয়ে বলে,
“আর আমার রুমে যে কেউ আছে এই কথা যদি অন্য কারো কানে যায় তাহলে বুঝতেই পারছো কি হতে পারে! বি কেয়ারফুল ওকে?”

স্টাফ ঘাবড়ে বলল,
“কেউ জানবে না।”

প্রেমকে চেঞ্জ করিয়ে দেওয়া শেষে এবারও গিয়ে প্রেমের কাছে বসল ঐশ্বর্য। লোকটার এমন অবস্থার জন্য নিজের রাগ আর জেদকে দায়ি করল ঐশ্বর্য। তার চোখে অশ্রুর দেখা মিলল। আচমকা প্রেমের ঠান্ডা হাত ধরে নিজের কাছে হাতটা নিয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বলল,
“আই এম সরি মি. আনস্মাইলিং। আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি।”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৯

মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া এসে পৌঁছে যাচ্ছে ঐশ্বর্যের খোলামেলা ঘরে। শিউরে উঠছে সে মাঝে মাঝে। হৃদয়স্পন্দন তীব্র থেকে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে মাঝে মাঝে গর্জে ওঠা আকাশটা কোনো অজানা আশঙ্কার ইঙ্গিত করছে যেন। চাঁদ মেঘের আড়ালে নিজেকে মুড়িয়ে ফেলেছে।

একটা নিস্তব্ধ ও শান্ত ঘর। ঘরের সব জিনিস যেন অন্যরকম দৃষ্টি পেয়েছে। প্রাণহীন বস্তুও যেন মনোযোগ দিয়ে দেখে চলেছে এক অসম্ভাবনীয় সুন্দরী রমনীকে। যার রুপে আর শক্তিতে কমতি পাওয়া অসম্ভব বলা চলে। সেই মেয়ে একটা সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মরিয়া! ঐশ্বর্যের শান্ত দৃষ্টি শুধু অবচেতন মনুষ্যের দিকেই স্থির। দৃষ্টি সরালে যেন হারিয়ে যাবে এই নিপুণ মানুষটি। ঐশ্বর্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রেম নামক এই মানুষটির খুঁত বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষটার চোখে কোনোপ্রকার খুঁত নেই। একেবারে ঘন চোখের পাপড়িতে আবৃত চোখ! গম্ভীর চাহনি যেন তার জন্য আবিস্কৃত। চাপা দাড়িতে আবৃত গালের মাঝে একটা ছোট্ট তিল। দাড়ির কারণে বোঝা না গেলেও খুব কাছ থেকে দেখলে বেশ বোঝা যায়। সুদীর্ঘ কপালে হালকা ভেজা চুলগুলো নেতিয়ে পড়ে আছে। ঐশ্বর্য সেগুলো সরিয়ে দিল। দিতেই হঠাৎ চোখে পড়ল একটা অস্পষ্ট দাগের। সেলাইয়ের দাগ মনে হচ্ছে। কপালে লেগেছিল তার মানে তার! চুল দিয়ে ঢাকা থাকায় ঐশ্বর্যের চোখে পড়েনি কখনো। কিন্তু এই খুঁতটা কেমন জানি সৌন্দর্যের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে! আশ্চর্য! ঐশ্বর্য আবারও চুল দিয়ে ঢেকে দিল কপালের সে জায়গা। ঐশ্বর্য আপনমনে বলে উঠল,
“আচ্ছা, আপনি তো আমাকে এমনিতেও দুচোখে দেখতে পারেন না। যখন জানবেন আমি আদেও মানুষই নই তখন আপনার রিয়েকশন কি হবে? নিশ্চয় আমার ছায়া অবধি ঘৃণা করবেন? আপনি আমাকে ঘৃণা করেন না আমি জানি। আবার ভালোও বাসেন না সেটাও জানি। ভালো না বাসুন তবে ঘৃণা করবেন এটা আমার কাছে অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক হবে। তাই কখনো জানবেন না আমি মানুষ না।”

উঠে দাঁড়ায় ঐশ্বর্য। গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় খোলা বারান্দায়। বৃষ্টির ঝাঁপটা চোখেমুখে এসে পড়ছে তার। চোখ মাঝে মাঝে খিঁচে বন্ধ করে নিজের কোঁকড়ানো চুল হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিতেই তার চোখে পড়ল অনুভবের ভায়োলেন। পানির ঝাঁপটাতে ফোঁটা ফোঁটা পানি চুইয়ে পড়ছে সেখান থেকে। ঐশ্বর্য একটু হেলে ভায়োলেন হাতে তুলে নেয়। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় বিছানায় শুয়ে থাকা প্রেম ব্যক্তিটার দিকে। তাকে নিয়ে হঠাৎই গান গাইতে ইচ্ছে করল তার। যেমন কথা তেমন কাজ। পিছন দিকে ফিরে রেলিংয়ের ওপর বসে প্রেমের দিকে চোখ রাখল ঐশ্বর্য। ঝাপসা ড্রিমলাইটের আলোতে বেশ সুন্দর মতো লাগছে তাকে। ভায়োলেনে সুর তুলে চোখ বুঁজে নেয় সে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চিকন সুরে গাইতে থাকে।
“Dil kho geya ho geya kisi ka!
aab rasta mil gaya
khusi ka akkhon main hai khouabsa!
kisi ka! Aab rasta mil gaya
khusi ka! Rista neya rabba,
dil chu raha hai
khiche mujhe koi dor, teri or!”

সকালটা হয়েছে অনেকক্ষণ। একঝাঁক পাখি আনন্দের সঙ্গে ডানা মেলেছে আকাশে। নতুন সকাল! নতুন প্রেরণা! বাতাসে যখন ঘরের পর্দা উড়ে ওঠে তখন দিনের আলো প্রবেশ করে ঐশ্বর্যের ঘরে। ছুঁইয়ে দেয় সেই আলো ঐশ্বর্যকে। ঘুমন্ত ঐশ্বর্য নিজের গালে বেশ জ্বলুনি অনুভব করে। বেশ বিরক্ত ও তিক্ত মেজাজে চোখ না মেলেই নিজের গালে হাত রাখে সে। তারপর একটু একটু করে চোখ মেলে তাকায়। চোখ বন্ধ করে তড়িঘড়ি করে সরে আসে রোদ থেকে। রোদ থেকে বেঁচে বড় হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। তারপর হঠাৎ করে কিছু একটা মনে হতেই রোদের দিকে তাকায় সে। এগিয়ে যায় আস্তে করে রোদের দিকে। হাতটা রোদের কাছে রাখতেই হাত পুড়ে যাবার উপক্রম হয় তার। ঢক গিলে সরিয়ে নেয় হাত। বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,
“এটা কি হচ্ছে? রোদে আমার ভ্যাম্পায়ারের সমস্যা হলেও আমার তো আহামরি রোদের এতো সমস্যা ছিল না? আমি তো রোদে ঠিকই চলাফেরা করতে পারতাম। আজ এমন জ্বলে যাচ্ছে কেন আমার স্কিন?”

কথাগুলো বলতেই তার মস্তিষ্ক জানান দিল তার রুমে সে একা নেই। আরেকটা মানুষ রয়েছে। সেই মূহুর্তেই আঁখি বড় বড় হলো তার। হকচকিয়ে তাকালো পেছনে। তাকিয়ে আরো বিস্ময়ে ভাসতে লাগল। আশেপাশে দৃঢ় দৃষ্টি দিয়ে খুঁজতে থাকলো কাঙ্খিত মানুষটাকে। কিন্তু না পেয়ে ভ্রু কুঁচকালো সে। প্রেম কোথায়? ঘুম কি এখনো তার চোখ থেকে যায়নি? দুচোখ ডলে আবারও আশেপাশে তাকালো সে। কিন্তু কেউ নেই। হঠাৎ তার ফোনের মেসেজের টোন বাজতেই চকিতে তাকালো ফোনের দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে টেবিল থেকে ফোনটা হাতড়ে নিল সে। ফোনের স্ক্রিন অন করতেই সুন্দর করে ওপরে লিখা ভেসে উঠেছে, ‘মি. আনস্মাইলিং’। মূহুর্তের জন্য যেন হৃৎস্পন্দনের থেমে গেল। কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ অন করতেই ভাসতে থাকল লিখাগুলো।
“মিস. ইরিটেটিং, সকালে উঠে নিশ্চয় আমাকে খুঁজছ? লাভ হবে না। কারণ আমি চলে এসেছি নিজের জ্ঞান ফিরতেই। হয়ত তোমার ঘুম ভাঙা অবধি অপেক্ষা করা উচিত ছিল কিন্তু পারলাম না সেটা। আর তোমার প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ যে তুমি সারারাত আমার কেয়ার নিয়েছো। সো মিস. ইরিটেটিং, তোমার যদি ফিউচারে কোনো প্রবলেম হয় তাহলে অবশ্যই আমাকে পাশে পাবে। আই প্রমিস। তুমি আমাকে নিয়ে সারাজীবন থাকার কল্পনা জল্পনা করেছো। তোমার মন ভেঙেছি আমি। তুমি কি জানো, তোমাকে যতটা বিরক্তিকর ভেবেছিলাম তুমি ততটাও নও। তোমার মধ্যে সুপ্ত নমনীয়তা লুকিয়ে রয়েছে। তোমাকে অবহেলা করা যায় না। তবুও হয়ত জিজ্ঞেস করতে পারো, কেন তোমার নাম ইরিটেটিং রাখলাম? কারণ তোমাকে নামটা স্যুট করে। আই উইশ তোমার জীবন খুশিতে ভরে যাক। আমি বলব, আমার সাথে যা করেছো ঠিক করেছো। আমি কখনো কিছুর যোগ্য ছিলাম না হয়ত।

ইউর মি. আনস্মাইলিং!”

ঐশ্বর্য থম মেরে বসে রইল মেসেজটা পড়ে। কেমন রিয়েকশন দেওয়া উচিত সে বুঝলোই না। সে বাকরুদ্ধ। তার হয়ত আর কিছু বলা উচিত না।

দেখতে দেখতে সময়ের স্রোতের সাথে পাঁচটা দিন অনায়াসে কেটে গেল। ভ্যাম্পায়ার কিংডমে গোপন কক্ষ আজ হঠাৎ করেই খোলা। কক্ষের ভেতরে দুজন নারী আর একজন পুরুষ। দুটো নারী হচ্ছে শার্লি আর মৌবনী। পুরুষটি হচ্ছে ইলহান। এরা তিনজন ভ্যাম্পায়ার প্রাসাদেরই সদস্য। সবসময় কুইন এবং কিং এর খেয়াল রেখে আসছে। তাদের হয়ে কাজ করে আসছে। এই কিংডম যেন তাদের প্রাণ। তাকে বাঁচাতে ওরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তবে আজ আকস্মিকভাবে একটা ঘটনা ঘটেছে তাদের সাথে। আচমকায় ঐশ্বর্যের আসল পরিচয় ফাঁস হয়েছে তাদের মাঝে। আর এই বিষয় নিয়ে তারা চিন্তিত। তিনজনের চোখেমুখে রয়েছে চিন্তার রেশ। নিরবতা ভেঙে শার্লি বলল,
“এতো বড় একটা সত্যি সেটা কুইন মাধুর্য বা কিং অনুভব কেউ আমাদের জানালো না?”

“নিজের মেয়ের খবর আর কি জানাবে শার্লি?”

প্রতিত্তোরে বলল ইলহান। শার্লি উত্তেজিত হয়ে বলছে,
“যার পরিচয় কিনা একজন ফিউচার ডেভিল কুইন মানে আমাদের চিরশত্রুর রানী তাকে কিনা আমাদের রাজ্যের ভবিষ্যতে রানী বানানোর চেষ্টা চলছে? এটা তো আমাদের রাজ্যের সাথে অন্যায়!”

“সেটা জানি। তবে এতে আমরা কি করতে পারি? নিয়ম অনুযায়ী সেই যুগ থেকে কিং এর মেয়ে বা ছেলেই আমাদের এই কিংডমকে সামলাবে। এতে আমরা কি করতে পারি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে বলে মৌবনী। তবে শার্লি ছাড়ল না বিষয়টা।
“কি করতে পারি মানে? আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের রাজ্যের জন্য আমরা প্রাণও দিতে পারি। আর তাছাড়া কিং আর কুইন এতো ভুল চিন্তাভাবনা করছে কি করে? একটা ডেভিলকে আমাদের রাজ্য সামলানোর দায়িত্ব দেবে? প্রিন্সেস ঐশ্বর্য তবে আমাদের রাজ্যে ধ্বং*সলীলা চালাবে। সে ধ্বংসের রানী। সে কখনো এই রাজ্যের রানী হতে পারে না। আমি এক্ষুনি কুইন মাধুর্যের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর চাইব।”

বলেই হম্বিতম্বি করে কক্ষ থেকে বের হতে নেয় শার্লি। বাঁধা দেয় মৌবনী।
“পাগলামি করো না শার্লি। কুইন এটা স্বীকার করবে না। কারণ হতে পারে উনি এর সমাধান খুঁজে চলেছেন!”

“উনার সমাধান খুঁজতে খুঁজতে আমাদের রাজ্য হয়ত মৃ*ত্যুপুরীতে পরিণত হবে মৌবনী! তুমি কি সেটা চাও?”

“সেটা চাই না কিন্তু কি করব?”

শার্লি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর মৌবনী আর ইলহানের দিকে তাকালো। তাদের কটাক্ষ করে বলল,
“তোমরা বলো, তোমরা কি এই রাজ্যকে ভালোবাসো? এই রাজ্যকে বাঁচাতে চাও?”

“হ্যাঁ চাই। প্রাণের বিনিময়ে হলেও চাই।”
একসাথে বলে উঠল ইলহান ও মৌবনী। শার্লি এবার শক্ত গলায় বলল,
“প্রাণ দিয়ে নয়। প্রাণ নিয়ে রাজ্য বাঁচাতে হবে এবার। যে রাজ্যের জন্য ক্ষ*তিকর তাকেই শেষ করে ফেলব আমরা। সে হক অন্যকেউ বা আমাদের প্রিন্সেস!”

চলবে….

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২০

“মা, পার্টিতে কি যেতেই হবে? না গেলে কি নয়?”

“কেন বলো তো? না যেতে চাওয়ার কারণ কি? এমনি রাতে যেসব ক্লাবে পার্টি হয় সেখানে গিয়ে তো জেগে পার্টি করে ছাইপাঁশ গিলে আসতে পারো। আর এঙ্গেজমেন্ট পার্টিতে যেতে কি সমস্যা হচ্ছে তোমার?”

দৃঢ় কন্ঠে ঐশ্বর্যের কথার জবাব দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল মাধুর্য। ঐশ্বর্য মাধুর্যের কথার কর্ণপাত না করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কেমন যেন ক্ষীণ দৃষ্টি তার। চোখ-মুখের লাবণ্য কোথাও ঢাকা পড়েছে হঠাৎ! চোখ বন্ধ করে ঐশ্বর্য জবাব দিল,
“আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। ব্যাস… তুমি আর বাবা যাও। আমি বাড়িতেই থাকব। পাক্কা প্রমিস! কোথাও যাব না।”

মাধুর্য আরো চটে গেল।
“না না না। তোমাকে বাড়িতে একা থাকতে দিতে পারব না। চলো তো বাহিরে যাবে আমাদের সাথে। বাড়িতে একা রাখা যাবেনা।”

শেষের কথাগুলো মাধুর্য যেন বেশ চিন্তিত কন্ঠেই বলল। ঐশ্বর্য চোখ মেলে ভ্রু কুঁচকালো। আর বলল,
“কেন? বাড়িতে একা রাখলে কি এমন হবে? বাড়ি থেকে কি কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়ার চান্স আছে কারোর?”

“উফফ… বড্ড বাড়তি কথা বলো তুমি ঐশ্বর্য। উঠে পড়ো আর রেডি হও। তোমাকে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। বলা যায় না সেদিনের মতো কোথাও গিয়ে এক্সিডেন্ট করে বসতে পারো!”

ঐশ্বর্যের সবরকম কথা উপেক্ষা করে একপ্রকার জোর করেই ঐশ্বর্যকে রাজি করালো মাধুর্য। আজ প্রেমের এঙ্গেজমেন্ট রোজের সাথে। অবশেষে ঐশ্বর্যের কথায় ডিল টা ফাইনাল হয়েছে। সেই কারণেই প্রেমের এঙ্গেজমেন্টে ঐশ্বর্যের পুরো ফ্যামিলি ইনভাইটেশন পেয়েছে। আর সেখানেই যাওয়ার তোড়জোড় চলছে।

একটা বেগুনি রঙের লং গাউন গায়ে জড়িয়ে এসে ধপ করে আয়নার সামনে বসে পড়ল ঐশ্বর্য। নিজের ডাগরডাগর চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করল নিজেকে। ঘাড় এদিকওদিক ঘুরিয়ে দেখল। এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল ঘাড়ে ছড়িয়ে আছে। নেড়েচেড়ে চুল ঠিক করার বদলে আরো ঘেঁটে দিল চুলগুলো ঐশ্বর্য।
“মা, তুমি যদি বুঝতে তোমার মেয়ে ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে আগুনে গিয়ে দগ্ধ হওয়ার মতো যন্ত্রণা উপভোগ করবে। তাহলে হয়ত তুমি কখনোই ওখানে জোর করে নিয়ে যেতে চাইতে না।”

বলে একটা মুচকি হাসি দিল ঐশ্বর্য। তবে তার হাসিতে সেই জৌলুস নেই। হেঁসে আবারও নিজের অগোছালো চুলগুলো ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঐশ্বর্য। চুলে চিরুনি চালিয়ে বলল,
“চলো, যখন অনুষ্ঠানে যাচ্ছিই তখন অনুষ্ঠানটাকে মাতিয়ে দিয়ে আসি। আজকে নিজেকে এমনভাবে তৈরি করব যে মি. আনস্মাইলিং নিজের উডবি ওয়াইফকে না দেখে আমার দিকেই আঁড়চোখে তাকাবে। অনুষ্ঠানের সকলের নজর আমার দিকে থাকবে। আই নো, মি. আনস্মাইলিং এর সৌন্দর্যের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই। যদি থাকতো তাহলে তো কবেই উনি আমাকে ভালোবেসে ফেলতেন। অবশ্য সেটাকে ভালোবাসা বলে আখ্যায়িত করা যায় না। আর এমন ভালোবাসা ঐশ্বর্যের চাই না।”

কথাগুলো অনায়াসে বলতে বলতে নিজের চুলগুলো বেঁধে একদিকে বেণী করে ছেড়ে দিল ঐশ্বর্য। কানের নিচে চুলের বেণীর ফাঁকে গুঁজে দিল একটা সাদা রঙের ফুল। সাথে ঠোঁট রাঙিয়ে দিল গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিকে। কানে লম্বা দুল পড়ে নিল যা ছুঁয়েছে ঘাড় অবধি। গলায় দিল চিকন একটা নেকলেস। আলো পড়তেই চকচক করে উঠল তা। হাতে রকমারি আংটি সেই সাথে ব্যাচলেট। সব মিলিয়ে নেওয়ার পর নিজেকে আয়নায় দেখলো ঐশ্বর্য। খারাপ লাগছে না! ভালোই লাগছে। নিজের নীল চোখের দৃষ্টি তাকে আরো আর্ষণীয় করে তুলছে। আয়নায় খানিকটা ঝুঁকে বলে,
“আমার সামনে রোজকে রিং পড়াতে আপনার হাত কাঁপবে না তো মি. আনস্মাইলিং?”

চারিদিকে তোড়জোড় চলছে। রাজমহলের ন্যায় বাড়ি আজ খুশিতে গমগম করছে। বাড়ির সাজসজ্জায় কোনো কমতি নেই। এরই মাঝে করিডোরের এক প্রান্তে সোফায় বসে হাতে একটা কালো রঙের ফাইল নিয়ে বেশ মনোযোগের সহিত দেখে চলেছে প্রেম রেলিংয়ের ওপর রাখা কফির কাপ থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেই কফির কাপ হাতে নিয়ে বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে চুমুক দিতেই কোথা থেকে যেন মিসেস. পরিণীতা হনহনিয়ে এসে প্রেমের সামনে দাঁড়ালেন। ফাইল থেকে চোখ উঠিয়ে মায়ের দিকে তাকালো প্রেম। মায়ের কড়া দৃষ্টির কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হতেই মিসেস. পরিণীতা বলে উঠলেন,
“প্রেম, তুমি কি ভুলে যাচ্ছো? আজ তোমার এঙ্গেজমেন্ট?”

“নো, অফকোর্স ভুলি নি।”

“কিন্তু তোমাকে দেখে তো সেটা মনে হচ্ছে না। আজকেও দিনেও তুমি ফাইলস্ আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত! তোমার এঙ্গেজমেন্ট এটা। একটু তো এটেনশান দাও!”

প্রেম ফাইল রেখে কিছুটা ভার গলায় জবাব দিল,
“কি মা, এটেনশান দেওয়ার কি আছে? এঙ্গেজমেন্টই তো। এখন তো ফ্রি আছে। কিছু করে অন্তত টাইম পাস করতে হবে তাই না? সে কারণেই তো ফাইল নিয়ে বসেছিলাম।”

“গেস্ট আসতে শুরু করেছে। তোমার ঘরে স্যুট রাখা আছে। রেডি হয়ে নাও চটপট যাও।”

তাড়া দিয়ে বললেন মিসেস. পরিণীতা। প্রেম বড় শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফাইল হাতে নিয়ে ঘরে যেতে নিতেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“মা, বিয়েটা এতো তাড়াতাড়ি হওয়া টা কি জরুরি?”

অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে প্রেমের দিকে তাকালেন মিসেস. পরিণীতা। হতভম্ব হয়ে বললেন,
“কি বলছো এসব? এটা কিভাবে তাড়াতাড়ি হয় প্রেম? সব ঠিকঠাক এগোচ্ছে। আর তোমাকে এভাবে বিয়ে না দিলে মনে হয় না জীবনে কখনো বিয়ে করবে বলে! তোমার উপর সব ছেড়ে দিলে জীবনে বৌমার মুখ দেখতে পাব না। আর তুমি ভুলে যাচ্ছো যে তোমার বাবা আর আমার এনিভার্সারি গিফট হিসেবে তুমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে!”

“বাট মা, আই এম নট রেডি ফর ম্যারেজ। আই নিড টাইম!”

“বিয়ের জন্য খুব একটা প্রস্তুতি নিতে হয় না প্রেম। আর এক্ষেত্রে তোমার বাবার আরেকটা ডিলও বিয়ের সম্পর্কে জুড়ে রয়েছে। এই সময় এসে সময় চেয়ো না।”

প্রেম আর প্রতিত্তোরে কিছুই বলল না। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে।

চারিদিকে সরগম। ওপরে চলছে রঙবেরঙের লাইট। আর স্পটলাইট চারিদিকে ঘুরছে। সকলে গল্প নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কেউ হাসিতামাশায় মেতে উঠেছে। আবার কেউ কেউ অপেক্ষা করছে আসল অনুষ্ঠানের। এঙ্গেজমেন্ট মিসেস. পরিণীতা বড়ই সাধ করে নিজের বাড়িতে অনুষ্ঠান ঠিক করেছেন। নয়ত এটা সাধারণত মেয়ের বাড়িতে হয়। হঠাৎ প্রেমকে দেখা যায় সিঁড়ির ওপর থেকে নামতে। স্পটলাইট পড়ে তার দিকে। সেই সবসময়ের মতো হাসি বিহীন গম্ভীর রাজ্যের অধিকারী ব্যক্তিটিকে সাদা রঙের শেরওয়ানিতে অন্যরকম স্নিগ্ধ লাগছে। সিঁড়ি থেকে যখন নামছে যে অনবরত চুল ঢেউ খেলছে। নিচে নামলেও স্পটলাইট তার দিকেই থাকল। হলরুমের এক সাইডে রয়েছে একটা স্টেজ। যেখানে মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে জুবায়ের। প্রেমকে দেখা মাত্র সে বলতে শুরু করে দিল,
“হ্যালো, লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান! আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ আপনাদের সকলের সামনে। পুরো হ্যান্ডসাম লুকে ধরা দিয়েছে প্রেম ভাই!”

কথাটা বলা মাত্র জুবায়ের এর দিকে চোখ গরম করে তাকালো প্রেম। জুবায়ের দাঁত কেলিয়ে হেঁসে বলল,
“ওহ হো ব্রাদার, আজকের দিনেও এমন চোখ গরম করতে নেই। আজকে যাই বলো না কেন ভয় পাবো না। এনিওয়ে গাইজ খবর এসে গেছে বাহির থেকে গাড়ির হর্নের সাউন্ড পাচ্ছে। আর সবাই সিউর এটা আরেকটি প্রধান আকর্ষণের আগমন হতে চলেছে। সো প্লিজ, ওয়েলকাম দ্যা লাকি গার্ল!”

সবাই উৎসুক হয়ে চাইলো সদর দরজার দিকে। আশেপাশে প্রেমের মেয়ে কাজিন গুলো অপেক্ষা করছে তাদের ভাবির দেখা মেলার। তাদের হাতে একটা করে প্লেট। প্লেটে রয়েছে অনেক গোলাপের পাপড়ি। যা দিয়ে স্বাগত জানানো হবে মেয়েপক্ষ এবং মেয়েকে। এরই মাঝে জুবায়ের তার ভাই ইফানকে ফিসফিসিয়ে বলে,
“বুঝেশুনে স্পটলাইট ফেলবি। ভাবির ওপরেই যেন পড়ে। নয়ত পাবলিকের হাতে ক্যালানি মাস্ট!”

ইফান এক গাল হেঁসে বলল,
“ইফান এই কাজে ভুল করতেই পারে না ভাই! নো টেনশন। জাস্ট দেখো কি দুর্দান্ত হয় আমাদের ওয়ান অ্যান্ড অনলি অপ্রেম থুক্কু প্রেম ভাইয়ের হবু বউয়ের আগমন!”

সদর দরজায় কে যেন পা রাখলো। মাথা নিচু করল নিজের লং গাউন সামলাতে ব্যস্ত সে। চোখেমুখে প্রচন্ড বিরক্তি ছেয়ে আছে। হঠাৎ করেই তার খেয়াল হলো তার ওপর স্পটলাইট পড়েছে। বিরক্তি ছেড়ে আশেপাশে নির্বাক হয়ে দৃষ্টিপাত করল। স্পটলাইট তার দিকে তার আশেপাশের সকলে হা করে তাকে দেখছে। নিজের প্রতি অস্বস্তি লাগা শুরু করল ঐশ্বর্যের। যার ওপর স্পটলাইট পড়েছে সে হচ্ছে ঐশ্বর্য। আচমকাই তার ওপর ফুলের পাপড়ি বর্ষিত হলে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল ঐশ্বর্য। সবই হঠাৎ করেই হয়ে গেল। ঐশ্বর্য নিজেই হতভম্ব। ঐশ্বর্যের পেছনে এসে দাঁড়াল অনুভব এবং মাধুর্য।

সবদিকে নিরবতা। পরিস্থিতি সামলাতে প্রেমের বাবা এগিয়ে এলেন অনুভবকে ওয়েলকাম জানাতে।
“ওয়েলকাম মি. সিনহা! ওয়েলকাম ওয়েলকাম!”

অনুভব ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো। ঐশ্বর্য এখনো হতভম্ব। কি হলো তার সাথে?

জুবায়ের এসব দেখে ইফানকে সাইডে নিয়ে এসে বলল,
“এই ব্যাটা, সব নাকি ঠিকঠাক করিস? এটা কি করলি?”

ইফান লাজুক লাজুক হয়ে বলল,
“আমার কি দোষ? ওই মেয়েটাই এতো সুন্দর ছিল যে স্পটলাইট আপনাআপনি ওর দিকে চলে গেছে।”

“হপ! সব ঘেঁটে দিলি।”

“ধুর রাখো তো এসব। আগে গিয়ে ওই মেয়েটার খোঁজ লাগাবো। সিঙ্গেল হলে প্রেম ভাইয়ের পর আমার পালা আসবে।”
দাঁত কেলিয়ে বলল ইফান।

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২১

বাড়িতে রোজ ও তার পরিবারের আগমন হয়েছে। তবে রোজের আগমনে যেমন স্বাগত জানাতে চেয়েছিল সেভাবে হয়নি আর। ঐশ্বর্যকে আগমন করেই সকলে হকচকিয়ে গেছে পুরোপুরি। অথচ ঐশ্বর্য তার কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ না করে হলরুমের এক কর্ণারে থাকা বারের সামনে পায়ে পা তুলে বসে আছে। নীল রঙের ঘোলাটে আলো পড়ছে তার ওপর। সব কিছু নীল নীল লাগছে। লোকজন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঐশ্বর্যের প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে। এমন এক সুন্দর রমনীর আবির্ভাব হয়েছে এখানে। সেখানে তো লোকজনের নজর থাকবেই। তবে অনেকে ঐশ্বর্যের বারের সামনে বসে থাকা নিয়ে ভ্রু কুঁচকাচ্ছে। মেয়েকে বারের সামনে মানায় না। তাও হরেক রকম ড্রিংকসের সামনে। ড্রিংকস সার্ভ করা একটা বয় এলো তার সামনে। ফোনে চোখ লাগিয়ে রাখা ঐশ্বর্য মাথা উঠিয়ে তাকিয়ে বলল,
“ওয়ান গ্লাস!”

ড্রিংকস সার্ভ বয় মাথা নাড়িয়ে অন্যদিকে গিয়ে গ্লাস এনে এগিয়ে দিল ঐশ্বর্যের দিকে। অতঃপর গ্লাসটা হাতে নিয়ে আশেপাশে তাকালো ঐশ্বর্য। আসার পর থেকে প্রেমকে সে কোথাও দেখেনি। রোজ এখানেই উপস্থিত। তবে তার উডবি হাজবেন্ড কোথায়? এসব ভাবনা বাদ দিয়ে ঐশ্বর্য গ্লাসে চুমুক দিতেই হুট করে কোথা থেকে যেন একটা ছেলে এসে টুল টেনে বসল ঐশ্বর্যের পাশে। ঐশ্বর্য কিছুটা চকিতে তাকালো ছেলেটার দিকে। পরনে নেভি ব্লু শেরওয়ানি, হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। অনেক বড় বড় চুল অগোছালো হয়ে রয়েছে। আর মুখে বোকা বোকা হাসি। ঐশ্বর্যের কাছে কেন জানি না হাসিটা বোকা বোকায় মনে হলো। কিন্তু মুখে কিছু না বলে হাতের গ্লাসটা শক্ত করে ধরতেই ছেলেটা বলে ওঠে,
“মেয়ে হয়ে ড্রিংকস করো? কুল! ”

“এক্সকিউজ মি! এটা কোথায় লিখা আছে যে ড্রিংকস শুধু ছেলেরা করতে পারবে? মেয়েরা পারবে না? আর যদি এখানে মেয়েরা ড্রিংকস করতেই না পারতো তাহলে স্পেশালি সাইনবোর্ড টানাতে পারতেন যে অনলি ফর ম্যানস!”

ঐশ্বর্যের এমন উত্তর শুনে যে বেশ থতমত খেয়ে গেছে ছেলেটা সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার মুখটার থেকে সেই বোকা হাসি গায়েব হয়ে থমথমে হয়ে গিয়েছে। ঐশ্বর্য আর কথা না বাড়িয়ে গ্লাসে চুমুক দিল। গ্লাসে স্কচ রয়েছে। ঐশ্বর্যের পছন্দ না হলেও সেটাতে চুমুক দিল। অনেকদিন হলো এসব সে ছাইপাঁশের আশেপাশে সে যায় না। প্রেমের প্রেমে নিজের আগের জীবনটাকে ভুলতে বসেছিল সে। তাই হঠাৎ করে ড্রিংকস নেওয়ায় কেমন জানি বিদঘুটে লাগছে বটে! ছেলেটা এবার তার প্রতিত্তোরে বলল,
“না না আপনি ভুল ভাবছেন আমি সেটা বলিনি। অবশ্যই এটা সবার জন্য। বাট আপনাকে দেখে মনে হয়নি আপনি এসব খেতে পারেন বলে! তাছাড়া আজকালকার মেয়েরা সফট ড্রিংকস পছন্দ করে সো…”

ছেলেটাকে কথার মাঝপথে থামিয়ে ঐশ্বর্য বলে ওঠে,
“সো আপনি এক্সপেক্ট করেছিলেন আমিও হালকা কিছু পছন্দ করব? আপনি ভুল ভেবেছিলেন। আর অন্যকেউ যা ভাবতে পারে না ঐশ্বর্য সেটা ভাবতে পারে। কারো ভাবনার ঊর্ধ্বে ঐশ্বর্য। আর আমার গায়ে বা ড্রেসে কোথাও লিখা আছে নাকি যে আমি হার্ড ড্রিংকস পছন্দ করি না?”

“নো নো। আই এম কিডিং। সো আপনার নাম ঐশ্বর্য রাইট? হাই আমি ইফান। যার এঙ্গেজমেন্ট হচ্ছে আই মিন প্রেম ভাইয়ের কাজিন।”

ঐশ্বর্য ফোনেই তাকিয়ে ছিল। ইফানের কথা যেন কিছুক্ষণের জন্য ওর কান অবধিই পৌঁছায়নি! কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
“সো হোয়াট?”

এবার ইফান বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ভ্যাবাচেকা খেয়ে ঢক গিলে বলল,
“আমাকে ডাকছে। এক্সকিউজ মি!”

বলে আর এক মূহুর্ত সেখানে বসে রইল না। লজ্জায় মাথা নিচু করে উঠে স্থান ত্যাগ করল। মেহমানদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল জুবায়ের। সেই সময় মুখ কাঁচুমাচু করে এসে পাশে দাঁড়াল ইফান। ইফানের মুখ দেখে তার বুঝতে দেরি হলো না যে সে কিছু ঘটিয়ে এসেছে। তাই দুজন একটু আলাদা এসে জুবায়ের জিজ্ঞেস করল,
“ব্যাপার কি? এমন চুপসানো মুখ নিয়ে কি করছিস? মনে হচ্ছে কেউ তোর বেলুন ফাটিয়ে দিয়েছে। বেলুনের সাথে তুইও চুপসে গেছিস।”

“জীবন থাকতে আর কারো লগে ফ্লার্ট করার ট্রাই করব না। মাফ চাই দোয়াও চাই! লাইফে ফার্স্ট টাইম এক লারকি মেরে দিলকো ছু দিয়া। পার উসকা এডিটিটিউ ফায়ার হায় ফায়ার!”

জুবায়ের ভ্রু কুঁচকালো। ইফানের কথার বোঝার চেষ্টা করল। অতঃপর তার কিছু একটা মনে হতেই চোখ বড় বড় করে বলে উঠল,
“ওয়েট ওয়েট! তুই কি ওই মেয়েটার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলি নাকি?”

“হু! পাত্তা দিল না। জীবনটা বেদনা!”

“কে পাত্তা দিল না?”

জুবায়ের কিছু বলার আগেই পেছন থেকে প্রেমের গম্ভীর কন্ঠস্বর পেয়ে কেঁপে উঠল দুজনেই। প্রেম তাদের কথা শুনতে এগিয়ে এলো। ইফানের ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
“কি হয়েছে?”

“কিছু না ভাই। তোমার তো রোজের থুক্কু ভাবির সাথে থাকার কথা। এখন আমাদের কথায় কান দিও না।”

ইফানের কথা শেষ হতে না হতে জুবায়ের হেঁসে কুটি কুটি হয়ে বলে,
“আর বলিয়ো না ভাই! ছেলেটা শখ করে গিয়েছিল ফ্লার্ট করতে। কিন্তু পাত্তা না পেয়ে এসে কাঁদছে।”

“সিরিয়াসলি? কোন মেয়ে ইফানকে পাত্তা দিল না?”

ইফান কাঁদো কাঁদো হয়ে বারের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিল। প্রেম মাথা উঠিয়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখতেই তার পুরো চোখজোড়া ধাঁধিয়ে গেল। নরম হয়ে এলো দৃষ্টি। শিরায় শিরায় ঠান্ডা হয়ে এলো। প্রেমের মনের ফাঁকে একটা প্রশ্ন উঁকি দিল, ‘এই রমনী আজ এতো সুন্দর হয়ে এসেছে কেন? পারতো না একটু অগোছালো হয়ে আসতে? সে না আসলেও তো পারতো। কেন এসেছে? এই সৌন্দর্যময়ী কি জানে না? সে থাকলে হয়ত এই এঙ্গেজমেন্ট তার পক্ষে করাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। তার হৃদয় কাঁপবে। ছুটবে। আর্তনাদ করবে?’

ইফানের কথায় নিজ হুঁশে এলো প্রেম। ঢক গিলে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
“ওই মেয়ে তোদের পাত্তা দেবে না। ওর দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করিস না।”

ইফান আর জুবায়ের চোখ গোল গোল করে তাকালো। উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“কেন কেন কেন? কি হয়েছে? নজর দেওয়া যাবে না কেন?”

“ব্যা…ব্যাস এমনিই। ও তোদের পাত্তা দিবে না তাই।”

“তো কাকে দিবে তোমাকে?”
দাঁত কেলিয়ে বলল ইফান। প্রেম ভড়কে গেল। তবে নিজেকে সামলে বলল,
“তা কেন হবে? তোরা যা তো। বাড়িতে এতো গেস্ট আর ফাইজলামি শুরু করেছিস।”

বলেই সেখান থেকে এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলে চলে আসে প্রেম। খুব ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে বারের দিকে। সেখানে বসে থাকা ঐশ্বর্যের দিকে। এমনভাবে এগোচ্ছে যেন ঐশ্বর্য টের না পায়। ঐশ্বর্যের পেছনে দাঁড়িয়ে আচানক ঐশ্বর্যের হাত থেকে গ্লাস এক টানে নিজের হাতে নিয়ে ফেলে সে। একধ্যানে ফোন নিয়েই বসে ছিল ঐশ্বর্য। কোনো আগন্তুকের এমন ব্যবহারে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে পিছু ফিরে চিল্লিয়ে উঠল…
“হোয়াট দ্যা…”

পুরো কথা সম্পূর্ণ না করতেই যখন ঐশ্বর্যের সেই অক্ষিকোটরে বন্দি হলো প্রেম নামক ব্যক্তিটি তখনই থামলো সে। এক মুহূর্তের জন্য যেন থেমে গেল ঐশ্বর্যের দুনিয়া। মানুষটি আগন্তুক নয়। মানুষটি তার চেনা। তারই প্রিয়! নিজেকে সামলাতে সময় লাগলেও বেশ হেঁসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওপপস… মি. পাত্র, আপনি? তো নিজের উডবিকে রেখে আমার গ্লাস নিয়ে টানাটানি করছেন কেন?”

“ইটস অ্যা এঙ্গেজমেন্ট পার্টি ঐশ্বর্য। তোমার ছাইপাঁশ খাওয়ার জায়গা নয়।”

“তো বার দিয়ে রেখেছেন কেন? আশ্চর্য!”

প্রেম চোখ গরম করে তাকায় এবার। হাতের গ্লাস জোরে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“রেখেছি। বাট তোমার জন্য নয়। তোমার মা দেখলে কি ভাববে? আর বাকিরা সবাই ভালো চোখে দেখছে ভেবেছো?”

ঐশ্বর্য নির্বিকার সুরে উত্তর দিল,
“তো আমি কি সবার কাছে গিয়ে হাতজোড় করে বলেছি? যে আমাকে ভালো ভাবো, আমাকে ভালো ভাবো? না তো! আমাকে কে খারাপ ভাবলো আর কে কি ভাবলো তা নিয়ে আপনার মাথা ঘামাতে হবে না।”

বলে আবারও বারের সামনে বসতে নিল ঐশ্বর্য। কিন্তু প্রেম এবার হাতটা টেনে ধরল ঐশ্বর্যের। ক্ষোভের সাথে বলল,
“আমি মাথা ঘামাচ্ছি কারণ তোমাকে মানুষ কি বলল না বলল তাতে তুমি না ভাবলেও ভাবনাটা আমার আসে।”

“আমাকে বসতে দিন!”

ঐশ্বর্যের এমন দায়সারা কথায় চোটে গেল প্রেম। তার হাত ধরে টানতে টানতে অন্যদিকে নিয়ে চলে গেল।

এসব কিছু বেশ মনোযোগের সহিত দেখল জুবায়ের আর ইফান। দুজনেই দুজনের দিকে তাকালো। মাথা নাড়ালো। তারপর জুবায়ের প্রশ্ন করল,
“কিছু বুঝলি?”

ইফান একটু ভেবে বলে,
“বুঝিনি। বাট এতটুকু বুঝেছি ডাল মে কুছ কালা হায়।”

“এই কালা ডাল আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”

ঐশ্বর্যকে প্রেম টানতে টানতে করিডোরের কাছে নিয়ে এসে বলে,
“এখানেই থাকবে। নয়ত নিচে সব গেস্টদের সাথে। বারের ধারের কাছেও যাবেনা।”

“আমি যাব তো আপনার কি?”

“তুমি বেশি প্রশ্ন করো ঐশ্বর্য!”

ঐশ্বর্য কিছু বলল না ফোঁস করে তাকালো। তখনি একজন এসে প্রেমকে বলল,
“আপনাকে নিচে ডাকছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে।”

প্রেম সম্মতি জানিয়ে বলে,
“আমি আসছি। আমাকে একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে।”

তারপর প্রেম ঐশ্বর্যকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“লিসেন! এখানেই থাকবে। বলে দিলাম!”

বলেই করিডোরের অন্যপাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করে প্রেম। ঐশ্বর্য ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকলেও হঠাৎ তার খেয়াল হয় রোজের দিকে। রোজ প্রেমের পিছু পিছু যাচ্ছে। তাও যেন তেড়ে যাচ্ছে। করিডোরে তেমন কেউ নেই। সবাই নিচে। প্রেমের খেয়াল নেই। ঐশ্বর্য এগিয়ে গেল। এগোতে এগোতে ঐশ্বর্যের চোখে পড়ল রোজের অপ্রত্যাশিত রূপ। রোজের চোখের রঙ বদলিয়ে ক্রমাগত লাল হয়ে যাচ্ছে। চেহারা হয়ে উঠছে হিং’স্র। রোজ প্রেমের পিছু যাচ্ছে। এমন সময় কেউ তার মুখ চেপে ধরে আর হাওয়ার বেগে তাৎক্ষণিক ছাঁদে আবিষ্কার করে সে। রোজকে ছেড়ে ধাক্কা দেওয়া হয়। রোজ রেগেমেগে পেছন ঘুরতেই দেখে স্বয়ং ঐশ্বর্যকে। তৎক্ষনাৎ নিজেকে স্বাভাবিক করে রোজ। চোখের রঙ বদলে স্বাভাবিক হতে থাকে। এমন সময় ঐশ্বর্য রাগে ফুঁসে উঠে বলে,
“ইনাফ! নিজের রঙ বদলানোর দরকার নেই। আমি দেখে ফেলেছি তোমার আসল রূপ। নিজের আসল রূপে এসো।”

রোজ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার নিরবতা ঐশ্বর্যকে আরো রাগিয়ে তোলে। তার চোখে ভাসতে থাকে প্রেমের দিকে তেড়ে মারতে যাওয়ার দৃশ্য। চিৎকার দিয়ে উঠে নিজের আসল রুপে আসে ঐশ্বর্য। নখ অস্বাভাবিকভাবে ধারালো আর লম্বা হয়। শরীরের প্রতিটা রগ ফুলে সবুজ হয়ে ওঠে। চোখের রঙ নীল বদলে লাল টকটকে হয়ে ওঠে সেই সাথে ঠোঁটের দুই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে ধারালো দাঁত।
“সাহস একটু বেশি করে ফেলেছো। আমার প্রিয় মানুষকে আ’ঘাত করতে গিয়েছো। তাকে আ’ঘাত করার কথা ভেবেছো। আমি মানুষ হলে হয়ত ছাড় পেতে। আমি যে মানুষ নয় রোজ।”

“আমিও তো মানুষ নই। কথায় বলে রতনে রতন চেনে। আর শয়’তান শয়’তানকে চেনে।”

রোজ এবার মুখ খুলে কথাগুলো বলে। নিজের আসল রূপে আসে সে। কি হবে আর এই খোলস রেখে? ঐশ্বর্য কিছুটা হতবাক হয়।
“কে তুমি? কি তোমার পরিচয়?”

“ডেভিল। আপনার জন্য এই মানুষের জগতে এসেছি আমি। আজ পর্যন্ত যা যা করেছি সব আপনার জন্য করেছি। আপনার আদেশ শিরোধার্য ডেভিল কুইন!”

চলবে….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]