প্রেম তরঙ্গ ২ পর্ব-০৩

0
215

#প্রেম_তরঙ্গ২
#আলিশা
পর্ব~~৩

— তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না রোজ

— ওহ, টিটাস, কানিজ আমার মেয়ের মতো। ওর এটুকু খেয়াল রাখা কোনো ব্যাপার ছিল না আমার জন্য।

তিতাস কৃতজ্ঞতায় রোজ নামের মেয়েটাকে মুচকি একটা হাসি উপহার দিলো। তাদের মাঝে কথা হলো সম্পূর্ণ ইংরেজিতে। কানিজ তার রুমের দরজার নিকট দাড়িয়ে দেখে গেলো তাদের। হঠাৎ এরই মাঝে রোজ এগিয়ে গেলো কানিজের নিকট। কানিজ রোজের ডাক পেয়েই তড়িঘড়ি করে এসে দরজার দাড়িয়ে ছিল। যেহেতু তার ববা সাথে রোজ কথা বলছিলো তাই সে আর বাগড়া দেয়নি তার মাঝে।

— লাভ ইউ সো মাচ, কানিজ

— লাভ ইউ ঠু মম।

কানিজ মুচকি হেসে বলল। রোজ কানিজের কপালে চুমু দিয়ে শুদ্ধ ইংলিশে বলল

— আমার কষ্ট হচ্ছে তোমাকে রেখে যেতে। এই এক মাসে তোমার সাথে মিশে গিয়েছিলাম। আর তোমাকে ধন্যবাদ আমার কথা রাখার জন্য। আমাকে মম ডাকার জন্য। আমি তোমার মাঝে আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুঁজে পাই।

কথা ব্যাক্ত দশায় রোজের চোখ উপচে পরলো জল। কানিজ হাত বাড়িয়ে যত্ন করে জল মুছে দিয়ে ইংরেজিতে সান্ত্বনা দিয়ে বলল

— কেঁদো না। সে আছে। দূর আকাশে তারা হয়ে আছে। আমারও তো মা নেই রোজ। আমি কিন্তু তোমাকে মা ডেকেছি। তুমি আমায় মেয়েই ভেবো।

কানিজের কথায় রোজের কান্নার মাত্রা বাড়তে চাইলেও সে থমকে দিলো তা। ঘুড়ে দাঁড়ালো তিতাসের দিকে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিদায় নিলো। কানিজ, তিতাস তাকে বাসার গেট থেকে বিদায় দিলো বিষন্ন মনে মলিন হেসে। রোজ আজ পনেরো দিনের মতো কানিজের কাছে ছিলো। তিতাস গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। ডাক্তারি পেশার দরুন। সেক্ষেত্রে কানিজের খেয়াল -খুশি দেখার জন্য রেখে গিয়েছিল রোজকে। রোজ তিতাসের সুপরিচিত এক কলিগ।

.
আমেরিকার ক্লিভল্যান্ড শহরে তখন সাঁঝ নামার তাড়া। প্রকৃতির এক স্নিগ্ধ রুপ ফুটে উঠেছে। ইরি লেকের থেকে খুব দূরে নয় কানিজের বাসা। তার কক্ষ হতে সম্মুখের স্বচ্ছ কাচের গায়ে দৃষ্টি ফেললে সহজেই দেখা মেলে ইরি লেকের। দূরে কোথাও দেখা যায় সারি সারি পালতোলা নৌকা। জল ভরা লেকের শান্ত রূপ আজ চোখ যতোই ধারণ করছে কানিজ ততই যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। মনের কৌতুহল মেটানোর আকাঙ্ক্ষা দ্বিগুণ হতে শতগুণ হচ্ছে। সে থাকছে তিতাসের কাছে। ছোট থেকে বড় অব্দি সে জানে তিতাসই তার বাবা। মা হিসেবে জেনে গেছে কণাকে। তবে ডায়েরি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তবে তিথি-ক্যারেন কে? তারা কোথায়? তাদের কি হলো? তিথি কেন সম্পূর্ণ লেখা লেখেনি ডায়েরিতে? মিলি-তীন কোথায় থাকে? কানিজ ভাবনার মাঝে আরো কৌতুহলী হয়ে উঠলো। ঠিক এমন সময়ই তাকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে তিতাসের কন্ঠ কানে গেলো তার।

— তিথি-ক্যারেন তোমার মা-বাবা, কানিজ।

কানিজ চমকে উঠলো। তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে চেয়ে দেখলো তিতাসের হাতে সেই ডায়েরি। তিতাস ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কানিজ বরাবর দাড়িয়ে বলল

— আরো একটু বড় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। বলতে চাইনি এসব। সহ্য করতে পারবে?

কানিজ মুখের বুলি হারিয়ে ফেলল। কম্পমান হাত পা নিয়ে সে বলল

— আমিই পারবো। প্লিজ বাবা তিথি-ক্যারেনের কাহিনী শোনআও। তারা কোথায়? আমি তাদের দেখতে চাই… তারা আমাকে রেখে দূরে কেন?

কানিজের চোখ ভিজে উঠলো। তিতাস বুকে শতকোটি কষ্ট তালাবদ্ধ করে দেখে গেলো কিয়ৎক্ষণ কানিজকে। স্বভাবটা পুরোটাই মায়ের পেয়েছে। চেহারা পুরোটাই পেয়েছে বাবার।

.
সেদিন যখন তিথির সাজানো পরিকল্পনার পূর্বে এলো ঝড়। ক্যারেন তাকে জ্বরের ঘোরে নিজের করে নিলো তখন তিথির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো। সে পরদিন সকালে বুকে রাগ, ক্ষোভ দুঃখ পুষে রেখে এমন ভাব করতে চাইলো যেন কিছু না বোঝে ক্যারেন। সে শুধুই চাইলো। কিছু কভু মনে না পরুক ক্যারেনের। এমনটা হলো। তিথির চাওয়া পূর্ণ হলো সেদিন তবে তার আগে এলো এক নীরব ঝড়। মুহূর্তেই ঘমকে দেয় তিথির রাগ ক্ষোভ। ক্যারেনের আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা। যেন সেদিনই ক্যারেনের বুকের ভালোবাসার দেয়ালে পরে কালো রঙের কালি। তিথির রাগ, ক্ষোভের মাত্রা যেন দেবে যায়। সেদিন সকাল বেলা এসে কণা তিথিকে জড়িয়ে ধরে শুরু করে কান্না। কণা এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সে চাইলে কখনো পারবে না তিতাসকে খুব আপন করে নিতে। মৃত্যু তার ঘরের পানে ছুটে আসছে। তিথি এ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। ক্যারেন ভেঙে পরলো, গুড়িয়ে গেলো। যার ভালোবাসা তিথির থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে দেওয়া হলো সে ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও পাবে না। ক্যারেন সেদিন পুরোই স্তব্ধ মনে উপলব্ধি করলো, ভালোবাসা বুঝি জোর করে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা বুঝি প্রতারণা দিয়ে কেনা যায় না।

ক্যারেন এরপর আর তিথির সম্মুখে এলো না। সে তিনদিনের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো আমেরিকায় চলে যাবে বোনকে নিয়ে। কণার কোনো আপত্তি নেই। দু ভাই বোন বুঝে গেছে ভালোবাসার মর্ম! ক্যারেন আমেরিকায় যাওয়ার পূর্বে শেষ বারের মতো দেখা করতে আসে তিথির সাথে। সেদিন তিথির অনুমতি ব্যাতিত একবার খুব শক্ত করে দু মিনিটের জন্য জড়িয়েও ধরে। অতঃপর জল ছলছল আঁখি নিয়ে তিথিকে সেদিন সে বলেছিল

” পৃথিবীতে সবচাইতে কঠিন শাস্তি কি জানো টিটি? সবচেয়ে কষ্টের জিনিস কি জানো? ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও না পাওয়া। ভালোবাসার মানুষের চোখে ঘৃণা দেখা। আমি তোমাকে জোর করবো না। আমি তোমার সামনে আর কখনো আসবো না। চিরবিদায় নিলাম। সাথে নিয়ে গেলাম এক বুক কষ্ট। মিলি বলেছিলো আমি আমাদের দেশে একশো একটা মেয়ের সাথে চলাফেরা করি। পুরোটাই ভুল। আমিও কিন্তু একজন মুসলিম। এই এক জনমে আমি তোমাতেই আটকে গেছি। ”

পুরো কথাগুলো নিজের মাতৃভাষায় ব্যাক্ত করে ক্যারেন সেদিন চলে যায়। লাল মুখাবয়ব নিয়ে ঘনঘন চোখের পানি হাতের পিঠে মুছতে মুছতে ধীর পায়ে চলে যাওয়া ক্যারেনের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তিথি। তবুও সেদিন তার মন গলে ঢলে পরেনি। বরং পূর্বের মতোই রুদ্ধ রয়ে যায় তার বুকের দ্বার। সেখানে ক্যারেন নামের ছেলেটা সেদিনও জায়গা পায় না।

এরপর কেটে গেলো মাস দুয়েক। তিথি পড়ালেখা করে নিজের জায়গা ঠিক করে নিতে চাইলো। মা-বাবা সবটা জেনে গেলো। তিথির দিনাতিপাত হতে লাগলো শুধুই ব্যাস্ততা নিয়ে। এরই মাঝে হঠাৎ সেদিন রাতের সর্বনাশ গাঢ় হয়ে একো তিথির জীবনে। হুট করে একদিন জানা হলো সে মা হবে। অন্তরাত্মা কেবলই কেঁপে কেঁপে উঠলো তিথির। যেন তার ভরাডুবি সর্বনাশ হয়ে গেলো। কথা ছিলো ক্যারেন ডিভোর্স পেপার পাঠাবে। তাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। এখন কি হবে? ক্যারেনকে কি জানাবে তিথি?

দিন যায় ক্ষণ যায় তিথির পেটের ব্যাথা সহ্য করে করে। অনাগত সন্তানের জন্য কষ্ট সহ্য করে। ক্যারেন যথা সময়ে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিলো। তিথি তা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। পেটে সন্তান থাকা অবস্থায় তালাক হয় না। তিথি এই সন্তান একাই বড় করার ক্ষমতা রাখে। বাচ্চা আসছে বলে যে সে ক্যারেনকে তা জানিয়ে ক্যারেন মুখী হবে সে কথা যেন কেও না ভেবে বসে। তিথি ঠিক করলো পেটের মেয়েটার বাবার প্রয়োজন আছে। তার পরিচয় পাওয়ার অধিকার আছে। মেয়ে চাইলে বাবার কাছে যাবে। ক্যারেন চাইলে মেয়েকে স্নেহ ভালোবাসা দিতে পারবে। তবে সে যাচ্ছে না। এক ছাদের নিচে ক্যারেন-তিথির দেহ মন থাকবে না। মোট কথা সন্তান তার মা-বাবা দু’জনকেই পাচ্ছে। তবে তিথি যাচ্ছে না ক্যারেনের কাছে, ক্যারেন পাচ্ছে না তিথিকে।

চলবে….