প্রেম তরঙ্গ ২ পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
381

#প্রেম_তরঙ্গ২
#আলিশা
সমাপ্ত~~অংশ

আজ বহুদিন পর খোলা হলো ক্যারেনের রুমের দরজা। ছোট থেকেই কানিজ জানতো এটা স্টোর রুম। বিধায় তার কৌতুহল জাগেনি কখনো এঘরে আসার। কিন্তু আজ তিতাস ঘরের দরজা খুলে দিলো। কানিজ ধুলোয় মলিন ঘরে প্রবেশ করে প্রথমেই লাইট অন করলো খুঁজে খুঁজে। অক্ষিপটে মুহূর্তেই ভেসে উঠলো সাদা কাপড় দিয়ে আস্তরণ দিয়ে রাখা উঁচু উঁচু জিনিসপত্র। একে একে ধীর পায়ে গিয়ে নিজ হাতে কানিজ সব কাপড় সরিয়ে ফেলতেই জাঁকজমকপূর্ণ জিনিসপত্র বেরিয়ে এলো। বেডের নিকট দেখা মিলল এক রিডিং টেবিলের। সাদা পর্দা সরিয়ে ফেলতেই তার উপর দেখা মিলল এক অতি সুদর্শন পুরুষদের। ঠোঁট প্রসারিত করে সে হেঁসে তাকিয়ে আছে যেন কানিজের দিকেই। তার পাশেই আরো একটা ছবি দেখা যায়। একটা মেয়ে খুবই অল্প হাসি ঠোঁটে নিয়ে গালে হাত রেখে বসে আছে এক চেয়ারে। পরনে তার কালো শাড়ি। চোখ দু’টো যেন জীবন্ত। কানিজের মনে হলো সেই চোখ দিয়ে সেই রমনী যেন অনিমেষ কানিজকেই দেখে যাচ্ছে। চোখ ভিজে উঠলো। ছোট্ট কলিজাটা হুহু করে উঠলো কানিজের। বুঝতে বাকি রইলো না পাশাপাশি ছবিতে তারই দিকে তাকিয়ে থাকা দু’টো মানব মানবী তার বাবা-মা। কানিজ ঠাঁই দাড়িয়ে থেকে দেখে গেলো নয়ন ভারে ছবি দুইটা। অতঃপর চোখ পরলো তার টেবিলের কোণায় রাখা একটা স্কেচে। কেউ যেন খুব যত্নে সেটা রেখেছে ওখানে। কানিজ হাতে তুলে নিলো। স্কেচে দেখা যায় এক শাড়ি পরা একটা নারীর এক পায়ের পাতায় কেউ পা রেখেছে। যেন আটকে দিয়েছে তাকে। উপরের পাটা জিন্স পরিহিত এক ছেলের। নিচের পাটা এক মেয়ের। মনে হচ্ছে যেন মেয়েটা কোথাও যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তাকে ছেলেটা আটকে দিয়েছে তাকে। কানিজ অপলক এই স্কেচ দেখে গেলো। বুঝতে বাকি রইলো না ছেলেটা তার বাবার প্রতিরূপ আর মেয়েটা তার মায়ের। পনেরো বছরের কিশোরী মেয়েটা মা-বাবার এই দৃশ্য দেখের এক মুহূর্তে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো। বুকে চেপে ধরলো স্কেচ। ক্রমশই তার কান্নার বেগ বাড়তে বাড়তেই উচ্চ শব্দে রূপ নিলো। তিতাস রুমের বাইরে দাড়িয়ে ছিলো। দৃষ্টি তার ছিল কাঁচের বিশাল জানালা ভেদ করে ঐ দূরে। কানিজের কান্নার শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তিতাস দাঁতে দাঁত চেপে রাখলো। চোখ ভিজে উঠলো তার।

নিয়তি কেমন কি করলো তা তিতাস জানে না। তবে তার সেদিনের পর থেকে বার বারই মনে হয়, এমনটা না হলেও পারতো। সেদিন কানিজকে জন্মদিতে গিয়ে তিথি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় না নিলেও পারতো। সকলকে স্তব্ধ করে দিয়ে বুকের একপাশে কষ্ট আর অন্যপাশে খুশি নিয়ে আমেরিকা থেকে সন্তানের জন্য ছুটে যাওয়ার পথে ক্যারেন মৃত্যুর কোলে ঢোলে না পরলেও পারতো। ড্রাইভিং দশায় তখন ক্যারেন কেমন ছিলো? না জানি তার মনটা তখন কেমন করছিলো। সন্তানকে দেখার জন্য কতই না ছটফট করেছিলো সেদিন।

কোনোভাবে ক্যারেন খোঁজ পেলো তার সন্তানের কথা। সেদিন তিথির ডেলিভারি। তিথির অবস্থা ছিল বড্ড করুণ। ক্যারেন প্রথম যখন শুনলো তার বাচ্চার মা হবে তিথি তখন সে যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারলো না। হিসেব মেলাতে বসলে আবছা সব। মনে পরে না এমন কিছু। তবে মন বলে, হতেও পারে। ছুটে চলে গেলো আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে। তিথি তখন রংপুর। ক্যারেন ঢাকা থেকে বাবার থেকে গাড়ি নিয়ে ছুটলো সন্তান আর তিথির উদ্দেশ্যে। রংপুর আর ঢাকার মাঝামাঝি পথে, নেমে এলো নিষ্ঠুর কিছু। শতশত গাড়ির মধ্যে সেদিন মোট পাঁচটা গাড়ির ক্ষতি হলো। দু’টো বিশাল ট্রাকে ট্রাকে সংঘর্ষ হলো। দু’টোই উল্টে পরলো পাশের তিনটা প্রাইভেট কারের ওপর। সেখানে একটা প্রাইভেট কার ছিলো ক্যারেনেরও। চির বিদায়! চির বিদায়! ক্যারেন মুখে যেন বুলি আনারও সুযোগ পেলো না।

এদিকে তিথি, সেও ছটফট ছটফট করে নিশ্বাস থমকে দিলো। শুধুই নিঃস্ব করে দিলো কানিজকে। সবশেষে দিন ছেড়ে সাঝ নামলো। একসময় এক করা হলো দু’টো লাশকে। জানাজা হলো, দাফন হলো একই সাথে। সেখানে উপস্থিত থাকা এমন একটা মানুষ ছিল না যার চোখ ভিজে যায়নি। আফসোসের বণ্যা বয়ে গেলো ক্যারেনের জন্য। এই ছেলেটা তো নিজের সন্তানের মুখটাও দেখতে পারলো না।

.
এমন নিষ্ঠুর মুহূর্ত পেরিয়ে গেলে অসুস্থ কণা তখন প্রায় পাগল হয়ে গেলো। ছোট মেয়েটাকে আটকে নিলো। নিজেই ক্যারেনের মানের সাথে মিল রেখে ছোট মেয়েটার নাম রাখলো কানিজ। অতঃপর তিথির পরিবার কানিজকে নিতে চাইলেও কণা দিলো না। এক প্রকার দাবি জানিয়েই সে নিয়ে নিলো কানিজকে। বাচ্চা তার বাবার বাড়িতে থাকবে। একই সাথে এমন কথা ক্যারেনের মা-বাবাও জানালো। মেয়ে অসুস্থ। একেবারে মৃত্যু পথ যাত্রী যেন। দেহের মধ্যে এইডস নিয়ে বসবাস করে যাচ্ছে। একটা সুস্থ সবল ছেলে ছিল। সেও চলে গেলো তাদের ছেড়ে। থাকলো কি তাদের? বংশের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই কানিজ হয়ে গেলো ক্যারেনের মা বাবার আর বোনের। কণার তখন ট্রিটমেন্ট চলছিলো আমেরিকায়। সে ছোট কানিজকে নিয়ে পারি জমায় সেখানে। সাথে আসে ক্যারেনের সতমা। তিতাস এতসব কিছুর পর যেন ছেড়ে দিলো সব। রাগ ক্ষোভ উবে গেলো। কণা তাকে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছিল অনেক আগেই। অতঃপর একদিন তিথির সাথে মুখোমুখি দাড়িয়ে তার চোখে চোখে শত কথা হয়েছে। মুখ ফুটে “মাফ করে দিও” বলার মতো সাহস না হলেও চোখের ভাষায় যেন বলে দিয়েছিলো।

তিথি আর ক্যারেন যখন পরলোকে চলে গেলো তখন তিতাস ডাক্তারি পড়ার খাতিরে বিদেশে। এরপর তার দেশে ফেরা হলো প্রায় এক বছরের অন্তে। কণা আর তার মাঝে কোনো ডিভোর্স হয়নি। কণার অসুস্থতার কথাও তার জানা। দয়া হলো, মায়া হলো। ভাবলো, কণার প্রতি দায়িত্ব আছে তার। বিয়ে তো অমান্য করার মতো কিছু নয়। সেও তার পেশার দ্বারা সেটেল্ড হতে চাইলো আমেরিকায়। ভাগ্যে জুটলো। তারপর প্রায় দুই বছর পর অর্থাৎ কানিজের বয়স যখন তিন বছর তখন কণাও পৃথিবী ছেড়ে পারি জামালো ওপারে। তারপর থেকে তিতাসই রইলো কানিজের কাছে। সব হারিয়ে সসেও যেন নিঃস্ব হলো। হাঁপ ছেড়ে কানিজের মুখপানে তাকিয়ে দিনাতিপাত করা শুরু হলো তিতাসের।

ভাবনা ছেড়ে তিতাস চোখের কোণের জল মুছে নিয়ে এগিয়ে গেলো কানিজের নিকট। কানিজ কেঁদেই যাচ্ছে। তিতাস পেছনে দাড়িয়ে বলে উঠলো

— আমরা বাংলাদেশে যাবো কানিজ। খুব শীঘ্রই।

কানিজ কান্নার দমকায় কিছু বলতে পারলো না। তিতাস প্রস্থান করলো এ ঘর হতে। আসছে বিশ অক্টোবর ক্যারেন-তিথির মৃত্যুবার্ষিকী। ষোলোতম মৃত্যু বার্ষিকী। সেই সাথে কানিজ পা ফেলছে ষোল বছর বয়সের ঘরে। সেই সাথে তীন আর মিলির ছেলের মাস ছাড়িয়ে এক বছর বয়স হচ্ছে তেইশে অক্টোবরে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তিথি তীনের হাতে মিলিকে তুলে দিলেও মিলি পিছু হটেছিলো। সে বলেছিলো, ” জোর করে ভালোবাসা হয় না। আমি কণার মতো ভুল বা অপরাধ করতে চাই না।” এরপর তাদের দূরে সরে আসা। তার প্রায় তিন বছর পরে তীনই প্রস্তাব রাখে সে মিলিকে বিয়ে করবে। অন্যরকম হয়ে যায় তাদের জীবন। সকলের অগোছালো জীবনের মাঝে এই একটা দম্পতির সংসারি একটু গোছালো হলো। বহু দিন পর, প্রায় তিন বছর পরে তীনের হঠাৎ মনে হয়েছিলো। জীবনে নিঃসঙ্গ থাকলে হয়তো সে শেষ হয়ে যেতো। পাশে তার সত্যিই কাউকে দরকার ছিলো। একথাটা সেদিন তিথি বুঝেছিলো বলেই মিলিকে তার হাতে তুলে দিয়েছিলো।

সমাপ্ত