প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-২+৩

0
511

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব-২+৩
#রাউফুন
পর্ব-২
‘এই রেস্টুরেন্টে তো এই পোষ্টে ত্রিশ বছর বয়সি কাউকে নিয়োগ করা হয়না! আপনি কি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লেখাটি খেয়াল করেন নি?’

ম্যানেজার এর কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আশেপাশে তাকালাম। না এই মুহুর্তে আমি ছাড়া কেউ-ই নেই এখানে। আমি সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করলাম,
‘স্যরি বুঝলাম না স্যার! আপনি কি আমাকে বলছেন? আর বিজ্ঞপ্তি দেখেই তো ইন্টারভিউ দিতে এসেছি!’

‘আপনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আপনার বয়স ত্রিশের নিচে না তাই বললাম!’

কেমন অদ্ভুত শুনালো ম্যানেজার এর কথা।
আমি কিছু টা চড়াও গলায় বললাম,
‘আপনাকে কে বললো যে আমার বয়স ত্রিশ! আমার বয়স সবে মাত্র তেইশ।’

‘স্যরি বাট এই রেস্টুরেন্টে চাকরির জন্য আকর্ষণীয় ফেইস ফিচার দরকার! যেটা আপনার নেই! ইউ মে গো নাউ!’

এরপর কিছু বলে উঠার আগেই ম্যানেজার চলে গেলেন। আমি নিজের প্রতিচ্ছবি টা সামনের জানালার কা’চে দেখে নিজেকে গুটিয়ে ফেললাম। আমার মুখ তারুন্য হারিয়েছে! এবং আমার চোখের পাতা যেগুলো ঘন পল্লব বিশিষ্ট ছিলো সেটাও মলিন হয়ে গেছে। আমার শুকনো শরীর, কুচকানো মুখ এবং পুরনো পোশাক বিগত কয়েক বছর ধরে আমার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম যেনো এই ক-বছরে যেনো আমি বৃদ্ধদের মতো হয়ে গেছি। নিজের যত্নের প্রতি বোধহয় এতোটাও উদাসীন, অপারগ হওয়া উচিত হয়নি। যে রুপ আমার জীবনের কাল, সেই রুপ যে আমিও চাইনি। তাই তো এরকম সাদামাটা ভাবেই চলবার চেষ্টা করি। এক সময় যেখানে মানুষ আমাকে চোখে দেখে মুগ্ধ হতো এখন সেই কত রকম মানুষের কটাক্ষ আমাকে হজম করতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। নিজের মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখে ম্যানেজার এর বলা কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই আনমনে হাঁটছিলাম।

আমি কোনো রকম নিজের, ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত শরীরের টাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম শুধু। হঠাৎই আমি রাস্তায় লক্ষ্য করলাম শাহনাজ আর সুজানা আপুকে। সুজানা আপু বার বার শাহনাজের হাত চে’পে আলতো চুম্বন দিচ্ছে আর মনে হচ্ছে কোনো আবদার রাখছে শাহনাজের কাছে। আর শাহনাজ হেসে হেসে তা মেনে নিচ্ছে। শাহনাজ আমাকে দেখতেই কিছু টা ছু্ঁটেই আসছিলো। আমি হাঁটার গতি বাড়াতে চাইলাম। হঠাৎই শাহনাজ আমাকে ডেকে উঠলো,

‘শুকরিয়া দাঁড়াও! এই শুকরিয়া!’

আমার সারা শরীরে যেনো ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো৷ কত দিন, কত দিন পর শাহনাজ আমার নাম ধরে এভাবে ডাকলো। শাহনাজের ডাকে আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। পিছনে ফিরতেই প্রথমে যেটা চোখে পরলো, দামী বি’এম ডাব্লিউ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুজানা আপু। তার সুদর্শনা মুখের আদলে যেনো প্রসাধনী চকচক করছিলো। সুজানা আপুকে বেশ ভালোই মানিয়েছে শাহনাজের সঙ্গে। দ্যে আর ম্যাড ফর ইচ আদার! ওঁকে দেখেই প্রথমে যে কথা গুলো আমার মাথায় এলো, সুশ্রী, ভদ্র, শিক্ষিত একটি মেয়ে। ঠিক যেমন আগে আমাকে দেখাতো। সুজানা আপু বয়সে আমার বড় হলেও তাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি কম বয়সি লাগে! শুনেছিলাম, মা’রে নারীর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়! আমার সৌন্দর্য টা বোধহয় কিছু টা মা’রে’র কারণে তার উজ্জ্বলতাকে নিভিয়ে দিয়েছে।

হঠাৎ আমি চমকে উঠলাম! শাহনাজের ডাকে সুজানা আপুও আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সুজানা আপু আমার কাছে এসে আমার আপাদমস্তক পরখ করে হেসে বললো,

‘আরে মালা, এত দিন পর? তো তোমার কি অবস্থা?’

আমি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না তার প্রশ্নের। আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পরলাম। আর নয় এভাবে কি কাউকে ফেস করা যায়। নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত আমি। শাহনাজ দৌড়ে এসে রিকশা থামিয়ে দিলো আর বললো,

‘পালাচ্ছো কেন শুকরিয়া? আমাকে ফেস করতে ভয় পাচ্ছো? শুনলাম আমার আর সুজানার বিয়েতে এসেছিলে? কি ভেবেছিলে লুকিয়ে আসলেই আমি জানতে পারবো না?’

আমার ভেতরে তোলপাড় চলছে। যেনো সব কিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আমি সাহস সঞ্চার করে বললাম,

‘আপনার সাহস কি করে হয় আমার নেওয়া রিকশা থামিয়ে দিলেন? আমি কিন্তু চেঁচাবো এভাবে আমাকে হ্যারাস করলে!’

‘ওহ তুমি এখন আমাকে লোকের ভয় দেখাচ্ছো? আমি কি ভয় পাচ্ছি নাকি তোমার এই সামান্য লেইম ধমকানোতে? বলো কেন গিয়েছিলে আমার বিয়েতে? মিনিমাম লজ্জাও নেই নাকি?’

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘আপনার বউকে দেখতে গেছিলাম আর কিছু? আর হ্যাঁ লজ্জা নেই আমার, তো?’

‘হ্যাঁ তোমার মতো মেয়েদের লজ্জা না থাকার ই কথা! বাই দ্যা ওয়ে ঠিক করে খেয়েছিলে তো? এতো ভালো ভালো খাবার তো সব সময় পাও না তাই না?’

অপমানে আমার গা রি’রি করছে। সহ্য হচ্ছে না আমার। আমি রিকশা ওয়ালা কে বললাম এগোতে। কিন্তু শাহনাজ টেনেটুনে আমাকে রিকশা থেকে নামালো।

‘আরে যাচ্ছো কোথায়? দাঁডাও! বলো তো আমাদের এক সাথে কেমন লাগছে?’

এবারে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। আমার সঙ্গে এদের কিসের এতো কথা! আমাকে কি ভেঙে দিতে এসেছে আবারও? রাগ টা তরতর করে বারলো এভাবে শাহনাজ আমার হাত ধরাই। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বললাম,

‘এই তুই আমার হাত ধরেছিস কেন? আমার হাত ধরলি কেন? তুই হাত ছাড় আমার! নইলে কিন্তু আজ আমার থেকে খারাপ কেউ-ই হবে না। তোর সঙ্গে তো আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে তাহলে কোন অধিকার নিয়ে তুই হাত ধরলি?’

সুজানা আপু এগিয়ে এসে বললো, ‘এই তোমার তো দেখছি বড্ড সাহস বেড়েছে? তুমি শাহনাজের সঙ্গে এভাবে কথা বলছো?’

কাউকে মানলাম না আমি। আমার সিক্সথ সেন্স কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। উম্মাদের মতো বললাম, ‘ এই পেত্নার বউ পেত্নি একটাও কথা বলিস না তুই! নইলে তোকেও ধুয়ে দেবো আজকে! দরকার পরলে তোর ওই সুন্দর চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ফেলে দেবো।’

আমার রাগ দেখে মিইয়ে গেলো সুজানা। শাহনাজ আমার হাত তখনও ছাড়ে নি। রাগের বশে হাতের ব্যাগ দিয়ে শাহনাজের মাথায় ধুপ ধাপ করে কয়েকটা বা’রি বসিয়ে দিলাম। শাহনাজ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে নিজের মাথা ঘষছে আর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আগে কখনোই তো আমাকে এরকম রুপে দেখে নি না। আমি বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি এই মুহুর্তে! কোনো দিক ভাবার সময় নেই আমার।

‘তুই এখান থেকে যাবি নাকি আমি আরও কয়েক ঘা বসিয়ে দেবো? কোনটা করবি বল?’

‘এই তুমি আমাকে তুই তুকারি করছো, আমার গা’য়ে হাত তুলছো? হাউ ডেয়ার ইউ?’

‘তোর ডেয়ারের গুষ্টির পিন্ডি চটকাবো আমি। দাঁড়া।’

বলেই আশেপাশে ইট, পাথর খুজতে লাগলাম। একটু খুঁজে পেয়েও গেলাম। কয়েকটি পাথর নিয়ে শাহনাজের দিকে ঢিল ছুঁড়তে লাগলাম। শাহনাজ কোনো রকমে দৌড়ে গাড়িতে উঠলো। ওরা যেতেই কান্নায় ভেঙে পরলাম আমি। নাহ এভাবে আর দুর্বল হওয়া চলবে না। দুর্বলতার সুযোগটা মানুষ খুব ভালো ভাবেই কাজে লাগাই এটা আমি হারে হারে টের পেয়েছি। আর দুর্বলতা নয়। আমি রিকশাওয়ালা কে বললাম আমাকে এই পার্লারে নিয়ে চলো। একটু মেক-অভারের দরকার।

পার্লার থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। রিকশায় বসে ভাবতে লাগলাম ছোট থেকে এই পর্যায়ে কি কি পেলাম জীবনে। আমি যখন খুব ছোট্ট তখন থেকেই নাকি খুব জেদি আর একঘেঁয়ে, একরোখা ছিলাম। ছোট বেলায় জেদ করতাম জন্য আম্মুর হাতে অসামান্য মা’র খেয়েছি। আম্মু যখন মারতো এক পা ও নরতাম না সেখান থেকে। সেই সুযোগে আম্মু আরও বেধরক পে’টা’তো। কি’ল, চ’ড়-থা’প্প’ড়, লা’থি খেয়েই বড় হতে লাগলাম। আমার জেদের জন্য এমন একটা দিন ও যায়নি যে আম্মুর হাতের মা’ই’র আমার পিঠে পরেনি। আমিও যেনো আম্মুর মা’রে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। এভাবেই আস্তে আস্তে বড় হলাম। আমার জেদ দিন কে দিন বেগতিক ভাবে বেড়েই চললো আর সাথে আম্মুর মা’র। কথায় আছে না লেবু বেশি কচলালে সেটা তেঁতো হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রেও সেরকম। মা’রে মা’রে শক্ত হয়ে গেছিলাম।

সময়ের সাথে সাথে পনেরো বছরে পা রাখলাম আমি। আমাকে এই বয়সেই বিয়ে দেওয়া হলো গ্রামের আব্বুর বন্ধুর বড় ছেলের সঙ্গে। আমার শশুড় মশাই আর আমার শাশুড়ী আমাকে পছন্দ করেন। শুনলাম আমার যার সঙ্গে বিয়ে হবে তার বয়স ২৭-২৮। বয়সের এতো তফাৎ জেনেও না করার সাহস আমার মধ্যে ছিলো ন। ছেলে চট্টগ্রামে পড়াশোনা করেছে আর চাকরি করে সেখানেই। চট্টগ্রামে নিজের বাড়িও করেছে আমার শশুড় মশাইয়ের টাকায়। কোনো রকম খোঁজ খবর না নিয়েই বিয়ে ঠিক করা হলো আমার। বড়লোক, চাকরিওয়ালা জামাই পাবেন আমার বাবা মা। আমার ভাগ্য তো খুলে গেছে সবার মুখে মুখে একই কথা রটে গেলো। ভাবলাম সত্যিই হইতো আমার জীবন বদলের দিন শুরু। আমরা তিন ভাই বোনের মধ্যে আমিই বড়। বোন টা আমার থেকে আট বছরের ছোট। তখন আমার ভাই সবে মায়ের কোলে। আমাকে বিয়ে দেওয়া হলো শাহনাজের সঙ্গে। মেনে নিলাম নিজের ভবিতব্য কে। শুরু হলো আমার জীবনের কালো অধ্যায়!

রিকশাওয়ালা ছেলেটার ডাকে আমার ভাবনায় ভাটা পরলো।

‘আপু আমরা চলে এসেছি। নামুন।’

আমি কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাকালাম রিকশাওয়ালার দিকে। তাকিয়ে দেখলাম রিকশা চালক একদম অল্প বয়সী। আনুমানিক বয়স হবে ১৮ কিংবা তার থেকে একটু বেশি। একটা ট্রাউজার আর হালকা বাদামী রঙের টি-শার্ট পরা। ছেলেটা এতো সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে ভেবেই অবাক ভাব টা ফুটে উঠেছে। কারণ চট্টগ্রামের লোকজন সাধারণত এখানকার স্থানীয় ভাষায় কথা বলে। আমার প্রথম দিকে চট্টগ্রামের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হতো। তবে এখন বুঝি চট্টগ্রামের ভাষা। ছেলেটা বুঝি আমার মনোভাব বুঝলো। তাই মাথা নত করে লজ্জা পেয়ে বললো,

‘আপু আমি চট্টগ্রামের স্থানীয় না। আমি এখানে পড়াশোনা করি। এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ার আপু। এই যে রিকশা দেখছেন এটা চালিয়ে যে টাকা হয় এবং একটা টিউশনি করাই তা দিয়েই নিজের পড়াশোনার খরচ টা বহন করার চেষ্টা করি।’

আমি মুগ্ধ হলাম ওর এতো সুন্দর ব্যবহারে। কত সুন্দর করে আপু বলে ডাকলো। আমি শ্লেষাত্নক কন্ঠে বললাম,

‘কিছু মনে করো না ভাইয়া। তোমার পড়াশোনার খরচ সামান্য রিকশা চালিয়ে কি হয়?’

ছেলেটা সংকোচ করেই বললো, ‘না তা তো হয় না। বড় ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি অনেক কষ্টে। এখন দেখি কি হয়!’

আমি কিছু একটা ভাবলাম। ভেবেই বললাম, ‘ভাইয়া আমাকে যেখান থেকে আজকে তুলেছো সেখানে কি কাল দাঁড়াতে পারবে?’

‘হ্যাঁ আপু অবশ্যই পারবো। আমাদের তো কাজ ই এটা। যে যেখানে বলবে সেখানেই যাওয়া।’

আমি আমি রাস্তার এই পাশ থেকে দেখলাম আম্মু আর আব্বু আমার ছোট ভাই গহীনকে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে দৌড়ে আসছেন। যা দেখে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলো।

#চলবে

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩
#রাউফুন

‘রোগী এখনো অজ্ঞান রয়েছে। তবে বাচ্চাটির অবস্থা বেশ স্থিতিশীল। কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির জন্য বাচ্চার ব্রেইনে সামান্য চাপ সৃষ্টি হলেই ছোট খাটো আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চাটির অপারেশন না করালে ওঁকে বাঁচানো রিস্কি হয়ে পরবে। খুব জলদি ওর বোন ম্যারু ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে হবে। অপারেশনের আগ অব্দি রোগীকে আমাদের অবজার্ভেশনে রাখতে হবে। আপনারা দ্রুত টাকার ব্যবস্থা করুন। না হলে আমাদের হাতে আর কিছুই থাকবে না। আপনার ভাইয়ের ভাগ্য ভালো যে ওর ডিএন এর সঙ্গে ম্যাচ করেছে এমন বোন ম্যারু আমাদের হসপিটালে আছে। এখন শুধু টাকার প্রয়োজন!’

একদমে কথাগুলো বলে ডক্টর চলে গেলেন।
আমি ধপ করে বসে পরলাম। আমার চোখ শুকিয়ে গেছে। ভেতর টা চুরমার হয়ে গেলেও বাইরে তার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে না। ঘন্টা খানেক আগে গহীন কে হসপিটাল নিয়েছি। আব্বু নিস্তেজ হয়ে বসে আছে। পাশে আম্মু, পুতুল। পুতুল হলো মোমের মতোই নরম ছোট ছোট বিষয়ে যে মেয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায় সে আজকে ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে কি করে ভালো থাকবে? আমি বোধহয় আব্বুর মতো হয়েছি একেবারে কাঠখোট্টা। কিন্তু সেই একরোখা, কাটখোট্টা মানুষ টা আজ নিস্তব্ধ, নির্মল অবস্থায় বসে আছে কিন্তু আমার চোখ জল শুন্য। ছেলের শোক বোধহয় আব্বুকে আজ ভেতর থেকে ছুঁয়েছে?

আমরা গহীনের অসুখ সম্পর্কে অবগত ছিলাম।ওর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন হঠাৎই গহীন অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন অপারেশন করতে পারতাম কিন্তু ওর বয়স কম ছিলো আরও অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতো তাই বয়স একটু বাড়লে ডক্টর অপারেশন করানোর জন্যে পরামর্শ দেন।

বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশান (অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন) কে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশান বলে। (বিএমটি) বা স্টেম সেল প্রতিস্থাপন হল একটি প্রক্রিয়া যা ক্ষতিগ্রস্ত বা রোগাগ্রস্ত বোন ম্যারো রক্ত সৃষ্টিকারি স্বাস্থ্যকর স্টেম সেল দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি তখন দরকার যখন বোন ম্যারো সঠিকভাবে কাজ করে না এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বাস্থ্যকর রক্ত কনিকা প্রস্তুত করতে পারে না।

আমি বসে আছি আব্বু আমার কাছে এসে বললেন,

‘আমার ছেলেটাকে বাঁচাও মা। ডক্টর বললেন টাকার অংক অনেক বেশি। এই এতো গুলো টাকা আমি কোথায় পাবো। কিভাবে জোগাড় করবো?’

‘কেন আপনার তো অনেক টাকা! জমি বেঁচেছেন আর খেয়েছেন। জুয়ার নেশায় ডুবে থেকেছেন। ভিটে মাটিও তো আর অবশিষ্ট নেই। ব্যাংকে যে টাকা গুলো ছিল সেটাও তো নেই। যান না আরও জুয়াই মেতে থাকুন। সব সময় তো বলেন আপনার ছেলেই আপনার সব। এখন ছেলের জন্য কিছু করুন।’

আব্বু অসহায় মুখ করে হসপিটালের বাইরে চলে গেলেন। আমার ভেতর টা জ্বলে যাচ্ছে। পুতুল আমাকে বললো, ‘ আপু আব্বুকে এভাবে না বললেও পারতে। আব্বু খুব কষ্ট পেয়েছে। অন্তত আজকে তো এভাবে বলা উচিত হয়নি।’

আম্মু করুন চোখে তাকালেন আমার দিকে আর বললেন, ‘এমনিতেই শরীরের বেহাল অবস্থা তোমার আব্বুর! বাইরে কোথায় গেলো কে জানে? ছেলের চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে গেছে উনার আর তুমি তাকে এভাবে এতো গুলো কঠিন কথা শুনালে? দিন দিন শিমার হয়ে যাচ্ছো মালা!’

আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন আম্মু। আমি ভেবে পেলাম না কি করবো। আমি মোটেও আব্বুকে ওভাবে বলে কষ্ট পাচ্ছি না। তাহলে কি আমার ভেতর থেকে সবার জন্য মায়া, মহব্বত বিলীন হয়ে গেলো। আমি সত্যিই শিমার হয়ে গেছি। আব্বুকে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি তা আমি জানি৷ কিন্তু আমার কষ্ট কেন হচ্ছে না? কেন হচ্ছে না কষ্ট?আমি চাই আমার কষ্ট হোক। আমার হঠাৎ করেই মনে পরলো কিছু একটা। আম্মুকে বললাম,

‘আম্মু আমি আসছি!’

‘কোথায় যাচ্ছো?’

‘আম্মু টাকার তো জোগাড় করতে হবে নাকি!এভাবে বসে থাকাটা সমাধান নয়।’

‘তুমি ওতো গুলো টাকা কোথায় পাবে? তোমার দ্বারা তো সম্ভব নয় এটা তো জানা কথা!’

‘আম্মু এখন এতো কথা বলার সময় নেই। আসছি। আপনি পুতুলের খেয়াল রাখবেন!’

‘আমি যদি আপনাকে সাহায্য করি? নেবেন! আমি মন থেকে আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি।’

কণ্ঠের মালিকের দিকে তাকানোর আগেই আমি বুঝে গেলাম সে কে! আমি ঘুরে দেখলাম লোকটা চশমা ঠিক করে এদিকে এগিয়ে আসছে। আমি তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলাম। এখন এই লোকটার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইছি না আমি।

‘কি হলো কোথায় যাচ্ছেন? শুনুন? দেখুন আপনি এক সময় আমার ঐশীকে রক্ত দিয়ে ওর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। এখন আমি আপনার বিপদে আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।’ বলতে বলতে উনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলেন।

‘আমি আপনাকে সাহায্য করেছি বলেই বুঝি সাহায্য করতে এসেছেন? কারোর প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাকে বিনিময় করতে নেই জানেন না? ঐশীকে র’ক্ত দিয়েছি বলেই কি আপনার কাছ থেকে আমার সাহায্য নিতে হবে?’

‘কিন্তু সেই- সময় আপনি সাহায্য করেছিলেন বলেই কিন্তু ঐশীকে আমরা ফিরে পেয়েছি। এখন আপনার একটা বিপদ হয়েছে সেখান থেকে আমি কিভাবে পিছপা হয় বলুন?’

‘আমার চাই না আপনার সাহায্য! সেদিন বিয়ে করতে চাইলেন সাহায্য করেছি বলে। আমি ঐশীকে রক্ত না দিলেও রক্ত ঠিকই কেউ না কেউ দিতো। আপনি কি তাকেও বিয়ে করতে চাইতেন, বা তার বিনিময়ে টাকা অফার করতেন? অবশ্য বলাও যায় না আপনাদের দ্বারা সব সম্ভব।’

‘আপনি আমার সব কথার এমন উল্টো মানে কেন বের করেন বলুন তো। আই’ল জাষ্ট হেল্প ইউ না? এই সময়েও আপনার এরকম টা করা কি ঠিক হচ্ছে?’

‘আমার কারোর কোনো দয়া চাই না। আমার ভাইয়ের চিকিৎসা, খরচ বাবদ সম্পুর্ন টাকায় আমি নিজে জোগাড় করবো। আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই। সাহায্যের জন্য টাকা দিয়ে তার বিনিময়ে আবার না বলে বসেন, “আপনার আমাকে বিয়ে করতে হবে” তাই না? বুঝবো না ভেবেছেন আপনার মতলব!’

‘আসলে কি বলুন তো আপনার আমার সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। তা কেন আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তাই বলে এভাবে কাউকে বলাও ঠিক নয়।’

‘আমাকে যেতে হবে সরুন।’

‘আপনি একবার হেরে গিয়েই আপনার এই অবস্থা?’ সহাস্যে বললো প্রিহান।

‘আপনি হইতো জানেন না আমি কুল কিনারা হারানো একজন মানুষ। যার অবস্থা এখন খুবই খারাপ। যাকে আস্তা কু,ড়ে আবর্জনার মতো জাষ্ট ছুড়ে ফেলেছিলো একজন। আর সেখান থেকে উঠে এসেছি আমি। আমাকে ছুড়ে ফেলার মতো সুযোগ আমি কাউকেই দেবো না। আমি এখন ভেঙে ভেঙে নিজেকে গড়ে তুলা একটি শক্তিশালী বটবৃক্ষ।।

‘একজন নির্বোধ মানুষ কে আমার বুঝানো কাম্য নয়। এই সময় আপনার উচিত আমার সাহায্য টা নেওয়া। আপনার ভাইয়ের চিকিৎসা হওয়াটা আগে ইম্পর্টেন্ট!’

আমি কিছু না বলে উনাকে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। উনি দৌঁড়ে আমার পাশে এসে বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে একা একা যাবেন না! অন্তত পক্ষে আমি আসি আপনার সঙ্গে!’

‘কোনো দরকার পরবে না। আমি দুর্গম পথে একাই চলা শিখে গেছি।’

পিছনে না ফিরেই বললাম। আমি জানি না এই লোকটা আমাকে কেন সাহায্য কর‍তে আসছে! আমার বিপদের কথা কিভাবে তার কাছে যাচ্ছে? কিন্তু আমি আর কোনো পুরুষ মানুষ কে বিশ্বাস করতে চাই না। আমি ভেতর থেকে সম্পুর্ন একজন অকেঁজো মানুষ। বার বার ঠকেছি আমি। আর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। করবোও না।

প্রিহান রুপমের কাঁধে হাত রেখে বিস্তৃত গলায় প্রশ্ন করলো, ‘ একটি সরল হেরে যাওয়া, লড়াকু মেয়ে আর সুন্দরীর মেয়ের মধ্যে যদি তোকে কাউকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে কাকে বেছে নিবি?’

‘নিশ্চয়ই সুন্দরী জন কে!’

‘উঁহু ভুল বললি রুপম। আমি তো সরল হেরে যাওয়া জনকেই বেছে নেবো। কারণ সে অনেক কঠিন কিছু মোকাবিলা করার অদম্য ক্ষমতা রাখে। হেরে যেতে যেতে সে চলতে শিখে গেছে। সে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। তার বুদ্ধির কারবারি অনেক প্রবল, তীক্ষ্ণ। সে সরল কিন্তু বোকা নয় তাই তার জয় নিশ্চিত।’

‘আমি বুঝলাম না প্রিহান তুই এই সেকেলে মেয়ের মধ্যে কি এমন পেলি যে ওর পিছু পিছু ঘুরছিস? তাও এভাবে? কত অপমান করছে তোকে আর তুই? শুন তুই কিন্তু আরও ভালো কাউকেই ডিজার্ভ করিস!’

‘বুঝবি না তুই। এই মেয়েটার সব কিছু আমাকে খুব উৎফুল্ল করছে রুপম! ওর দাপুটে আত্মসম্মানবোধ, জেদি, কথার তেজ,মেয়েটির উদাসীনতা, সরলতা, আমাকে বড্ড টানছে। আ’ম জাষ্ট ইম্প্রেস।’

#চলবে