প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-০৫

0
386

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৫
#রাউফুন

দুই সপ্তাহ কে’টে গেছে। গহীন এখন সম্পুর্ন সুস্থ। ভাইয়ের চিকিৎসার পর থেকে আব্বুর মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি আমি। আগের মতো কথা বলে না, চুপচাপ থাকে। বাইরেও বের হয় না৷ জুয়া খেলা ছেড়ে দিয়েছেন মনে হয়। ছাড়লে তো ভালোই। আম্মুকে এখন একটু প্রফুল্ল, সজীব লাগে। নির্জীবতা কে’টে গেছে মুখের আদল থেকে।

আমি আছি এখন একটি বিউটি পার্লারে। এটা আমার নিজের পরিশ্রমের ব্যবসা। নিজের পার্লার থাকতেও আমি এমন সাদামাটা থাকি এটা আমার পার্লার এর মেয়েরা যেনো মানতে পারে না। অথচ কত মানুষের মেক-অভার আমি নিজে করি। আমার যে এতো বড় পার্লার আছে বাড়িতে কেউ-ই জানে না। আম্মু বা আব্বু কেউ-ই পছন্দ করেন না বলেই এভাবে বিষয় টা লুকিয়ে রাখা। পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবসাটা বড় করতেই আমাকে দশ-বারো লাখ টাকা ইনভেস্ট করতে হয়েছে এক মাস আগেই। যদি রিসেন্ট আমাকে টাকাটা খরচ করতে না হতো তবে এই টাকায় ভাইয়ের চিকিৎসা টা দিব্বি করে ফেলতাম। ভেবেছিলাম ছয় মাসের মধ্যে যে টাকা আয় হবে সেটা দিয়ে ভাইয়ের চিকিৎসা করাবো। কিন্তু কে জানতো ভাইয়ের শরীর হঠাৎই খারাপ হবে। নিয়মিত ডক্টর দেখানো হতো তবুও কেন যে বুঝতে পারেননি ডক্টর জানা নেই।

আমার পার্লারের সব কিছু উন্নত করতে হয়েছে। তাই তো চাহিদা আরও বেড়েছে। রাস্তার সঙ্গে হওয়াই চাহিদা অনেক বেশি। এয়ারকন্ডিশন সহ, কসমেটিকস, ইন্সট্রুমেন্ট, চেয়ার, আয়না, হেয়ার স্পা মেশিন, হেয়ার রিকোভারি মেশিন, ফেসিয়াল মেশিন, হেয়ার হিটার, মোটদা কথা যা কিছু লাগে একটি পার্লার করতে সবকিছু রয়েছে।

ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্যই এই পার্লার। ছেলেদের জন্য আলাদা রুম আর মেয়েদের জন্য আলাদা। তিনটে ছেলে আছে আর আজকে থেকে ওই দিনের সেই রিকশা চালক ছেলেটাও থাকবে। এই পার্লার টা আমার দুই বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা একটি স্বপ্ন! শাহনাজের সঙ্গে ডিভোর্স এর পর আমি মেক-আপ এর জন্য ট্রেইনিং করি। এরপর আমার বিয়ের যে গহনা ছিলো সেগুলো বিক্রি করেই ছোট্ট একটা পার্লার খুলেছিলাম আর এখন এটা অনেকটাই বড়।

কিছুক্ষন পর ছেলেটা আসলো। ছেলেটার নাম প্রশান্ত বললো। দেখতে শুকনো নয় আবার অনেক বেশি স্বাস্থ্য ও নয়। মিডিয়াম শারীরিক গঠন। মাথায় কোকড়ানো, ঝাকরা চুল। ফর্সা চেহেরা। হালকা আকাশী রঙের টি-শার্ট আর জিন্সের জ্যাকেট পরেছে। আমি পার্লারে বসে সেই ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ওঁ পার্লার থেকেই আমার নাম্বার জোগাড় করেছে। সেদিন নাকি ওঁ এসেছিলো আমাকে পাইনি। পরে কথা হলে ওঁকে সব কিছু খুলে বলেছি। আমি ওঁকে বসতে বললাম। কথা বলতে বলতে জেনে নিলাম ওর পরিবারে কে কে আছে। ওর দুই বোন আছে একটা পুতুলের বয়সী ক্লাস এইটের স্টুডেন্ট, আর একজন তিন বছরের। খুব ছোট! ওর বাবা নেই৷ ওর বাবা এক বছর আগে গত হয়েছে। খুব খারাপ লাগলো শুনে। বাবা যে কি তা বোধহয় যার নেই সেই বুঝতে পারে। আর রিকশাটা ওঁর বাবার ছিলো। বাবার মৃত্যুর পর নিজের সংসারের হাল ধরেছে ছেলেটা।

কথা বাড়াতে আমি হেসে বললাম, ‘প্রশান্ত, খুব আন-কমন নাম টা। ভীষণ সুন্দর!’

আমার কথায় প্রশান্ত একটু লজ্জা পেলো মনে হয়। আমি বললাম, ‘তুমি সেদিন বললে ইংলিশ নিয়ে অনার্স করছো? এতো সাবজেক্ট রেখে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে কেন?’

‘কারণ আমার অন্য সাবজেক্টের চেয়ে ইংলিশ বেশি ভালো লাগে।’ হেসে বললো প্রশান্ত।

‘ওহ আচ্ছা।’

‘এমনি তোমার ফিউচার প্ল্যান কি? মানে ইংলিশ নেওয়ার কোনো স্পেশাল রিজন আছে?’

‘কোনো স্পেশাল রিজন নেই। বাট যেসব মানুষ ইংলিশ ঠিক মতো জানে না তাদেরকে আমার ইংলিশ শেখানোর ইচ্ছে আছে। যেমন ধরুন, গ্রামের দিকের মানুষ তেমন ইংলিশ জানে না।’

‘ইংলিশ আমাদের ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ। সবার শেখা উচিত। তোমার কথা গুলো ভালো লাগলো। যায় হোক আজ থেকে তুমি এই পার্লারে কাজ করবে!’

‘আমি পার্লারের কাজ কিভাবে করবো আপু?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো প্রশান্ত।

‘বা’রে এখানে তো হেয়ার স্পা, হেয়ার কা’ট, ছেলেদের ও ফেসিয়াল করানো হয়।’

‘কি যে বলেন আপু, ছেলেরা আবার ফেসিয়াল করে নাকি?’

হেসে ফেললাম আমি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললাম,
‘আরে তুমি করো না জন্য কি অন্যরা করে না। ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্যই এই পার্লার। তুমি বোধহয় খেয়াল করো নি বাহিরে সাইনবোর্ডে লেখা, জেন্টস এন্ড লেডিস বিউটি পার্লার! এখানে কি কি করানো হয় সব কিছুই লেখা আছে।’

‘ওহ আচ্ছা। আপু আমি তো তেমন কোনো কাজ ই পারি না। কিভাবে কি করবো!’

‘শিখে নাও। মিনিমাম তিন মাস সময় লাগবে সকল কাজ শিখতে!’

‘ততদিন আমার পরিবার চলবে কিভাবে এটা নিয়ে চিন্তায় পরে গেলাম।’

‘আরে চিন্তার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার স্যালারি টা অগ্রিম দিচ্ছি এই মাসের। আর তুমি আরেকটা টিউশনিও পাচ্ছো।’

‘বুঝলাম না আপু।’

‘কাল থেকে তুমি আমার ছোট বোন আর আমার ছোট ভাইকে পড়াবে৷’

আমার কথায় প্রশান্তর মুখে হাসি ফুটলো।

‘থ্যাংক ইউ আপু। আপনি যে আমার কত বড় উপকার করলেন বলে বুঝাতো পারবো না।’

‘আরে ধন্যবাদ এর প্রয়োজন নেই। বরং তোমাকে আমার ধন্যবাদ দেওয়া প্রয়োজন। তুমি নিজের অজান্তেই আমার যে কি উপকার করলে তুমি জানো না। আমি নিজেই একটা টিচার খুঁজছিলাম ওঁদের জন্য। এখন আমার কষ্ট কমলো। এখন তো টিচার পাওয়াও সহজ নয়। আমার ভাইটার কয়েকদিন হলো অপারেশন হয়েছে এখন তো ওর হাঁটাহাঁটি কম করতে হয় তাই বাড়িতেই পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।’

‘ঠিক আছে আপু আমি ওদের কে সকাল আটটা থেকে পড়াবো।’

আমি ওঁকে বললাম, ‘ ঠিক আছে সময় বের করে চলে যেও। আমার এখন যেতে হবে! আমারও পার্ট টাইম জব করতে হবে। সন্ধ্যা থেকে রাত দশ টা পর্যন্ত!’

‘কিন্তু আপনার এতো বড় একটা পার্লার থাকতে আপনি জব কেন করছেন? বুঝতে পারছি না আপু।’

‘বুঝবে না ভাইয়া। আমার কি শুধু এই একটাই কাজ করলে হবে। তাছাড়া আমার মিশন টা কমপ্লিট করতে হবে তো!’

‘কিসের মিশন আপু?’

উফ! বেফাঁস কি যে বলে ফেললাম! আমার মুখে কিছু থাকে না। ভাগ্যিস কিছু বুঝতে পারেনি ওঁ।
‘কিছু না ভাইয়া থাকো হ্যাঁ। আমি ওঁদের বলে দিয়েছি ওঁরা তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দেবে।’

প্রশান্ত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো।

গতকাল রাতে সেই রেস্টুরেন্ট থেকে আমাকে কল করা হয়েছিলো আমার নাকি ওখানের চাকরি টা হয়েছে। আমার একটা বিষয় কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না, যে রেস্টুরেন্ট থেকে শুধু মাত্র আমার ফেস দেখে আমাকে রিজেক্ট করেছিলো সেখান থেকেই দুই সপ্তাহ পর চাকরির জন্য কল কেন করলো? আদোও কি কোনো কারণ আছে? কারণ তো নিশ্চয়ই আছে! না হলে তো এতো দিনে ওই পোষ্ট টা খালি থাকার কথা না। আর আমাকে ডাকলো তো ডাকলো তাও দুই সপ্তাহ পর? আমার এতো কিছু ভেবে কাজ নেই। আমার তো যে কোনো ভাবে ওই রেস্টুরেন্টে ঢুকা চাই। একবার যখন চান্স টা পেয়েছি হাত ছাড়া করতে চাই না।

রেস্টুরেন্টে ঢুকেই কারোর সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। টাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে নিলে কেউ একজন আমায় ধরে ফেললো। বন্ধ চোখ খুলে দেখলাম মিষ্টার প্রিহান আমাকে ধরে রেখেছেন। বুঝতে পারলাম না এই লোকটা এখানে কি করছেন? উনি কি আমাকে ফলো করছেন কোনো ভাবে। রোজ এই লোকটার বিরক্ত আর নেওয়া যাচ্ছে না। মানে আমি যেখানেই যাবো সেখানেই উনাকে যেতে হবে?

‘ভাগ্যিস ধরে ফেললাম না হলে কোমড় ভা’ঙা বউ নিতে হতো আমাকে!’

লোকটার গা ছাড়া কথা বার্তা শুনে গা জ্বলে যাচ্ছে।

‘আপনি এখানে কি করছেন?’উনার থেকে সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম!

‘আমি এখানে কি করছি মানে? আপনি যেখানে আমি সেখানে।’

‘আপনি কি আমাকে ফলো করছেন?’

‘হ্যাঁ ফলো করছি তো!’ স্পষ্ট জবাব উনার।

‘আপনি কি আমাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দিবেন না?’

‘ নাহ বিয়ের আগে শান্তি নেই আপনার। শান্তি তো পাবেন আমাদের বিয়ের পরে!’

‘এসব ভুলভাল স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন মিষ্টার প্রিহান হাওলাদার।’

‘আপনার কাছে ভুলভাল হতে পারে আমার কাছে না।’

‘যত্তসব!’ বলে চলে আসছিলাম। উনি পেছন থেকে বললেন,

‘এই যে মালা আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে আজকে! লাইক ড্রাগনফ্লাইস!

‘ই’ডি’য়ে’ট লোক!’

#চলবে