প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-০৭

0
332

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৭
#রাউফুন

মালা খুব ভালো করে সব দিকে খেয়াল রাখছে৷ ঔশীকে নজরে নজরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। প্রিহান এসেছে ওর ভাগনির বার্থডে পার্টি সেলিব্রেট করতে আর সে কি না গা’ধা’র মতো তাকেই চলে যেতে বলছিলো এতক্ষণ। ভেবেই লজ্জা লাগছে তার। লোকটাই বা কেমন তাকে ভুলানোর জন্য এভাবে ঘা’ড় ত্যারামো না করলেও পারতো। সরাসরি বললেই তো হতো যে সে এখানে বার্থডে পার্টি থ্রো করেছে। মালা আনমনে খাবার অর্ডার নিচ্ছে। গরম খাবার সার্ভও করছে। প্রিহান খনে খনে তাকেই দেখছিলো এটা মালা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে।

সুজানাকে দেখা গেলো ওঁদের সাথে বসেছে। কিন্তু প্রিহানের সেটা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। প্রিহান এখনো অব্দি বাড়ির কাউকেই সুজানার খা’রা’প দিক গুলোকে তুলে ধরে নি তাই সে আজকের এই ইভেন্টে আছে। বাড়ির সবাই জানে প্রিহান সুজানাকে রিজেক্ট করেছে তাই সুজানা অন্যত্র বিয়ে করেছে। প্রিহানের বাবা, মা, দাদু, দাদিমা সবাই খুব বেশি পছন্দ করতো সুজানাকে৷ প্রিহান তাকে বিয়ে না করাই তাদের সবার আফসোস হয়েছে। একমাত্র শুধু ঔশীই সুজানাকে পছন্দ করেনি।

মালা খাবার সার্ভ করছিলো। ওর হাতে ড্রিংকস আর গরম খাবার৷মালা সুজানাকে পাস করে এগিয়েই যাচ্ছিলো সে-সময় সুজানা ওর পায়ে লেংড করে৷যার দরুন মালা নিজেকে কন্ট্রোল করতে চেয়েও পারলো না৷পা স্লিপ করে পরে গেলো। হাতে থাকা খাবারের প্লেট আর ড্রিংকস এর গ্লাস টা ছিটকে পরে গেলো৷ যার সব টাই প্রিহান আর তার পাশে বসে থাকা তার মায়ের উপর পরলো। প্লেটে থাকা কা’টা চামচ গিয়ে প্রিহানের ঘাড়ের সামান্য নিচে লাগলো। আকস্মিক এই ঘটনায় কয়েক জোড়া চোখই হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মালার দিকে।

সুজানা আনন্দের হাসি হাসলো।সে যখন পার্টিতে উপস্থিত হয় তখন সে মালাকে দেখতে পাই।আর এটা সে মানতে পারছিলো না মালা এখানে চাকরি করে। আলাদা একটা ক্ষোভ কাজ করছিলো রাস্তায় করা সেদিনের ব্যবহারের জন্য। তাই সে একটা মিনি গেইম খেললো। মনে মনে সে আওড়ালো,

‘হাহ্ মালা এবার আমিও দেখবো কি করে তুমি তোমার চাকরি বাঁচাও।’

রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মালাকে বকাঝকা করতে নিলে প্রিহান হাত নেড়ে ইশারায় তাকে যেতে বললো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে সবার উদ্দেশ্যে বললো,

‘আব্বু, দাদু, দাদিমা তোমরা খাওয়া কমপ্লিট করো। আর আম্মু তুমি একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আসছি।’

‘কোথায় যাচ্ছো তুমি?’ প্রশ্ন করলেন তার দাদু।

‘যার জন্য এই ইন্সিডেন্ট টা হয়েছে তাকে তো একটু হলেও শ্বাস্তি ভোগ করতে হবে তাই না?’

মালা প্রিহানের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। না জানি কি হতে যাচ্ছে আজ তার সঙ্গে। প্রিহান গম্ভীর মুখে বললো,

‘কাম উইদ মি মিস মালা।’

মালা গুটিগুটি পায়ে প্রিহান কে অনুসরণ করলো। প্রিহান একটা রুমে ঢুকলো। বাধ্য হয়ে মালাকেও ঢুকতে হলো৷ ঝট করে প্রিহান দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিজের স্যুট খুলে ফেললো। শার্ট খুলতে নিলেই মালা ভয়ে আঁতকে উঠলো। ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘একি আপনি আপনার পোশাক কেন খুলছেন?’

‘আপনাকে দেখানোর জন্য!দেখবেন না?’

‘দেখানোর জন্য মানে? কি দেখবো?’ পিছনে ফিরে বললো মালা।

প্রিহান এর মধ্যেই ওর শার্ট খুলে ফেলেছে। প্রিহান মালার কাছে এসে দাঁড়ালো। প্রিহানের গায়ে সাদা সেন্ট্রো গেঞ্জি আছে। মালা পিছনে সরতে নিলে প্রিহান ওর হাত টেনে ওর কাছে আনলো৷ অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো মালা।

‘কি করছেন মিষ্টার প্রিহান?’

‘দেখুন কি করেছেন!’

প্রিহান ঘাড় নিচু করে দেখালো ওর ক্ষতস্থান। মালা তা দেখে আহত হলো। প্রিহানের ঘাড় থেকে রক্ত ঝড়ছে। কা’টা চামচ গেঁথে গেছিলো তার সে সময়। ব্যথা পেলেও মালার কথা ভেবেই একটুও শব্দ করে নি সে। বাইরে এটা দেখালে মালার আরও সমস্যা হতো। তাই প্রিহান মালাকে আলাদা ভাবে ডেকে নিয়ে এলো। মালা বললো,

‘এটা কি করে হলো?’

‘আপনার মতোই ধারালো জিনিস দিয়ে হয়েছে!’

‘আমার মতো ধারালো মানে?’ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো মালা।

‘কা’টা চামচ, কা’টা চামচ বুঝলেন?’

‘আ’ম স্যরি মিষ্টার প্রিহান। আমি বুঝতে পারিনি।আমাকে ক্ষমা করুন।’ অনুনয় করে বললো মালা।

‘তা কি করে হয়। ক্ষমা তো আপনি পাবেন না৷ আপনি এক কাজ করুন এখানে মলম লাগিয়ে দিন নিজের হাতে। আর এটাই আপনার শাস্তি।’

‘কিন্তু এটা তো আপনি নিজেই লাগাতে পারতেন।’

‘পারলেই আমি লাগাবো কেন?’

‘কেন লাগাবেন না শুনি? আর এখানে মলম কোথায় পাবো?’

‘মলম আমার কাছে আছে।’ পকেট থেকে বের করে মালার সামনে ধরলো প্রিহান।

‘আপনি কি মলম ও সাথে করে নিয়েই ঘুরেন নাকি?’

‘হ্যাঁ অবশ্যই।কখন লেগে যাবে কে জানে,সেটা ভেবেই রাখা আরকি।’

‘আপনিই লাগিয়ে নিন না।’

‘আচ্ছা আপনি এভাবে শুনবেন না তাই তো? আমি কি এটা নিয়ে বাইরে যাবো?বাইরে নিয়ে গিয়ে দেখাই সবাইকে যে কি হয়েছে?’

‘না না আপনি দিন মলম।আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি।’

”বজ্জাত লোক একটা।”বিরবির করে বলল মালা।

উপায়ন্তর না পেয়ে সে মলম টা হাতে নিলো। প্রিহান বিজয়ের হাসি হাসলো। মালা ভাবলো এখন এই অবস্থায় প্রিহান বাইরে গেলে আরও একটা হট্টগোল হয়ে যাবে। তাই সে বাধ্য হয়েই প্রিহান কে মলম লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রিহানের ঘাড়ে হাত গেলো না তার। কারণ প্রিহান ইচ্ছে করে পা উঁচু করে রেখেছে যাতে মালা ওর ঘাড়ে হাত না দিতে পারে। মালা বিরক্তিকর শ্বাস নিলো। এই লোকটা ইচ্ছে করেই তাকে জ্বালাচ্ছে। ইডিয়েট লোক। আর প্রিহান ও খুব মজা পাচ্ছে মালাকে জ্বালিয়ে। মালা জোর করে ধরে প্রিহানের ঘাড়ে হাত ছোঁয়ালো। হঠাৎ ঠান্ডা হাতের ছোঁয়াই অজানা শিহরণে কেঁপে উঠলো প্রিহান। কোনো অদ্ভুত শিহরণ! মালাও কিছু টা ইতস্তত বোধ করলো। কারণ সেও প্রিহানের হঠাৎ কঁম্পন বুঝতে পেরেছে। অস্বস্তিতে ঢোক গিলে নিলো সে৷ ঠিক সে সময় প্রিহানের ফোন বেজে উঠলো আর ফোন দেখেই সে পোশাক পরে কোট হাতে নিয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেলো।

সকালে প্রশান্ত আসতেই পুতুল পড়ার জন্য রুমে চলে গেলো। আজও মালা প্রশান্ত কে ব্রেকফাস্ট করিয়েই ছাড়লো।যদিও প্রশান্ত রোজ ই বলে সে ব্রেকফাস্ট করে এসেছে তাও মালা তো নাছোড়বান্দা।মালা ঠিক বুঝতে পারে প্রশান্ত মিথ্যা বলছে।ওতো দূর থেকে আসে ছেলেটা।ওতো ভোরে যে খাবার রেডি থাকে না মালা তা ঢের বুঝতে পারে।পুতুল আর গহীন লক্ষীটি হয়ে পড়তে বসলো।আর মালা রোজকার মতোই কাজে বেরিয়ে পরলো।

পুতুল পড়ছে আর প্রশান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। থেকে থেকেই সে প্রশান্তকে দেখে যাচ্ছে। ছোট্ট কিশোরী মনে কেমন বসন্তের হাওয়া বয়ে যায় এই মানুষ টাকে দেখলে।না চাইতেও পুতুল তার স্যার কে মন দিয়ে বসেছে।সে আটকে রাখতে পারেনি মানুষ টার প্রতি তার ভালোলাগাকে৷এভাবে হইতো কখনোই তার কাউকে ভালো লাগে নি যতটা না তার স্যার কে লেগেছে।তার বান্ধবী প্রিয়ন্তি ওর বয়ফ্রেন্ড আছে তারপর রিয়ারও বয়ফ্রেন্ড আছে। শুধু ওর আর মাহিয়ার নেই। মন যেনো কেমন উড়ু উড়ু করে তার। স্যার কে দেখলেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। মনে হয় কেউ বুকের ভেতর মনে দামামা বাজাচ্ছে। পরীক্ষা দিয়ে সে সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। আর এখন তার মনে প্রশান্ত মানে তার স্যার কে নিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি জেগে উঠেছে!হঠাৎ পুতুল কেঁপে উঠলো।প্রশান্ত ধমক দিয়েছে তাকে।অভিমানে নাকের পাটা ফুলে উঠলো ছোট্ট কিশোরী মন!

‘কি সমস্যা তোমার?পড়াশোনা রেখে হা করে কি দেখছো?’

পুতুল ঘাবড়ে গিয়ে বলে, ‘ক’কই স-স্যার। আমি তো ভাবছিলাম কিভাবে এই অংক টা করবো!’

‘কই দেখি খাতা দেখাও!’

‘নাহ স্যার ঠিক আছে!’

‘দেখাও! দেখি কোথায় সমস্যা হচ্ছে!’

না চাইতেও পুতুল কে খাতাটি দিতে হলো। প্রশান্ত খাতা নিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর পানে। খাতার পাতায় ওর আর পুতুলের নাম লেখা। প্রশান্ত + পুতুল।যেমন টি উঠতি বয়সের মেয়েরা করে থাকে। রেগেমেগে প্রশান্ত জিজ্ঞেস করলো,

‘এসব কি পুতুল?’

‘ক-কি স্যার!’

‘খাতায় আমার নাম কেন লিখেছো?’ ধমকে উঠে প্রশান্ত।পুতুল ওর ধমকে কেঁদে দিলো।

‘চুপ। কাঁন্না থামাও। একদম কাঁন্নাকাটি না!’

‘ভুল হয়ে গেছে স্যার আর হবে না!’

‘আর যদি কোনো দিন এসব দেখেছি আমি আর পড়াতে আসবো না! পড়াশোনা রেখে কি আজকাল এসব করা হচ্ছে?’

‘না না স্যার এভাবে বলবেন না। আপনি আসবেন স্যার। আমি আর এমন করবো না।’

‘কি হয়েছে স্যার? আপনি আপুকে বকছেন কেন? এই আপু তুমি কাঁদছো কেন?’ বললো গহীন।

‘না গহীন কিছু না। তুমি পড়ো হুম। তোমার আপু একটু দুষ্টুমি করেছে তাই বকে দিলাম।’

গহীনের ছোট্ট মস্তিষ্কে এতো কিছু গেলো না। সে আবার পড়াই মন দিলো। আর পুতুল? তার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে অংক কশতে লাগলো। প্রশান্ত সবকিছুই অবলোকন করছে পুতুলের হাবভাব। সে আরও আগেই বুঝতে পেরেছিলো পুতুলের মনোভাব। পুতুলের এখন উঠতি বয়স। এসময় টা সবার মন আবেগের হয়। বিশেষ করে একজন পুরুষকে যখন সে রোজ দেখবে তখন তার প্রতিই ভালোলাগা কাজ করবে। এই মেয়েটির শান্ত চাহনি যে তাকে ঘায়েল করেনি তা কিন্তু একেবারেই নয়৷ পুতুলের প্রতি সে কি অনুভব করে একমাত্র সেটা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। পুতুলের প্রতি তার অনুভূতি চেয়েও কোনো ভাবে দমাতে পারেনি সে। কিন্তু লুকিয়ে তো রাখতেই পারে এটাকে। সে নিজেকে মানাতে পারবে যে পুতুল তার এক না পাওয়া কেউ, ধরা ছোঁয়ার বাইরের একজন।

তবে প্রশান্ত চাই না পুতুলের তার প্রতি কোনো আকর্ষণ কাজ করুক। পুতুল কে প্রশ্রয় দেওয়া মানে ওর হঠাৎ হওয়া অনুভূতি, আবেগ কে প্রশ্রয় দেওয়া। প্রশ্রয় পেয়ে এই বয়সের মেয়েদের মন আরও আহ্লাদী হয়ে উঠে। তাছাড়া সে যদি পুতুল কে প্রশ্রয় দেই তবে যে মালার কাছে তার মুখ থাকবে না। তখন কি জবাব দেবে সে মালাকে। যার জন্য সে আজ এতো দূর, তার পুরো পরিবার চলছে, তা তো এই একজন মানুষের জন্য। সে কিভাবে বেইমানি করতে পারে তার সঙ্গে। বারাবাড়ি কিছু দেখলে পুতুল কে আরও সাবধান করতে হবে তাকে। না হলে জল অনেক দূর গড়াবে।
অনেক দূর। আর যেটা প্রশান্ত কখনোই চাই না। কখনোই না।

#চলবে