প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-০৮

0
322

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৮
#রাউফুন

আজ প্রিহান আর ঔশী নিউ মার্কেট গিয়েছিলো। প্রিহান ঔশীকে গাড়িতে বসিয়ে একটুর জন্য শপিং মলের ভেতরে গেছিলো শপিং ব্যাগ গুলো আনতে৷ এর মধ্যেই কতকগুলো লোক ঔশীর মুখ চেপে গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করছিলো।মালাও সে সময় একই শপিং মলের বাহিরে ছিলো।ঔশীকে তুলতে দেখেই দৌড়ে আসে সে।শপিং ব্যাগ ফেলে ঔশীকে ধরে মালা।লোক গুলো মালাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেয়েও পারলো না৷মালা জোরে জোরে দুটো লা’থি দিলো ঔশীকে ধরে রাখা লোকটাকে।এর মধ্যে লোকজন জড়োসড়ো হয়েছে মালার চিল্লানোতে।

প্রিহান শপিং ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে বের হয়েই দেখতে পেলো সব টা। সে চেঁচিয়ে দৌঁড়ে আসে।প্রিহান কে দেখতেই সেই মুখোশধারী লোক গুলো ঔশীকে আর মালাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালালো।মালা কোনো রকমে গাড়ির নম্বর প্লেট টা দেখতে পেলো।ঔশীর গোঙানির শব্দ শুনে প্রিহান অস্থির হয়ে ছুটে যায় তার কাছে।আর ঔশীকে হসপিটালে নিয়ে যায়।ঐশী জ্ঞান হারিয়েছে ভয়ে।প্রিহান পুলিশ কে ফোন করে হসপিটালে ডাকলো।

কয়েকমাস আগেও ঔশী কে মে’রে ফেলার একটা চেষ্টা করেছিলো কেউ৷প্রিহান পুলিশ কমপ্লেন করেছিলো এখনো অব্দি কোনো খবর পাইনি পুলিশ। প্রিহান অফিসার কে জোর দিয়ে বললো,

‘দেখুন অফিসার আমি আপনাকে বার বার বলছি এগুলো সব কিছু পূর্ব পরিকল্পিত প্ল্যান ছিলো।’

‘আপনি কিভাবে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছেন সেগুলো পুর্ব পরিকল্পিত ছিলো? এর আগে আপনার কথামতো সব খোঁজ নিয়েছি কিন্তু কোনো ট্র‍্যাস পাইনি।’

‘আপনারা ট্র‍্যাস করতে পারছেন সেটা আপনাদের অক্ষমতা অফিসার। আপনার উচিত এই বিষয়টির প্রতি আরে দায়িত্বশীল হওয়া। তা না করে আপনার আমাদের সন্দেহ হচ্ছে?’

এতো কিছুর মধ্যে মালা ভুলেই গেছিলো যে তার গাড়ির নম্বর মনে আছে কিছুটা। সে পুলিশ অফিসার এর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

‘আমার সেই গাড়িটার কথা মনে আছে অফিসার।’

‘আপনি কে?’

‘আমি মালা। অফিসার যখন ঘটনা টা ঘটে আমিই ঔশীকে ধরে ছিলাম।’

‘আপনার আর কি কি কিছু মনে আছে?’

‘হ্যাঁ ওটা একটা ব্ল্যাকস্কুয়ট পিওর ছিলো। এম ডব্লিউ, আর গাড়ির নম্বরের শেষ দুটো নম্বর ছিলো, সিক্সটি ফোর! তখনকার এতো কিছুর মধ্যে আর কিছু মনে নেই আমার।’

‘কিন্তু আপনি তো নিজেই বলছেন আপনার ঠিক করে মনে নেই। তাহলে আমরা কিভাবে বুঝবো আপনি কথা গুলো সত্যি বলছেন।’ অবিশ্বাসের সুরে বললেন অফিসার।

‘কারণ ওই মানুষ টা আমার সামনে তুলতে চাইছিলো ঔশীকে। কোনো মানুষ একজন ঘাতক কে ভুলতে পারে না।’ বিশ্বাসের সহিত বললো মালা।

‘আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন মিষ্টার প্রিহান?’ অফিসার প্রিহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ সন্দেহ তো করি৷ আমি একজন লইয়ার। আইনের কাজ করি। উকালতি করতে গেলে শত্রু তৈরি হবে এটা স্বাভাবিক। ঘাতক রা হইতো চাইছে আমার দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করতে। আপনি ভালো করে খুতিয়ে দেখুন ব্যাপার টা।’

‘ঠিক আছে আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।আর অবশ্য সাবধানে থাকতে হবে আপনার পরিবারের সবাইকে। আমরা আরও ভালো ভাবে খোঁজ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব বিষয়টা নিয়ে। আর মিস মালা আপনার যদি আরও কিছু মনে পরে তবে আমাদের কে অবশ্যই ইনফর্ম করবেন।’

মালা মাথা নাড়লো। প্রিহান বললো, ‘থ্যাংক ইউ অফিসার৷’

অফিসার চলে যেতেই মালা প্রিহান কে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আপনি যে পেশায় উকালতি করেন বলেন নি তো?’

‘আপনি জিজ্ঞেস করেন নি তাই বলিনি। কখনো দেখেছেন কেউ নিজেই নিজের ঢা’ক পেটায়?’

‘বারবার ঔশীকেই কেন তুলতে চাইছে বলুন তো মিষ্টার প্রিহান? আপনি বলছেন ঠিকই যে, আপনার দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করতে চাইছে কিন্তু আমার অন্য কিছু মনে হচ্ছে। আপনার উচিত পারসনালি বিষয় টার উপর নজরদারি করা।’

‘আপনি ঠিক বলছেন মালা।এভাবে হাত গুটিয়ে থাকা ঠিক হবে না।আমার স্পেশাল খোচর লাগাতে হবে।’

মালা মনে মবে ভাবলো, ‘আপনি না নিলেও এবার আমাকে খোঁজ নিতে হবে। যদিও সব টাই আমার দায়িত্ব! না হলে মেমকে কি কিভাবে মুখ দেখাবো?’

এতক্ষণ ধরে প্রিয়ন্তি, রিয়া, মাহিয়া, পুতুল চারজন গ্রুপ স্ট্যাডি করছিলো। যদিও তাতে পুতুল আর মাহিয়া ছাড়া বাকি দুইজনের মন ছিলো না। প্রিয়ন্তি আর রিয়া দুইজন ওঁদের বয়ফ্রেন্ড এর সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলো। পুতুল একটু রেগে যায়,

‘এই প্রিয়ন্তি, রিয়া তোরা সারাক্ষণ মোবাইল ধরে বসে থাকিস কেন বল তো? এভাবে চললে ক্লাস টেন পাশ টাও করতে পারবি না।’

‘আমার কথা বাদ দে! আগে বল এটা কি?’

পুতুল সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো, ‘কি এটা?’

মাহিয়া ঝট করে বললো, ‘এটা তুই কোথায় পেলি?’

‘কেন তোর ডাইরিতে।’

‘দে ওটা দে বলছি? অন্যের জিনিস না বলে নেওয়া টা ঠিক না জানিস না?’

মাহিয়ার কথায় পাত্তা দিলো না প্রিয়ন্তি। সে হাতে থাকা চিঠিটা পড়তে থাকে,

‘‘মাহিয়া মনে পরে? তোমাকে দেখা সেই প্রথম দিন টা? তোমার হাতের প্রথম ছোঁয়াটা? তুমি আছো আমাকে ঘিরে আমিও থাকতে চাই তোমাকে ঘিরে। খুঁজতে চাই তোমার মন টাকে, খুঁজে এসেছি বরাবর। আমার মন টা শুধুই তোমারি যে। তার কি তুমি রাখো খবর? ভালোবাসায় তুমি মাহিয়া।’’

ইতি
‘ভালোবাসার নয়ন!’

‘ওহো ভালোই তো মোটামুটি লিখাটা।’

‘ওর প্রেমটাও তাহলে মোটামুটি।’ বললো রিয়া।

‘কিরে রিয়া চল আমরা এখন যায়। মাহিয়া আর পুতুল তো এক সাথেই যাবে। আমি আর তুই বরং যায়!’

পুতুল মাহিয়ার প্রেমপত্র শুনে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। মাহিয়া পুতুলের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো। আজকেই সে পুতুল কে জানাতো তার আগেই প্রিয়ন্তি টা সব কিছু শেষ করে দিলো।এভাবে প্রিয়ন্তি চিঠিটা না পড়লেও পারতো।

শেষ মেষ মাহিয়াও প্রে’ম করছে আর এটা তার কাছে লুকিয়েছে।পুতুল সব সময় মাহিয়াকে আলাদাভাবে নজরদারি করে। ওকে একটু স্পেশাল ভাবে রিয়া আর প্রিয়ন্তির থেকে আর সেখানে প্রিয়ন্তিই কিনা তার প্রে’ম নিবেদনের কথাটা লুকালো। একটুতেই পুতুলের চোখ ভিজে উঠে। ভেতর থেকে কষ্ট হচ্ছে তার। পুতুল অভিমান করে একা একাই হাঁটতে থাকে। স্কুল থেকে বেরিয়েই গটগট করে বের হলো সে৷ মাহিয়া দৌঁড়ে ওর পাশে পাশে হাঁটছে। আর পুতুল কে বুঝানোর চেষ্টা করছে।

‘আরে পুতুল দাঁড়া লক্ষীটি। আগে শুনবি তো নাকি? আমার কথাটা তো শুন?’

‘কি শুনবো তোর কথা? আমি ভাবতাম অন্তত তুই আমার কাছে কিছু লুকাবি না। এটুকু বিশ্বাস তো ছিলো।কিন্তু আজকের পর আর সেটাও রইলো না।’

‘আহা পুতুল আমার পাখি শুন না। আগে আমার কথা শুনে নে। আমি আজই তোকে বলতাম নয়নের কথা। নয়ন নিজেই আমাকে বারণ করেছিলো যাতে আমাদের সম্পর্কের কথা কাউকেই না জানাই। ও চাইছিলো না আমাদের সম্পর্ক টা পাঁচ-কান হোক এখনি।তাই আমিও ওঁকে কথা দিয়েছিলাম যে কাউকেই বলবো না৷ তুই ভুল বুঝিস না প্লিজ! কিন্তু ওই প্রিয়ন্তি টা সব ঘেঁটে দিলো।’

‘আচ্ছা যাহ মেনে নিলাম। আজকের পর কিন্তু আর কিছু লুকাবি না। যেমনটা আমি তোকে লুকাই না।’

‘আচ্ছো বল তোর খবর কি?’

‘তুই বলেছিলি না স্যার কে আকার -ইঙ্গিত করে বুঝাতে? স্যারকে অনেক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছি। সেদিন খাতায় আমার আর স্যার এর নাম টা দেখে ফেলেছিলো। এতেই স্যার সেকি রাগ! স্যার কে এর আগে কখনোই আমি এতো রেগে যেতে দেখিনি। আমার ভীষণ ভয় হয় এখন। যদি স্যার বাসায় বলে দেই তবে যে আব্বু আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। এমনিই আব্বু সব সময় মুখিয়ে থাকেন।’

‘আচ্ছা। তাহলে এখন কিছু দিন অফ রাখ বুঝলি। নয়নের কথা শুন? ও খুব ভালো ছেলে। বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। খুব বড়লোক। আমাকে খুব ভালোবাসে জানিস?’

‘ভালোবাসলে তো ভালোই।’ বললো পুতুল।

ওরা গল্প করছিলো আর হাসছিলো। কিছুক্ষণ পরই মাহিয়ার বাড়ি এসে যাবে। এরপর পুতুল কে রিকশা বা অটোতে যেতে হবে।

আজ প্রশান্তর ভার্সিটি থেকে ফিরতে লেট হয়েছে। সে বাসার উদ্দেশ্যে উল্টো পথে বাড়ি ফিরছিলো। তার সামনে রাস্তা থেকে একজনের হাসির শব্দ শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। একটা তো তার বোনকে দেখছে! আরেকটা? এই কন্ঠঃস্বর শুনলেই তার হৃদয়ে ছলকে উঠে। হার্টবিট বেড়ে যায়। এই মেয়েটির কন্ঠঃস্বর যে তার একান্ত আপন। সে বাড়ির ভেতর যেতে চেয়েও পারলো না। দাঁড়িয়ে রইলো এক পলক দেখার জন্য সেই কাঙ্ক্ষিত মুখটা। পুতুল আর মাহিয়া একদম প্রশান্তর মুখোমুখি হয়ে যায়। প্রশান্তর বাক-শক্তি যেনো লোপ পেয়েছে। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সে পুতুলের মুখোশ্রীর দিকে। এলোমেলো চুল, শুকনো ঠোঁট, কপালের খুঁচরো চুল গুলো মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে। জড়োসড়ো হয়ে মাথা নত করে থাকা মেয়েটির এই রুপের দাপট যেনো ভেতর থেকে পু’ড়ি’য়ে ছা’ই করে দিচ্ছে প্রশান্ত কে।

প্রশান্ত কে এখন এখানে দেখে পুতুলের বুকের উঠানামা এতোটাই বেড়ে যায় যে ওর ওর ব্যাগ টা শক্ত করে চেপে ধরে।এই মানুষ টা এখানে কেন? কি করছেন তিনি এখানে? প্রথম অনুভূতি, প্রথম প্রেম, প্রথম হৃদস্পন্দন বাড়া এই মানুষ টার জন্য যে অনুভব করেছে সে। কি করে তাকে ভুলে থাকতে পারে।

‘আরে ভাইয়া তুমি কখন এলে?’

‘এইতো এখনি। তোকে দেখেই দাঁড়িয়েছি। ওঁ তোর ফ্রেন্ড?’

‘হ্যাঁ ওর নাম পুতুল!’

‘চিনি ওঁকে আমি!’

‘কিহ?’

‘নাহ কিছু না। তুই ভেতরে যা আমি আসছি।’

‘আচ্ছা ভাইয়া। এই পুতুল একটা অটো ধরে চলে যা। ভাইয়া তুমিই না হয় ওঁকে একটু ছেড়ে দাও!বেচারি একা একা যাবে।’

‘আচ্ছা তুই যা। আমি দেখছি।’

এতক্ষণ যেনো পুতুলের সবটাই মাথার উপর দিয়ে গেলো।প্রশান্ত স্যার মাহিয়ার ভাই? হায় আল্লাহ এখন কি হবে?এখন যদি মাহিয়া জানতে পারে যে, সে যাকে পছন্দ করে সে তারই ভাই।তাহলে কি মাহিয়া তাকে ভুল বুঝবে?জানলে যদি ভুল বুঝে তখন?

#চলবে