প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-০৯

0
312

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৯
#রাউফুন

প্রশান্ত একবার পুতুল কে ভালো ভাবে দেখে নিলো। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। বড্ড মায়া হলো তার। নিশ্চয়ই মেয়েটা ক্লান্ত খুব। একটু জিড়িয়ে নিলে বোধহয় ভালো লাগবে। তাই সে ভনিতা না করে গম্ভীরমুখে বলে,

‘তুমি এক কাজ করো বাড়ির ভেতরে আসো। তুমি একটু অপেক্ষা করলে এক সাথে যেতে পারি।’

হ্যাঁ বা না কিছুই বললো না পুতুল। সে শুধু বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রশান্ত ভাবলো মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে বসানো উচিত! তাই সে নিজের বোন কে হাক ছেড়ে ডাকলো,

‘এই মাহিয়া, মাহিয়া, তোর ফ্রেন্ড কে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা। আমার একটু জরুরি কাজ আছে। আমিও ওইদিকেই যাবো ভাবলাম আমার সঙ্গেই না হয় যাবে।’

মাহিয়া ভাইয়ের ডাকে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। সে একটু লজ্জা পেলো। ইশ! সে যদি নিজেই পুতুল কে ঘরে নিয়ে আসতো। লজ্জা পেয়েই সে পুতুল কে টেনে ঘরে নিয়ে এলো। সে পুতুল কে খাটে বসিয়ে দৌঁড়ে গেলো মায়ের কাছে। মাকে গিয়ে বললো,

‘ও আম্মা আমার ফ্রেন্ড পুতুল এসেছে। ওঁকে প্লিজ কিছু একটা খেতে দাও। আজকে প্রথম বারের মতো এলো। এভবে খালি মুখে যেতে দিবো?’

‘সেকি রে আগে বলবি তো।’

‘ভাইয়া ভেতরে নিয়ে এসেছে। আমি লজ্জায় ওকে বাড়িতে নিয়ে আসিনি কখনো। কিন্তু আজ যেহেতু এসেছে এভাবে কিভাবে যেতে দিই।’

‘তুই বস আমি বিস্কুট, মুড়ি মাখাচ্ছি। এরপর নিয়ে যা। ভাত ও খাইয়ে পাঠাবো আজ।’

‘আচ্ছা!’

কাজ শেষে সালেহা বেগম হাত মুছলেন আঁচলে। হন্তদন্ত হয়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে ঘরে গেলেন। সংকোচ করে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখেই তার ভীষণ ভালো লাগলো। নাম টা যেমন পুতুল দেখতেও তেমন পুতুলের মতো। আহ কি মিষ্টি মেয়েটা! তার ছোট মেয়েটাও এরকম গড়নের।
পুতুল উনাকে দেখেই সালাম দিলো। তিনি সালাম নিয়ে ইতস্তত করে বলেই ফেললেন,

‘মা তোমার কিন্তু এখন যাওয়া হচ্ছে না। আন্টির বাড়ি প্রথম বার এসেছো হাত মুখ ধুয়ে আসো। চারটে খেয়ে যাবে এখান থেকে।’

‘না না আন্টি এসবের প্রয়োজন নেই৷ আমি তো চলেই যাচ্ছিলাম কিন্তু মাহিয়া ঘরে আনলো!’

‘তাতে কি হয়েছে মা। তুমি তো আমার মাহিয়া আর মিহির মতোই আরেকটা মেয়ে। যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো।’

এই পর্যায়ে গিয়ে পুতুল কি বলবে ভেবে পেলো না। তবুও ওর নার্ভাসনেস কা’ট’ছে না। সালেহা বেগম মাহিয়াকে পাঠালেন পুতুলের কাছে। তার ছোট মেয়ে মিহি এখন ঘুমাচ্ছে। পুতুল না চাইতেও মাহিয়ার সঙ্গে কল ঘরে গেলো। হাত মুখ ধোয়ার জন্য যাবে তখনই প্রশান্তর সামনে পরলো। মাত্রই গোসল করা শেষ করেছে সে। মাথার ভেজা চুল গুলো গামছা দিয়ে মুছে নিচ্ছে। প্রশান্ত লুঙ্গি পরে আছে শুধু। পুতুলকে দেখে লজ্জা পেয়ে তারাতাড়ি গেঞ্জি পরে নিলো।

প্রশান্তকে এক পলক দেখেই পুতুলের সারা শরীর কাঁপছে। জীবনে প্রথম বার প্রেমে পরার অনুভূতি বোধহয় এতোটাই তীব্র হয়? এভাবে লোকটাকে দেখে উলটো দিকে ঘুরে রইলো সে।

‘ভাইয়া তুমি যাও। পুতুল হাত মুখ ধুয়ে নিবে।’ বললো মাহিয়া।

‘কল চেপে দিস। তোর ফ্রেন্ড পারবে না মনে হয়।’

‘আচ্ছা যাও।’

প্রশান্ত পুতুলের ঘাবড়ানো মুখ দেখে তারাতাড়ি সরে গেলো এবার। পুতুল আর মাহিয়া হাত মুখ ধুয়ে মুছে বসলো ঘরে। সালেহা বেগম অনেক গল্প করলেন ওঁদের খেতে দিতে দিতে। এদিকে পুতুল প্রশান্তর সামনে এক লোকমা ভাত ও গলা দিয়ে নামাতে পারছে না। বুকের ভেতর হার্ট টা যে নাচানাচি করছে এক অজানা কারণে এটা সে কিভাবে বুঝাবে? প্রশান্ত শুধু একটু পর পর তাকিয়ে পুতুলের মতিগতি দেখছে। সে মাহিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘কি রে মাহিয়া তোর বান্ধবী তো কিছুই খাচ্ছে না৷ তাই তো বলি এরকম বাঁ’শে’র কঞ্চি কেন!’

‘উফফ ভাইয়া তুমিও না।’

‘একটা নতুন জায়গায় এসেছে মেয়েটা। হইতো লজ্জা পাচ্ছে। তুই এভাবে বলিস না তো।’

বলেই সালেহা বেগম ছেলেকে ধমক দিলেন চোখের ইশারায়।

‘মা তুমি খাও তো। আমার ছেলেটা এমন ই।’

পুতুল শুধু মৃদু হাসলো। আসলে ও খেতেই পারছে না একটুও। ও কম খাবার খাই তবে এখন তো একটুও খেতে পারছে না। কোনো রকমে দুই লোকমা খাবার খেয়েই উঠে পরলো সে।

প্রশান্ত তৈরি হয়ে বাহিরে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুতুল মাহিয়া কে বাই বললো, আর সালেহা বেগম কে সালাম দিয়ে বের হলো। ওর একই সঙ্গে খুব ভালো লাগছে আবার ভেতরে ভেতরে নতুন কিছুর আভাস পাচ্ছে। আজকের পর প্রশান্তর প্রতি তার ভালোবাসা তীব্র থেকে তীব্র হলো। ও আস্তে করে প্রশান্তর সাইকেলে বসে পরলো।

‘ভালো ভাবে বসো। দেইখো পরে না যাও।’

পুতুল চুপটি করে ভালো ভাবে বসলো। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে তার জবান কেউ বন্ধ করে রেখেছে। কথা গলায় আটকে আছে। পুতুল ভালো ভাবে বসেছে প্রশান্ত বুঝতে পেরে সাইকেল টানলো। কিছুক্ষণ যেতেই পুতুলের সারা শরীর ঝংকার দিয়ে কম্পন শুরু হলো। প্রথম বার, প্রথম বার প্রশান্তর গায়ের গন্ধ পেলো সে৷ প্রশান্ত আপন মনে সাইকেল চালাচ্ছে কিন্তু পুতুলের মনে তোলপাড় হচ্ছে। প্রশান্ত উঁচু নিচু দেখে চালাচ্ছে সাইকেল যেনো ঝাকুনিতে পুতুলের অসুবিধা না হয়। এদিকে পুতুলের মনে হচ্ছে যে হারে সে কাঁপছে এভাবে চললে সে পরে যাবে সাইকেল থেকে। দোনামোনা করতে করতে শেষে এক হাতে প্রশান্তর কোমড় শক্ত করে চেপে ধরলো পরে যাওয়ার ভয়ে। হঠাৎ স্পর্শে প্রশান্ত বেসামাল হয়ে পরলেও নিজেকে সামলে সাইকেল চালানোই মন দিলো কিন্তু মন কি আর সে কথা শুনে। দেখতে দেখতে পুতুলের বাড়ি চলে আসে। পুতুল নামতেই প্রশান্ত একবারও পুতুলের দিকে না তাকিয়ে জোরে সাইকেল টানলো।পুতুল যেনো অন্য জগতে চলে গেছে এই মুহুর্তে।আনমনে হেঁটে ভেতরে চলে এলো কোনো দিক না দেখে।

শাহনাজ গাড়িতে হেলান দিতে দাঁড়িয়ে আছে আনমনা হয়ে। কিছু একটা খুব ভাবাচ্ছে তাকে। সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না ডিভোর্সের পর যে সে শুকরিয়াকে মোটা এমাউন্টটি দিয়েছিলো এটা দিয়ে তো তার খুব ভালো ভাবে জীবন যাপন করার কথা ছিলো! তবে এমন সাদাসিধা জীবনযাত্রা কেন করছে সে? যদিও ডিভোর্স টা সে দিতে চাইনি শুকরিয়ার পক্ষ থেকেই ছিলো। কারণ শাহনাজ খুব ভালো ভাবেই জানতো শুকরিয়ার মতো মেয়ে সে একটাও পাবে না। হিউজ গার্লফ্রেন্ড থাকার পরেও যে মেয়ে তিন তিনটে বছর সহ্য করে থেকে গেছিলো তার সঙ্গে। এভাবে কেউ-ই থাকতো না। শাহনাজ যে তাকে ভালোবাসতো না তা কিন্তু একেবারেই নয়। কিন্তু সে অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গ কিছুতেই ছাড়তে পারছিলো না। আর শেষ পর্যন্ত এটা শুকরিয়া মানতে পারেনি।

কিন্তু যখন সে সুজানার থেকে জানতে পারলো যে শুকরিয়া আলাদা আলাদা পন্থায় রোজগার করছে এটা সে মানতে পারছিলো না। সে তো চাইলে তার দেওয়া মোটা অংকের এমাউন্ট দিয়ে আনন্দে জীবন অতিবাহিত করতে পারতো। সেদিন ওঁদের মুখোমুখি দেখা হওয়ার কথা ভাবলেই ওর বেশ অবাক লাগছে। ওঁদের ডিভোর্সের তিন বছরের মধ্যেই শুকরিয়ার নুরের মতো চেহেরাটা যেনো অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে। আর কিছু দিন গেলে হইতো শাহনাজ ওঁকে চিনতেই পারতো না। আচ্ছা শুকরিয়া তার আর সুজানার বিয়ের কথাটা জানলো কি করে? ওর তো জানার কথা নয় তবে কি সে তার খোঁজ রাখে? সে বড্ড দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে এতো কষ্টের জীবন পার করেও শুকরিয়া কেন তার দেওয়া এলিমেন্ট টাকে কাজে লাগাইনি?

শাহনাজ বাসায় এসে ওর চেয়ারে বসে আছে বেশ সিরিয়াস হয়ে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো কার সাজি আছে না হলে তো এরকম টা হওয়ার কথা নয়। শাহনাজ যখন ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে গেলো দেখলো সবাই তখন নিজেদের খাবার খেয়ে নিয়েছে। এমন কি সুজানাও। অথচ শুকরিয়া খাবার বেড়ে ওতো রাত অব্দি তার জন্য অপেক্ষা করতো। এখন শুধু তার মা ডাইনিংয়ে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে টেবিলে বসতেই তার মা তাকে খাবার বেড়ে দিলো। সে খেতে খেতেই তার মাকে বললো,

‘বাই দ্যা ওয়ে মম তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো!’

শাহনাজের মা ছেলের কথায় উৎসাহিত হয়ে শুধালেন, ‘হ্যাঁ কি বলবে বলো?’

‘মম আমাদের ডিভোর্স এর পরে শুকরিয়া কি ওর খর্পশের টাকাটা নিয়েছিলো?’

এতো বছর পর ছেলের মুখে মালার কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন তিনি।

‘এতো বছর পর ওর কথা জিজ্ঞেস করছো যে হঠাৎ? কিছু কি হয়েছে?’

‘বলো মম। যা জিজ্ঞেস করছি তা সোজাসাপটা উত্তর দাও।’

তৎক্ষনাৎ তার হাতে থাকা চামচ টি পরে গেলো। তার রিয়েকশন দেখে শাহনাজ যা বুঝার বুঝে নিলো।

‘না মালা টাকা গুলো নেই নি।’

‘এই কথা তুমি কেন আমাকে বলো নি? তুমি কেন ওঁকে টাকা গুলো দাওনি? আমি তো ভাবতাম টাকা গুলো নিয়ে ও বেশ ভালোই আছে।’

‘আমি তাকে টাকা দিইনি এটা ভুল। মালা নিজেই খর্পশের টাকা গুলো না নিয়ে আমাকে ফেরত দিয়ে গেছিলো।’

কথাটা শুনে শাহনাজের মুখ কালো হয়ে গেলো। সে শান্ত তবে রেগে বললো, ‘তবুও তুমি একবার আমাকে কথা গুলো বলতে পারতে।’

‘আমি কেন বলতে যাবো হুহ্। আমাদের পরিবারের সঙ্গে ওই মেয়ের দীর্ঘদিন ধরে সব সম্পর্ক শেষ। সে যদি আমাদের থেকে কোনো সাহায্য না নিতে চাই আমি কেন বলবো এসব কথা তোমাকে?’

‘শুকরিয়ার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই কিন্তু সে এখনো আমার সন্তানের মা! ও কিন্তু জানে না যে ওর সন্তান এখনো বেঁচে আছে। আমাদের সাথে না হোক ওঁ কিন্তু আছে।’

‘চুপ চুপ আস্তে কথা বল। দেয়ালের ও কান আছে।’

#চলবে