ফেইরিটেল পর্ব-৪০+৪১ | বাংলা ধারাবাহিক গল্প

0
537

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–40

মিরা পিটপিট করে তাকিয়ে আছে৷ আপাতত এই মূহুর্তে সামনে থাকা অতিমাত্রায় সুদর্শন ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিতে মন চাচ্ছে তার। আচ্ছা ফাজিল একটা৷ ওর হাসি হাসি মুখের দিকে তাকালে গা জ্বলে যায়৷ মন পুড়ে যায়। নাহ্ ওই হাসির পানে আর তাকানো যাবে না। একবার তাকিয়েছিল এবং জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছে। আর নয় সেই একই ভুল। ইমান ব্যস্ত তার গিফট নিয়ে৷

মিরা নিচে নামার উদ্দেশ্য হাঁটা ধরলে ইমান তার পথ আটকায়। তার বাহু আলতো করে ধরে বলে, “কোথায় যাচ্ছো?”

–” নিচে যাই।”

–” কেন?”

–” আপনাকে কেন কারণটা বলব?”

ইমান ভ্রু কুচকে বলে, ” ওসব বাদ দাও। সারাদিন তো নিচেই থাকো। আমি সাতদিন পর আসলাম। ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা অব্দি করলা না৷ নট ফেয়ার।”

–” আপনি ভালো আছেন?”

প্রশ্নটা খুবই কমন৷ কিন্তু ইমানের মনে হলো এই প্রশ্নে কটাক্ষের আভাস আছে৷ সে বলে, ” আমার ভালো থাকা দিয়ে কি যায়-আসে? ”

–“সেটাই।”

–” গিফট দিলে এখন আমার উচিত রিটার্ন গিফট দেওয়া। বল কী নিবে?”

–” আমার কিছু চাই না।”

ইমান বাকা হেসে বলে, ” ফিডার গিফট দেই? নাকি ডায়পার?”

মিরার লজ্জায় এবারে নাক কাটা যাচ্ছে৷ উফ, এখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায় সে। সে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ” আই জাস্ট হেইট ইউ।”

ইমান শব্দ করে হাসে শুধু। এরপর এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে৷ এতে বেশ অপ্রতিভ দেখালো মিরাকে। সে ওড়নার কোণা গুটিয়ে আঙুলের সঙ্গে প্যাচাতে লাগে৷

ইমান তার একদম মুখের সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর বলে উঠে, ” তুমি কী জব নিয়েছো?”

–” হ্যাঁ।”

–” খুব ভালো। মন দিয়ে কাজ করবে। তোমার জন্য এবার সত্যি একটা গিফট আনা দরকার। আমি সিরিয়াস৷”

–” লাগবে না বলছি তো!”

ইমান আচমকা তার গালে হাত ছোঁয়ালো। সে চকিতে উঠে তার আঁখিযুগলের দিকে তাকালো। ইমানের চোখে চোখ রেখে বলে, ” পারমিশন ছাড়া আমাকে কোনদিন টাচ্ করবেন না৷”

বিদ্যুৎ গতিতে ইমান তার হাত ছড়িয়ে নেয়৷ হুট করে যে তার হয়ে গেল৷ এই অহংকারী মেয়েটার আদুরে গাল ছুয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল? বেহায়া মন কেন তার অবাধ্য হচ্ছে? কেন? এক্সপ্লেনেশন দিতে যাবে তার আগেই নিচ থেকে হাসনাহেনার চিৎকার শোনা যায়৷ ইমান-মিরা দুজনেই চমকে উঠে। ভড়কে উঠে৷ এক অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তারা দুজন দোতলা থেকে নিচে নেমে পরে৷

হাসনাহেনা তার রুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে আর চিল্লাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ইমানের মনে পড়ল মিরাকে কোলে তুলে উপরে নিয়ে যাওয়ার আগে হাসনাহেনার রুমের দরজা লক করে দিয়েছিল। যেন সে পাছে তাদের ওভাবে দেখে না ফেলে। দেখে ফেললে ইমান ওনার সামনে সেকেন্ড টাইম লজ্জায় যেতে পারবে না৷

মিরাকে অতিক্রম করে সে হনহনিয়ে দরজার সামনে গিয়ে প্রশ্ন করে, “আপনি কী আটকা পরেছেন?”

ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে হ্যাঁ।

এমন সময় সাদও বের হলো। মিরা আর সাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দুজনের কেউই কিছু বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছে না। এদিকে ইমান পরেছে বিপাকে। কি করবে সে? ওরা টের পেলে তার মান-সম্মান কিছু রইবে না৷ যতোই হোক সিনিয়র সে। এসব বাচ্চামো কী মানায়? হুহ!

অগত্যা সে অভিনয় শুরু করে৷ লক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হ্যান-ত্যান শুরু করে৷ ভাবখানা এমন লকে সমস্যা হয়েছে। অবাক হলেও সত্যি এই যে, ইমানের এক দারুণ প্রতিভার আবির্ভাব ঘটেছে। সে ইদানীং ফাস্ট ক্লাস এক্টর হয়ে গেছে৷ কী সুন্দর অভিনয় করে সে! এই যে এখন অভিনয় করে ভাবখানা এমন দেখাচ্ছে যেন নকে সমস্যার জন্য উনি আটকা পরেছেন। সে বেশ সাবধানে লক খুলে এবং দরজা খুলে দিয়ে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকল৷

হাসনাহেনার ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে৷ মিরা দৌড়ে গিয়ে পানি আনলো। উনি এক ঢকে সবটা পানি খেয়ে বলে, ” হুট দরজা খুলতে পারছিলাম না৷ কি যে ভয় পেয়েছি।”

ইমান বলে, ” লকে সমস্যা হয়েছে মনে হয়৷”

উনি বলে, ” কী সমস্যা হয়েছে?”

ইমান বলে উঠে, ” আমি কীভাবে বলব? মিস্ত্রী ডেকে চেক করান।”

–” তুমি-ই তো মিস্ত্রী।”

হাসনাহেনা মুখে ফসকে কথাটা বলে উঠে। ইমান চোখ বড় করে তার দিকে তাকালো। উনি আমতাআমতা করে বলে, ” মানে ইঞ্জিনিয়ার মানুষ তুমি। এসব বুঝো ভালো। এজন্য বললাম আরকি। মনে কিছু নিও না৷ ”

ওনার কথায় সাদ আর মিরা দুজন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম৷

ইমান একবার হাসনাহেনার দিকে তাকায় এরপর মিরাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ” এ বাসার সবাই পাগল-ছাগল। ইঞ্জিনিয়ারকে মিস্ত্রী বানায় দিলেন? মানে আমার ডিগ্রির এভাবে অপমান! এ দিনও দেখা লাগলো? এরচেয়ে রাখাল বলতেন খুশি হতাম৷ ”

হাসনাহেনা বলে, ” আমি কালকেই মিস্ত্রী এনে চেক করাব।”

–” মিস্ত্রী কেন আনবেন? মেকারনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আনেন৷ যত্তসব।”

ইমান গজরাতে গজরাতে উপরে উঠে যায়। ও চলে যাওয়ার পর তারা তিনজন মিলে হাসার লাইসেন্স পেয়ে গেল যেন! ঘর অট্টহাসিতে কেঁপে উঠে৷

রাতের ডিনারে একেবারে নিচে নামল। আজকাল তার কী যেন হয়েছে। বাসায় খাওয়া-দাওয়া করছে৷ অন্যথায় সে বাইরে থেকে খাবার অর্ডার দিয়ে এনে খায় নাহলে রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে আসে৷ ইদানীং এনার্জি খরচ করে বাইরে খেতে মন চায়। বাসায় খেতেই ভালো লাগছে। সে চেয়ার টেনে বসতেই হাসনাহেনা প্লেট এগিয়ে দিল৷

মিরা আর সাস হলরুমে টিভির রুমে নেটফ্লিক্স ছেড়ে রেখেছে। মনে হয় মুভি সিলেকশন করছে৷ ওরা কী রাতে আবারো মুভি দেখবে?

ইমান বলে, ” খেতে আসো তোমরা।”

ইমানের এককথায় সবাই টেবিলে বসল। যেন সে এ বাসার অঘোষিত হেডমেম্বার৷

খাওয়া শেষ করে সাদ বলে, ” আমরা মুভি দেখন ভাইয়া। তুমি জয়েন কর আমাদের সঙ্গে।”

–” সকালে অফিস আছে৷”

–” ওহ আচ্ছা৷”

–” কি মুভি দেখবি তোরা? ”

–” ওটাই তো সিলেক্ট করতে পারছি না।”

–” হরর কিছু দেখ। মজা পাবি।”

–” নাইস আইডিয়া৷ ”

ইমান একবার মিরার দিকে তাকালো। এরপর টিটকারি মেরে বলে, ” সাদ হরর দেখিস না৷ মিরা ভুত ভয় পায়৷”

মিরা তখন খাচ্ছিল। চামচ মুখে দিয়েছে। এ কথা শুনে সে চামচ মুখ থেকে বের না করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠে, ” আমি ভূত আর ভালোবাসায় বিশ্বাসী নই।”

ইমান খুকখুক করে কেশে উঠে৷

____________

রাত দুটোয় মিরা আস্তে আস্তে রুমে ফিরে আসে। তারা সত্যি ভয়ংকর একটা হরর মুভি দেখেছে৷ আপাতত সে ভয়ে সিটিয়ে আছে৷ মানে এত্তো ভয়ংকর কোন মুভি হয়? এখন নিজের চুল টানতে মন চাচ্ছে। কেন সে পন্ডিতি করে ভূতের মুভি দেখতে গেল? উফফ! রুমটা একদম ওই হরর মুভির মতো অন্ধকার হয়ে আছে৷ সে দরজার ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজে সামান্য ভয় পেয়ে ঢোক গিলে৷ মানে আজকে সবকিছুই কুফা তার জন্য। পুরা রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা৷

সে ডিভানে এসে বসতেই ইমান নড়েচড়ে উঠে বলে উঠে, ” মিরা”।

মিরা চমকে উঠে বলে, ” কী?”

–” তোমার পেছনে ওই সাদা ওটা কী?”

এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে লাফ দিয়ে উঠে চেচিয়ে উঠে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইমান ঝারবাতি অন করে হাসতে থাকে৷

—” ভীতুর ডিমদের ভূতের মুভি দেখা শোভা দেয় না।”

–” আমি মোটেও ভীতুর ডিম না। আপনি যেভাবে চেচিয়েছেন যেকোন মানুষ ভয় পাবে৷”

ইমান মজা নিয়ে বলে, ” আচ্ছা তাহলে তুমি ভীতুর আন্ডাবাচ্চা। এক গ্রেড প্রোমোশন করিয়ে দিলাম।”

–” শয়তান কোথাকার।”

তার কথা শুনে ইমান সিরিয়াস মুড নিয়ে বলে, ” এমন রাতে শয়তানের নাম নিও না। সত্যি সত্যি ডেভিল চলে আসবে তোমার কাছে।”

মিরা ঢোক গিলে বলে, ” শয়তানকে আমি দাওয়াত দিইনি৷”

–” জনাবের দাওয়াত লাগে না। ভীষণ ছ্যাচড়া। নাম নিলেই বান্দা হাজির হয়৷ আর সুন্দরী মেয়েরা ডাকলে তো কথাই নাই। লুঙ্গিতএ গিট দিয়ে দৌড়ে আসবে৷

–” ইভিল লুঙ্গি পরে?”

–” পরতেই পারে। হু নোজ।”

মিরা গাল ফুলালো। এবং সঙ্গে সঙ্গে কেমন উদ্ভট একটা শব্দ তার কানে ভেসে আসল। মিরা আতকে উঠে ডিভানে পা তুলে বসে। ইভিল তার ডাক শুনে চলে আসলো না তো? আজকের মুভিতে মেয়েটা ডেভিলকে মজা করে ডা দেয়। এবং সত্যি সত্যি ওটা মেয়েটার পিছু নেয়৷ মিরার চেহারা ভয়ে পাংশুটে হয়ে আসে৷

ইমান আরেকদফা হাসে। কারণ এই সাউন্ড তার ফোনে সেট করা। ইচ্ছা করে মিরাকে ভয় দেখানোর জন্য বাজাচ্ছে। বুঝো ঠ্যালা এবার! তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করা হলো, আজব একটা ব্যাঙ গিফট দিল আবার ইগনোর করা তো আছেই। এর শোধ তো তুলবেই সে। এমনি এমনি ছাড় দেওয়ার পাব্লিক নয় সে। ইমান পৈশাচিক হাসি হাসল। দশ মিনিট পর আবারো সাউন্ড হবে৷

দশ মিনিট পর যখন আওয়াজ শুরু হলো। মিরা সুরসুর করে তার দিকে এসে বলে, “আপনি কোন আওয়াজ শুনতে পারছেন?”

ইমান ঘুম ঘুম ভাব করে বলে, ” তুমি আমার রাজ্যে কী করছো?”

–” এই আহাম্মক চুপ কর। আওয়াজ শুনতে পারছেন কোন?”

–” না। কিসের শব্দ?”

মিরাকে চিন্তিত দেখালো ভারী। ইমান হাসি আটকে রেখে তাকিয়ে আছে৷ মানুষকে জ্বালানোতে এত মজা! উফফ!

আচমকা মিরা কেদে উঠে। ইমান পুরা শক হয়ে যায়৷ ওর কান্নার বেগ বাড়লে ইমান উঠে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আরে পাগলী কোথাকার। ”

চলবে৷

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur. (ছদ্মনাম)
Part-41

— “তোমরা মাইয়া মানুষরা এতো ঝামেলার ক্যান বল তো? মেয়ে মানুষের অপর নাম প্যারা হওয়া উচিত ছিল৷ মানে ভুত ভয় পায় উনি তাও কাঁপতে কাঁপতে হরর ফিল্ম দেখবে৷ এরপর রাতে আর অন্ধকারে ঘুমাতে পারবে না৷ বাথরুমে যাইতে পারবে না। কী রং-তামাশাময় জীবন!”

ইমান সমান তালে বকেই যাচ্ছে মিরাকে। মিরা তখনো তার বুকের মধ্যিখানে অবস্থান করছে৷ মিরার নরম অধর যুগল তার বোতাম খুলে রাখা উম্মুক্ত বুকে কিঞ্চিৎ ছুঁয়ে দিচ্ছে। এতেই যেন বেসামাল হয়ে পড়ছে সে। নিজেকে সামলানোর জন্য ইমান আবোলতাবোল বকছে। মাইড ডিস্ট্রাক করার অভিনব কৌশল। এভাবে ভর রজনীতে সুন্দরী ললনাকে জড়িয়ে ধরে বড় ভুল করেছে সে। এখন তার নিজের চরিত্রেই বিরাট ঘাপলা লাগছে৷ সে এতো ঘ*নি*ষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে তার বুকের ওঠা-নামার অস্তিত্ব অব্দি টের পাচ্ছে৷ নিজের উপর আস্থা থাকলেও কন্ট্রোললেস হয়ে পরছে সে। আচানক সে টের পেল মিরা তার বাহুতে চিমটি কাটছে৷ তার ভ্রু আপনা-আপনি কুচকে গেল। সে মাথা নিচু করে দেখার চেষ্টা করছে ঘটনা কী। তার আগেই মিরা তার প্যান্টের পকেট হতে মোবাইল বের করল। মোবাইলে দশ মিনিট পর পর ওই ভয়ংকর আওয়াজ সেট করা ছিল৷ সে ফোন হাতে নিতেই ফোন হতে আওয়াজ ভেসে আসে। মিরা কটমট করে ইমানের দিকে তাকালে সে জিভ কেটে বলে উঠে, “ওহ শিট, ধরা খেয়ে গেলাম।”

মিরা একহাতে ফোন ধরে এবং আরেকহাতে ওর চুল ধরে টেনে বলে, “বজ্জাত একটা! মানুষ এতো মিনমিনা শয়তান কেমনে হয় আপনাকে না দেখলে জানতাম না। ইতর। অভদ্র৷”

–” আমি তো মজা করছিলাম। কে জানত তুমি কেঁদে দিবে ভ্যা করে।”

শেষের লাইনের দ্বারা মিরাকে ছোট করা হচ্ছে। সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলে, ” আপনার ফোন আমি পঁচা পানি ফেলে দিব৷”

ইমান সঙ্গে সঙ্গে মিরার হাতের উপর হাত রেখে চেপে ধরে নিজের ফোন। যেন ফেলে দিলে চাইলেও না পারে। এবং সর্তক করে বলে, ” খবরদার আমার আইফোনের দিকে নজর দিবা না৷”

মিরা কটমট করে বলে, ” আমার হাত ছাড়েন৷”

–” তোমার হাত ছাড়লে আমার বউ হাত ছাড়া হয়ে যাবে৷”

মিরা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। সে-ই ইমানের বউ। তাহলে হাতছাড়া কে হবে? রুমের মধ্যে অন্য কোন মেয়ে মানে ওর আরেক বউকে লুকিয়ে রেখেছে কীনা? আয়হায়!

সে চোয়াল শক্ত করে বলে, ” বউ হাতছাড়া হবে মানে? আপনার কোন বউ হাতছাড়া হবে শুনি?”

— যেভাবে বলছো যেন আমার চারটা বউ৷ তুমি জানো না আমার বউ কয়জন?”

–” জানি।”

ইতিমধ্যেই তারা কথা বলতে বলতে হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেছে৷ মিরা একহাত দিয়ে তার চুল টেনেই যাচ্ছে। ইমান তার বাম হাত দিয়ে মিরার হাত সরানোর চেষ্টা করছে নিজের চুল থেকে ৷ এবং আরেক হাতে মোবাইল ধরে রেখেছে৷

হাতাহাতি করতে করতেই ইমান বলে উঠে, ” কী হলো বললে না যে আমার বউ কয়টা?”

মিরা সোজাসুজি বলে, ” আমার জানা মতে একজন। আপনার তো বেঠিক দশা। আরো বউ থাকতে পারে। যাদের লুকিয়ে রেখেছেন৷ যেভাবে আমাকে সবার কাছ থেকে আড়াল করেছেন৷”

মিরার ত্যাড়া কথার তোড়ে সামান্য হেলে পরে সে৷ হজম করতে টাইম নিল। এরপর নিজের ফোন মিরার হাতের মুষ্টি থেকে কেড়ে নিয়ে বলে, “এইটা হলো আমার আসল বউ। সারাটা দিন বুকে থাকবে। রাতে পাশে শুবে৷ বাকি বিবিগণেরা তো সোফায় ঘুমায়৷”

“বিবি গণ” শুনে মিরার রাগ নাকের ডগায় হুড়মুড়িয়ে এসে গেঁথে গেল পুঁথির দানা মতো। রক্ত টগবগ করছে তার ৷ ভেতরে ভেতরে আগ্নেয়গিরির লাভা বিচ্ছুরণ ঘটছে৷

সে তৎক্ষনাৎ ওর শার্টের কলার ধরে মারলো এক হ্যাচকা টান। ইমান কিছুটা তার দিকে ঝুকে পরলে, মিরা ফটফটা হাত দিয়েই ওর শার্টের বোতাম ছিঁড়ে ফেলে রাগের বশে।

ইমানের ক্ষণেই হতভম্বের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল। মেয়েটাকে দেখলে মনে হবে গায়ে জোর নাই। পাতলা-শুকনা পাট কাঠি৷ কিন্তু আজকে হাতাহাতি করতে গিয়ে টের পেল এই মেয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এনার্জি! মানে এক টানেই তার শার্টের দুটো বোতাম ছিঁড়ে ফেলল। ভাবা যায়?

ইমান সবসময় টপ দুটো বোতাম খুলে রাখে বাসায়৷ কোথাও যাওয়ার হলে তখন লাগিয়ে নেয়। টপ বোতাম খোলা থাকায় সেগুলো ছিঁড়ার সুযোগ পায়নি সে। নিচের দিকে বোতাম দুটো ছিঁড়ে দিয়েছে জন্য ইমান শার্ট পরে থাকলেও শার্টহীন হয়ে গেল৷

এবার ইমান মিরার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে,” শাকচুন্নি মেয়ে! কি শুরু করছো এগুলা? একবার চুল টানো। একবার শার্টের বোতাম ছিঁ*ড়ো। আরেকবার কী প্যা/ন্টে/র চে/ন খু/লে ফে/লে দিবে!

তার কথা শুনে মিরা রাগান্বিত চোখে তাকালো। ইমান থমথমে খেয়ে যায় নিজের কথায় এবং শুধালো,

“ইয়ে মানে নেক্সটে এমন করার সাহস পাবে যদি আমি কোন স্টেপ না নেই। দ্যাটস হুয়াই তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি এখন তোমার ওড়না ছি*ড়ে দিব৷”

–” ডোন্ট ইউ ডেয়ার।”

বলেই মিরা ছুট লাগায়। ইমানও তার পিছু নেয়৷ মিরা পাতলা মানুষ। ফুস করে রুমের অন্যদিকে ছুট লাগায়। ডিভান থেকে বালিশ নিয়ে ইমানের দিকে ছুঁড়ে মারে। ইমান সেটা সঙ্গে সঙ্গে ক্যাচ করে ব্যঙ্গ করে বলে,”এহ আইসে। বালিশ ফিক্কে মারো ক্যান? ডিরেক মন ছুঁড়ে মারো।”

মিরা চোখ-মুখ কুচকে ফেলে এরপর ভেংচি কেটে বলে, “শখের কোন কমতি নাই।”

রুমের ওপাশ থেকে পুনরায় এপাশে বেডের সামনে দৌঁড়ে এলো মিরা। ইমান তাকে ধাওয়া করতে করতে পিছে এসে দাঁড়ালো কিন্তু বেচারার আজ লাক খারাপ। বেডের নিচে সাজিয়ে রাখা সাদা তুলতুলে নরম লেদারের পাপোসটার কোনার সঙ্গে পা বাঁধিয়ে সে উষ্টা খেয়ে পাপোসের উপর পড়ল। এ পাপোসটা সে ইটালি থেকে কিনেছে। দাম রেখেছিল হাজারের কাছাকাছি ডলার। দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও সে কিনেছে৷ আর আজ সেই পাপোস তার সঙ্গে বেঈমানী করে বসলো।

তাকে পরে যেতে দেখে মিরা ঝংকার শব্দ তুলে খিলখিল করে হেসে উঠে। সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকল অপলক নয়নে সে। পরে যাওয়া বৃথা হলো নাকী তবে? এমন হাসি বিরল খুব!

এরপর কুজো হয়ে বসে মিরার হাত ধরে টান মারে।

হাসির রেখা সঙ্গে সঙ্গে মিরার চেহারা থেকে হাওয়া হয়ে যায়। সে হা হয়ে গেল৷ এক পলের অন্তর সে ধাক্কার টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায়৷ একদম ইমানের বোতাম খোলা বুকের উপর। ইমানের মুখে তখন হাসির ঝিলিক৷ মিরাকে শায়েস্তা করতে পেরে সে দারুণ খুশি। মিরা উঠে দাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগলে তার কো*ম*ড় আলতো করে চেপে ধরে বলে, ” আমার বউ সাহেবারা না প্রেম-মোহাব্বত বুঝে না। খালি দূরে দূরে থাকো।”

মিরা দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” বিবিদের কাছে যান। আমাকে ধরে টানছেন কেন?”

ইমানের হাসি চওড়া হলো। সে বলে উঠে, ” দুঃখের কথা শেয়ার করছি। দুঃখ ভাগাভাগি করলে কমে যায়।”

মিরা মুখ ফিরিয়ে নিল। এবং ইমানের নজর পড়ল মিরার গলার ছোট-বড় সাইজের পাশাপাশি কালচে তিল দুটির দিকে। তিল দুটো বড় টানে তাকে। মনে হয় হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে দিক সে৷ বহুদিনের লুকায়িত বাসনা আজ মৌমাছির ঝাঁকের ন্যায় ধেয়ে আসছে। নিজেকে কন্ট্রোল করা এতো কঠিয় হয়ে গেল। নাহ, সে কেন যেন আজ আর পারল না। টুপ করে নিজের ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে তিলের উপর। প্রশান্তিতে সে চোখ বুজে ফেলে। বুকের ভেতর যেন ভেঙে চুরমার হওয়ার শব্দ হচ্ছে। ধুকপুক আওয়াজ বেড়ে গেছে৷সে ব্যতীত এই আওয়াজ আর কারো কানে যাচ্ছে না। ওহ হো! এত শব্দ কিসের? মাই গড, তার হৃদয় কী ভেঙে গেল এক চু*মুতে। ইমান বুঝে পেল না সত্যি কী হৃদয় কারো সংস্পর্শে ভাঙ্গে? সে তো আর সাহিত্যিক নয় যে মন-হৃদয় নিয়ে ভেবেছে কোনদিন। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সে। সারাদিন প্রোগ্রামিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে!

মিরা আতকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজের সব শক্তি ব্যয় করে ইমানের উপর থেকে সরে এসে মেঝেতে শুয়ে পরে৷ অবশ্য অনিচ্ছা বা ইচ্ছায় ইমান তার বাধন আগলা করে দিয়েছে৷

মিরা কঠিন গলায় বলে, ” বারং করেছিলাম না? তাও শুধরাবেন না?”

ইমান মনে করার চেষ্টা করে কি বারণ করেছে ও। পরবর্তীতে মনে পড়ে হার হাইনেস কে চামড়ার হাতে ধরতে মানা করা হয়েছিল। ইমান দুষ্ট হেসে বলে, ” আমি নিষেধ করা কাজ করতে ভালোবাসি।”

তখনই ভৌতিক আওয়াজ পুনরায় বেজে উঠল মিরা খেপে গিয়ে বলে, ” এবার সত্যি আপনার ফোন ভেঙে দিব।”

ইমান বিড়বিড় করে বলে, ” কি*স দিতে গিয়েই মনটা ভাঙ্গে দিলা ললনা। এখন দশটা আইফোন ভাঙ্গেও কিচ্ছু যায়-আসে না।”

ইমান শোয়া অবস্থাতেই ফোন বের করে ভয়েজ অফ করে দিতে গেলে ফোনে হাত বেকায়দায় গ্যালিরির শেষ ছবি বেরিয়ে আসে স্ক্রিনে। তার আর জুইয়ের টেক্সাসের একটা সেলফি৷ ডিনারে গিয়েছিল সেখানে তুলেছে৷

হুট করে মিরা উঠে দাঁড়ালো এবং ডিভানের দিকে অগ্রসর হলো।

সে প্রশ্ন করে, “কী হলো?”

মিরা জবাব দিল না। সোজা ডিভানে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে৷

___________________________

পড়তে পড়তে বিরক্ত লাগায় ইরা তার বায়োলজি বই বন্ধ করে দিল। আজ-কাল পড়াশুনায় মনোযোগ কম তার। গতরাতে সে সারারাত এক্টিভ ছিল৷ সে চেষ্টা করছে পড়ায় মন দেওয়ায় কিন্তু পারছে না৷

টেবিল ছেড়ে উঠে ফোন হাতে নিতেই “আবরার সাদ” আইডি থেকে ম্যাসেজ আসল। গত কয়েকটি দিন ধরে এই আইডি থেকে অনবরত ম্যাসেজ আসছে। ভদ্রছেলেটা জানতে চাচ্ছে গুলিস্তান কী জিনিস! বেচারা বুঝি সত্যি বিদেশে থাকে। ছবি দেখে তাই মন হচ্ছে৷ কিন্তু ছবির ব্যক্তি আর একাউন্টটির মালিক কি সেইম পারসন? সেদিন ম্যাসেঞ্জারে নক দিয়েছিল। কেন যে রিপ্লে দিল ইরা। এখন সারাদিন জ্বালায়৷ ফ্রেন্ডশিপ করতে চায়। রাগের বশে ইরা বলে দিয়েছিল, আমি গুলিস্তানের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিনা। ব্যস নিউ টপিক পেল ব্যাটা। গুলিস্তান কী তার জানা চাই। আরে যেখানে সারাদিন বসে বসে “এক পিস পঞ্চাশ টেকা নিয়ে যান নিয়ে যান” করস সেই আপন জায়গা চিনস না ফেসবুকে আসে।

তখন তার মামী এসে বলে, ” ইরা ভাতটা একটু চুলা থেকে নামাও তো৷ আমি বাইরে যাচ্ছি। বাসায় আর কেউ নাই। অনিক ওর রুমে ঘুমাচ্ছে৷ ”

সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে, ” আচ্ছা।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে বেজায় রেগে আছে। এখানে আসা থেকে মামী তার কাছ থেকে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সে কেন কামলা খাটবে? অনিক ভাইয়াকে দিয়ে ভাত চুলা থেকে নামাক। তাকে দিয়ে কেন করাবে। আজব৷

রান্নাঘরে গিয়ে চুলা থেকে ভাত নামিয়ে মাড় গালার সময় তার হাতে গরম ভাতের ফ্যানা পরে যায়। সে কুকিয়ে উঠে৷ চোখে পানি চলে আসল। কিন্তু তার ব্যথাতুর আওয়াজে কেউ এগিয়ে আসল না৷ মা বাসায় নেই। দোকানে গেছে।মামা-মামী ও বাইরে। বাসায় শুধু সে আর অনিক ভাই আছে। অনিক তাদের মামাত ভাই হয়। ভার্সিটিতে পড়ে৷

ইরা দাঁতে দাঁত পিষে যন্ত্রণা সহ্য করে। এতে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের না হলেও চোখ দিয়ে জল পরতে থাকে। মনে মনে সে ভীষণ ক্ষিপ্ত হলো মায়ের উপর। মায়ের জন্য সব হয়েছে। আজ তাদের এ দশা কেবল মায়ের জন্য। কী দরকার ছিল নানুবাড়ি আসার? মায়ের উপর দিন দিন তার রাগ ঘৃণায় পরিনত হচ্ছে৷

চলবে৷