বাবুই পাখি পর্ব-০১

0
2487

বাবুই পাখি🌿
#সূচনা_পর্ব
Writer-Afnan Lara
.
“এমন যদি হতো
আমি পাখির মতো
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ
এমন যদি হতো
আমি পাখির মত
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ
পালাই বহুদূরে
ক্লান্ত ভবঘুরে
ফিরবো ঘরে কোথায় এমন ঘর
বৃক্ষ তলে শুয়ে তোমার দুঃখ ছুঁয়ে
বৃক্ষ তলে শুয়ে তোমার দুঃখ ছুঁয়ে
ঘুম আসেনা ঘুমও স্বার্থপর”
.
-“অমি ভাই আর কত গান গাইবো?তোকে দেওয়া ডেয়ারটা আদৌ পূরণ করবি নাকি আমরা সবাই গোছগাছ করে চিরতরে চলে যেতাম?আর আসবো না তোর বাসায় আড্ডা দিতে বলে দিলাম।”
.
অমি নামের ছেলেটা বারান্দার রেলিংয়ে উঠে বসে পা দোলাচ্ছে নিচের ফাঁকা রাস্তাটার দিকে চেয়ে।রাত তখন সাড়ে এগারোটা বাজে।ঘড়ির টিংটং আওয়াজ শোনা যায়। ঘড়িটি বিদেশী।চাচা সৌদি থেকে আসার সময় এনেছিলেন।সবসময় সাড়ে বাজলে আওয়াজ করে।পনে/পনেরো বাজলেও বাজে আবার ঘন্টা পূর্ন হলে অনেকক্ষন ধরে বাজে।
অমির বাসায় আজ তার বন্ধু চারজন এসেছে আড্ডা জমাতে।চঞ্চল,টুটুল,দিদার আর রিজবি।
আড্ডা শেষ হতে না হতেই তারা ঠিক করলো ট্রুথ ডেয়ার খেলবে।তাই সেটা খেলতে লেগে গেলো আড্ডা বাদ দিয়ে।অমি প্রথমে ট্রুথ নিয়েছিল।পর পর দু তিনবার তার ভাগ্যে চাকা ঘুরার কারণে শেষে বাধ্য হয়ে সে ডেয়ারটা নিলো।তার বন্ধু চঞ্চলের মতে তার ডেয়ারটা হলো এখন এসময়ে সে রাস্তায় নামবে। সবার আগে যে ব্যাক্তি তার সামনে এসে দাঁড়াবে তাকে প্রোপোজ করবে।হোক সে ছেলে!হোক সে মেয়ে।
টানা ১৫মিনিট ধরে ভেবে সে এবার সিদ্ধান্ত নিলো যাবে।কারণ তা নাহলে ওর বন্ধুরা ওকে ছাড়বে না।অথচ ওদের কি সুন্দর ডেয়ার দিয়েছিলো সে।যেমন চিকেন রান্না করা,দু মিনিটে ডিম ৭টা খাওয়া
আর ওর ভাগ্যে কি জুটলো?যদি কোনো ছেলে হয়?এত রাতে তো আর মেয়ে আসবে না।মেয়ে হলে আরেক বিপদ!
-“ভাববে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছি।তখন ঠাস করে চড় মেরে দেবে।কি করার!”
.
রিজবি ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো,”তুই যাবি নাকি ধাক্কা দিয়ে বেলকনি টপকে নিচে ফেলবো তোকে”
.
অমি কপালের ঘাম মুছে গায়ের টি শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে দরজা খুলে বের হলো।সে দোতলায় থাকে।আস্তে আস্তে করে নিচ তলায় এসে রোডটার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রোডের মাঝে এসে দাঁড়ালো সে।আবাসিক এলাকার রোড বলে বাস/ট্রাক না থাকলেও অনেকক্ষণ পর রিকশা,বাইক,প্রাইভেট কার নজরে আসে।ঢোক গিলে অমি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।কেউ আসছে না দেখে উপরে তাকিয়ে বললো,”কেউ তো আসছে না?চলে আসি আমি?”
.
টুটুল নিচে তাকিয়ে বললো,”নাহ!আসা অবধি ওয়েট করতে হবে তোকে”
.
অমি বিরক্ত হয়ে আবারও সামনে তাকালো।দুমিনিট পর নজরে আসলো একজন।হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই আসছে সে।দেখে মনে হয় একটি মেয়ে।পরনে হলুদ খয়েরী রঙের মিশ্রিত জামা।গায়ে ওড়না ঝুলিয়ে এদিকেই ছুটে আসছে।
.
-“কপালে মনে হয় আমার শনি আছে।এরে প্রোপোজ করলে নির্ঘাত চড় খাব।”
অমি ঢোক গিলে গালে হাত দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো
মেয়েটা ওর সামনে এসে থেমে গেছে।অমি চোখ বন্ধ করে বললো”আই লাভ ইউ বাট প্লিস আমায় চড় মারবেন না।”
.
অমি মেয়েটার কোনো সাড়া না পেয়ে আস্তে করে চোখ খুললো।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার চেহারা মোটামুটি দেখা যায়।মুখের সামনে দুপাশ থেকে চুল এসে ভর্তি।খোলা চুল।মেয়েটার চোখ গুলিয়ে আসছে।চোখ কেমন কেমন করে মাথায় হাত দিলো সে।তারপর নিচে পড়ে গেলো মেয়েটা।অমি মুখে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে।উপর থেকে চঞ্চল হেসে বললো,”তোর প্রোপোজে মুগ্ধ হয়ে মেয়ে জ্ঞান হারাইছে রে অমি”
.
অমি তার কথার উত্তর না দিয়ে নিচে বসে বললো”হ্যালো??আপনি ঠিক আছেন?এক্সকিউজ মি?”
.
কোনো সাড়া না পেয়ে অমি মাথা তুলে বললো”মেয়েটা মনে হয় সিক।”
.
চঞ্চল আর টুুটুল এবার সিরিয়াস হলো।আসছি বলে ওরা এদিকে ছুটলো।অমি মেয়েটার মুখ থেকে চুল সরিয়ে মুখ টিপে এদিক ওদিক ফিরালো।সত্যি সত্যি জ্ঞান হারাইছে মনে হয়।
.
টুটুল কোমড়ে হাত দিয়ে বললো”কি করা যায় এরে?”
.
চঞ্চল বললো”পুলিশ স্টেশন?”
.
অমি মুখ বাঁকিয়ে বললো”হসপিটাল?”
.
-“চুপ থাক অমি!ওরে হসপিটালে নিয়ে গেলে উনারা ভাববে আমরা মেয়েটার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করছি।মেয়েটা তো এমনি এমনি অজ্ঞান হয় নাই।নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে।আই থিংক পানির ছিঁটা দিলে উঠে যাবে।এক কাজ কর বাসায় নিয়ে আয়”
.
-“আর ইউ ম্যাড চঞ্চল? ওরে আমার বাসায় নেবো?কেউ দেখলে কি বলবে?”
.
-“এত রাতে কে দূরবীন নিয়ে তোকে ফলো করছে?যা বলছি তা কর।নাহলে একসাথে সবাই ফাঁসবো”
.
চঞ্চলের কথামতন মেয়েটাকে তারা বাসায় নিয়ে আসলো।সোফার উপর শুইয়ে দিয়ে চারজন মিলে দূরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ওকে দেখছে এখন।অমি হাত ভাঁজ করে বললো”সারা গায়ে মারধরের আঘাত দেখতে পাচ্ছিস?”
.
চঞ্চল গালে হাত দিয়ে বললো”হুম!কি হয়েছে ওর সাথে কে জানে”
.
-“রেপ?”
.
টুটুল ব্রু কুঁচকে বললো”রিজবি?আমি কি দেখছি ওর রেপ হইছে নাকি অন্য কিছু??আমার দিকে তাকায় আস্ক করিস কেন?”
ঐ যে ভবিষ্যত পুলিশ অফিসার দিদার দাঁড়িয়ে আছে।ওকে বল তদন্ত করতে”
.
-“না ভাই।আমি এখনও পুলিশ হই নাই।তবে আমার সিক্স সেন্স বলছে মেয়েটার জ্ঞান ফিরা অবধি ওয়েট করা উচিত।”
.
-“আরও পানি মার ওরে।”
.
-“অলরেডি দেড় লিটার পানির বোতলের এক বোতল পানি ঢালা হইছে ওর মুখে টুটুল!”
—-
পাক্কা দশ মিনিট পর মেয়েটা চোখ খুললো।চোখ খুলে তার চোখের সামনে চারটা ছেলেকে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক চিৎকার করে সোফার এক কোণায় চলে গেলো সে
বুকের ভেতর ধরফর করছে তার।কি করে নিজেকে বাঁচাবে তাই ভাবছে।
অমি আর বাকিরা একটু পিছিয়ে বললো”আমরা তোমার কিছু করবো না।”
.
মেয়েটা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো”আমি কোথায়?”
.
-“আমার বাসায়”
.
-“আপনি কে?আমি এখানে এলাম কি করে?”
.
অমি ব্রু কুঁচকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিজবি বললো”তুমি আমার বন্ধুর প্রোপোজ শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলা।তোমাকে আমরা এখানে নিয়ে আসলাম সেজন্যে”
.
মেয়েটার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।সোফার পাশের সেন্টার টেবিলটার উপরে থাকা পানির জগটা দেখছে শুধু।
অমি তা বুঝতে পেরে বললো,”পানি খেতে পারো”
.
মেয়েটা পানি নিয়ে মুখে দিতে গিয়ে আবার কি মনে করে রেখে দিলো।খেলো না।
এখানে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।না জানি পানিতে কি মিশিয়েছে।
.
-“তোমার সাথে উল্টাপাল্টা করেছে কেউ?নাম বলতে পারো।আমরা তোমায় হেল্প করবো সঠিক বিচার পেতে”
.
মেয়েটার মুখ তুলে তাকালো রিজবির দিকে তারপর বললো”উল্টাপাল্টা বলতে?”
.
অমি ভ্রু কুঁচকে বললো”উল্টাপাল্টা কি জানেন না?সোজা হিসেবে রেপ বলে।যৌন নির্যাতন।আর কিছু শুনবেন??”
.
মেয়েটা রেগে গেলো তারপর চেঁচিয়ে বললো,”আজগুবি কথা বলেন কেন?আমার সাথে এসব কিছুই হয়নি।আন্দাজে কথা বলবেন না একদম”
.
অমি শব্দ করে বসে গেলো চেয়ারে।বাকিরা ওর রাগ দেখে তোয়াক্কা না করে আবারও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো”তো তোমার এই হাল কেন তাহলে?”
.
মেয়েটা জামার হাতা টেনে হাতের দাগ ঢেকে বললো”ঐ আসলে আমার বাবা…..”
.
-“ছিঃ ছিঃ!!তোমার সৎ বাবা এসব করেছে?”
.
-“আশ্চর্য! একটু থামবেন?আমাকে বলতে দিবেন?এরকম গেস করার কোনো দরকার নাই।আমার নিজের বাবা আমায় জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল আর তাই আমি পালিয়ে এসেছি।এবার বুঝেছেন সব?”
.
-“গায়ে বিয়ের শাড়ী কই?”
.
-“আজ গায়ে হলুদ ছিল।”
.
-“তো আপনি যাবেন কোথায় এখন?”
.
অমির প্রশ্নে মেয়েটা বললো,”যেখানে দুচোখ যায় সেখানে যাব তাও ঐ বাড়িতে ফিরে যাব না”
.
অমি চেয়ার থেকে উঠে নিজের রুমে যেতে যেতে বললো”চঞ্চল এই সিনেমার হিরোইনটাকে নিয়ে আমার বাসা থেকে বের হ সবাই।কাল আমার চৌদ্দ গুষ্টি আসবে বাসায়”
.
মেয়েটা সোফা থেকে নেমে বললো”কে হিরোইন?আমার বলা কথা কি আপনার কাছে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট মনে হয়?আজব লোক তো আপনি।কথায় কথায় শুধু অপমান।”
.
টুটুল রিজবির শার্টের কলার টেনে কান টাকে কাছে এনে ফিসফিস করে বললো”চল আমরা কেটে পড়ি”
.
দিদার আর চঞ্চল কেটে পড়েছে ততক্ষণে।টুটুল আর রিজবিও উধাও।মেয়েটা টেবিলের উপর থেকে পানি নিয়ে হাতে ঢেলে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে পানিটা খেলো।এরপর জগটা আবারও টেবিলে রেখে এদিক ওদিক তাকালো সে।ড্রয়িং রুমটা সুন্দর তবে বেশ আগোছালো।সব ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে।
.
-“কিরে গেলি তোরা?
.
অমি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে রুম থেকে এসে দেখলো মেয়েটা চোরের মতন দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায় আর পুরো রুম খালি
.
-“রিজবি?টুটুল?দিদার?চঞ্চল?কই তোরা?”
.
-“উনারা চলে গেছেন”
.
-“তো আপনি এখানে কি করেন?আপনিও যান।টাটা!”
.
মেয়েটা মাথা নিচু করে আরেকটু পানি খেয়ে দরজা খুলে বের হলো বাসা থেকে।অমি দরজা লাগিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে।দু কদম হাঁটতেই সামনে পড়লো একজন বয়স্ক মহিলার।
তিনি ওর হাত খপ করে ধরে বললেন,”ওহ আচ্ছা তাহলে তুমি অমির হবু বউ সিনথিয়া?”
.
মেয়েটা মাথা তুলে বললো,”আমার নাম তো পুতুল।”
.
-“হ্যাঁ?কি বললে?শুনি না কানে আজকাল।ডাক্তার দেখাতে হবে ভালো দেখে।কোনো কানের ডাক্তারের নাম জানো?ভালো নাম করা”
.
পুতুল এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,”আমি আসি”
.
কিন্তু মহিলা হাত ছাড়লেন না।ওকে টেনে ধরে কলিংবেলে চাপ দিলেন।অমি ড্রয়িং রুম ঝাড়ু দিচ্ছিলো সেসময়ে।ঝাড়ু নিয়ে দরজা খুললো সে
উর্মি আন্টিকে দেখে ঝাড়ু ফেলে দিলো।তারপর সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বললো।উর্মি আন্টি সাথে করে পুতুলকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।
অমি পুতুলকে দেখে চমকে তাকিয়ে আছে
চলবে”””””