বাবুই পাখি পর্ব-০২

0
1180

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২
Writer-Afnan Lara
.
-“সিনথিয়াকে দেখলাম চলে যাচ্ছে।তোমার বাবা এসেছিল নাকি?”
.
অমি সোফার কুশনগুলো গুছিয়ে রেখে বললো,”নাহ।বাবা কাল আসবে।একটা কাজে রাঙামাটি গেছে।কিন্তু উনি তো সিনথিয়া….”
.
-“আরে জানি আমি ও সিনথিয়া।লজ্জা পাও কেন?তোমরা আজকালকার যুগের ছেলেমেয়ে।বিয়ের আগে দেখা সাক্ষাৎ একেবারেই স্বাভাবিক।আমি খারাপ দেখছি না।সিনথিয়া তো লজ্জা পেয়ে পালিয়েই যাচ্ছিলো।জোর করে নিয়ে এলাম।একি সিনথিয়া? ওভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো না”
.
উর্মি আন্টি পুতুলের হাত ধরে জোর করে বসিয়ে দিলেন সোফায়।অমি কপাল কুঁচকে বললো,”সিনথিয়া একটু রান্নাঘরে আসবে?আন্টিকে স্যুপ বানিয়ে খাওয়াতাম।আমার হাতের স্যুপ অনেক পছন্দ করেন উনি”
.
পুতুল চোরের মতন উঠে অমির পিছু পিছু গেলো।রান্নাঘর অবধি আসতেই অমি পুতুলের হাতের কুনুই ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,”আপনি সিনথিয়া?জানেন ও কে হয় আমার?”
.
পুতুল মাথা নিচু করে বললো,”আমি বলেছি আমি পুতুল
নই।কিন্তু উনি তো কানে শোনেন কম।বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি।জোর করে ধরে নিয়ে আসলেন আমি কি করবো?”
.
অমি পুতিলরে হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,”যান এখন।”
.
পুতুল মাথাটা নিচু রেখেই দরজা খুলে চলে যেতে নিতেই উর্মি আন্টি ওকে বাধা দিয়ে বললেন উনার পাশে এসে বসতে।পুতুল ঢোক গিলে অমির দিকে তাকালো।অমি মুখটা ফুলিয়ে চুলায় পাতিল বসিয়েছে।পুতুল চুপচাপ আন্টির পাশে এসে বসলো।
.
-“একটা কথা বলি মা শুনো।অমি খুব ভালো একটা ছেলে।আমি যতদূর জানি ও তোমার চোখে জীবনেও অশ্রু আসতে দেবে না।দরকার হলে নিজে বসে বসে কাঁদবে তাও তোমায় কাঁদতে দেবে না।সেই ১২বছর বয়স থেকে ও এখানে থাকে।সেসময় থেকে আমি ওকে চিনি।আমি বাপু বাসায় আমার বুড়োকে নিয়ে থাকি।ও আমাকে নাতিপুতির অভাব বুঝতেই দেয়নি কোনোদিন।দেখো না এখন আমার জন্য স্যুপ বানাচ্ছে।”
.
-“আন্টি আমি সিনথিয়া নই।আপনি ভুল ভাবছেন।”
.
-“হ্যাঁ?কি বললে?তুমি খুব আস্তে কথা বলো।আমি বুঝি না একদম।”
.
-“আচ্ছা আমি আসি আন্টি।ভালো থাকবেন।”
.
পুতুল উঠে দাঁড়াতেই আন্টি আবারও ওকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বললেন,”এরকম যাই যাই করো কেন?তোমার হবু বরের বাসা এটা।এত লজ্জা পেলে চলে?”
.
অমি স্যুপের বাটি এনে আন্টির সামনে রেখে চামচ দিয়ে নেড়ে বললো খেতে।আন্টি স্যুপটা খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,”আমি আজ আসি।সিনথিয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিও।এত রাতে একটা মেয়েকে একা যেতে দিও না।তার উপর সে তোমার দায়িত্ব। বুঝেছো?আমি আসি”
.
আন্টি চলে গেছেন।পুতুল উনি চলে যেতেই সেও বেরিয়ে পড়লো।একটু থেমে পিছনে তাকিয়ে অমিকে দেখলো একবার।অমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।এখনও লাগায়নি।
পুতুল মন খারাপ করে চলে গেলো।রাতের নির্জন রাস্তায় নেমে আগের মতন হাঁটা ধরেছে সে।কিছুদূর এসে দুটো ছেলেকে দেখে গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়লো সে।একজন তার বড় ভাইয়া আসাদ আর আরেকজন হলো যার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সাইমন।গাছটা ধরে ভয়ে কাঁপছে পুতুল।আজ ধরা খেলে বিয়েটা হয়েই ছাড়বে।ওরা দুজন হাঁটার গতি বাড়িয়ে এদিকেই আসছে।পুতুল এদিকে এসেছে আন্দাজ করে ওরাও এখান অবধি পৌঁছে গেলো।
গাছটার পাশেই ল্যাম্পপোস্ট একটা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।গাছের কাছাকাছি এসে তাকালেই পুতুলকে ঠিক চেনা যাবে।ভয়ে শেষ পুতুল।কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।ওরা খুব কাছে এসে গেছে।গাছটার কাছাকাছি আসতেই যেই না সেদিকে তাকাবে অমি এসে পুতুলের পাশে দেয়ালের উপর হাত রেখে ওকে ঢেকে ফেললো।
আসাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,”রাত বিরাতে এসব করো ঠিক আছে।কিন্তু পাবলিক প্লেসে করো কেন?”
.
অমি ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো,”ভাই আপনার সমস্যা? ”
.
-“না সমস্যা না।চলো সাইমন।ওদিকে দেখি”
.
পুতুল মুখে হাত দিয়ে চুপ করে আছে।ওরা চলে যেতেই অমি সোজা হয়ে দাঁড়ালো দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে।পুতুল চোখ মুছে বললো,”ধন্যবাদ।আপনি হেল্প না করলে এখনই ধরা খেতাম”
.
-“ইটস ওকে।”
.
পুতুল ওড়না দিয়ে গা ঢেকে আবারও ছুটলো।অমি ওর পিছু কিছুদূর এসে বললো,”বান্ধুবীর বাসা নেই?”
.
পুতুল থেমে মাথা ঘুরিয়ে বললো,”একজনের আছে।আজ তার বাসায় মেহমান এসেছে।আমার জায়গা নেই।তবে দুই তিনদিন পর হবে”
.
অমি থুতনির নিচে হাত রেখে কিসব ভাবলো তারপর বললো,”আচ্ছা চলুন আমার সঙ্গে।”
.
-“কোথায়?”
.
-“আমার একটা মেয়ে ফ্রেন্ড আছে।ও ফ্ল্যাটে থাকে ওর বোনের সাথে।আপনি ওর বাসায় থাকতে পারেন আমার সুপারিশে।তবে ঠিক তিন চারদিন।ও কিপটে।বেশি রাখবে না।তারপর আপনি আপনার বান্ধুবীর বাসায় গিয়ে থাকবেন”
.
পুতুল মাথা নাড়ালো।অমি পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা রিকশা থামালো।পুতুল ওর পিছু পিছু ওকে ফলো করছে।অমি রিকশায় উঠে বসে বললো”হ্যাঁ রিতু আমি তোর বাসায় আসছি।ফ্রি আছিস?”
.
পুতুল চোরের মতন উঠে বসলো অমির পাশে।অমি রিতুর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।দশ পনেরো মিনিট বাদে একটা চার তলা দালানের সামনে এসে রিকশা থামলো।অমি রিকশা থেকে নেমে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিতে দিতে বললো,”হাঁটা ধরেন।আমি আসছি”
.
টাকা দিয়ে সে ও চললো।নিচ তলায় থাকে রিতু তার বোনকে নিয়ে।কলিংবেল বাজতেই রিতুর বড় বোন তন্নি এসে দরজা খুলে অমিকে দেখে দাঁত কেলিয়ে বললো,”কি হ্যান্ডসাম??নিজে হেঁটে তন্নির কাছে ধরা দিলে!
মতলব কি?”
.
অমি হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বললো,”এরে কদিন রাখবা!
প্যাম্পার করবা।তাহলে অমি তোমাকে নিয়ে এক কাপ কফি খেতে রেস্টুরেন্ট যাবে।বাই দ্যা ওয়ে রিতু কই?”
.
-“সে ওয়াসরুমে।আচ্ছা ও কে?”
.
-“ও হচ্ছে।আচ্ছা আপনার নাম কি?”
.
-“পুতুল চৌধুরী”
.
-“নাম ও জানো না।আজিব তো।কই পেলে এরে?”
.
-“সেসব রিতুকে মেসেজ করে দেবো।এরে রাখো।যত্ন করবা ভালোমতন বুঝলে?নাহলে কফির বদলে মিনারেল ওয়াটার এক বোতল ধরিয়ে দেবো”
.
তন্নি দাঁত কেলিয়ে অমিকে ধরতে যেতেই অমি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো।পুতুল অমির চলে যাওয়া দেখছে।রিতু এসে বললো,”ও আমাদের সাথে থাকবে কলে অমি বললো।চলে গেছে নাকি?”
.
-“হ্যাঁ গেছে।কোথাও দু মিনিট থাকার ছেলে নাকি সে?আসো ভেতরে আসো পুতুল ম্যাডাম।”
.
অমি রিকশা আরেকটা নিয়ে বাসায় ফিরেছে।দরজা লাগিয়ে নিজের রুমে ঢুকে লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।আধঘন্টা পর ওর ফোনে একটা কল আসলো।রিতুর নাম্বার থেকে কল।ঘুম ঘুম চোখে অমি রিসিভ করলো কলটা।ওপাশ থেকে একজন বললো,”প্লিজ আমি এখানে থাকতে চাই না।”
.
অমি লাফ দিয়ে উঠে বসে বললো,”কে?”
.
-“আমি পুতুল”
.
-“রিতুর নাম্বার না এটা?কি হয়েছে তোমার?”
.
-“আপনি প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান।
আমি যেখানে চোখ যায় চলে যাব।কিন্তু এখানে থাকতে পারবো না”
.
-“কেন কি হয়েছে?কিছু বলবা তো।হ্যালো?”
.
কল কাটা গেলো।গভীর ঘুম ভেঙ্গে এরকম সংবাদ শুনে অবাক হয়ে বসে আছে অমি।নিজের মাথার চুল টেনে রুমের লাইট জ্বালালো সে।রাত দেড়টা বাজে তখন।”এসময়ে রিকশা পাবো তো?আর কি সমস্যায় পড়লো সেটাও তো বললো না।রিতু ও তো বলেনি কিছু।”
.
টিশার্টটা খুঁজে পরে নিয়ে দরজা লক করে বের হয়ে গেলো অমি।রিকশা পাচ্ছে না বলে হেঁটেই চললো।রিতুদের বাসা বেশি দূরে না আবার কাছেও না।তিনটে গলি ক্রস করতে হয়।
বিশ মিনিট হেঁটে রিতুদের বাসা পর্যন্ত এসে পৌঁছালো অমি।কলিংবেলে দশবার ক্লিক করার পর তন্নি এসে দরজা খুলেছে।বাসার অবস্থা দেখে অমির চোখ কপালে।ভেতরে শুধু রিতু আর তন্নি না বরং ছেলে আর মেয়ে সহ আরও দশ পনেরো জন
মানুষে গিজগিজ করছে।সবাই হেলেদুলে গানের সাথে নেচে যাচ্ছে কেউ কেউ সোফায় মরার মতন পড়ে ঘুমাচ্ছে তন্নি অমির হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে কাছে এনে বললো,”সঠিক সময়ে এসেছো।লেটস্ ডান্স।”
.
অমি তন্নির হাত ছাড়িয়ে পুতুলকে খুঁজতে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বেডরুমের দিকে গেলো।একটা রুমের দরজা বন্ধ।অমি সেই রুমের দরজা ধাক্কাতেই ওপাশ থেকে পুতুল বললো,”খবরদার!আমি দরজা খুলবো না।মরে গেলেও না।দূরে থাকুন নাহলে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিব বলে দিলাম”
.
-“আমি এসেছি”
.
অমির গলার আওয়াজ শুনে পুতুল সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিলো।ওর চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে আছে।কেঁদে দিয়ে বললো,”এরা সবাই খারাপ।আমি এখানে থাকবো না”
.
অমি মাথা নিচু করে পুতুলের হাত দরে বেরিয়ে আসলো ঐ বাসা থেকে।ফাঁকা নির্জন রোড দিয়ে দুজনে হেঁটে চলেছে।
পুতুল চোখ মুছতে মুছতে বললো,”অনেক কষ্টে রিতু আপুর ফোনটা পেলাম।সেটা থেকে আপনার নাম সার্চ করে নাম্বারে কল দিলাম।এতগুলো ছেলে বাসায়!!!আমাকে টাচ করার চেষ্টা করেছিল একজন।পরে আমি রুমের দরজা লক করে বসে ছিলাম।আর একটু দেরি হলে না জানি কি হতো”
.
অমি পুতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,”রিতুর বারান্দায় গ্রিল আছে।ঝাঁপ দেওয়ার ভয় দেখিয়েছিলে কেন?গ্রিলের ভেতর ঝাঁপ দিতে কোথায়?তাছাড়া বাসা নিচতলায়
ঝাঁপ দিলেও তো মরতে না”
.
-“ভয়ের চোটে আরেকজনকে ভয় দেখিয়েছি।কি বলেছি নিজেও জানি না”
.
-“ওরা যে এমন আজ জানলাম।এতদিন ভাবতাম এমনি এমনি ফ্লার্ট করে।বাট আজ এসব দেখে বুঝলাম ওদের স্বভাবই এরকম”
.
-“আপনি আমায় অনেক হেল্প করেছেন।কি করে ধন্যবাদ দেবো জানি না।আপনি বাসায় ফিরে যান।আমি দেখি আমার ঐ বান্ধুবীর বাসায় যাব”
.
-“আমার বাসায় ছয়টা রুম।একটাতে আপনার জায়গা হয়ে যাবে।এতরাতে একটা মেয়েকে একা ছাড়া কেমন ভুল তা বুঝতে পেরেছি আমি।আগে ছেড়েও ভুল করেছিলাম।একটুর জন্য ধরা খেতেন।আমার সাথে চলুন”
.
-“কিন্তু!”
.
-“আমি আপনাকে টাচ করবো না।”
.
-“না সেটা নয়।আজকে দেরি হয়ে গেছে।কাল সকাল সকাল চলে যাব”
.
-“আপনার বান্ধুবীর বাসার মেহমান যাওয়া অবধি থাকতে পারেন।সমস্যা নেই”
.
-“আপনার নাকি কাল চৌদ্দ গুষ্টি আসবে বাসায়?তারা আমায় দেখলে?”
.
-“বাবা ফোন করেছিল।দেরি করে আসবে”
.
-“আপনার মা?ভাই বোন তারা কোথায়?”
.
-“বাসা এসে গেছে।চলুন যাই।ঘুম আসে।কাল কত কাজ”
.
পুতুল তার প্রশ্নের জবাব না পেয়ে পিছু পিছু গেলো।অমি তাকে গেস্ট রুম দেখিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেছে।
খিধায় পেটে ডাক দিচ্ছে পুতুলের।সন্ধ্যায় খিচুড়ি খেয়েছিল সে মায়ের হাতে।এরপর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি তার।অন্ধকারে রান্নাঘরে এসে ফ্রিজ খুলে একটা আপেল নিয়ে চলে আসলো রুমে।এক কোণায় বসে আপেলটা খাচ্ছে সে।অমি তাকে যে রুমে থাকতে দিয়েছে সেই রুমটায় একটা খাট ছাড়া আর কিছু নেই।একেবারে কিচ্ছু না।আপেল খেয়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো পুতুল।মা বাবার কথা মনে পড়ছে খুব।
-“তারা আমায় জোর না করলে আজ আমি এখানে থাকতাম না।”
চলবে”””