বিকেলের শেষ আলো পর্ব-০৬

0
304

#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_৬

গোপনে বিমোহিত হয়ে আমি তার কথা শুনে গেলাম আর তিনিও বলে গেলেন‚ ”তবে বাকি আধা ঘন্টা কিন্তু আমি আমার বউকে বউয়ের মতো দেখতে চাই; একদম মিষ্টি একটা বউ। যার মুখ জুড়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্রতা ছড়িয়ে দিবেন। আমি মুগ্ধ হবো আর তাঁর শুকরিয়া আদায় করবো।” একটু থেমে তিনি আমাকে ডাকলেন‚ “মিষ্টি?” এদকম অন্যরকম স্বরে ডাকলেন। আমি ঈষৎ চমকে উঠে তাকালাম; জবাব দিলাম না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ “শুধু চুপ করেই থাকবে? কিছু বলবে না?”

চোখ নামিয়ে আমি ‘না’ বোধক মাথা নেড়ে বুঝালাম আমার কিছু বলার নেই। তিনি হালকা শব্দে উঠে বললেন‚ ”কিচ্ছু বলার নেই! কিন্তু সারারাত তো অনেক কিছু ভাবলে। তুমি স্বীকার না করলেও সেই কথা আমি জানি। এখন সেই ভাবনা থেকেই বলা না গো। তোমার সাথে আজ সারাদিন কথা বলবো আর শুনবো বলেই তো বাড়ি থেকে এক পা-ও নড়বো না।”

“নড়বেন না মানে? সারাদিন এভাবে বসে থাকবেন নাকি?” তার কথা শুনে আমি এত অবাক হলাম যে ফটফট করে এসব প্রশ্ন করে বসলাম। আর তিনিও আমার প্রশ্ন শুনে সরু চোখে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন‚ “কেন? বসে থাকলে তোমার সমস্যা আছে নাকি?”

একটু দমে গিয়ে আমি জবাব দিলাম‚ “একেবারেই যে সমস্যা নেই তা তো নয়। কিন্তু……….”

“কিন্তু কী?”

“আমার ছেলেমানুষী কথা ছাড়ুন। কাজের কথা বলুন।”

“ছাড়লাম। কিন্তু এমন ভোরবেলা কীসের কাজ?” কেমন বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করলেন। আমি কপালে কুঞ্চন সৃষ্টি করে বললাম‚ “হেয়ালি করার মোডে আছেন দেখছি।”

তিনি মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলেন‚ “না না না………. হেয়ালির মোডে একদমই নেই। আমি এখন গোছানো মোডে আছি।”

“গোছানোর মোডে মানে?” একটু বিস্মিত হলাম।

“ব্যাগপত্তর যা গোছানোর আছে গুছিয়ে নাও।” হঠাৎ ব্যাগপত্র গোছানোর কথা কেন বললো বুঝতে পারছি না। আমি আন্দাজে কথার ঢিল ছুঁড়ে দিলাম‚ “আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন বুঝি? একদিনেই সংসার করার সাধ মিটে গেছে!”

আলতো হাতে আমার নাক টেনে বললেন‚ “মিষ্টি মিষ্টি বউয়ের মন মাতানো রাগ কোন অধম দেখতে চাইবে না বলো?”

“বুঝলাম না।”

“বললাম‚ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলে কি মিষ্টির মিষ্টি রাগ দেখতে পারবো?”

“আজব! তাহলে ব্যাগ গোছাতে বলছেন কেন?” জবাব না দিয়ে তিনিও উঠলেন আর এতক্ষণ ধরে রাখা আমার হাত জোড়া টেনে আমাকেও তুললেন। এরপর ধীরেসুস্থে বললেন‚ “বিছানায় গিয়ে বসো। মেঝেতে বসে থাকলে ঠান্ডা লাগতে পারে। আল্লাহ তাআলা মাফ করুক।”

আমি নিঃশব্দে বিছানার ওপর হাঁটু মুড়ে বসলাম। তিনি জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে আমার সম্মুখে এসে বসলেন। আর বসেই আবার আমার হাত দু’খানা বুকে আগলে নিলে। বলা নেই কওয়া নেই এমন হুটহাট হাত নিজের দখলে নিয়ে নিচ্ছে। এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম‚ “আপনি কি হাত না ধরে কথা বলতে পারেন না?” আমার গলার স্বর যতটা রূঢ় শোনালো তারচেয়ে বেশি মিষ্টি করে হেসে তিনি বললেন‚ “আল্লাহ তাআলা দুই হাত দিয়েছেন ভালো জিনিস আঁকড়ে ধরতে। এখন চোখের সামনে নিজের বউয়ের হাত ছাড়া তো ভালো জিনিস নেই। তাই আর কি………. থাকলে তোমার হাত ভুলেও ধরতাম না।” শেষের কথা খুব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন। কিন্তু আমি বুঝলাম এই তাচ্ছিল্য মিথ্যা।

“যাক গে‚ শোনো। কালকে আমরা সিলেট যাবো। সকাল দশটায় ফ্লাইট।” তার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম‚ “প্লেনে করে সিলেট যাবো! তাও একেবারে কালকেই?” আমাকে অতিমাত্রায় অবাক হতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন‚ “যা বলি তাতেই এত অবাক হও কেন? আল্লাহ তাআলা তোমাকে অবাক হওয়ার ক্ষমতা মনে হয় অনেক বেশিই দিয়েছেন।”

“আর আপনাকে বিভিন্ন রূপ ধরার ক্ষমতা দিয়েছেন।” বলেই মুখ ঝামটা মেরে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে ভাবলাম‚ “নাউজুবিল্লাহ! আমার মধ্যে টিপিক্যাল বউদের আচরণ কেন ভাসছে?” আমার ভাবনার মাঝে তিনি আমার দুই হাত টেনে টেনে সামনে পিছনে মৃদু ঝাঁকালেন। এরপর বললেন‚ “তুমি এত বেশি কথা বলো! কালকে রাত থেকে তোমার সাথে জরুরি কথা বলতে নিলেই তুমি আজেবাজে জিনিসে টেনে কত-শত কথা বলো। অ্যাই মিষ্টি‚ এত কথা কোথায় জমিয়ে রাখো গো?”

আমি বাঁকা চোখে তাকালাম। তিনি হাসি মাখা মুখে বললেন‚ “এভাবে তাকিয়ো না বউ। এমনিতেই বয়সে বড়ো তুমি। মা*রধ*র না আবার শুরু করো সেই ভয়ে আমার প্রাণ যায় যায়। এভাবে তাকিয়ে বুকের কাঁপুনি আর বাড়িয়ে দিয়ো না। ভেবেছিলাম তোমাকে শাসনে শাসনে হৃদয়ে বন্দী করে রাখবো ইন শা আল্লাহ। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যা দেখাচ্ছেন দুই দিন ধরে তাতে মনে হচ্ছে তুমিই আমাকে শিকল পরিয়ে রাখবে গো।”

“নিজে এত কথা বলতে পারেন আর আমাকে বাচাল বলেন? ক্লাসে তো ভদ্দরনোকের মতো মুখে তালা দিয়ে বসে থাকতেন অথচ এখন! বাব্বা যেন মাটির হাঁড়িতে খই ভাজা হচ্ছে। ফটফট করে কত কথা বলে চলেছেন।” আমি সুযোগ পেয়ে তাকে একগাদা কথা শুনিয়ে দিলাম। একতরফা তিনিই শুধু আমাকে খোঁচা মেরে কথা বলবেন আর আমি শুধু হজম করবো তা আবার হয় নাকি?

“কিন্তু ফটফট করেও তো শুধু অকাজের কথাই বলছি।”

“তো বলুন না বাবা। কে আপনাকে মানা করছে?”

“অ্যাই‚ আমি তোমার বাবা।” তিনি ধমকে উঠলেন।

“জানি। এবার কাজের কথা বলুন নয়তো হাত ছাড়ুন। কালকে থেকে এই এক ঘরে বসে থেকে আমার দম আটকে আসছে।”

“আচ্ছা বলছি। কিন্তু খবরদার অন্য প্রসঙ্গ টানবে না।” আমি জবাব দিলাম না। তিনিও অপেক্ষা করলেন না। বলে গেলেন‚ “বিয়ের আগেই টিকিট কে*টে রেখেছিলাম। আমরা এক সপ্তাহের জন্য সিলেটে যাবো। শুধু মাকে বলেছি। বউ নিয়ে ঘুরতে যাওয়াও পুণ্যের কাজ মিষ্টি। আর আমি কোনোকিছু ঢাকঢোল পিটিয়ে করি না। আল্লাহ তাআলার দেওয়া নেয়ামত গোপনেই আস্বাদন করতে চাই ইন শা আল্লাহ। কালকে সকালে নাস্তা খেয়েই ইন শা আল্লাহ বেরিয়ে যাবো। তুমি আর আমিই শুধু যাবো।”

“মা বাড়িতে একা থাকবেন?” কথাটা জিজ্ঞেস না করে পারছিলাম না। কী জানি কেন তবে হঠাৎ করে শ্বাশুড়ি মায়ের জব্য চিন্তা হলো।

তিনি ভ্রু ভঙ্গ করে আমার দিকে তাকালেন। বুঝাই যাচ্ছে কথায় বাঁধা পেয়ে বিরক্ত হয়েছেন। তার এমন চাহনি দেখে ভয়ই হচ্ছে। না জানি আবার ধ*মক দিয়ে উঠেন। আমি শুকনো ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে নিলাম। কিন্তু হায় আল্লাহ! এই লোক আমাকে ধ*মক না দিয়ে আলতো করে নাক টেনে বললেন‚ “বউ গো বউ তুমি আমাকে মনে হয় না কোনোদিন ঠিকমতো কথা বলতে দিবে। খালি কথার মাঝে বাঁধা দিচ্ছো। দেখা যাবে‚ মরণ উপস্থিত হলে সেখানেও……….” তার মুখে এমন কথা শুনে আমার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠলো। থামিয়ে দিয়ে ব্যাকুল হয়ে বললাম‚ “আল্লাহর ওয়াস্তে এসব কথা কখনো বলবেন না। হায়াত-মউত সব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার হাতে। কিন্তু আমি মনে মনে অনেক চাই‚ আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলো অনেক বছর বাঁচুক অন্তত আমার আগে যেন তিনি তাদের তুলে না নেন।”

“অ্যাই মিষ্টি‚ মন খারাপ করলে? বউয়ের সাথে মজা করা যায় গো। মন খারাপ করো না। মৃত্যু যারই আগে হোক; মহান আল্লাহ তাআলা যেভাবে সাজিয়ে রেখেছেন। তবে আমি তাঁর দরবারে রোজ ফরিয়াদ করছি যেন জান্নাতে সংসার করতে না হলেও অন্তত ঝ*গড়া করার জন্য যেন তিনি আমাদের একসাথে রাখেন। কিন্তু এক মিনিট……….” মনে হয় হঠাৎ করে তার কিছু মনে পড়লো। কী যেন ভেবে তিনি বললেন‚ “তোমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ! কিন্তু তুমি তো আমাকে স্বামী হিসাবে স্বীকার করছো না তাহলে গুরুত্বপূর্ণ কীভাবে হলাম?”

………. চলবে ইন শা আল্লাহ