বিবাহ অভিযান পর্ব-০২

0
161

#বিবাহ_অভিযান (২)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

সমুদ্র ডেস্কে বসে কাজ করছিল পাশ থেকে এক কলিগ বলল,
– “কি ভাই আজ সকাল থেকে খুশি-খুশি লাগছে কেন?”

সমুদ্র সত্যিটা বলতে গিয়েও চেপে গেল। এদের কাছে বলা মানে নিজে যেচে অপমানিত হওয়া, তাই চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে‌ করল। সমুদ্র স্বাভাবিক ভাবে বলল,
– “এমনিতেই ভাই। কেন হাসি-খুশি থাকতে পারি না নাকি?”

সমুদ্রে’র কলিগ মুখটা বাঁকিয়ে বলল,
– “না আমি তো জানতাম বিবাহিত মানুষ’রা সকাল সকাল হাসি-খুশি থাকা মানে রাত’টা খুব ভালো কেটেছে কিংবা আসার সময়ে বউয়ের কাছ থেকে আদর খেয়ে এসেছে। অবিবাহিত মানুষদের তো সেই সুযোগ নেয়, তাই খুশি থাকার কারন জানতে চাইলাম।”

কলিগের কথা শুনে সমুদ্রে’র বিষম লেগে যায়। মানুষ এতটা নির্লজ্জ কিভাবে হয়! একটা মানুষ’কে অপমান করার জন্য এইগুলো কেউ বলে!

– “আরে ভাই বিষম খেয়ে গেলেন যে! যদিও সত্যি’টা সবার সহ্য হয় না।”

সমুদ্রে’র বিরক্তির মাত্রা বাড়তে লাগল, এদের ব্যবহার দিনকে দিন লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কলিগ ছেলেটা সমুদ্রে’র পিঠ চাপড়ে বলল,
– “বলি কি ভাই এইবার বিয়ে করে নাও। দেখবে সবকিছু রঙিন লাগবে।”

সমুদ্র ভদ্রতার খাতিরে মেকি হাসি দিল। ছেলেটাও হেসে নিজের ডেস্কে গিয়ে সমুদ্রে’র দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
– “একবার বিয়ে করো তারপর বুঝবে কি মজা। তোমাকে হাসিখুশি দেখলে আমার বড্ড জ্বলে, তুমি আমার সিনিয়র হয়েও এখনো অবিবাহিত আর আমি জুনিয়র হয়ে বিবাহিত। বিবাহিত জীবনে প্রতিদিন জ্বলছি আর তুমি সিঙ্গেল লাইফে এনজয় করবে! এইটা তো মেনে নেওয়া যায় না।”

সর্বনাশ! কি ভয়ানক প্ল্যান। নিজে বিবাহিত জীবনে জ্বলছে বলে সমুদ্র’কে সিঙ্গেল থাকতে দেবে না। লাইক সিরিয়াসলি!

ওইদিকে সমুদ্র মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
– “আর মাত্র কয়েকদিন তারপর আর আমাকে বিয়ে নিয়ে অপমান করতে পারবে না।”

সমুদ্র বিয়ে করা নিয়ে খুব খুশি। অথচ ওহ জানে না ওকে নিয়ে কি মারাত্মক প্ল্যান করা হচ্ছে।বিয়ের কি জ্বালা সেটা যে করেছে একমাত্র সেই ভালো জানে।

মাঝে কয়েকদিন কেটে যায়। আজ সমুদ্রে’র‌ জন্য পাত্রী দেখতে যাবার কথা। সমুদ্র তো প্রচন্ড এক্সটাইটেড, জীবনে প্রথমবারের মতো পাত্রী দেখতে যাচ্ছে এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে!

পাত্রী সমুদ্রের মায়ের পছন্দ করা মেয়েটি নয়, অন্য একজন।‌সেই মেয়েটার বাড়িতে কথা বলার সময়ে জানা যায় মেয়েটির বিয়ে অনত্র ঠিক হয়ে গেছে কিছুদিন আগেই। সমুদ্রে’র মনটা ভেঙে যায়, মেয়েটা’কে ওর কাছে মন্দ লাগেনি তারউপর এতদিনে বিয়ের জন্য রাজি হওয়া মায়ের প্রথম পছন্দ ছিল মেয়েটা। একটু কষ্ট তো‌ লাগবেই। সমুদ্রে’র মা ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছিলেন,
– “বাবু মনখারাপ করিস না। দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে নাকি? আরো কত ভালো মেয়ে আছে।”
– “হু।”

তারপর আর কি! ঘটক’কে আবার আনা হয়, পাত্রী পছন্দ করা হয় এবং তাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠানো হয় আর ফাইনালি আজ দেখতে যাবার কথা,

সমুদ্র রেডি হয়ে বারবার আয়নার সামনে গিয়ে দেখছে সবকিছু ঠিক আছে কিনা।

– “কি বাবু তোর হলো! তাড়াতাড়ি আয়।”

মায়ের ডাক শুনে সমুদ্র লাস্ট বারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে বসার ঘরে উপস্থিত হলো। সমুদ্রে’র মা ছেলেকে দেখে বললেন,
– “বাহ্ আমার ছেলেকে পুরোই রাজপুত্র লাগছে। পাত্রীপক্ষের এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যাবে।”

সমুদ্রের বাবা পাশ থেকে ফোঁড়ন কেটে বললেন,
– “আগে থেকে ভবিষ্যত বানী করো নাহ পরে হতাশ হতে পারো।”

সমুদ্রের মা ক্ষেপে গেলেন, স্বামীর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললেন,
– “তোমার মুখে খালি অলুক্ষণে কথা। বলি একটু ভালো করে কথা বলতে পারো না?”
– “সত্যি বললাম। পরে কিছু হলে আমার দোষ দেবে না।”

সমুদ্রের মা রেগেমেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই সমূদ্র মাকে থামিয়ে দিল। এখন যুদ্ধ শুরু হলে পাত্রী দেখা লাটে উঠতে বেশি সময় লাগবে না।

– “মা বাবা দেরি হচ্ছে চলো এইবার।”

স্বামীর রাগটা এইবার ছেলের উপর গিয়ে পড়ল। সমুদ্রে’র মা রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,
– “বাপ ঝগড়ার করার জন্য মুখিয়ে আছে। আর ছেলে বিয়ে করার জন্য একেবারে পাগল হয়ে যাচ্ছে, আমার ফাটা কপাল কেউ আমাকে বোঝে না।”

সমুদ্র মুখটা কাঁচুমাচু করে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “মা শান্ত হও। তোমার যদি ইচ্ছা না থাকে তাহলে থাক আজ আমরা পাত্রী দেখতে না যাই।”

সমুদ্রে’র মা কিছুটা শান্ত হলেন, গম্ভীর গলায় বলল,
– “চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

সমুদ্রে’র মুখে হাসি ফুটে উঠল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “লাভ ইউ মা।”
– “থাক এত ভালোবাসা দেখাতে হবে না। চলো।”

সমুদ্রে’র বাবা মা ছেলের ভালোবাসা দেখে মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
– “আমে-দুধে মিশে গেল আর আমি আঁটি মাটিতে পড়ে রইলাম। হায় রে, কেউ আমাকে ভালোবাসে না।”

স্বামীর নাটকীয় কথা শুনে সমুদ্রে’র মা আর রাগ করে থাকতে পারেন না, মুচকি হাসলেন। সেইটা দেখে বাবা -ছেলের মুখে হাসির রেশ দেখা গেল। সম্পর্কগুলো তো এইরকম হওয়া উচিত, হাজার ঝগড়া, মান-অভিমানের পরেও মানিয়ে নিয়ে কাছে টেনে নেওয়া।

সমুদ্র ও ওর বাবা মা পাত্রীর বাড়িতে বসে আছে। পাত্রীর বাবা’র সাথে টুকটাক কথা বলছে। মেয়ের বাবা তো নিজের মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

– “আমার নিজের মেয়ে বলে বলছি না, আমার মেয়ে খুবই লক্ষী। ঘরে-বাইরে উভয় দিকেই সমানভাবে পারদর্শী, ওর মতো মেয়ে আমাদের সারা এলাকায় একটাও পাবেন না।”

পাত্রীর বাবার কথা শুধে সমুদ্রের মা মনে মনে বললেন,
– “অতি ভক্তি চোরের লক্ষন। মেয়ের এত নাম করছে, আমার কিরকম একটা সন্দেহ হচ্ছে।”

অন্যদিকে সমূদ্র পাত্রীর গুনগান শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। ওর ভাবতেই অবাক লাগছে এতটা গুনী, ভালো মেয়ের সাথে ওর বিয়ের কথা চলছে।

সমুদ্রে’র মা অতি গুনগান সহ্য করতে না পেরে বলল,
– “ভাই এইবার মেয়ে’কে নিয়ে আসুন। অনেকক্ষন তো হলো।”
– “হ্যাঁ। এই রিতা’কে নিয়ে আয়।”

কিছুক্ষনের মধ্যেই, গোলাপী শাড়ি পড়া একটা মেয়ে সমুদ্রে’র সামনের সোফায় এসে‌ বসল। সমুদ্র উৎসুক হয়ে সামনে তাকিয়ে চোখ’টা নামিয়ে নিল। কিন্তু সমুদ্রে’র মা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরখ করছেন। ছবি’তে মেয়েটা’কে যতটা সুন্দর লাগছিল সামনে থেকে ততটা সুন্দর লাগছে না। উনি প্রশ্ন করলেন,
– “তোমার নাম কি মা?”
– “রিতা।”
– “পড়াশোনা কতদূর করেছো?”
– “এম.এসসি ১ইয়ার রানিং।”
– “বাহ্। কোন সাবজেক্টে?”
– “কেমিস্ট্রি।”
– “তা মা সংসারের কাজ পারো?”
– “হ্যাঁ মোটামুটি পারি।”

পাশ থেকে রিতা’র মা বললেন,
– “বোন কি আর বলব আমার মেয়ে তো ঘরের সব কাজ করে। বাড়িতে থাকলে আমাকে একটাও কাজ করতে দেয় না।খুব লক্ষী মেয়ে আমার।”

সমুদ্রে’র মা বিরক্ত হয়ে বললেন,
– “বোন যাকে প্রশ্ন করছি সেই না হয় উত্তর গুলো দিক!”

সমুদ্রে’র মায়ের কথা শুনে রিতা’র মায়ের মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে যায়। উনি নিজের স্বামীর দিকে তাকাতে উনি চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললেন।

সমুদ্রে’র মা রিতা’কে আরো কিছু প্রশ্ন করল। তারপর বললেন,
– “আমার মতে ছেলে-মেয়ে’কে একটু আলাদা কথা বলতে দেওয়া উচিত। আপনারা কি বলেন?”

রিতা’র বাবা-মা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললেন,
– “ঠিক আছে। রিতা ওকে নিয়ে ছাদ থেকে ঘুরে আসো তো।”

রিতা মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। সমুদ্রে’র মা ওকে ইশারা করে যেতে বলল। মায়ের কথা মতো সমুদ্র উঠে রিতার পেছন পেছন ছাদে যায়।

রিতা রেলিংয়ের ধার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র কথা বলার জন্য উশখুশ করছে কিন্তু কি দিয়ে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। জীবনে কখনো মেয়েদের সাথে কথা না বলার ফলাফল এইটাই।

অনেক কষ্টে অস্বস্তি কাটিয়ে সমুদ্র ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করল,
– “ভালো আছেন?”

ওর কথা শুনে রিতা করুন কন্ঠে বলল,
– “ভালো আর থাকতে দিলেন কোথায়।”

রিতা’র বাঁকা কথা সমুদ্র ঠিক বুঝল না। তাই জিজ্ঞেস করল,
– “মানে?”

#চলবে….