বিষাদের শহরে তুমি এলে পর্ব-০৪

0
197

#বিষাদের_শহরে_তুমি_এলে
#পর্ব_০৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সবুজ অরণ্যে ঘেরা চারপাশের পরিবেশ। চারদিকে নিরবতা জোট বেঁধে বিরাজ করছে। এ যেনো ইফাদের মনের কথা আগে থেকে জেনেছিল। তার আসার পূর্বাভাস পেয়ে, নিজ থেকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। সবাই মিলে যত গভীরে যাচ্ছে। নিরবতা ততই গভীর হচ্ছে, শান্তিতে কাটানোর মতো সুন্দর একটা পরিবেশ। ইফাদ চারপাশটা মুগ্ধ হয়ে, পর্যবেক্ষণ করছিল। এমন সময় শুভ্র শার্ট পড়া, শ্যাম বর্নের পুরুষটাকে কেউ একজন ক্যামেরা বন্ধী করে নিল। ক্যামেরার আড়ালে থাকা মানুষটি ইফাদের চোখ এড়ালো না। রাগান্বিত হয়ে, ক্যামেরা হাতে থাকা, মানুষটির দিকে অগ্রসর হলো। আচমকা ক্যামেরার সামনে, একজন মানুষ চলে আসায় চমকে উঠে, ক্যামেরা হাতে থাকা মেয়েটি। দ্রুত ক্যামেরা চোখ থেকে সরায়। মানুষটাকে এগিয়ে আসতে দেখে, মেয়েটির হৃদস্পন্দনের গতিতে বেগ দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে। মেয়েটি দ্রুত গতিতে পালিয়ে যাবে। এমন সময় কারো গম্ভীর কণ্ঠ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছালো। থমকে গেল দু’টি পা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। তার বান্ধবী গুলো কেউ আছে নাকি। আশেপাশে তাকিয়ে, কেউ নজরে আসলো না। মেয়েটি একটু ভয় পেল। তবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল।

–এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না! তুমি আমার অনুমতি ব্যতীত আমার ছবি তুললে, ছবি তোলার আগে, আমার থেকে অনুমতি নিয়েছিলে?

–আমি কোথায় আপনার ছবি তুললাম? আপনি আমার ক্যামেরার সামনে চলে এসেছেন। আপনি যদি আমার ক্যামেরার সামনে না আসতেন? তাহলে আপনার ছবি আমার ক্যামেরায় উঠতো। মেয়ে মানুষ দেখলেই, ভাব নেওয়া শুরু হয়ে যায় তাই না। সুন্দরী রমণীর কথায় ফুঁসে উঠলো ইফাদ। রমণীর দিকে, দু’কদম এগিয়ে গিয়ে, মেয়েটির হাত থেকে, ক্যামেরাটি কেঁড়ে নিয়ে, গাছের সাথে বারি মেয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল ক্যামেরাটি। কেঁপে উঠলো রমণীর হৃদয়। শিরা-উপশিরায় ক্রোধ জাগ্রত হলো। নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে, বলিষ্ঠ দেহের পুরুষের গালে, কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। নিজের রাগ কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। ক্রোধে চক্ষুদ্বয় জোড়া অশ্রুতে ভিজে এসেছে। সামান্য একটা মেয়ের হাতে প্রহার খেয়ে, রক্তিম চোখে তাকালো ইফাদ। তখনই পাশে থেকে কেউ একজন বলে উঠলো।

–কি রে তানহা তোর ছবি তোলা হলো? দেখ অনেক সময় হয়ে গিয়েছে। এবার বাসায় ফিরতে হবে। বাসায় যদি জানে, কলেজে ফাঁকি দিয়ে, আমরা ছবি তুলতে এসেছি। তাহলে আজকেই আমাদের শেষ দিন হবে। কথা গুলো বলতে বলতে আরো তিনজন রমণী এসে দাঁড়ালো তানহার পাশে, তানহার ক্যামেরা টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে, চমকে উঠলো। বিস্ময় নয়নে ইফাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তানহার বান্ধবী পুতুল বলে উঠলো।

–তোর ক্যামেরার কি হাল হয়েছে। কি করে হলো এসব? পুতুলের কথা শুনে, চৈতালি রাগান্বিত হয়ে বলল।

–এই ছেলেটা কে? নিশ্চয়ই এই ছেলেটা তোর ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে। এই ছেলেকে তো আমরা দেখে ছাড়বো। চৈতালির কথা শুনে, ইফাদ হুংকার দিয়ে উঠে।

–তোমাদের সাহস কি করে হয়? আমার সামনে উচ্চ স্বরে কথা বলার। এই মেয়ে তুমি আমার গায়ে হাত তুললে কেনো? তোমার হাতে কত জীবানু লেগেছিল। আমাকে থাপ্পড় মারার আগে হাত ধুয়েছিলে? আমাকে মারার আগে বলতে পারতে, আমার পকেটে স্যানিটাইজার ছিল। সেটা দিয়ে হাত পরিষ্কার করে, তারপরে আমাকে স্পর্শ করতে। ঠিকঠাক মতো থাপ্পর ও দিতে পারলে না। এর থেকে মশাও জোরে কামড়ে দেয়। কথা গুলো বলেই শক্ত হাতে তানহার নরম গাল জোড়া শক্ত হাতে চেপে ধরলো। ইফাদের কথা সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। অতিরিক্ত জোরে ধরায় তানহার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দু-চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে। স্রুতি আর প্রিয়া মিলে, ইফাদের দু’পায়ে দু’জন প্রহার করল। ইফাদের অবস্থান আগের ন্যায় বিরাজ করছে। দু’জনের প্রহার ইফাদকে আরো ক্ষেপিয়ে তুলেছে। সে তানহাকে আরে শক্ত করে ধরলো। স্রুতি আর প্রিয়া ভয়ে পিছিয়ে আসলো। এর মাঝে ইফাদের চার বন্ধু চলে আসলো। দ্রুত ইফাদকে তানহার থেকে সরিয়ে দিল। ইফাদের থেকে ছাড়া পেতেই, জোরে জোরে শ্বাস নিল তানহা। প্রচন্ড কাশি হচ্ছে তার। রাগান্বিত হয়ে উচ্চ স্বরে বলে উঠলো।

–আপনার মধ্যে কোনো পারিবারিক শিক্ষা নেই। একটা অচেনা মেয়ের ক্যামেরা ভেঙে দিলেন, আবার তাকেই প্রহার করছেন। আপনার পারিবারিক শিক্ষার বড্ড অভাব। আমার ক্যামেরার টাকা না দিলে, এখানে থেকে এক কদমও এগোতে দিব না।

–আমি তোমার ক্যামেরার টাকা দিব না। তোমার ক্যামেরা ভেঙেছি। বেশ করেছি। দরকার পড়লে তোমাকে ও ভেঙে দিব। বাঁশের মতো পাতলা শরীরটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে, দুই সেকেন্ড সময় লাগবে না। তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তখন থেকে আমার সাথে উচ্চ স্বরে, কথা বলেই যাচ্ছো।

–আপনি কি এসে গিয়েছেন? যে আপনার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলা যাবে না। অভদ্র লোক কোথাকার। তানহার কথায় ইফাদের ললাটে কয়েকটি ভাজ পড়লো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তানহার দিকে তাকালো৷ সে অনুভব করল। তানহার সাথে কথা বলতে, তার বুক কাঁপছে। কথা গুলো গলায় এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। শরীরটা কেমন জানি অবশ হয়ে আসছে। সে ভেতর থেকে রাগ করতে চাইছে। কিন্তু রাগ গুলো বড্ড খামখেয়ালি হয়েছে। নিজ দায়িত্ব থেকে, কিছু মুহুর্তের জন্য পালিয়ে গিয়েছে। ইফাদের ভাবনার মাঝেই তানহার রাগান্বিত কণ্ঠ ভেসে এলো।

–আমার ক্যামেরার টাকা দিবেন কি না? ইফাদ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

–দিব না কি করবে? ইফাদের কথা শেষ হবার সাথে সাথে, তানহা ইফাদের দিকে এগিয়ে আসলো। আচমকা ইফাদের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। ইফাদ মৃদুস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। তানহা এক হাতে ইফাদের ফোনটা ধরলো। আরেক হাতে স্যানিটাইজার ধরলো। তারপরে তাচ্ছিল্য করে বলল।

–ভয় পাবেন না। আমি হ্যান্ড স্যানিটাইজার করে নিচ্ছি। না হলে আপনার ফোনে জীবানু লেগে যাবে। তানহার কথা শুনে, সবাই মুখ চেপে হাসতে শুরু করল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে, তানহা নিচে থেকে একটা পাথর তুলে, ইফাদের ফোনটা কয়েক টুকরো করে ফেলল। তারপরে ইফাদের কাছে গিয়ে, কানে কানে বলল।

–তানহা কারো ঋন রাখে না। কথা গুলো বলেই চার বান্ধবী মিলে চলে আসলো। ইফাদ রাগান্বিত হয়ে, তানহার দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। ইফাদের বন্ধুরা সবাই নিরবতা পালন করছে। পরিবেশটা কেমন শীতল হয়ে উঠেছে। ইফাদ রাগে গজগজ করতে করতে রাস্তায় চলে আসলো। তিনজনকে রেখেই বাসায় চলে আসলো। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। একটা মেয়ে তার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেছে। তার শরীরে প্রহার করেছে। বিষয়টি ভিষণ করে তাকে পিড়া দিচ্ছে। রুমের সবকিছু এলোমেলো করে ফেলছে। ভয়ে ইফাদের কক্ষের সামনে অগ্রসর হবার সাহস কেউ পাচ্ছে না। একটু পরে পরিবেশ একাই ঠান্ডা হয়ে গেল। ইফাদ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে, নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা করছে।

তানহা বাসায় এসে কোনো কথা না বলে, নিজের রুমে চলে গেল। শখের জিনিসটা চোখের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। দৃশ্যটা মনে হতেই, কলিজাটা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সবার সামনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেও, চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কষ্টকর। তার ভালোবাসার জিনিসটাকে সে আর ছুঁয়ে দেখতে পারবে না। ভাবতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তানহা। অশ্রুধারা কিছুতেই বাধ মানছে না। নিজ নিয়মে গড়িয়ে পড়ছে। শরীরে আঘাত করলে-ও ভেতরে এতটা ক্ষত হয় না। পছন্দের জিনিস হারিয়ে গেলে, ভেতরে যতটা ক্ষত হয়। ক্যামেরা ভেঙে যাবার দৃশ্যটা তানহার কোমল হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। প্রায় দুই ঘন্টা কান্না করার পরে শান্ত হলো মন। এখন নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। উঠে গোসল করতে চলে গেল। গোসল করে এসে, খাবার টেবিলে বসে। চিৎকার করে উঠলো।

–আম্মু তাড়াতাড়ি খেতে দাও। প্রচন্ড ক্ষুদা পেয়েছে।

–একদম আমার ওপরে চিল্লাবি না। আমাকে তোর বাবা কাজের লোক রেখেছে। যখন যা হুকুম তামিল করবি। আমাকে ঝড়ের গতিতে কাজ করতে হবে। আমার একটা কাজ নিয়ে পড়ে থাকলে হয় না। বাসার সমস্ত কাজ আমাকে একা করতে হয়। এত বড় মেয়ের ভাত বেড়ে নিয়ে, খাওয়ার যোগ্যতা হয় নাই। মহারানী সারাদিন টো টো করে আসবে। জমিদারের বাচ্চার মতো হুকুম করবে, আমাকে যথাযথ সময়ে পালন করতে হবে। খালি তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে, সংসারটা করে যাচ্ছি। অন্য কেউ হলে, কবেই সংসার ছেড়ে চলে যেত।

–আম্মু এক কথা কয়েক বছর ধরে শুনতে শুনতে কান আমার পঁচে পেল৷ নতুন কিছু বলতে পারো না। এতগুলো কথা না বলে, খেতে দিলে এতক্ষণে আমার অর্ধেক খাওয়া হয়ে যেত। তানহার মা কোনো কথা বলল না। খাবারের প্লেট নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলো। মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। সন্দিহান দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। তানহা মায়ের দৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে, খাওয়ার দিকে মনযোগ দিল। খালি পেটে মস্তিষ্ক কাজ করতে চায় না। খেয়ে মাথাটা ঠান্ডা করে, শান্ত মস্তিষ্কে মায়ের সাথে কথা বলতে হবে।

–কি রে তোর চোখ লাল হয়ে আছে কেনো? সত্যি করে বল তুই প্রেম করছিস নাকি?

–আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না আম্মু!

–পৃথিবীর সবাইকে বিশ্বাস করলে-ও আমি তোকে বিশ্বাস করি না। সারাদিন এদিক ওদিক টো টো করিস। পাশের বাসার মারিয়াকে দেখেছিস। মেয়েটা কতটা ভদ্র। বাসা থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হয় না। আর সকাল হলে, সারাদিনে তোর রুপটা দেখা যায় না।

–আমি বাদে, পৃথিবীর সবাই তোমার কাছে ভালো। আমি কি করেছি। যে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না। তোমার এক কথা শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত। ছোট থেকে বড় হয়েছি। বাসায় কখনো কোনো বাজে রিপোর্ট পেয়েছো। একদম অন্যের সাথে আমার তুলনা দিবে না। অন্যের সাথে তুলনা দেওয়া মানে, নিজেকে অপমান করা।

–তোর নামে বাজে রিপোর্ট আসে নাই দেখেই এখনো পড়াশোনা করাচ্ছি। যেদিন বাসায় কোনো রিপোর্ট আসবে, সেই দিনই ধরে রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিব। মায়ের কথা রাগান্বিত হয়ে মায়ের দিকে তাকালো তানহা। মেয়েকে রাগান্বিত হয়ে তাকাতে দেখে, তানহার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল।

–এই যে, এত রাগ দেখাস। আমি জন্যই সহ্য করে নিচ্ছি। অন্য কেউ হলে, কবেই ছেড়ে চলে যেত। কথা গুলো বলেই রান্না ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। মায়ের কান্ড দেখে, আনমনে হেসে উঠলো তানহা। সত্যি তো মায়ের সাথে যত রাগ দেখায়। মা বলে সহ্য করে নেয়। অন্য কেউ হলে, কবেই ছেড়ে চলে যেত। সবাই কি আর মা হতে পারে। তানহা খেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। কি করবে বুঝতে পারছে না। তার নিজের ফোন ও নেই। বাবার থেকে জেদ ধরে ক্যামেরাটা কিনে নিয়েছিল সে। তানহা ফটোগ্রাফি করতে বেশ ভালোবাসে। ক্যামেরা কিনার সময় বলেছিল। ক্যামেরা কিনে দিলে, জীবনে আর কিছু চাইবে না। ফটোগ্রাফি করা তানহার নেশা। ধীরে ধীরে এটি তার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। ক্যামেরা ছাড়া তার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।

পরের দিন সকাল বেলা তানহা মলিন মুখ করে কলেজে আসলো। সবাই আড়চোখে তানহার দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম তানহা ক্যামেরা ছাড়া কলেজে এসেছে। সে প্রতিদিন ক্যামেরা নিয়ে, কলেজে আসে। এই নিয়ে নজরুল স্যারের কাছে প্রচন্ড কথাও শুনেছে। তা নিয়ে তানহার আক্ষেপ নেই। সে কলেজ শেষ করে, প্রতিদিন ছবি তুলতে যায়। আচমকা তানহার কাঁধে কেউ হাত রাখলো। পেছনের মানুষটিকে দেখে তানহা রক্তিম চোখে, মানুষটির দিকে তাকালো।

চলবে…..