বিষাদের শহরে তুমি এলে পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
338

#বিষাদের_শহরে_তুমি_এলে
#পর্ব_০৭(শেষ পর্ব)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

তানহা যখন ইফাদের সামনে থাকে, ইফাদ অনুভব করে তার হৃদস্পন্দনের গতিবেগ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। ইফাদ তানহাকে চোখের আড়ালে করতে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

–তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। তুমি আজ আসতে পারো। প্রয়োজন হলে, আমি তোমাকে ডেকে নিব। তানহা আর কথা বাড়ালো না। নিঃশব্দে ইফাদের বাসা ত্যাগ করল। তানহা ইফাদের সামনে থাকলে, সে হয়তো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারাই যেত। মেয়েটা তার সামনে আসলে, তার অনুভুতিরা এমন আনন্দে মেতে উঠে কেনো? সে আর ভাবতে পারলো না। চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল। ছেলের নিরবতা দেখে আনমনে হেসে উঠলো আদনান আহির। স্মিত হেসে স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। রাহেলা বেগম স্বামীর দিকে দৃষ্টিপাত করে, মুখ বাকিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরলো তানহা। তানহাকে মনমরা হয়ে বাসার মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে, তানহার মা আড়চোখে মেয়ে দিকে দৃষ্টিপাত করল। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।

–তানহা আগেই নিজের রুমে যাবি না। আজকাল তোকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে দেখছি। তা তোর সঙ্গী কই? দু’দিন হলো তাকে তোর সাথে দেখছি না। মায়ের কথা কর্নপাত হতেই চমকে উঠলো তানহা। এখন মাকে সে কি জবাব দিবে। তানহার মায়ের কথার সাথে তাল মিলিয়ে তানহার বাবা জবাব দিল।

–তানহা তোর মা সত্যি কথা বলছে! এটা তো আমি আগে খেয়াল করি নাই। যে মেয়েটা খেতে বসলেও ক্যামেরার দিকে চোখ রাখে, সেই মেয়ের হাতে ক্যামেরা নেই।

–আমি আগেই বলতাম। কিন্তু কাজের চাপে আর সংসারের অশান্তিতে ভুলে গিয়ে ছিলাম। তানহার রুম গোছাতে গিয়েও, তানহার ক্যামেরা আমার চোখে পড়ে নাই। ও মেয়েকে বলো এত দামি ক্যামেরা কোথায় রেখে এসেছে? নাকি কাউকে দান করে দিয়েছে। মেয়ের তো আবার দান করার স্বভাব। তাই নিজের পছন্দের জিনিস অন্য কাউকে দিয়ে দিবে।

–আমি কাউকে ক্যামেরা দেই নাই আম্মু।

–দেব দু’টো লাগিয়ে। আবার বেয়াদবের মতো মুখে মুখে তর্ক করছিস। মুখে মুখে তর্ক না করে, সত্যি করে বল ক্যামেরা কোথায় রেখেছিস?

তানহা নিরুত্তর রইলো। এখন সে কি জবাব দিবে। সে তো মিথ্যা কথা বলতে পারে না। তানহাকে চুপ থাকতে দেখে, তানহার বাবা মুখটা গম্ভীর করে বলল।

–কি হলো কথা বলছিস না কেনো? বাবার গম্ভীর কণ্ঠ কর্ণকুহরে আসতেই মিনমিনে কণ্ঠে বলল।

–আব্বু আসলে আমার ক্যামেরাটা নেই।

–নেই মানে, ক্যামেরার কি হাত-পা গজিয়েছে।

–আসলে সেদিন কলেজে ফাঁকি দিয়ে, পাশের এলাকায় ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা ছেলের সাথে ঝামেলা হয়। ছেলেটা রাগ করে আমার ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে। আমিও ছেলেটার ফোন ভেঙে দিয়েছি। কথা গুলো বলেই দৃষ্টি নত করে নিল তানহা।

–এই তুই আমাকে আগে জানাস নাই কেনো? কোন ছেলে তোর ক্যামেরা ভেঙেছে। আজকেই আমাকে দেখিয়ে দিবি।

–আদনান আহির আংকেলের ছেলে ভেঙে দিয়েছে। তানহার কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করার পরে, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল।

–মন খারাপ করিস না মা। আমি তোকে আবার ক্যামেরা কিনে দিব।

–বেশ হয়েছে। ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে। ঐ ক্যামেরা মেয়েটাকে একদম নষ্ট করে দিচ্ছিল। যে ছেলে তোর ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে। তাকে আমার কাছে নিয়ে আসিস। উপহার স্বরুপ দশ টাকা দিব। এবার অন্তত মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। তানহার মায়ের কথা শুনে, তানহা অভিমানী দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। তানহার দৃষ্টি উপেক্ষা করে তানহার আম্মু উচ্চ স্বরে বলে উঠলো।

–ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? ক্যামেরার কথা মাথা থেকে নামিয়ে দে। ভালো করে পড়াশোনা কর। তোর বাবা যদি তোকে আবার ক্যামেরা কিনে দেয়। আমার বাসায় আগুন জ্বালিয়ে দিব। এই বাড়ি ছেড়ে বনবাসে চলে যাব৷ তখন তোর শান্তি করে থাকিস।

–সে তো তুমি আমাদের জন্মের পর থেকেই চলে যাচ্ছো আম্মু। খালি মুখেই বলো। কোনো দিন যেতে দেখলাম না৷ একবার সত্যি সত্যি গিয়ে দেখিয়ে দিলে-ও তো পারো। তানহার কথায় তানহার আম্মু রক্তিম চোখে মেয়ের দিকে তাকালো। তানহা ভয় পেয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। তানহা চলে যেতেই রাহেলা বেগম স্বামীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তানহার বাবা সুন্দর একটা হাসি উপহার দিয়ে ভয়ার্ত মুখ করে, নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। তখনই কর্ণকুহরে এসে কয়েকটি বাক্য ঝনঝন করে উঠলো।

–মেয়েকে খালি ক্যামেরা কিনে দাও। আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। একটা বাসা থেকে বের হয়েছে। এইবার দুই বাবা-মেয়েকে বাসা থেকে বের করবো। কথা গুলো বলেই চলে গেল রাহেলা বেগম।

ছয়মাস পর…..

চারিদিকে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। যানবাহন গুলো নিজ গন্তব্যে ছুটে চলেছে। এই কয়দিনে তানহা আর ইফাদের বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ফাইয়াজ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বাবার কাছে এসে মাফ চেয়েছে। ইফাদ এসেছে তানহার জন্য ক্যামেরা কিনতে। তানহার রাস্তা পার হতে একটু ভয় পায়। সাথে কেউ থাকলে ভয়ে হাত জড়িয়ে ধরে। আজকেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ইফাদের হাত ধরতে চাইছিল। তখনই ইফাদ তার হাত দ্রুত গতিতে সরিয়ে নিয়ে বলল।

“তুমি আগে বলো তুমি আমার হাত ধরে রাস্তা পার করে দিবে, নাকি সারাজীবন পার করবে ।

“তানহা সরল নয়নে তাকিয়ে উত্তর দিল । আমি আপনার হাত ধরে রাস্তা পার করে দিব । কারন আপনাকে রাস্তা পার করে দেওয়া পর্যন্তই আমার দায়িত্ব । আপনার সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার মতো দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয় নাই ।”

তানহার সোজাসাপটা উত্তর পেয়ে বেশ খুশি হলো ইফাদ। অন্তত কেউ একজন আছে। যে তার মন রাখার জন্য মিথ্যা বলেনি। ছলনার আশ্রয় নেয় নি। যত দিন যাচ্ছে, মেয়েটার প্রতি সে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। মেয়েটা আশেপাশে থাকলে, আর রাগ হয় না। অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করে। অনুভূতিরা খুশিতে আন্দোলন শুরু করে দেয়। মেয়েটা চক্ষুদ্বয়ের আড়াল হলেই চক্ষুদ্বয় জোড়া মেয়েটাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। ইফাদকে ভাবতে দেখে তানহার ললাটে কয়েকটি ভাজ পড়লো। শান্ত কণ্ঠে বলল।

–এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাববেন নাকি দোকানে যাবেন। তানহার কথায় হুস আসলো ইফাদের। একবার মেয়েটার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকলো। অদ্ভুত এক ইচ্ছে এসে মনে হানা দিল। এই প্রথম মন থেকে কোনো মেয়েকে ছুঁইয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নিল। সে তানহার হাত ধরে রাস্তা পার হবে। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে নিলেও, বাস্তবে হাত ধরার সাহস হচ্ছে না। হৃদ ক্রিয়া দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। হাত জোড়া কাঁপছে। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। ইফাদের আচরনে বিরক্ত হলো তানহা। বিরক্তি মাখা মুখ করে, কঠিন কণ্ঠে বলল।

–আমার ক্যামেরা কিনা লাগবে না। আপনি সারাদিন এখানে বসে ভাবতে থাকুন। আমি বাসায় চলে গেলাম। দেরি করে বাসায় গেলে, আম্মু আমার দফারফা অবস্থা করে ফেলবে। তানহা চলে যাবার জন্য সামনের দিকে ঘুরতেই। ইফাদ তানহার হাত ধরে ফেলল। ইফাদকে হাত ধরতে দেখে তানহা চোখ গোল গোল করে তাকালো। যেনো ইফাদ কোনো বড় অপরাধ করে ফেলছে। তানহাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, ইফাদ দৃষ্টি নত করে নিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে, শান্ত কণ্ঠে বলল।

–ওভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? আমি বলেছি কিনে দিব না। তোমার মন যখন আমি ভেঙেছি। তখন তোমার মনটা আমিই জোড়া লাগিয়ে দিব। আর একটা কথাও শুনতে চাই না। তোমার হাত ধরেছি রাস্তা পার হবার জন্য। ইফাদের কথা শুনে তানহা চিন্তিত হয়ে বলল।

“আপনি যে আমার হাত ধরেছেন। আপনার হাতে জীবাণু লেগে যাবে না। হতেও পারে আমার হাতে অনেক জীবাণু ছিল। কথা গুলো বলেই তানহা হেসে দিল। তানহাকে হাসতে দেখে, ইফাদ এক হাসে মাথা চুলকে সে-ও হেসে দিল।

(সমাপ্ত)