বুক পিঞ্জরায় পর্ব-০৩

0
160

#বুক_পিঞ্জরায় (০৩)
ফাতেমা তুজ জোহরা

তিন.

রেদোয়ান ফোনটা নিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন। স্বাভাবিকভাবেই দু’বন্ধু কুশলাদি বিনিময় করলো। তারপর দু’জনই ফোনের দু’পাশ থেকে চুপ হয়ে গেলো। মাহফুজ ভাবছে যে, মেহেরের এই বিয়েতে আপত্তির কথা কিভাবে বলবে ? রেদোয়ান ভাবছে যে, মেহরাবের বিয়েতে আপত্তির কথা কিভাবে বলবে ? অবশেষে দুজনেই নিজেদের সন্তানের বিয়েতে অমতের কথা বলে ফেললো। সমস্যা না বললে এর সমাধান পাওয়া যাবে না। তাই দুজনেই সমাধান খুঁজছে এখন। যে করেই হোক, মেহরাব-মেহেরের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তে তারা দুই বন্ধু অটুট। কিন্তু আদৌও কি সম্ভব হবে ?

মেহেরের ক্ষুধা পেলো। কিন্তু এখন উঠে গিয়ে খেতেও ইচ্ছা করছে না। মা যে কেন এই অকর্মা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে এটা তার মাথায় ঢুকছে না। এসব ভাবনার মাঝে দরজায় আওয়াজ হতে শুনলো। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো মাইশা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার ছোট প্লেটে পেয়ারা কাটা। মেহের কিছু না বলেই দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁয়। মাইশা মেহেরকে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “উফ আপু, ভূতের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে রইলে কেন ? আমাকে ভেতরে আসতে দিতে চাইছিলে না ?”

মেহের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল, “এখন এলি কেন ? এখন কথা বলার মুড নেই। চলে যা।”

মাইশা পেয়ারার প্লেটটা বিছানার উপর রেখে বলল, “চলেইতো যাবো। জাস্ট দেখতে এলাম যে তুমি কি করছো। আচ্ছা আপু, পাত্র কি আসলেই খুব খারাপ যে তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছো না ?”

মেহের এক টুকরো পেয়ারাতে কামড় বসিয়ে বলল, “বিয়ের বয়স হয়েছে আমার, বিয়ে করতেই পারি। কিন্তু এমন মানুষের সাথে আবদ্ধ হতে চাই না যার জন্য আমার ইহকাল আর পরকাল দুইকালই নষ্ট হয়। আম্মু কেন এসব দেখেও দেখছে না সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না। জোর করে আগুনে ফেলতে চাইছে আমাকে।”

মাইশা জ্ঞানীর ভাব করে বলল, “হুম হুম বুঝতে পারছি। আচ্ছা আপু, আমার মনে হয় কি যে তুমি আম্মুর মেয়ে না।”

এই কথা শুনে মেহের চোখ পাকিয়ে তাকালো মাইশার দিকে। পেয়ারাতে এমন কামড় বসালো যেন মাইশার ঘাড়ে কামড়ে দিতে পারলে আরো ভালো হতো। মাইশা বুঝতে পারলো মেহেরের চাহনী। সে সঙ্গে সঙ্গেই বলল, “না মানে আপু দেখো, আম্মুর নাম আয়শা আর আমার নাম মাইশা। দু’জনের নামের কত মিল। তোমার নামের সাথে আম্মুর নামের মিল নেই। আব্বুর নাম মাহফুজ আর তোমার নাম মেহের। তার মানে তুমি আব্বুর মেয়ে, আম্মুর নও। নইলে আম্মু এত জোর করতো না।”

মেহের ধমক দিয়ে বলল, “তোর এই গোবরে মাথার লজিক ধুয়ে তুই পানি খা। এখন যা এখান থেকে। আগামী কয়েক ঘন্টা যেন তোকে আমার আশেপাশে না দেখি।”

মাইশা এক প্রকার পালিয়ে যাওয়ার মতো করে ছুটে বের হয়ে গেলো মেহেরের ঘর থেকে। মাইশা বের হতে না হতেই আসীর এসে দরজায় উপস্থিত। মেহের দরজা লাগাতে গিয়ে দেখলো আসীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আসীরকে দেখামাত্র মেহের বলল, “এক শয়তান যেতে না যেতে আরেক শয়তান হাজির। একদম ঝাড়ফুঁক করে ভষ্ম করে দিবো। বল কেন এসেছিস ?”

আসীর বলল, “এসেছিলাম তোমার খোঁজ নিতে। এখন দেখি তোমার মেজাজ ফোর টুয়েন্টি। শুধু শুধু শকড খেয়ে অকালে মরতে চাইনা। গেলাম আমি।”

আসীর দাঁড়ালো না আর। সেই মুহুর্তেই চলে গিয়েছে। সে জানে মেহেরের মন খারাপের সময় একা থাকা পছন্দ করে। তবুও একটু চেক করতে এসেছিল। কিন্তু মাইশা হয়তো এমন কিছু বলেছে যাতে করে বড় বোনটার মেজাজ চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এইজন্য আর কথা বাড়ায়নি। আসীর চলে গেলে মেহের দরজা লাগিয়ে বিছানায় চলে যায়। শুয়ে শুয়ে পেয়ারাগুলোকে ইচ্ছামত চিবুচ্ছে। রাগগুলো যেন পেয়ারার উপর দিয়েই যাচ্ছে।

এদিকে মেহরাব হাঁটু গেড়ে বসে আছে রেদোয়ানের সামনে। রেদোয়ান ইচ্ছা করেই এভাবে ছেলেকে বসিয়ে রেখেছে। ছেলে যথেষ্ট বড় হয়েছে। তাই তিনি চাচ্ছেন না যে গায়ে হাত তুলে ছেলেকে শাষণ করুক। কিন্তু প্রয়োজন পড়লে তা তিনি করবেনই। রেদোয়ানের একটাই বক্তব্য, বিয়ে করলে মেহেরকেই করতে হবে। আকদ করিয়ে ফেলবেন। চেনাজানা যা হওয়ার আকদের পর দু’জনে করে নেবে। কিন্তু মেহরাব এই সিদ্ধান্তে নারাজ। রুচির বিপরীতে থাকা মেহেরকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না।

রেদোয়ান শেষমেশ মেহরাবকে উদ্দেশ্য করে সাফিয়াকে বলল, “তোমার ছেলেকে বলে দাও, মেহেরকে বিয়ে না করলে তাকে ত্যাজ্য করবো। এমন ছেলে আমার প্রয়োজন নেই যে কিনা সোনা আর তামার মধ্যে তফাৎ বুঝে না।”

কথা শেষে রেদোয়ান বের হয়ে যায় ঘর হতে। বাবা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই মেহরাব উঠে দাঁড়িয়ে মা সাফিয়াকে বলল, “আম্মু, বাবাকে বুঝাও। মেয়েটার মধ্যে কি এমন আছে যে আমাকে ওই মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। ত্যাজ্য করলেও আমি তাকে বিয়ে করবো না। বিয়ে দুদিনের খেয়াল নয় যে আজ বিয়ে করে কাল মেয়েটাকে ছেড়ে দেবো। যাকে পছন্দ না তাকে কিভাবে জীবনসঙ্গী করবো ? কিভাবে তাকে সহ্য করবো ?”

সাফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোর বাবা ঠিকই বলেছে যে, তুই তামা আর সোনার তফাৎ বুঝিস না এখনো। বিয়ের আগে তোর বাবাকেও আমার এত পছন্দ ছিল না। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে আমাদের। কই আমাদেরতো কিছু হয়নি। তোরা দুই ভাইবোনও জন্মেছিস। আমরা এখনো কিভাবে একসাথে আছি ? তোকে শুধু সঠিক শিক্ষাটাই দিতে পারিনি। পরিবার থেকে যা শিক্ষা দেয়ার তার সবটুকু দেয়ার চেষ্টা করেছি। বেশিরভাগ শিক্ষাই তোকে গ্রহণ করাতে পারিনি। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই। যদি যা শিক্ষা দিতে চেয়েছি তা গ্রহণ করতি তাহলে মেহেরকে এখন চোখ বন্ধ করে মেনে নিতি। আমার আর কিছু করার নেই। তোর বাবা যা বলবে আমি সেটাই শুনবো।”

সাফিয়া কথা শেষে সেও বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। যাদের ঘর তারাই বের হয়ে গেলো। রইলো শুধু মেহরাব। পুরো শরীর তার থরথর করে কাঁপছে। কারণটা কি রাগ, দুঃখ নাকি অন্যকিছু তা সে বুঝতে পারছে না। নিজেকে কন্ট্রোল করতে হিমশিম খাচ্ছে। কোনোরকমে দেয়াল ধরে ধরে এঘর হতে নিজের ঘরে পৌঁছে। পৌঁছাতেই ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। দেহ যেন আর এগোচ্ছে না। এভাবে একটা অপছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে, এটা ভাবলেই বিরক্তি ছেয়ে যাচ্ছে হৃদয় জুড়ে। মেয়েটার নেই কোনো আহামরি সৌন্দর্যতা। এই মেয়েকে বিয়ে করলে ফ্রেন্ডের সামনে উপস্থিত হবে কিভাবে ? ওদের বউগুলো কত স্মার্ট ! তাদের মধ্যে মেহের খাপই খাবে না।

দরজা খোলাই ছিল। রাবাব ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো মেহরাব ফ্লোরে বসা। ছোট বোন বড় ভাইয়ের এরূপ অবস্থা দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। রাবাব ছুটে গেলো মেহরাবের দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মেহরাবের সামনে। চিন্তিত কণ্ঠে বলল, “ভাইয়া কি হয়েছে তোমার ? এত ঘামছো কেন ?”

মেহরাব কিছু বলছে না। রাবাব ছুটে গিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করে দিলো। তারপর মেহরাবকে টেনে তুলে নিয়ে গেলো বিছানায়। রাবাব আর কোনো প্রশ্ন করলো না মেহরাবকে। ফ্যানের বাতাস রাবাবের কাছে কম মনে হচ্ছে। ছুটে গিয়ে ছোট চার্জার ফ্যানটা এনে চালু করে মেহরাবের সামনে রাখে। বোনের দরদ দেখে মেহরাবের কিছুটা স্বস্তি লাগছে। রাবাবকে আস্তে করে বলল, “আমাকে একটু একা থাকতে দে। দরজাটা লাগিয়ে যাস।”

ভাইয়ের বাধ্যগত বোন আর কথা বাড়ালো না। দরজা চাপিয়ে চলে গেলো এঘর হতে। রাবাব বুঝতে পারছে বিষয়টা। সব সমস্যা এই বিয়ে নিয়ে।

চলবে…