বুক পিঞ্জরায় পর্ব-০৪

0
66

#বুক_পিঞ্জরায় (০৪)
ফাতেমা তুজ জোহরা

চার.

দু’প্রান্তে দুজনের রাতটা কেটে গেলো চিন্তার সাগরে ভাসতে ভাসতে। কেউই কাউকে চায় না। পুরোপুরি বিপরীতে থাকা দু’টো স্বভাবের মানুষ কিভাবে এক হতে পারে ? যদিওবা এক হয়, তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত অন্ধকারাবৃত্ত। মেহের ফজরের নামাজ পরে বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালো। পূর্ব পাশের আকাশী গাছটার চিরল পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্য উঁকি দেয়ার সময় এখনো হয়নি। তবুও তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ সেদিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে এলো পশ্চিমের দিকে। নিজ হাতে লাগানো গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে মনের প্রশান্তি আসছে। বেগুন, টমেটো, কাঁচামরিচ ইত্যাদি আরো কত গাছ, এসবে ফল এসেছে। নিজ হাতে টুকটাক সবজি চাষ বেশ ভালো লাগে মেহেরের। মাথা উঁচু করে ছোট আম গাছটার দিকে তাকালো। আমের গুঁটিগুলো এখনো হাফ ইঞ্চি পরিমাণ। ঘুরে ফিরে এসব দেখতে দেখতে এলার্ম বাজলো ফোনে। ছুটে গেলো ঘরে। সেরে নিলো গোসল। এদিকে আয়শা রান্না করছেন। মেহের ভালো করে চুল শুকিয়ে তৈরি হয়ে নিলো হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।

খাবার খেতে বসলো পরিবারের সবাই একসাথে। মেহের দ্রুত খাবার খাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি থেকে বের হতে চাচ্ছে। নয়তো আবারো ওই ছেলের সাথে বিয়ের কথা উঠবে। মেহেরকে দ্রুত খেতে দেখে মাইশা বলল, “আপু, তোমার হাসপাতালে কী আজ অভিজান চলবে নাকি ?”

মেহের মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে বলল, “না, কেন ?”

মাইশা বলল, “তাহলে কি ইন্সপেকশন ?”

মেহের বলল, “উঁহু।”

মাইশা বলল, “তাহলে এত তাড়াতাড়ি খাচ্ছো কেন ? একমাত্র হাসপাতালে ইন্সপেকশন হয় সময় তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য এভাবে খাও। তাহলে আজ কেন ?”

মেহের মুখের খাবার শেষ করে বলল, “খাবার খাওয়ার সময় এত কথা কেন ? চুপ থাকো।”

মাহফুজ বলে উঠলো, “সবাই চুপ থাকো। মেহের, ধীরে খাও। নয়তো অল্প খাও আর সাথে করে কিছু খাবার নিয়ে যাও। একটু পর না হয় আবার খাবে।”

মেহের বলল, “লাগবে না আব্বু। যথেষ্ট খেয়েছি।”.

মাহফুজ বলল, “আর শোনো, হাসপাতাল থেকে আবার ছুটি নিও। আমরা সবাই রেদোয়ানদের বাড়িতে যাবো। ওরা দাওয়াত দিয়েছে।”

সাফিয়া, আসীর, মাইশা সবাই তাকালো মাহফুজের দিকে। মেহের তখনো তাকিয়ে ছিলো খাবারের প্লেটের দিকে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর মেহের মাহফুজকে বলল, “আব্বু, যেই ছেলের সাথে বিয়েটাই করতে রাজি নই তাহলে কেন যাবো সেই বাড়ি ? আমি অন্য যে কাউকে বিয়ে করবো তবুও ওই ছেলেকে না।”

মেহের উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। মাহফুজ বলল, “বিয়ে করবে কি করবে না সেটা পরের বিষয়। প্রথমত রেদোয়ান আমার বন্ধু। তার দাওয়াতে আমরা যেতেই পারি। তুমি কখনওই যাও না। তবে এবার যাবে। দ্যাটস ফাইনাল।”

মেহের বলল, “আমি অযথা কারো সামনে যেতে চাই না আব্বু। হাসপাতালে রিসিপশনের কাজ সহজ আর পর্দা সহিত থাকা যায় বিধায় আমি জবটা করছি। বিয়েটা হলে আমি এই কাজটাও করবো না। পর্দার বিধান পুরোপুরি মেনে চলার চেষ্টা করবো। আমাকে এভাবে সবার সামনে যেতে বলবে না আব্বু। আম্মু বা মাইশা, তাদেরও এভাবে চলা উচিৎ।”

মেহের আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। হাত ধুয়ে ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে পড়লো। বাকী সবাই খাবার টেবিলে চুপ করে বসে রইলো। তবে আসীর অল্পস্বল্প মুখে দিতে রইলো। তার খাওয়াতে ব্রেক পড়েনি। মাহফুজ চিন্তিত চোখে তাকিয়ে রইলেন খাবারের প্লেটের দিকে। নিজের সিদ্ধান্তে কি আসলেই ভুলের বীজ লুকিয়ে আছে কিনা তা বুঝতে পারছেন না। আয়শা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবারে মনোযোগী হলেন। মাইশা তাকিয়ে রইলো বোনের চলে যাওয়ার দিকে। বড় বোনের থেকে রোজই যেন তার কিছু না কিছু শেখা হচ্ছে। এখনো যেন এক শিক্ষা পেলো।

_____

মেহরাবের ঘুম ভাঙেনি এখনো। সাফিয়া বেশ কয়েকবার ডেকেও মেহরাবের ঘুম ভাঙাতে পারেনি। দায়িত্ব পড়লো রাবাবের কাঁধে। অগত্যা ভাইকে সে-ই ডেকে তুললো। কিছুক্ষণ বাদেই পরিবারের সবাই খেতে বসলো একসাথে। খেতে খেতে রেদোয়ান বলল, “মাহফুজের পুরো পরিবারকে দাওয়াত করেছি। ওদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে যেন ভুল না হয়।”

মেহরাব খাওয়া থামিয়ে বলল, “যাকে পছন্দ নয় বলে বিয়ে করবো না বলেছি, তার পুরো পরিবারসহ দাওয়াত দেয়ার মানে কি ?”

রেদোয়ান বলল, “তোমার জন্য আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে বলছো ? নিজেকে কি ভাবো তুমি ? খাওতো বাপের ঘাড়ে বসে বাপের কামাই। আর ওই মেয়ে কতটা শালীনতা বজায় রেখে চলাফেরা করে। তোমারতো বাজারের মাছি ভনভন করা খোলা মিষ্টি পছন্দ, ঘরে যত্ন করে তৈরি মিষ্টির কদর বুঝবে কি করে ? সেটাতো তোমাকে শিখাতে পারিনি। মেহের তোমার থেকে ভালো ছেলে ডিজার্ভ করে। তোমার মতো বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা মানাবে না। আমারই রুচির দুর্ভিক্ষ হয়েছে।”

মেহরাবের ভিষণ রাগ হলো। খাবারের খোঁটা শুনলো, পছন্দের খোঁটা শুনলো, ক্যারেক্টার নিয়েও বাদ পড়লো না খোঁটা শুনার। এখানে আর এক মুহুর্ত বসতে ইচ্ছা হচ্ছে না তার। খাবার ফেলে রেখেই গটাগট করে বের হয়ে গেলো। রাবাব ডাকলো পিছু। সাফিয়া মেয়েকে কড়া গলায় বললেন, “হতচ্ছাড়াটাকে একদম ডাকবে না। এভাবে খাবার ফেলে গিয়েছে সে।”

রেদোয়ান বলল, “রিজিক নষ্ট করার ফল সে অবশ্যই পাবে। এতটুকু খাবার যোগাতে যে কত খাটুনি খাটতে হয় তা সে এখনো জানে না। বেশ মাথায় তুলে ফেলেছি।”

তিনজনে নিজেদের খাবার খাওয়াতে মনোযোগী হলো। ভাইয়ের না খেয়ে বের হয়ে যাওয়াতে রাবাবের বেশ খারাপ লাগছে। কি হতো যদি বাবা এই কথাগুলো খাবার খাওয়ার পরে বলতো ? ভাইটা অন্তত খাবারটা খেয়ে বের হতো। রাগ করে কোথায় বের হয়েছে তা অজানা। রাগের মাথায় কোনো ভুল যেন না হয় এটাই দোয়া করছে রাবাব।

_______

হাসপাতালে চার-পাঁচজন লোক একসঙ্গে একজনকে দ্রুত নিয়ে এলো। আহত ব্যক্তির অবস্থা খুবই খারাপ। মোটরসাইক এক্সিডেন্ট করেছে কাভার ভ্যানের সাথে। ডাকাডাকি শুরু হলো ডাক্তারের। ইমার্জেন্সি ডাক্তার রবিউল হাসান আহত ব্যাক্তিতে চিকিৎসা দিলেন। করা হলো এক হাত ও এক পায়ের ব্যান্ডেজ। তারপর করা হলো এক্স-রে। ধরা পড়লো হাঁটু ভেঙেছে। হাত না ভাঙলেও ফাটল ধরেছে। মাথাতে বেশ আঘাত পেলেও বড়সড় ক্ষতি হয়নি হেলমেটেই জন্য। পুরো দেহ জুড়ে রক্তে মাখামাখি। মেহের রিসিপশনে বসে বারবার রোগীর অবস্থা দেখছে। নাকমুখ বেশ ফুলেছে। মেহের বুঝতে পারেনি যে এটা মেহরাব। চমকালো তখন, যখন রিসিটে নাম ও বয়স দেখলো। তবুও শিওর হওয়ার জন্য মেহের তার বাবাকে কল করে ওনার বন্ধু রেদোয়ানের কাছে খোঁজ নিতে বলল।

মাহফুজ রেদোয়ানের কাছ থেকে মেহরাবের সম্পর্কে জানলো। কি ধরনের পোশাক পড়ে বের হয়েছে তা কনফার্ম হওয়ার পর মেহেরকে জানালো। মেহের তার বাবাকে কনফার্ম হয়ে জানালো যে এক্সিডেন্ট হয়ে আসা লোকটা রেদোয়ানের ছেলে মেহরাব। এটা জানার পর মাহফুজ রেদোয়ানকে নিয়ে সোজা চলে আসে হাসপাতালে। মেহরাবের অবস্থা রেখে রেদোয়ান মনে মনে কষ্ট পেলেও মুখে স্বীকার করলেন না। সন্তানের জন্য কে না কষ্ট পায় ? মেহরাব এখন অজ্ঞান অবস্থায় আছে। তাকে সাহায্য করা লোকজনদের রেদোয়ান নিজের যতটুকু সম্ভব সম্মান জানালেন। লোকগুলো চলে গেলো। রেদোয়ান মাহফুজকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এতকালতো আমার ঘড়ে বসেই খেয়েছে। এখন না হয় পার্মানেন্টলি বসে খাবে। আরেকটা মেয়েকে তার সাথে জুড়ে মেয়েটাকে কষ্ট দেয়ার মানে নেই। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”

মাহফুজ বলল, “আহ রেদোয়ান, এভাবে বলতে নেই। দোয়া করি মেহরাব যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরে।”

চিন্তিত দুই বন্ধু দুপুরের আজান হওয়াতে চলে গেলো নিকটস্থ মসজিদে। মেহের মেহরাবের সামনে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। এত সুদর্শন চেহারা কোথায় গায়েব হলো ? হা-পা ভেঙে বসে আছে। কোন সুন্দরী আসবে তাকে বিয়ে করতে ?
আরো কত রকম কথা মনে মনে বলে যাচ্ছে মেহের।

চলবে…