বুক পিঞ্জরায় পর্ব-০৮

0
66

#বুক_পিঞ্জরায় (০৮)
ফাতেমা তুজ জোহরা

আট.

নামাজ শেষ হতে না হতেই দরজায় টোকা পড়লো। মেহের জায়নামাজ তুলে বিছানার কিনারায় রেখে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দেখলো রাবাব ও মাইশা দাঁড়ানো। মাইশার আগে রাবাব ঘরে প্রবেশ করে ফেললো। মেহেরের এক ধরে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাবি, দুপুরের খাবার খাবে চলো। তখনতো কিছুই খাওনি।”

মেহের অপর হাতে মাথায় ভালো করে ঘোমটা টেনে বলল, “একটুখানি পরে যাই।”

রাবাব বলল, “উঁহু, তা হবে না। এখন মানে এখনই। খাবার খাওয়ার পর আরো কাজ আছে।”

মাইশা এসে মেহেরের আরেক হাত জড়িয়ে ধরলো। বলল, “আপু চলোনা। খাওয়ার পর ইমপোর্টেন্ট একটা কাজ আছে।”

মেহের আর কিছু বলল না। ওরা দু’জন যে তাকে এখন ছাড়বে না তা ভালো করেই বুঝতে পারছে মেহের। খাবার টেবিলের সামনে যেতেই দেখলো শাশুড়ী সাফিয়া খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন। বাসার দু’জন পুরুষ এখন উপস্থিত নেই এখানে। সামনে রাখা এত খাবারতো আর মেহের একা খাবে না। মাইশা ও রাবাব দু’জনে মিলে মেহেরকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে মেহেরের সামনে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছিলো। এমন সময় মেহের বলল, “তোমরাও বসো। মা আপনিও বসুন।”

সাফিয়া হেসে মেহেরের পাশের চেয়ারটায় বসে বললেন, “উঁহু, এগুলো সব তোমার জন্য। বউ আপ্যায়ন বলে কথা। এখন তুমি হচ্ছো সাবজেক্ট আর বাকী সবাই অবজেক্ট।”

সাফিয়ার কথাগুলো কেমন লাগলো মেহেরের। যেন সে নিজের বাবার গৃহেই আছে। এমন আহ্লাদ যদি চিরদিন থাকে তবে মন্দ হবে না। মেহেরের চোখেমুখে কিছুটা বিষ্ময় দোল খাচ্ছে। মেহের বলল, “এতগুলো আইটেম আমার জন্য ! মা, আমার দ্বারা অসম্ভব। আর আমি একা সাবজেক্ট হতে চাই না। এখানের প্রত্যেকেই একেকটা সাবজেক্ট।”

রাবাব অধৈর্য হয়ে বলল, “উফ ভাবিজান, আগে খাবার খান। এই সাবজেক্ট-অবজেক্ট এর গ্রামার পরে না হয় আলোচনা করা যাবে।”

মেহের মুচকি হাসলো রাবাবের কথায়। সাফিয়া নিজ হাতে খাবার নিয়ে মেহেরকে খাইয়ে দিলো। মেহের নিজ হাতেই খেতে চেয়েছিল। কিন্তু শাশুড়ীর আবদার ফেলতে পারলো না। এই মুহুর্তটা মেহেরের কাছে এক টুকরো সোনালী স্মৃতি হয়ে থাকবে সবসময়। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নিয়ে চিন্তা না করে বর্তমানটাকে উপভোগ করবে। বর্তমান ঠিক থাকলে ভবিষ্যৎ এমনিতেই সুন্দর হবে। ভবিষ্যৎ সময় বর্তমান সময়ের উপর নির্ভরশীল। খাওয়া শেষে রাবাব আর মাইশা দুজন মেহেদী নিয়ে বসে পড়লো। খাবার খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে মেহেরকে উঠতে হয়নি। রাবাব ও মাইশা দু’জন দু’দিকের চেয়ার টেনে বসে দু’জন দু-হাত দখল করলো মেহেদী পড়ানোর জন্য।

বিয়ের মতো সুন্দর একটা সময়ে কনের হাতে মেহেদি রাঙা হবে না, তা হয় নাকি ? বিয়ের তাড়াহুড়ো থাকায় তখন মেহেদী পড়ার সময় হয়নি। তাই এখন সে কাজ করা হবে। রাবাব বাবার সাথে নিজে গিয়ে পাঁচটা মেহেদী কিনে আনে। যদিও এতগুলোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাবাবের ইচ্ছে সে ভাবির হাতে ইচ্ছামত হাত ভরিয়ে মেহেদী পড়াবে। রেদোয়ানও আর না করেনি। ছেলের বউ মানে আরেকজন কন্যা। নিজ কন্যার মতো তাকেও ভালোবাসা দেয়া হবে পুরোটাই। দু-হাত ভর্তি করে মেহেদী পড়ানো হলো। তারপর মেহেরকে নিজ কক্ষে রেখে আসা হলো।

মেহের বিছানার কিনারায় বসে বসে কক্ষের চারপাশ নজর বুলাচ্ছে। মনে মনে কত কী ভাবনা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেহরাবের সাথে কী আসলেই সম্পর্কটা সুন্দর ভাবে এগোনো সম্ভব? সম্ভব না হলেও সম্ভব করতে হবে। মেহের উঠে জানালার পাশে গেলো। বিকালের পড়ন্ত রোদের তেজ কমতে শুরু করেছে। যদিও তেজ কমার ব্যাপারটা খুবই সামান্য। ঝিরিঝিরি বাতাশ জানালার পর্দায় দোল জাগাচ্ছে। মেহের বাহিরের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় দরজায় আওয়াজ হলো। মেহের পিছনে তাকিয়ে দেখলো মেহরাব ঘরে প্রবেশ করেছে। মেহের কিছু বলল না। চুপ করে জায়গায়তেই দাঁড়িয়ে রইলো। মেহরাব মেহেরকে খেয়াল করেনি। এসেই সে গায়ের পাঞ্জাবী খোলা আরম্ভ করলো। পুরোপুরি খোলা হতেই মেহের সামনে এসে দাঁড়ায়। মেহরাব চমকে উঠে।

পাঞ্জাবীটা বুকের উপর ঢেকে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে মেহরাব বলল, “শাঁকচুন্নির মতো পুরুষ মানুষের ঘরে এভাবে হুটহাট ঢুকে পড়ো কেন ? লজ্জাবোধ কী নেই কিছু ?”

মেহের মেহরাবের সামনে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “তা এখানে পুরুষটা কে ?”

মেহরাব রাগ দেখিয়ে বলল, “কেন, আমাকে কী পুরুষ বলে মনে হয় না ?”

মেহের বলল, “যে পুরুষ এ ঘরে আছে সে আমার লিখিত সম্পত্তি। বৈবাহিক সকল নিয়ম মেনে তার সাথে আবদ্ধ হয়েছি। এ ঘর এখন আমার। অন্য পুরুষের নয়। সো, এখন আমি শাঁকচুন্নি হলেও আপনার স্ত্রী।”

“তাহলে খুব ভালো করে দেখো।” কথাটা মেহরাব ব্যঙ্গ করে বলে শরীর থেকে পাঞ্জাবী সরিয়ে ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। মেহের মুচকি হাসা শুরু করলো। এমন হাসি দেখে মেহরাব কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে রইলো। তারপর হঠাৎই মাথাচাড়া দিয়ে বলল, “এভাবে হাসার কি হলো ?”

মেহের বলল, “আপনার কী দেখবো বলুনতো। সিক্স প্যাক, ফোর প্যাক বলতে বডিতে কিছুই নেই যে আমি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাবো। যা আছে তা ওয়ান প্যাক। তবে এতে আমার সমস্যা নেই। আপনার বডি শেপ দেখে আপনাকে বিয়ে করিনি। আপনার দৈহিক অবস্থা আপনি আমার থেকে নিজেই ভালো জানেন।”

মেহরাব সরে গেলো ওয়ারড্রবের দিকে। এগোতে এগোতে বলল, “মুখে যেন খৈ ফুটে। এই মেয়ে নাকি স্বর্ণ। আমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করালো। স্বামীর সাথে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ পেয়েছে।”

মেহের কথাগুলো স্পষ্টই শুনলো। মেহরাবকে ডেকে সে বলল, “শুনুন, আপনাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করিনি। আপনার উপর যেন আল্লাহ রহমত দেন এবং আপনার অগোছালো জীবনটা গুছানো হয়, সেই আশাতেই আপনার সাথে জড়ানো। প্লিজ, আমি একটু ভালো থাকতে চাই। ইহকাল আর পরকাল, দুই কালই চাই।”

মেহরাব চুপ করে শুনলো মেহেরের কথাগুলো। কোনো উত্তর না দিয়ে একটা টি-শার্ট পড়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। মেহের দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেহরাবের যাওয়ার পানে চেয়ে। হাতের মেহেদীর দিকে তাকিয়ে দেখলো শুকিয়ে গিয়েছে প্রায়। হাতে আর রাখতে ইচ্ছা হলো না। ওয়াশরুমে চলে গেলো হাত ধুয়ে ফেলতে। আসরের আজান হয়ে যাওয়ায় একেবারে অজু সেরেই বের হলো মেহের। নামাজ শেষে দু-হাত তুলে অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য। রবের নিকট যত চাওয়া পাওয়া আর আবদার। এছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই। তিঁনি রহম না করলে কোনোভাবে কোনোকিছু সুন্দর হওয়া সম্ভব নয়।

মেহরাব ঘরে প্রবেশ করে দেখলো মেহেরের কান্না। এই অবস্থায় দেখে মেহরাবের হৃদয়টা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। সে স্পষ্টই মেহেরের মোনাজাতে যাওয়া কথাগুলো শুনছিল। এতটা আবেগ নিয়ে কেউ কারো জন্য রবের নিকট দোয়া করে ? মেহরাবের অস্বস্তি হলো। মেয়েটার সাথে ভালো ব্যবহার এখন পর্যন্ত করেনি। কিন্তু মেয়েটা ইতোমধ্যেই সব গুছিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। মেহেরকে যত দেখছে ততোই যেন অবাক হচ্ছে। নামাজ শেষ হলো মেহেরের। মেহের পাশ ফিরে মেহরাবকে দেখলো। সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। নিজ কান্না ভেজা চোখ অন্য কেউ দেখলে কেমন জানি অস্বস্তি হয় মেহেরের। দ্রুত জায়নামাজ তুলে ভালো করে চোখে মুছে নিলো।

মেহরাব মেহেরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “সন্ধ্যায় আমার কিছু ফ্রেন্ড আসবে। সেজেগুজে তৈরি থেকো। মেহমানের সামনে ক্ষেতের মতো যেও না।”

মেহের তৎক্ষনাৎ বলল, “ফ্রেন্ড কারা? ছেলে নাকি মেয়ে ?”

মেহরাব গর্ব করে বলল, “আমার ক্যারেকটার এত খারাপ নাকি। অবশ্যই আবার সব ছেলে বন্ধু।”

মেহরাব বলল, “আপনার চরিত্র খুবই গন্ধযুক্ত। বলি বউটা কার, আপনার নাকি আপনার বন্ধুদের? পরপুরুষের সামনে নিজের বউকে যেতে বলতে লজ্জা হয় না আপনার ?”

মেহরাব বলল, “এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে ? বউ কি দেখলে কমে যাবে ?”

মেহেরের ভীষণ রাগ হচ্ছে। নিজেকে শান্ত রাখার সবটুকু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মেহরাবকে বুঝিয়ে বলতে হবে ব্যাপারটা। নইলে সে বুঝেও বুঝবে না।

চলবে…