বৃষ্টি নামার পরে পর্ব-০৩

0
4856

#বৃষ্টি_নামার_পরে❤
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

৩.
-“তোমার একটুও লজ্জ্বা নেই গুঞ্জন?অবশ্য কাকে কি বলছি,তুমি তো আসলেই একটা বেয়াদব মেয়ে।”

“গুঞ্জন দু’হাতে চোখ চেপে ধরে রেখেছে।লজ্জ্বায় ও তাকাতে পারছে না,ছিহ!নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে ওর।দরজায় এভাবে লাথি না দিলেও পারতো,তাহলে এমন একটা দৃশ্য ওকে দেখতে হতো না।আসলে গুঞ্জন ভেবেছিলো মৃন্ময় বুঝি ইচ্ছে করেই ওয়াশরুম থেকে বেরুচ্ছে না।তাই যখন দরজায় লাথি দিলো ঠাস করে দরজাটা খুলে গেলো। আর মৃন্ময় সেসময় ওয়াশরুমের ভেতর খালি গায়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো, যদিও টাওয়াল পড়া ছিলো।”

“আর মৃন্ময় হঠাৎ দরজা খুলে যাওয়াতে ব্যাক্কলের মতো তাকিয়ে ছিলো বহুক্ষণ।রাগে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেই গুঞ্জনের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।”

“এদিকে গুঞ্জন চোখে হাত দিয়ে রেখেছে।যতই দোষ ওর হোক না কেন,মৃন্ময়ের সামনে সে দোষ স্বীকার করতে চায় না,তাহলেই সুযোগ পেয়ে গুঞ্জনের উপর কর্তৃত্ব ফলাবে।যেটা গুঞ্জন কখনোই হতে দেবে না।তাই অসীম সাহসিকতার সাথে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,রিডিকিউলাস!এভাবে কেউ দরজা বন্ধ না করে ওয়াশরুমে যায়?”

“মৃন্ময় রেগে বললো,আমি দরজা বন্ধ করবো না না করবো সেটা অভিয়াসলি আমার ব্যাপার।তুমি কোন সাহসে দরজায় লাথি দিলে?”

“গুঞ্জন বললো,আমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে লাথি দেবো।পুরুষ মানুষদের এতক্ষণ ওয়াশরুমে থাকতে নেই।ঘরে নতুন বউ রেখে আপনি একঘন্টা ওয়াশরুম দখল করে রাখবেন,সেটা তো হতে পারে না।টাইম মেইনটেইন করে চলতে হবে, গুঞ্জনের বেলায় কারো কোনো ছাড় নেই।গট ইট!”

“মৃন্ময় একরাশ বিরক্তি নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো।চুলগুলো এলোমেলো,গাল লাল হয়ে আছে,যদিও গুঞ্জন অতটা ফর্সা না।তবুও এলো চুলে মেয়েটাকে দারুণ দেখাচ্ছে।তবে রুপে মুগ্ধ হবার সময় এটা নয়।যে মেয়ে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে পারে,তার সাথে রিভেঞ্জ তো নিতেই হবে।তাই ওর গলায় ঝুলানো টাওয়ালটা গুঞ্জনের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,যত্তসব!”

“গায়ের উপর ভিজে তোয়ালে পড়ায় গুঞ্জনের বেশ ঠান্ডা লাগলো।এমনিতেই ভেবেছে যে,সকাল সকাল গোসল সে করবে না।এখন ভিজা তোয়ালের পানিতে ওর জামাটাও ভিজে গিয়েছে।সোফায় বসে থাকা মৃন্ময়কে দেখে রাগে ওর গা জ্বলছে।এই মুহূর্তে মৃন্ময়ের মাথার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো,মৃন্ময় অনেক ফর্সা।চুলগুলো আর্মিবাহিনীর লোকদের মতো করে ছাঁটা,বেশ লম্বাও।কালো রঙের টি-শার্টে ব্যাটাকে ঠিক কতটা সুন্দর লাগছে সেটা গুঞ্জন বলতে পারবে না।নির্ঘাত এর আর্মিবাহিনীতে চাকরি করার দরকার ছিলো কিন্তু তা না করে ব্যাটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিলো কোন উদ্দেশ্যে গুঞ্জন সেটা বুঝতে পারলো না।অবশ্য মৃন্ময় সেনাবাহিনীতে চান্স পেয়েও যায়নি।গুঞ্জন ফ্যাসফ্যাস করে বললো,আপনি আমার উপর এটা ফেললেন কোন সাহসে?”

“মৃন্ময় এমন একটা ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি।”

“গুঞ্জন আবারও জিজ্ঞেস করলো, একটা মেয়েকে অবলা ভেবে টর্চার করতে আপনাদের মতো পুরুষদের বিবেকে বাঁধে না?কি ভাবেন মেয়েরা ভীতু? তাহলে শুনে রাখুন, আর সব মেয়েরা যেমনই হোক না কেন মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য এই গুঞ্জন একাই যথেষ্ট।মেয়েদের নিজ ইচ্ছেয় চলার স্বাধীনতা অর্জন একদিন আমার হাত ধরেই হবে।দেশে মিছিল হবে, আন্দোলন হবে। পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করবে,একসময় গুলি চালাবে তাতেও এই গুঞ্জন কখনো ভয় পাবে না।দরকার হলে শহীদ হবো,তাও আপনি দেখবেন..আ..মি ”

“মৃন্ময় এক রাম ধমক দিয়ে গুঞ্জনেকে চুপ করালো।ধমক শুনে গুঞ্জনের কলিজা কেঁপে উঠলো।মৃন্ময় রেগে বললো,আর ইউ ম্যাড?এত কথা কিভাবে বলছো?ভিত্তিহীন কথাবার্তা!সবকিছুর একটা লিমিট থাকে,আর তুমি কিসব শুরু করেছো,হুম?”

“গুঞ্জন এবার একটু ভয় পেয়ে গেলো।মানে মানে কেটে পড়াই শ্রেয় মনে করে একদৌড়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।ভাবলো, যাক বাবা বেঁচে গিয়েছি।”

“গুঞ্জনের ভয়ার্ত মুখ দেখে মৃন্ময় খুব আনন্দ পেলো।যাক, একে শায়েস্তা করা গেছে।মাথা খেয়ে ফেললো এই মেয়ে।অতঃপর ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে গেলো অফিসের কাজ করতে।”

________

“সকালের নাস্তা শেষে গুঞ্জন মৃন্ময়ের দাদীমার সাথে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছে।বিভিন্ন ফুলে ভরে আছে পুরো বাগানটা।একদিকে গোলাপ,জুঁইয়ের সমারোহ!কাঠগোলাপ,পার্পল মিল্ক উইড,ক্যাকটাস লাগানো গেইটের পাশে।অন্যদিকে কামিনী আর হাসনাহেনা লাগানো।কামিনী ফুলের সুবাসে ভরপুর পুরো বাগান,গুঞ্জনের খুব পছন্দের।মৃন্ময়ের দাদীমা বললেন,কেমন লাগছে রে তোর?”

“গুঞ্জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট্ট করে বললো,ভালোই!”

-“জানিস,আমি না তোর কষ্টগুলো দেখতে পারছিলাম না,তাই একপ্রকার জোর করেই মৃন্ময়ের সাথে তোর বিয়েটা দিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসলাম!”

-“জানিতো আমি,তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো।অনেকেই হয়তো দেখতে পারেনা আমাকে, কিন্তু শুধু তোমার জন্য আমি কিছু মনে করিনা!”

“দাদীমা গুঞ্জনের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,এখ৷ তোর যা ইচ্ছে তুই তা-ই করতে পারিস।ওই বাড়ি থেকে তো আর কেউ তোর উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারবে না।তুই নিজের স্বপ্নপূরণ করে ওদের দেখিয়ে দিবি!”

“গুঞ্জন এই সুযোগে বলে উঠলো,কথা দিচ্ছো?আমি যা ইচ্ছে করতে পারবো?”

-“হুম,তুই যা করবি তা ভালোর জন্যই করবি আমি জানি।”

“গুঞ্জন বললো,তাহলে আমি যা করবো তোমাকে তা মেনে নিতে হবে দিদা,কিন্তু এটা জেনে রাখবে যে,গুঞ্জন কখনো তোমাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না।”

“দাদীমা মুচকি হেসে বললেন,আচ্ছা।তুই এখন একটা গান শোনা।”

“গুঞ্জন অতি উৎসাহের সঙ্গে বললো,তুমি শুনবে?”

“দাদীমা আগ্রহ নিয়ে বললেন,আরে ওই গানটা গা।আমি যেটা শুনি তোর কাছে।”

“গুঞ্জনের খুব ইচ্ছে করছিলো গলা ছেড়ে গান গাইতে।দাদীমা সবসময় গুঞ্জনের চোখের ভাষা বুঝে যায়।এখনো ঠিক তা-ই হলো।গুঞ্জন গান গাওয়া স্টার্ট করলো,

“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাঁটে
আমি বাইবো না,বাইবো না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে!
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাঁটে
চুকিয়ে দেবো বেচাকেনা,মিটিয়ে দেবো গো!
বন্ধ হবে আনাগোনা, এই হাটে।
আমায় না-ইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
না-ইবা আমায় ডাকলে।
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাঁটে!”

“গান গাওয়া শেষ করে সামনে তাকাতেই মৃন্ময়কে দেখতে পেলো গুঞ্জন। দাদীমা উঠে চলে গেলেন ভেতরে। গুঞ্জন চুটকি বাজিয়ে বলে উঠলো,বদমাইশ ছেলে কোথাকার।আপনি আমার অনুমতি ছাড়া আমার গান শুনছিলেন কেন?”

“মৃন্ময়ের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো।বললো,এভাবে কাকের মতো কা কা করলে সবাই শুনতে পাবে,বুঝলে?”

“মৃন্ময় একটু ভড়কে গেল।বললো,আমি গান পারিনা।”

“গুঞ্জন দাঁত চিবিয়ে বিড়বিড় করে সে বললো,গান পারেননা তো বড় গলা করেন লজ্জ্বা করে না?আবার বেহায়ার মতো বলে,আমি গান পারিনা।যেন উনি কি মহান কাজ করেছে গান গাওয়া না শিখে!যত্তসব নিরামিষ!”

“মৃন্ময়ের মুখখানা অপমানে থমথম করতে লাগলো। বললো,আমি নিরামিষ হলে তোমার সমস্যা হবার কথা নয়।”

“গুঞ্জন মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,তাহলে আর কি?ঘরে গিয়ে দুদু খাও,বার্লি খাও!”

“মৃন্ময় এবার রাগ সামলাতে না পেরে গুঞ্জন যে চেয়ারটাতে বসে ছিলো সেটা ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিলো।”

“গুঞ্জন পড়ে গিয়ে ভীষণ রেগে গেলো।মাটি থেকে উঠে মৃন্ময়ের কলার চেপে ধরে বললো,বদমাইশ পোলা।আমাকে কথায় কথায় ধাক্কা মারাটা কি আপনার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে? চড়াইয়া দাঁত ফালাবো বেয়াদব কোথাকার।”

“মৃন্ময় হতভম্ব হয়ে বললো, কিসব বলছো?”

“গুঞ্জন বললো,আপনি ভেবেছেন আমি গুঞ্জন আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাবো?হুম?তবে জেনে রাখুন আমি…কখনো..আ…প..!”

“মৃন্ময় ভাবছে এর মাথার তার সব ছিড়ে গেলো নাকি।বাসার সবাই এসব ভাষা শুনলে কি ভাববে?ছিহ!এদিকে গুঞ্জন কিছুতেই চুপ করছে না।শেষমেশ মৃন্ময় গুঞ্জনকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো।হাঁটা ধরলো রুমের উদ্দেশ্যে!”

চলবে…ইনশাআল্লাহ!