বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-০৫

0
594

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৫
গগনে কালো মেঘের আনাগোনা।কালো মেঘেরা সূর্য মামাকে যেন আজ আর খোলা আকাশে চিচড়ন করতে দিবে না বলে পণ করেছে।তারা নিজেদের আধিপত্য নিয়ে পুরো জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে খুব করে।সেই সাথে ধরনী ফোটায় ফোটায় ঝরছে বৃষ্টিগুলো।প্রকৃতি যেন বৃষ্টি খেলায় মেতে উঠেছে।উত্তাল বাতাসে বয়ে আসছে ভিজে মাটির গন্ধ। বাহির হতে বৃষ্টির শব্দ আসছে।ঝমঝম,ঝমঝম,ঝমঝম।আর তারা যেন আরাবীকে ফিসফিসিয়ে বলছে,

“সাদা মেঘ আকাশকে ঢেকে,
বেলার কেড়েছে গতি,
রোদ্দুর আজ না হয়
নিলো ক্ষনিকের বিরতি।”

আরাবী আনমনে প্রকৃতি বিলাশে ধ্যানমগ্ন ছিলো।নামাজ পরে মাত্রই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলো আরাবী।হঠাৎ ফোনের শব্দে চকিতো তাকায় ঘরের দিকে।মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট করছে ক্রমাগত।এতো ভোরে কে ফোন দিবে?মনটায় ধ্বক করে উঠলো।মায়ের কিছু হলো না তো আবার?দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো আরাবী।মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে আসলেই ওর মা ফোন করেছে।আরাবী ফোনটা রিসিভ করে বললো, ‘ হ্যালো আসসালামু আলাইকুম মা!’

অপাশ হতে আরাবীর মায়ের কন্ঠস্বর, ‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম! কেমন আছিস আরাবী?’

মায়ের কন্ঠস্বর শুনতে পেরে সস্থির নিশ্বাস ফেললো আরাবী।যাক মা তাহলে ঠিক আছে।আরাবী বললো, ‘ ভালো আছি মা।তুমি কেমন আছো?’

‘ আমার মেয়েটা ভালো আছে শুনে আমিও এখন অনেক ভালো আছি!’ আরাবীর মা বলে উঠলো।

আরাবী ভেজা কন্ঠে বললো, ‘ তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না মা!তুমি এসে পরো না আমার কাছে।আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিবো।ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে আমি একটা চাকরি খুজবো মা।তখন তুমি আমার কাছে চলে এসো আমরা দুজন একসাথে থাকবো।দাদুকেও নিয়ে আসো।তাহলে তো আর কোন সমস্যা নেই তাই নাহ?’

আরাবীর মা’র ও বুকটা ফেটে যাচ্ছে মেয়ের জন্যে।তাও মেয়ের ভালোর জন্যে উনাকে করতে হবে এমন।তিনি বলেন, ‘ একটু সহ্য করে নেহ মা।তুই আগে নিজেকে গুছিয়ে নেহ।তারপর আমি আর তোর দাদু তোর কাছে আসবো প্রমিস।মন খারাপ করিস না মা।আমি ভালো আছি তো।’

আরাবীর মনটা অল্প হলেও শান্ত হলো যেমন।আরাবী বললো, ‘ মা দাদু কেমন আছে?’

আরাবীর মা সয্যাশয়ী শাশুড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘ তিনি খুব ভালো আছেন।তোকে আমি এখান থেকে পাঠিয়ে দিয়েছি শুনে অনেক খুশি হয়েছে।’

আরাবী হঠাৎ ধীর কন্ঠে বলে, ‘ ওই লোকটা কিছু বলেনি মা?আমাকে না পেয়ে বাড়িতে?সত্যি করে বলবে কিন্তু?’

আরাবীর মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘ কি আর করবে ওই দুটো চড় থাপ্পর দিয়েছে যেটা রোজকার দেয়।এটা তো নতুন কিছু না রে মা।আমি শুধু প্রহর গুনছি কবে তোর বাবার মতোন এমন ভরসাযোগ্য কোন রাজকুমারের হাতে আমার রাজকুমারিটাকে তুলে দিবো।তাহলেই যে আমার আর কোন চিন্তা থাকবে না।এরপর এই পৃথিবীর মায়াটুকু কাটিয়ে পারি জমাবো তোর বাবার কাছে।লোকটা যে কতো বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে। একলা কবরে আমার আসার প্রহর গুনছে।’

আরাবী তার মায়ের বাবার প্রতি এতো ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারে নাহ।দ্বিতীয় বিয়ে হওয়া সত্তেও সেই লোকটাকে কোনদিন নিজের কাছে আসতে দেয়নি।সবসময় আরাবীর সাথে থেকেছে একরুমে।কোনদিন এই লোকটার সাথে এক ঘরে থাকেনি।আরাবীর আবার ওই জঘন্য লোকটার একটা দিক ভালো লাগে।সেও তার প্রথম স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন। এখনো ভালোবাসেন তিনি।তাইতো মা’কে বিয়ে করা সত্তেও কোনদিন তার মায়ের কাছেও আসেননি তিনি।এমনকি অন্যকোন মেয়ের কাছে যেতেন নাহ।ওই লোকের এই একটা দিককে আরাবী অনেক সম্মান করতো।আর যাই করুক।লোকটা তো ভালোবাসতে জানে। আরাবীকে কোন কথা বলতে না দেখে আরাবীর মা বলেন, ‘ আরাবী?এখন রাখি হ্যা মা?ওই হানিফ এসে পরবে।তখন তোর সাথে কথা বলতে দেখলে জেনে যাবে সব।তুই মন খারাপ করিস না মা।আমি তোর সাথে সবসময় আছি মা।’

আরাবী না চাইতেও বললো, ‘ আচ্ছা মা ভালো থেকো।’

আরাবী ফোন রেখে আবারও বাহিরে তাকালো।সকাল হয়ে গিয়েছে।বৃষ্টিও থেমে গেছে।বাহিরে গিয়ে একটু হাটাহাটি করলে মন্দ হয়না। প্রাহি শরীরে চাঁদর জড়িয়ে নিলো।বৃষ্টির কারনে বেশ ভালোই ঠান্ডা লাগছে।ঘড়ির দিকে নজর বুলালো আরাবী।সেখানে দেখাচ্ছে সকাল আটটা বাজে।বাহ এতোক্ষন হয়ে গেলো।আরাবী টেরই পেলো না।বাহিরে তাকালে মনে হয় এখনো ভোর। আরাবী মৃদ্যু হেসে রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মুখোমুখি হয় ইফতির।ইফতি আরাবীকে দেখেই হাসলো।বিনিময়ে আরাবীও হালকা হাসলো।ইফতি আরাবীর পাশে এসে বলে, ‘ কিরে ঘুম কেমন হয়েছে?’

আরাবী ধীর কন্ঠে বলে, ‘ ভালো ভাইয়া?’

‘ ভালো না হয়ে কেমনে হবে?যেই কুম্ভকর্নের মতো ঘুমাচ্ছিলি।খাবার খাওয়ার জন্যে মা এতো করে ডেকেছে যে আমিই সেই ডাকে বিরক্ত হয়ে উঠে এসেছি।অথচ তুই উঠলি না।বাহ বাহ তোর ঘুমের তারিফ করতে হবে।’

আসলে কাল কান্নাকাটি করার কারনে আরাবীর প্রচুর মাথা ব্যাথা হচ্ছিলো তাই ঘুমের একটা ঔষুধ খেয়ে আরাবী সুয়ে পরেছিলো।এইজন্যেই শুনতে পায়নি।আরাবী মুখটা একটুখানি করে অপরাধীর ন্যায় বলে, ‘ সরি ভাইয়া।আসলে কাল অনেক মাথা ব্যাথা করছিলো।তাই ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম এই জন্যে শুনতে পায়নি।’

ইফতি যেন এতে খানিক রেগে গেলো।আরাবীকে ধমকে বলে, ‘ মাথা ব্যাথা করেছে চা বা কফি খেতি।ঘুমের ঔষুধ কেন খেয়েছিস?একট চর দেবো ফারদার যদি দেখি এরকম করেছিস।’

আরাবীর মন খারাপ হলো।বললো, ‘ আচ্ছা সরি আর করবো না।’

ইফতি ঠোঁট টিপে হাসলো।এইবার আরাবীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো।আরাবী চমকে গেলো খানিক এতে।বিষ্ময় নিয়ে তাকাতেই ইফতি হেসে দিয়ে বলে, ‘ এমন অবাক হওয়ার কিছু নেই।আমি জানি বৃষ্টির পর তোর সেই ভেজা প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস আছে।আমি জানি তুই এখন বাগানে যাবি।চল আমার সাথে আমিও সেইখানেই যাচ্ছিলাম।’

আরাবী হেসে সম্মতি দিতেই ইফতি আরাবীকে নিয়ে নিচে নেমে আসলো।নিচে আসতেই মিলি আর মিহানের সাথে হালকা কথা বলে ওরা বাগানের উদ্দেশ্যে চললো।এদিকে বাগানে আসতেই প্রাহির মনে যেটুকু বিষাদের রেশ ছিলো।তা যেন একনিমিষে ধুয়ে মুছে মাটিতে পরে গেলো।বৃষ্টির পরে প্রকৃতিটা এতো স্নিগ্ধ দেখায়।এতো সতেজ আর মন মাতানো লাগে যে বলে বুঝানো যাবে না।আরাবী ঘুরে ঘুরে বাগানের সকল গাছগুলো হালকা হাতে ছুইয়ে ছুইয়ে দেখছিলো।আর ইফতির সাথে টুকাটাকি কথা বলছিলো।এমন সময় হঠাৎ ফোন আসে ইফতির মোবাইলে।ইফতি আরাবীকে বললো, ‘ আরাবী আমার একটা ফোন এসেছে তুই বাগানটা দেখ।আমি একটু কলটা এটেন্ড করে আসি। একটু ইম্পোর্টেন্ট কল নাহলে তোকে একা রেখে যেতাম নাহ।’

আরাবী হালকা আওয়াজে বলে, ‘ আরে ভাইয়া এতে এতো সরি বলার কি আছে?তুমি যাও ভাইয়া।আমি এখানেই আছি।’

ইফতি আরাবীর কথা শুনে চলে গেলো।এরপর আরাবী একা একা পুরো বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।পায়ের সেলোয়ারটা অনেক খানি ভিজে গেছে ভেজা ঘাসে হাটার কারনে।আরাবী নিচু হয়ে সেলোয়ারটা হালকা উপরে উঠিয়ে নিলো।তারপর আবারও হাটতে লাগলো।বাগানটা অনেক বড়।এখানে ফল গাছের থেকে ফুল গাছ সবচেয়ে বেশি।তাই এই ফুলের সমারহে যেন এই বাগানের সৌন্দর্য বেরে গিয়েছে দ্বিগুন।বাগানটার ওইপাশে আসতেই দেখে মাঝারি সাইজের একটা সুইমিংপুল। বেশ অবাক হলো আরাবী। পুলটা দেখার জন্যে এগিয়ে গেলো সেদিকটায়।কিন্তু আগাতেই দেখে সেখানে কে যেন দাড়িয়ে আছে। পিছন দিক হতে ভীষন সুদর্শন দেখাচ্ছে লোকটাকে।সুঠামদেহি শরীরে জড়ানো কালো রঙের টি-শার্ট সেই সাথে কালো রঙের টাউজার।পিটপিট করে কিয়ৎক্ষন লোকটাকে পর্যবেক্ষন করলো আরাবী।পরক্ষনে হুশ আসলো কিসব করছিলো ও।একটা ছেলেকে কিনা এইভাবে দেখছিলো আরাবী।ছিঃ ছিঃ আরাবী তুই এমন বেহায়া হলি কবে থেকে?নিজেকে মনে মনে গালি দিতে দিতে আরাবী যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো।কিন্তু হঠাৎ ভরাট গম্ভীর এক পুরুষালি কন্ঠ যেন ওকে জমিয়ে বরফ বানিয়ে দিলো।

‘ এই মেয়ে কে তুমি?আর এখানে কিভাবে আসলে?’

#চলবে_________