বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-০৬

0
586

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৬
বরফের ন্যায় সারা শরীর জমে গিয়েছে আরাবীর।হালকা ঠান্ডা বাতাসে যেন শরীরটা আরো শিরশির করে উঠছে।ধুকপুক করছে হৃৎপিন্ড।কথা গুলো যেন কন্ঠনালিতে এসে থেমে গেছে।আশ্চর্য এতো ভয় কেন লাগছে আরাবীর?একটা প্রশ্নই তো করেছে ওই অচেনা ব্যাক্তিটা।ঝটপট উত্তর দিয়ে দিতে পারলেই তো হয়?তাহলে কেন দিতে পারছে না ও?আরাবী এখনো ফিরে তাকায়নি লোকটার দিকে।এদিকে জায়ান বেশ বিরক্ত বোধ করছে। এইটা কেমন মেয়ে?ও একটা প্রশ্ন করেছে সেটার উত্তর না দিয়ে এইভাবে সং সেজে দাঁড়িয়ে আছে।নিশ্চয়ই এটা ভীষন বেয়াদবি।আর জায়ান তো ওর কেউ সাথে কেউ বেয়াদবি করুক মেনে নিতে পারে না।রাগটা যেন তর তর করে বেরে যাচ্ছে।তাও নিজেকে সংবরন করে।দাঁতে দাঁত চিপে বলে,

-‘ আই আস্কড ইউ আ কুইয়েশ্চেন।আন্সার মি কুইকলি।হু আর ইউ? আর ওদিকে ফিরে আছো কেন?লুক ব্যাক হিয়ার।’

আরাবী প্রায় কেঁপে উঠলো জায়ানের বলা প্রতিটা বাক্য শুনে।তারপরেও আস্তে ধীরে ফিরে তাকালো জায়ানের দিকে।এদিকে আরাবী ঘুরে তাকাতেই জায়ান ভ্রু-কুচকে তাকালো আরাবীর দিকে।আরাবীর পা হতে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করলো।শুভ্র রঙের জামা পরিহত এই মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেনি জায়ান।এদিকে আরাবী চোরা দৃষ্টিতে তাকালো জায়ানের দিকে।তাকাতেই যেন হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রোম।ভীষন সুদর্শন লোকটা।আরাবী আবারও তাকালো।এইবার ভালোভাবে লোকটার মুখশ্রী অবলোকন করলো।
গম্ভীর মুখশ্রী,ওই কালো চোখ দুটোতে যেন কিছু একটা আছে যা আরাবী ঠাওর করতে পারলো না,সরু নাক,পুরু ভ্রুদ্বয়,আর ভ্রুদ্বয়ের মাঝে হালকা একটা কাটা দাগও দেখা যাচ্ছে।জায়ান আরাবীর দিকে তাকাতেই আরাবী দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।মুখ খুলে কিছু বলতে নিবে তার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় ইফতি।এসেই হাপাতে হাপাতে বলে,

-‘ কোথায় গিয়েছিলি?আমি কতো খুজলাম ওখানে।হঠাৎ ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে এখানে এসে দেখি তুই এখানে।’

আরাবী মিনমিনে কন্ঠে বলে,

-‘ সরি ভাইয়া!’

ইফতি মুচঁকি হেসে আরাবীর থেকে চোখ সরিয়ে জায়ানের দিকে তাকালো।তারপর বলে,

-‘ ভাই ও আরাবী।জিহাদ আংকেলের মেয়ে।এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে।কালই এসেছে আমাদের বাড়িতে।’

জায়ান বিরক্ত চোখে তাকালো ইফতির দিকে।ভ্রু উচিয়ে বললো,

-‘ ডিড আই আস্ক ইউ?’

ইফতি মাথা নাড়িয়ে না জানাতেই।জায়ান আবার বলে,

-‘ তাহলে তুই কেন জবাব দিচ্ছিস?ওই মেয়ে কি বোবা?’

আরাবীর রাগ লাগলো।লোকটা ওকে কি বললো ও বোবা? রাগে,দুঃখে কি বলবে ভেবে পেলো না আরাবী।তার উপর আবার এইটা ওই লোকটার বাড়ি।আর সে নিছকই উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়ে।তারা মালিক এই বাড়ির।উনারা কেউ কিছু বললে আরাবীকে সহ্য করতে হবে।আর ছোট বেলা থেকেই আরাবী ঝগরাঝাটি এসব খুব একটা পছন্দ না করতো না।আর খুবই শান্ত আর নম্র স্বভাবের আরাবী।ওর যতো চঞ্চলতা ওর আপন মানুষদের ঘিরে।কিন্তু যবে থেকে আরাবীর বাবা মারা যান।সেদিক থেকে যেন মেয়েটা আরো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। আরাবী চুপ করেই থাকলো।ইফতি আছে এখানে।ইফতিই সামলে নিবে।

এদিকে ইফতি জায়ানের কথার পরিপেক্ষিতে বললো,

-‘ ভাই কিসব বলছো তুমি?আরাবী ছোট থেকেই এমন অপরিচিত কারো সাথে মিশতে ওর একটু সময় লাগে।’

জায়ান বাঁকা হেসে ব্যগ্র কন্ঠে বলে,

-‘ তো আমি কি বলেছি আমি এই মেয়ের সাথে মিশতে চাই বা এই মেয়েকে আমার সাথে মিশতে দিবো?হাহ্ জায়ান সাখাওয়াতের কাছে এতো টাইম নেই।আ’ম জাস্ট আস্কিং হার নেম। কারন হঠাৎ বাড়িতে এমন অপরিচিত একটা মেয়েকে ঘুরঘুর করতে দেখে খানিক খটকা লেগেছিলো আমার। যে হঠাৎ এই অচেনা মেয়ে কোথা থেকে আসলো আবার।’

ইফতি জানে তার ভাই এখন রেগে আছে কোন কারনে তাই এমন করে কথা বলছে।ইফতি পরিস্থিতি সামলাতে বলে,

-‘ আচ্ছা ভাই।আমি চলে যাচ্ছি ওকে নিয়ে।তুমি থাকো এখানে।’

জায়ান আরাবীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,

-‘ ডু হোয়াট-এভার ইউ ওয়ান্ট!’

জায়ান হনহনিয়ে বাড়ির ভীতর চলে গেলো।এদিকে জায়ান যেতেই ইফতি ধীর কন্ঠে বলে,

-‘ আরাবী তুই কিছু মনে করিস না।ভাই এমনি মানে এই অল্পতেই রেগে যায়।?ভাইয়ের পক্ষ হতে আমি সরি বলছি তোকে।’

আরাবী হালকা আওয়াজে বলে,

-‘ আরে কি করছো ইফতি ভাইয়া।আমি কি বলেছি তোমাকে সরি বলতে?আমি কিছু মনে করিনি।নূর আমাকে বলেছে যে ওর ভাই অনেক রাগি।’

ইফতি আরাবীর দিকে কেমন যেন একটা দৃষ্টিতে তাকালো। ঘোরলাগা গলায় বলে,

-‘ তুই অনেক ভালো একটা মেয়ে আরাবী।আর অনেক মিষ্টি দেখতে সাথে খুব খুব সুন্দর তুই।’

আরাবী হকচকিয়ে গেলো ইফতির কথায়।দৃষ্টি হলো এলোমেলো।সেই এলোমেলো দৃষ্টিতে একবার ইফতির দিকে তাকালো।সাথে সাথে বুকটায় ধ্বক করে উঠলো।ইফতির ওই চাহনী আরাবীর সহ্য হচ্ছে না একদম হচ্ছে না।আরাবী ইফতির ধ্যান ফিরাতে খানিক উঁচু কন্ঠে বলে,

-‘ ইফতি ভাইয়া?চলো ঘরে চলো নাস্তা করবে নাহ?’

আরাবীর ডাকে হুশ আসলো ইফতির।মাথা চুলকে বোকার মতো হাসলো ইফতি।তবে কিছু বললো না।আরাবীও কোন কথা না বাড়িয়ে না বাড়ির দিকে যেতে নিতেই।হঠাৎ কারো গলার আওয়াজে থেমে গেলো,

-‘ কিরে ইফতি?আজ শুক্রবার সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠেছে যে তুই এতো সকালে।জীবনে তো বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠিস না।’

ইফতি হাসি মুখে বলে,

-‘ বড়আব্বু মাঝে মাঝে জীবনে এমন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যে একদিনের ব্যাবধানে তা মানুষকে পরিবর্তন করে দেয়।বুঝে নেও আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।’

নিহাদ হাসলো ইফতির কথায়।কিছু বলবে তার আগে নজর যায় ইফতির পাশে আরাবীর দিকে।নিহাদ জিজ্ঞাসুক চোখে তাকালে ইফতি বলে,

-‘ এটা জিহাদ আংকেলের মেয়ে বড়আব্বু!’

নিহাদ যেন অনেক অবাক হলেন।পরক্ষনে বলেন,

-‘ মিহানের ফ্রেন্ড জিহাদ?’

-‘ হ্যা বড়আব্বু! আর ও এখন থেকে আমাদের এখানেই থাকবে।’

ইফতি এইবার আরাবীকে বললো,

-‘ আরাবী এইটা আমার বড় আব্বু।মানে জায়ান ভাই আর নূরের বাবা!’

আরাবী মিষ্টি হেসে সালাম জানালো।নিহাদও সালামের জবাব দিলেন।নিহাদ মায়াময়ী দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে। আরাবীর কাছে এগিয়ে গেলো আরাবীর মাথায় স্নেহপূর্ণ হাত রাখলো।আরাবীর কেন যেন চোখ ভিজে উঠলো।কতোদিন পর ঠিক কতোদিন পর বাবার পর কেউ এতোটা পরম স্নেহ নিয়ে ওর মাথায় হাত রাখলো।আরাবীর কান্না পেলেও কাঁদলো না।এদিকে নিহাদ স্নেহভরা কন্ঠে বলে,

-‘ এখানে নির্দিধায় থাকবে আম্মু।কোন জড়তা রাখবে না।তোমার যখন যেই বাড়িতে থাকতে মন চায় সেখানেই থাকবে।জিহাদ নেই আমি জানি।তবে আমাকে আর মিহানকে তোমার আব্বুর মতোই মনে করতে পারো আম্মু!’

আরাবী হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।নিহাদও হাসলো।ইফতি কিছু বলবে তার আগেই নূর বাড়ির ভীতর থেকে ছুটে আসলো আরাবীর কাছে।আরাবীর হাত ধরে ওকে টানতে লাগলো।এদিকে হঠাৎ এমন ঝড়ের মতো নূরকে আস্তে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো আরাবী।আর এখন ওকে ধরে টানাটানি করায় বলে,

-‘ চলো আরাবী আজ তুমি আমাদের সাথে নাস্তা করবে।চলো আমার সাথে।’

আরাবী অবাক হয়ে বললো,

-‘ আরে না মানে।থামো শুনো তো আমার কথা!’

-‘ শুনবো না। এই ইফতি ভাইয়া আমি আরাবীকে নিয়ে যাচ্ছি।’

ইফতি এগিয়ে আসলো আরাবীর আরেকটা হাত আকড়ে ধরে বলে,

-‘ না ও যাবে না।ও আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করবে।তুই যা তোর সাথে যাবে না ও।’

নূর কাঁদো গলায় এইবার নিহাদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-‘ আব্বু এইটাকে কিছু বলবা?সবসময় আমার সাথে এমন করে।আমি আরাবীর সাথে ব্রেকফাস্ট করবো।নাহলে আমি আজ ব্রেকফাস্ট করবো না।’

নূরের জেদ ধরা কথা শুনে হাসলেন নিহাদ।বললেন,

-‘ ইফতি জ্বালাস না ওকে।আরাবীকে নিয়ে যাক।তুই ও চল আমাদের সাথে।’

ইফতি আরাবীর হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

-‘ নাহ বড়আব্বু।মা আর বাবা বসে আছে আমার জন্যে।তোমরা যাও নাস্তা করো।আমি আরেকদিন করবো নেহ। আরাবীকেই নিয়ে যাও!’

অনুমতি পেয়ে নূর খুশি মনে আরাবীকে নিয়ে যেতে লাগলো।এদিকে আরাবী ভয়ে সিটিয়ে আছে।সাথির মুখোমুখি হতে হবে ওকে আবারও।ভেবেই হাতপা ভয়ে শীতল হয়ে আসছে।আরাবী সাথির ওই তীক্ষ্ণ চাহনী সহ্য করতে পারেনা।তিনি আরাবীকে একদম পছন্দ করেনা তা আরাবী খুব ভালো করেই জানে।তাই তো ও যেতে চাচ্ছে না নূরদের বাড়িতে।কিন্তু এই নূরকে থামাবে কিভাবে?ধুরুধুরু বুক নিয়ে আরাবী নূরের সাথে চললো ওদের বাড়িতে।

#চলবে___________

ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।