বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-১০+১১

0
397

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১০

আঁধার রাত। ঐশানীর পাশে ঐশী ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। ঘুমানোরই কথা! হলুদ থেকে মেহেদী শেষ হতে রাত প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল। সবাই ক্লান্ত অবস্থায় শুয়েছে। ঘুম নেই শুধু ঐশানীর। কথায় বলে, বিয়ের আগে টেনশনে কোনো ছেলে বা মেয়েরই ঘুম আসে না। কারণ পরেরদিন থেকে এক নতুন জীবনের সূচনা হওয়া কি কম বড় কথা? পাশে ঘুমিয়ে থাকার জন্য একজন মানুষ চলে আসবে ঐশানীর জন্য। আদোও লোকটা তার পাশে ঘুমোতে দেবে কি না তার ঠিক নেই। এক অনিশ্চয়তায় ভুগছে সে। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে সে বিয়ে করতে চায় না।

চোখ বুজে থেকে থেকে ঘুমানোর এক্টিং করে করে বিরক্ত এসে পড়ে ঐশানীর চোখে পাতায়। উঠে বসে পড়ে সে। জানালার দিকে তাকায়। অতিরিক্ত গরম থাকায় জানালা খোলা। দমকা হাওয়ায উড়িয়ে দিচ্ছে জানালার সাথে লাগানো পাতলা পর্দা। উঠে দাঁড়ায় ঐশানী। দুই পা বাড়াতেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। চমক খেয়ে থতমত হয়ে তাকায় দরজার দিকে। রাত প্রায় আড়াইটার কাছাকাছি।
–“ইয়া আল্লাহ, এই হোটেলে ভূত-প্রেতের উৎপাত আছে জানতাম না তো। ভূতের তো বেশ ম্যানার্স আছে। নক করে ঢুকতে চাইছে।”

বিড়বিড়িয়ে নিজের আপনমনে কথাগুলো বলতেই আবারও ঠকঠক আওয়াজ হয়। ঐশানীর হাঁটু কাঁপতে শুরু করে ভয়ে। এখন তার সবকিছু ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকলেও যেন কেউ পা টেনে নিয়ে যাবে। ঝড়ের গতিতে দৌড়ে নিয়ে লাফিয়ে বসে পড়ে বেডে। সাদা চাদরটা টেনে নিজের মুখচোখ ঢেকে ফেলে। ঠকঠক আওয়াজ হয়েই যাচ্ছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ঐশানী পিছাতে শুরু করে বেডে। ঐশী ঘুমের মাঝে বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে সরে যায়। ঐশানী ধাক্কা দিয়ে ঐশীর উদ্দেশ্যে বলে…..
–“ঘুমের মধ্যে তোর পেনসিল মার্কা বফরে দেখা বন্ধ করে একটু বাস্তবে আয়। ভূত ঢু…ঢুকতে চাচ্ছে।”

ঐশী চোখমুখ জড়িয়ে পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকায় আবারও চোখবুঁজে ঘুমিয়ে পড়তেই ঐশানী এক ঠেলা মারে তাকে।
–“উফফ…আপু এমনি গাল ব্যাথা করছে তোর জন্য। চড় খেতে হলো কত জোরে। দাঁত নড়েছে কি না চেক করতে হবে। আর তুই রাতেও কান্ড বাঁধাচ্ছিস?”
–“আরে আমি না ভূত!!”
ঐশী এবার চোখ খোলে। চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায় তার। চোখ ঢলতে ঢলতে উঠে বসে। হাই তুলে বলে….
–“বিয়ে ভাঙার চিন্তায় কি পাগল হয়ে গেলি নাকি আপু?”

ঐশানী কিছু না বলতেই দরজায় আবারও নক করার শব্দ হয়। ঐশী এবার নিজেও চমকে তাকায়। দুজনে চোখাচোখি করে ঐশী সাহস নিয়ে বলে….
–“হতে পারে কেউ দরকারে এসেছে। যা খুলে দে।”
–“আমি পারব না। যদি আমাকে সাথে করে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আমি শ্যামলা ঘোড়াকে বিয়ে করতে রাজি বিশ্বাস কর। তবুও ভূতের সাথে যাব না।”
এক পাহাড় সমান ভয় নিয়ে বলে ঐশানী। ঐশী ভেংচি কেটে ল্যাম্পশিট জ্বালিয়ে উঠে যায়। ঐশানী পেছন থেকে বলে….
–“তোর পেনসিল মার্কা বয়ফ্রেন্ডের কি হবে রে? সব থেকে বড় কথা আমাদের কি হবে যাস না।”

ঐশী জবাব না দিয়ে খুলতেই এবার সেও ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। অপ্রস্তুত হয়ে বলে….
–“অভয় ভাইয়া, আপনি?”
অভয় গম্ভীর ভাবভঙ্গি নিয়ে বলে ওঠে….
–“আসলে তোমার বোনের সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল আমার। অনেক ভাবলাম তবে বুঝতে পারলাম যে কথাগুলো না বললেই নয়।”
–“আচ্ছা ঠিক আছে ভেতরে আসুন।”
অভয় ভেতরে ঢোকে। অভয় থেকে ঐশানী চাদর ফেলে দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসে। ফুঁসে উঠে বলে….
–“আপনার কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই হ্যাঁ? কত ভয় পেয়েছি জানেন? হার্ট অ্যাটাক হতে হতে বেঁচে গেল।”

অভয় ঐশানীর কথায় পাত্তা না দিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে ঐশীকে বলে….
–“একটু বাহিরে যাবে? কথাগুলো পারসোনাল। জাস্ট টেন মিনিটস।”
ঐশী কি বুঝল তা কেউ জানে না। শুধু মুখ টিপে হেসে ‘সিউর’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
অভয় গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিতেই ঢক গিলে ঐশানী। ভয়ে মিনমিন করে নিজেকে বলে….
–“এ কেমন ছেলের পাল্লায় পড়লাম আমি? ক্যারেক্টারের সমস্যা আছে মনে হচ্ছে। এখন কি আমি যা ভাবছি তাই হবে?”
ভয়াতুর মুখ নিয়ে তাকায় ঐশানী অভয়ের দিকে। অভয়কে এগিয়ে দেখে পিছাতে থাকে সে।

ভয়ের কারণে ঐশানীর ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অভয় ঐশানীর পিছুতে দেখে আগাতে থাকে। ভ্রু নাচিয়ে বলে….
–“পিছচ্ছ কেন? ভয় লাগছে?”
ঐশানী মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। চেষ্টা করেও পারছে না কিছু বলতে। অভয় তা দেখে আবারও বলে….
–“অন্য সময় তো কথার ঝুড়ি নিয়ে বসো। আজ কি হলো? সম্মান যাওয়ার ভয় করছে?”
–“দে…দেখুন আপনি কিন্তু ঠিক ক….করছেন না। সরে যান।”
অভয় সরে না। আরো এগিয়ে এসে ঐশানীর ওড়নায় হাত ছোঁয়াতেই চোখজোড়া হাত দিয়ে ঢেকে জোরে বলে….
–“আজ আমি শেষ।”

বেশ কিছুক্ষণ পরেও যখন ঐশানী অনুভব করে তার সঙ্গে মোটেও কিছুই হয়নি হাত সরায় চোখ থেকে। অভয় তার থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অভয় দাঁতে দাঁত চেপে বলে….
–“ঠিক এভাবেই ভয় পেয়েছিলাম তোমার জন্য। যখন তুমি জ্বরের ঘোরে আমার সাথে……”
মাঝপথে আর বলতে পারে না অভয়। ঐশানী মুখ বেঁকিয়ে বলে….
–“এমন ভাব ধরছেন যেন আপনার সাথে ইচ্ছে করে এসব করেছি। আপনার সাথে শাহরুখ খানকে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। নয়ত আপনার সাথে? ছি! আমার চয়েস এতোটা খারাপ না।”

অভয় তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে ঐশানীর শেষ কথায়। মানে টা কি? সে কি এতোটাই খারাপ? ঘায়েল করা চোখজোড়া, প্রসারিত দেহের অধিকারী, খাঁড়া নাক, লম্বাচওড়া সব থেকে পারফেক্ট। ওর সৌন্দর্য আরেকটু বেশি বেড়েছে থুঁতনি দুটো ভাগ হওয়ায়। থুঁতনির নিচের দিকে মাঝে একটা ভাঁজ আছে অভয়ের। যা থুঁতনিকে দুটো ভাগ করে ফেলেছে। যার কারণে তাকে আরেকটু বেশি আলাদা সুদর্শন লাগে। দেওয়ালে জোরে হাতটা রেখে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে….
–“এই মেয়ে এই! তুমি কি মিন করতে চাইলে? আমি বাজে দেখতে? আমেরিকান কিছু কিছু মেয়েরা অবধি আমার পেছনে ঘুরেছে টাকা এবং আমি সুর্দশন সেকারণে। আর তুমি বলছো আমি খারাপ দেখতে?”

–“আমার চোখে আপনি কেমন মানুষ, আপনি কেমন দেখতে সেসব জেনে আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?”
অভয় ঐশানীর এই প্রশ্নে নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। চোখ নামিয়ে নেয়। সত্যিই তো! ঐশানীর চোখে সে কি তা জেনেই বা কি হবে? ঐশানীকে তো একদিন তার জীবন থেকে দূর হয়ে যেতেই হবে। হালকা কেশে অভয় বলা শুরু করে….
–“আসলে আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে এসেছি।”
–“কি এমন কথা যে মাঝরাতে আমাকে একান্তে এসব কথা বলতে হবে?”

–“তোমাকে আমি কোনোকালেই বিয়ে করতে চাইনি ঐশানী। তোমার প্রতি আমার একটা চাপা ক্ষোভ রয়েছে সেটা কি জানো?”
–“না জানার কি আছে? আপনার প্রতিটা কাজকর্মেই টের পাই আমি। এটা নিশ্চয় ওই সেদিনের ডেয়ারের কারণে। যার কারণে আপনার গার্লফ্রেন্ড আপনাকে ভুল বুঝেছিল তাই না?”
অভয়ের দিকে অদ্ভুত চাহনি নিক্ষেপ করে বলে ঐশানী। অভয় হ্যাঁবোধক মাথা নাড়াতেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ওঠে ঐশানী।

–“আজও আপনার গার্লফ্রেন্ড এর রাগ এবং সন্দেহ ভাঙাতে পারেননি? একটা প্রেমিকাও জুটিয়েছেন! যে কিনা পান থেকে চুন খসলেই সন্দেহ করে। আপনার বিরক্ত লাগে না? আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না এতো সন্দেহ নিয়ে আপনাদের ভালোবাসা হয় কি করে? ভালোবাসা ঠুনকো বিশ্বাসের ওপর তৈরি হয় না। ভালোবাসার মূল মন্ত্র হচ্ছে বিশ্বাস। যেই বিশ্বাস যখন একে অন্যের ওপর না থাকে সেটাকে ভালোবাসা নয় মোহ বা ভালোলাগা বলে। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি ওই মেয়ে আপনাকে ভালো টালো বাসে না।” (কিটকিটিয়ে হেসে)
–“শাট আপ! আমি তোমার কাছে কোনো ভালোবাসার সার্টিফিকেট চাইতে আসিনি। নিজে তো কখনো কাউকে ভালোবাসো নি। আবার ভালোবাসার সংজ্ঞা ঝাড়ছো?”

অভয়ের ধমকানিতে হাসি থেমে যায়। নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেঝের দিকে। অভয় তিক্ত মেজাজ নিয়ে বলে ওঠে…..
–“আমি তোমায় বিয়ে করব না বলে চাকরি খুঁজতে গিয়েছিলাম। যাতে চাকরি পেলে বিয়েতে না করতে পারি আর সায়রার সাথে অন্যকোথাও বিয়ে করে থাকতে পারি। কারণ বাবা বলেছিল, সায়রাকে বিয়ে করলে আমায় ত্যায্যপুত্র করে দেবে। মনে আছে সেদিন তুমি আমার বাইকের সাথে এক্সিডেন্ট করেছিলে ইচ্ছে করে? ওইদিন ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনটা সায় দিল না। যতই হোক পরিবারকে আমি ভালোবাসি। তাই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ইন্টারভিউটা দিতে পারিনি। কিন্তু এটা নয় যে সায়রাকে আমি ভালোবাসি না।”

ঐশানী খেয়াল করে অভয়ের কন্ঠস্বর কাঁপছে সায়রাকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলতে গিয়ে। দাঁত কেলিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে সে অভয়কে।
–“ভালোবাসি বলতে কন্ঠস্বর যখন কাঁপে। তখন যেই কন্ঠস্বর দিয়ে জোর করে ভালোবাসি না বলাই ভালো।”
অভয়ের নিরবতার সুযোগ নিয়ে ঐশানী আবারও প্রশ্ন করে……
–“আমাকে কি করতে বলছেন এখন? বিয়েতে না করতে? আগেই বলে রাখি এটা আমার দ্বারা সম্ভব না। আপনি যেমন আপনার পরিবারকে ভালোবাসেন তেমন আমিও আমার পরিবারকে ভালোবাসি। বিশেষ আমার বাবার অপমান হবে এই বিয়ে ভাঙলে। উনার মাথা নিচু হবে। সেটা আমি চাই না।”

–“বিয়ে ভাঙতে বলছি না তোমায়। জাস্ট বিয়ের পর দূরে দূরে থাকবে।”
ঐশানী তেতিয়ে উঠে বলে….
–“আহা, আমার যেন হার্ট নাগিন ড্যান্স দেই উনার কাছে যেতে। আজকে শুধু শাহরুখ খানকে আপনার মাঝে দেখেছিলাম তাই। নয়ত আপনার ছায়াও মাড়ায় না। হুহ। শ্যামলা ঘোড়ার আর শাহরুখ খানের নামের মাঝে একটা মিল আছে না? দুটোই ‘শ’ দিয়ে শুরু হয়। তাই গুলিয়ে ফেলেছিলাম।”
অভয় কটমট করে তাকায় ঐশানীর দিকে। ধীরে ধীরে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে….
–“কি বলছি আর ফাজিলের মহারানী কি বুঝছে! জাস্ট টু মাচ!”

দরজায় নক পড়ায় ধ্যান ভাঙে দুজনের। বাহির থেকে ঐশী ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে ওঠে….
–“আরে অভয় ভাইয়া, কালকে থেকে তো আপু পারমানেন্টলি তোমার বাড়িতেই শিফট হবে না? তখন যত পারসোনাল, পাবলিক, কনফিডেনসিয়াল কথাবার্তা বলে নিও। এখন তো ঘুমোতে দাও প্লিইইইজ!”
অভয় গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে ঐশীকে ছোট্ট করে ‘সরি’ বলে চলে যায়।
ঐশী হেলেদুলে এসে বেডে গা এলিয়ে দেয়। ঐশানীও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এসে শুয়ে পড়ে। রাতটা এভাবেই কেটে যায়।

সকাল হতেই চারিদিকে বিয়ে নিয়ে হইহই পড়ে গেছে। ব্যস্ত মানুষেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বর-কনেকে মিলিয়ে দিতে। কথায় আছে, যার বিয়ে তার খবর নেই পাড়াপড়শির ঘুম নেই। এখানেও ঠিক তেমন। যেই দুই মানুষকে তারা বিয়ের বন্ধন আবদ্ধ করতে যাচ্ছে তারা নিজেই একে অপরের ওপর উদাসীন! অন্যদিকে ঐশী সহ ঐশানীর বান্ধবী ও ঐশানীর কাজিনদের চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে এই নিয়ে যে, তারা বরপক্ষ আসার পর গেট ধরে টাকা আদায় করতে পারবে না। কারণ বিয়েটা একই হোটেলে হচ্ছে। তার ওপর অভয়ের না রয়েছে কাজিন আর না রয়েছে বন্ধুবান্ধব। বন্ধুরা সব আমেরিকার। সবাই দেবদাসের মতো সেজেগুজে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

–“ঐশানী তোর হলো? অভয়ের হয়ত ওদিকে হয়ে গেছে।”
মিসেস. দিশার কথায় কোনো হেলদোল হলো না ঐশানীর। পাশে থাকা দুজন মেকআপ আর্টিস্ট এতোক্ষণ ধরে কি সাজিয়ে চলেছে কে জানে! বোর হয়ে হাই তুলে মায়ের দিকে তাকায় সে। ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বলে…..
–“মা আমি ঘুমাবো! ঘুমানোর সময় হবে?”
অবাক আকাশের সর্বসীমায় ওঠেন মিসেস. দিশা। চোখ আকাশে তুলে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলেন….
–“একদম না। বিয়ের দিন আর তুই ঘুমাবি? আমার মাঝে মাঝে চিন্তা হয় তোর উদ্ভট কাজকর্ম আর কথাবার্তা নিয়ে। শ্বশুরবাড়ি যাবি কোনো পার্কে বেড়াতে যাবি না।”

–“ওটা পার্ক নয় মা। ওটা চিড়িয়াখানা। একটা সুন্দর শ্যামলা ঘোড়া আছে দেখো না?”
–“আবার?”
ধমকে বলেন মিসেস. দিশা। ঐশানী ঠোঁট উল্টে আয়নার দিকে তাকায়। লাল রঙের ভারি কাজ করা বেনারসি বইতে পারবে কি করে এতোক্ষণ ভাবছে সে। তার ওপর হাত ভর্তি চুড়ি। হাতটা নাড়াতে পারবে তো? গলায় লাগানো মোটা সোনার হার। মাথায় টায়রা পড়ানো। নাকে আবার মোটা নথ! বিয়ের সাজে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে ঐশানীর মাঝে। অনন্য লাগছে তাকে। তার এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা যেন গ্রাস করে দেবে সবাইকে। বেশ কিছুক্ষণ নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বকতে বকতে চলে গেলেন মিসেস. দিশা।

অভয় আয়নায় নিজেকে ভালোভাবে দেখে নেয়। তার পরনে সাদা শেরওয়ানি। সাদা শেরওয়ানির ওপর সোনালি কাজ করা। তা উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ে বেশ মানিয়েছে। মাথায় সাদা পাগড়ি। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রেখে দিয়েছে গালে।
–“আজ বর তো সেজেছি কিন্তু অন্য জনের জন্য!”
বলেই একটা শ্বাস নেয় অভয়। দরজা খুলে ঢুকে আসেন রাহাত সাহেব। দূরন্ত কন্ঠে বলেন….
–“হলো তোর?”
–“হুমম।”
অভয়কে সাথে করে নিয়ে যান রাহাত সাহেব। বসে পড়েন বিয়ের আসরে। কাজি সাহেব উপস্থিত রয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর কাজি সাহেব বলেন কনে কে নিয়ে আসতে। ঐশীসহ বেশ কয়েকজন মিলে উঠে যায় সিঁড়ি দিয়ে ঐশানীকে নিয়ে আসার জন্য। বেশ খানিকক্ষণ পরে যখন তারা আসে না ঐশানীকে নিয়ে সন্দেহ হয় অভয়ের। এই মেয়েটা কি পালিয়ে গেল নাকি? মনে মনে খুশি হয় সে। পালিয়ে গেলে ভালোই হবে। বিয়ে করতে হবে না।
হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসে ঐশী। অভয় এবার সিউর ঐশানী পালিয়েছে। যাক মেয়েটার দ্বারা একটা ভালো কাজ তো হলো! মিসেস. দিশা চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করেন….
–“কিরে? তোর আপু কোথায়?”
ঐশী এবার যা বলল এর জন্য মোটেও কেউ প্রস্তুত ছিল না।
–“আপু! আ…আপু তো ঘুমিয়ে পড়েছে।”

চলবে…..

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১১

–“আমারই ভুল হয়েছে। ওই মেয়েটার থেকে এমন কিছু এক্সপেক্ট করাই ঠিক হয়নি। ভাবলাম শেষমেশ আমার জন্য একটা ভালো কাজ করে যাবে। ও তো শুধু গন্ডগোল পাকাতে জানে। উফফ….!”
অভয়ের ভাবনার ওপর পানি ঢেলে দিয়ে ঘুমোচ্ছে ঐশানী। রাগে-দুঃখে কি রিয়েকশন দিবে সেটা অভয়ের নিজেরই বোধগম্য হচ্ছে না। মেয়ের কর্মকান্ডে মিসেস. দিশা নিজেই থতমত খান। এবার উনার সন্দেহ হতে শুরু করে। একি আদোও নিজের মেয়ে? বিশ্বাস হয় না! মিসেস. দিশা সবকিছুতেই বরাবরের মতো সিরিয়াস থাকেন। তার মেয়ে কিনা এতো ছন্নাছাড়া ভাবের। আশেপাশে সবাই প্রাণ খুলে হাসছে। তা দেখে উনার মাথা কাটা যাচ্ছে লজ্জায়। তবুও একটা জড়ো হাসি দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলেন…..

–“আজ ঐশানীর বিয়ে তো। তাই গতকাল ঘুমোতে পারেনি। তাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি দেখে আসছি।”
বলেই মাথার কাপড় ঠিকঠাক করে ঐশীকে নিয়ে ঐশানীর ঘরে যেতে লাগলেন। কাঠকাঠ গলায় বলেন….
–“ঘুমিয়েছে মানলাম। তোরা তুলে ডেকে আনতে পারিসনি? এসে সবার সামনে চিল্লিয়ে বলতে হবে আপু ঘুমিয়েছে? মানসম্মান আর রাখলি না।”
–“আরে মা। আমরা দূর থেকে ডাকছিলাম। অনেকবার ডেকেছি। কিন্তু আপু উঠছে না। জানো তো আপু ঘুমিয়ে পড়লে সহজে জাগতে চায় না। কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে নাড়িয়ে ডাকতে পারিনি কারণ আপু যদি অভয় ভাইয়ার মতো গালে চুমুটুমু দেয় তখন?”

মিসেস. দিশা চোখ গরম করতেই মুখটা বন্ধ করে চলতে শুরু করে ঐশী। রুমের ভেতরে ঢুকতেই তারা দেখতে পায় ঐশানীর বান্ধবীরা দেদারসে ডেকে যাচ্ছে। ঐশানী একটু একটু নড়চড় করে তাকিয়ে আবার চোখ বুজতেই মিসেস. দিশা গিয়ে বসেন তার পাশে।
–“বিয়ের দিনে কেউ এতোটা গাঢ় ঘুম দেয়? ঐশানী উঠে পড়। নয়ত পানি ছিটিয়ে দেব মেকআপ ধুয়ে যাবে।”
–“আরেকটু ঘুমায় না আম্মু। এতোক্ষণ কাকগুলো আমার মাথাব্যাথা ধরিয়ে দিল। তুমিও শুরু করো না প্লিজ।”

বলেই মায়ের হাত সরিয়ে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে মাথা তুলে মায়ের কোলে রেখে শুয়ে থাকে ঐশানী। ঘুম জড়ানো গলায় আবার বলে…..
–“আজ তো চলেই যাব না? আর তো যখন তখন এভাবে কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারব না।”
মিসেস. দিশা দুর্বল হয়ে পড়েন মেয়ের কথায়। আসলেই যখন তখন ঐশানীর পাগলামি দেখতে পাবেন না তিনি। বুকটা ধক করে ওঠে উনার। দুটো মেয়ে ছাড়া যে বাড়ি পুরোটা ফাঁকা লাগবে! চোখ ভরে পানি আসে। তবে মুছে নেন আড়ালেই। অনেকটা বুঝিয়ে শুনিয়েও যখন ঐশানীকে উঠানো গেল না তখন বকাবকি করে বসিয়ে দেন মিসেস. দিশা।

আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ঐশানী। হাই তুলতে তুলতে যখনই চোখ ডলতে যাবে তখনই রিনি হাত ধরে সিরিয়াসভাবে বলে….
–“চোখে হাত দিস না দোস্ত। এক ঝটকায় পরী থেকে পেত্নীতে রুপান্তরিত হবি। তখন মেকআপ ঠিক করতে করতে দুনিয়া আন্ধার হয়ে যাবে।”
ঐশানী এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে….
–“বিয়ে করতে কতক্ষণ লাগবে? ত্রিশ মিনিটে হবে? আমি আবার ঘুমাবো।”
–“চুপ চুপ। বিয়ের দিনেও থাপ্পড় খাবি মায়ের হাতে।”
ফিসফিসিয়ে বলে ঐশী। ঐশানী থম মেরে মায়ের দিকে তাকায়। সবাই যখন ওকে বিয়ের আসরে নিয়ে যেতে উদ্যত হয় তখনই আঁটকে দেন মিসেস. দিশা।

–“দাঁড়া তোরা।”
–“কেন আন্টি? বিয়েতে যাবে না?”
অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে মেঘনা। মিসেস. দিশা গম্ভীর মুখে উত্তর দেন….
–“কি করে যাবে? পারবে না তো।”
ঐশানীর মনটা হঠাৎ করেই নেচে ওঠে। মনটা তিড়িংবিড়িং করে বলে….
–“ঐশু! মনে হয় মা বিয়েটিয়ে দেবে না আর। নিশ্চয় কিছু বুঝেছে। ঐশানীর জিনিয়াস মা কিনা! বিয়ে ভাঙলে কোন ডান্সটা দিবি বল? কালা চশমা নাকি নাগিন ডান্স?”
ঐশী তাড়াহুড়ো করে প্রশ্ন করে…..
–“কেন মা কি হয়েছে?”

–“আরে ও বিয়েতে যাবে কি করে? ওর কান দুটো দেখেছিস? ফাঁকা করে রেখে দিয়েছে। এভাবে বিয়ের আসরে বসলে লোকে কি বলবে? এই ঐশানী কানের দুল কথায় রেখেছিস?”
নিমিষেই ঢেকে গেল ঐশানীর গজদাঁতের হাসি। মুখটা অসহায় করে জবাব দেয়….
–“খুব ভারি লাগছিল তাই খুলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছি।”
মিসেস. দিশা নিজহাতে মেয়েকে কানে দুল পরিয়ে পাঠিয়ে দেন মেয়েকে বিয়ের আসরে সবার সাথে। উনি পেছন পেছন আসেন।

বিয়ে পড়ানোর শুভ মূহুর্ত চলছে। কাজি সাহেব বিয়ে পড়াতে মগ্ন। পাত্রপক্ষ আর পাত্রীপক্ষের সামনে পাতলা পর্দা। সবার মাঝখানে ঝিম মেরে বসে আছে ঐশানী। মুখটা শুকিয়ে গেছে তার। যতই হোক এটা তার বিয়ে! সারাজীবনের ব্যাপার। চেয়েও হেলাফেলা করতে পারছে না। বারংবার নিজের মনকে শক্ত করতে চেয়েও শুধু কাঁদতে মন চাচ্ছে। যার মনে অন্যকেউ বসবাস করে তার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া কি ঠিক? এসব ভাবতে ভাবতে কাজি সাহেব হঠাৎ অভয়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন….
–“তিনবার কবুল বলুন।”

ঐশানীর নিশ্বাস ওঠানামা করতে থাকে। জোরে মুঠো করে নিজের বেনারসি। পলকহীন চোখে সাদা পাতলা ফিনফিনে পর্দা ভেদ করে দেখতে থাকে অভয়কে। একটা শুকনো ঢক গিলতেই অভয় একটু সময় নিয়েই একদমে তিনবার কবুল উচ্চারণ করে। তা শুনে এক নিশ্বাসে যেন ঐশানীর প্রাণটা বেরিয়ে আসে। চোখটা পলক পেলে বন্ধ করে নেয়। তার কানে ভেসে আসছে সবার আলহামদুলিল্লাহ বলা!

–“এবার কন্যার পালা। তিনবার কবুল বলুন।”
ঐশানীর গা শিরশিরানি দিয়ে ওঠে। শুধু তিনবার কবুল আর দুজনকে এক করে দেওয়া হবে? ভাবতেই কেঁপে ওঠে ঐশানী। তবে সমাজের দৃষ্টিতে এক হলেও বাস্তবে তাদের এক হওয়াটা পৃথিবীর অসম্ভব ব্যাপারগুলোর মাঝে একটা। সাইড চেপে ভীরু কন্ঠে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করে….
–“কবুল কি বলতেই হবে?”
–“ওমা, এটা আবার কেমন কথা? কবুল না বললে বিয়ে হবে কেমন করে?”

ঐশানীর গলা মূহুর্তেই শুকিয়ে এলো। সবাই উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারা অপেক্ষা করছে ঐশানীর মুখ থেকে কবুল শোনার। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে ফট করেই তিনবার কবুল বলে ঐশানী। সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে সবাই বলে ওঠে আলহামদুলিল্লাহ। দোয়া করা হয়, মিষ্টিমুখ করা হয়। রাহাত সাহেব এবং ইমতিয়াজ সাহেব জড়িয়ে ধরেন একে ওপরকে। মুগ্ধ হয়ে রাহাত সাহেব বলেন…
–“অবশেষে আমরা একে ওপরের বেয়াই রে। এই আনন্দ কই রাখি?”
–“যেখানে ইচ্ছা রাখ। শুধু আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিস। ভরসা করে তুলে দিলাম তোদের হাতে।”

মুখে হাসি নিয়ে দুর্বল কন্ঠে বলে ওঠেন ইমতিয়াজ সাহেব। রাহাত সাহেব উনার কাঁধ জড়িয়ে বেশ কনফিডেন্সের সাথে বলেন…..
–“আরে বেটা! তোর মেয়ে কি আমার মেয়ে নয়? শুধু দেখবি তোর মেয়েটা কত সুখে থাকবে।”
কথাটি শুনে স্বস্তি পান ইমতিয়াজ সাহেব।

খাওয়াদাওয়া শেষে বিদায়ের পালা শুরু হয়। ঐশানী কেঁদে কূল পাচ্ছে না। বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে চলেছে। একে একে পালা পালা করে সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মেয়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে ইমতিয়াজ সাহেব ভেতরে চলে আসেন। মিসেস. দিশা চোখেমুখে কাপড় ঢেকে কাঁদছেন। তার সংসার টা আর ঐশানীর পাগলামি দ্বারা মাতবে না। শুনতে পাবেন না মেয়ের মুখ থেকে, ‘আম্মু শোনো আমাকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। এখন খিদে পেয়েছে। খেতে দাও।’

সব শেষে ঐশীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে ঐশানী। ঐশী তো নাকের পানি, চোখের পানি একজায়গায় করে কাঁদছে। হুট করেই মূহুর্তেই নিরব হয়ে যায় সে। জড়িয়ে থাকা অবস্থায় ঐশানীর কানে কানে বলে…..
–“এই হুদাই প্যাচপ্যাচ করে কাঁদছিস কেন আপু? জাস্ট তো কয়েকটা মাস। তারপর আবার বাড়িতে!”
ঐশীর কথায় ঐশানীর কান্না বন্ধ হয়ে যায়। অতিরিক্ত এক্সাইটেড হয়ে বলে….
–“কি করে?”
–“তোর কথা যদি সঠিক হয় অভয় ভাইয়ের গফ আছে। যদি ওদের প্রেমের কাঁঠালের আঠা থাকে তাহলে নিশ্চয় ওরা এখনো একে ওপরকে চায়। ইট মিনস অভয় ভাইয়া তোকে ছাড়তে চাইবে।”

ঐশানী কান্নামাখা মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ও সরে দাঁড়ায়। সবাই ওর মুখে হাসি দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কিছুক্ষণ আগেই কেঁদে সব ভাসিয়ে ফেলছিল। এখন দেখা যাচ্ছে হাসি মুখে ধরছে না। অনিন্দিতা তো প্রশ্ন করেই ফেলল….
–“কি এমন বললে ঐশী? যে ভাবি একদম ঝাক্কাস হাসি দিচ্ছে?”
–“ইটস এ বিগ সিক্রেট!”
ভাব নিয়ে বলে ঐশী। তারপর ঐশানীকে ধীর গলায় বলে…..
–“শুধু এমন বাঁধনে নিজেকে বাঁধিস না যেই বাঁধন ছাড়াতে তোর প্রাণটা বেরিয়ে যায়। জগতে সব দুঃখ এসে তোর মনে ভীড় জমায়। তাহলে হাসিমুখেই বেরিয়ে আসতে পারবি।”

রিনিসহ সব বান্ধবীরা এসে একসাথে জড়িয়ে ধরে ঐশানীকে। চাপাচাপিতে দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম ঐশানীর। দিয়া ইমোশনাল হয়ে টিস্যু দিয়ে পানি মুছতে মুছতে বলে….
–“বেহায়ার মতো হাসছিস কেন বান্ধবী? তুই হাসলে আমি নকল চোখের পানি দিয়ে কি করব? মুছেই নিই। আসলে চোখে পানি আসছিলই না। তবে জীবনটা বরবাদ হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নে। কাজ করতে করতে দিনে আন্ধার দেখবি।”
দিয়ার কথায় সবাইকে ধাক্কা দিয়ে এসে গাড়িতে ওঠে ঐশানী। গাড়ি চলতে শুরু করে। জানালা দিয়ে তাকায় মা-বাবা আর বোনকে দেখার জন্য। মা আর বোনকে দেখলেও বাবাকে পাচ্ছে না তার চোখ। গেটে গিয়ে আঁটকে যায় তার চোখ বাবার দিকে। কোণায় অশ্রুসিক্ত নয়নে, হাসিমুখে উনি বিদায় দিচ্ছেন মেয়েকে।

নতুন বউ আসায় বাড়িতে রমরমা ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। গিজগিজ করছে মানুষ নতুন বউ দেখার জন্য। শ্বশুড়বাড়িতে পা রাখতেই ঐশানীকে ঘিরে ধরে লোকজন। ঘুম তো দূরে থাক ঘুম নামক জিনিসটা তার চোখ থেকে কর্পূরের মতো উড়ে যায়। পুতুলের মতো বসে থাকে বড় ড্রয়িংরুমের একটি সোফায়। অভয় আগেই উঠে গেছে রুমে ফ্রেশ হতে। তার আর ভালো লাগছে না এসব। বিয়েটা যে সে করেছে এটাই অনেক। এখন পুতুলের মতো ঐশানীর পাশে বসে থাকা ইম্পসিবল!!!

রুমে এসেও আরেক বিপত্তি! তার রুমটা সাজানো হচ্ছে। সব থেকে বড় কথা মেয়েদের রুম সাজানোর উপদেশ দিচ্ছেন তার বাবা স্বয়ং।
–“বাবা তুমি? কি করছো আমার রুমে? রুমে এতো ফুল দিয়ে সাজাতে বলছো কেন?”
–“আরে আজব! তোদের বাসর ঘর সাজাবো না? ঐশানী প্রথম ঢুকবে এই ঘরে। প্রথম না শুনেছি এর আগেও একবার এসেছে। কিন্তু এবার আসবে এই রুমের ভাগিদার হয়ে। তাকে স্বাগত জানাতে এসব করব না?”
অভয় থম মেরে দাঁড়িয়ে যায়। তার বাবার এসব ছেলেমানুষী স্বভাব কোনোদিনও পাল্টানো গেল না।

–“তাই বলে তুমি নিজের ছেলের ঘর এভাবে সাজাবে?” (ইতস্তত বোধ করে)
–“এভাবে সাজাবে মানে? ফুল দিয়েই তো সাজাচ্ছি। এমন করছিস তোর ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।”
–“আগুন লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছো মানে? পুরো আগুনের মস্ত বড় গোলা এনে তুলেছো বাড়িতে। সে নাকি আমার ঘরেও থাকবে। আমার ঘর তো এমনি পুরে যাবে।”
রাহাত সাহেব প্রচন্ড হাসেন অভয়ের কথায়। হাসতে হাসতে বলেন…..
–“তুই ঐশানীর কথা বলছিস? তাও ওর জন্য যদি তোর সুবুদ্ধি হয় তাহলে তো ভালো! এখন বের হ বের হ।”

অভয় একপ্রকার বিরক্ত নিয়ে বেরিয়ে আসে। অনিন্দিতার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে গা এলিয়ে দেয়। অনিন্দিতার এখন আসার কথা নয়। নতুন ভাবিকে নিয়ে যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাতে পুরো জগত ভুলেই গেছে।
একেবারে রাতে হাফ ছেড়ে বাঁচে ঐশানী। সবার মুখে ওর গজদাঁতের কথা শুনতে শুনতে তার কান পঁচে যাবার উপক্রম। তার চেহারা সুন্দর তার প্রশংসা যেমন শুনেছে তেমনই গজদাঁত থাকার হাজারো নিন্দা করে গেছে প্রতিবেশিরা। তাতে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই।

ঐশানীকে রাতের খাবার নিজহাতে তুলে খাওয়ালেন মিসেস. তনয়া। উনি শুনেছেন ঐশানীকে বেশিরভাগ সময় ওর মা তুলেই খাইয়ে দেন। তাই উনিও ঐশানীর শ্বাশুড়ি কম মা হবার কোনো কমতি রাখতে চান না। ক্লান্ত চোখমুখ নিয়ে খেল ঐশানী। সাথে অনিন্দিতাও ভাগ বসালো। সঙ্গে অভয় নেই। সে ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরেই খেয়ে নিয়েছে। তবে পাশে অভয়ের ফুপাতো ভাই রয়েছে। যে বাড়ি দূরে হবার কারণে বিয়ের সময় পৌঁছাতে পারেনি। ছেলেটা বেশ দুষ্টু আর ফাজিল প্রকৃতির। সেটা ঐশানী কথা বলেই বুঝেছে।

খাওয়াদাওয়া শেষে কিছুক্ষণ পরেই ঢুকিয়ে দেওয়া হলো ঐশানীকে ফুল সাজানো অভয়ের ঘরে। অনিন্দিতা ঐশানীকে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে….
–“নাও আমার নিরামিষ ভাইকে আমিষ ভাই বানানোর দায়িত্ব তোমার।”
–“ইম্পসিবল!” (বিড়বিড়িয়ে)
অভয় সবে ফোন হাতে নিয়েছিল। সায়রার অনেকগুলো কল দেখে সে কলব্যাক করতেই যাচ্ছিল তার আগেই ফোনটা কেঁড়ে নেয় অনিন্দিতা। কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে দৌড় মারে সে।

ঘরে রয়ে যায় অভয় আর ঐশানী। ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। টেবিলের ওপর একটা পাত্রে গোলাপের পাপড়ি আর পানি দেওয়া। তার ওপর প্রদীপগুলো টিমটিম করে জ্বলছে। সেই আলোতে হঠাৎ অভয়ের চোখজোড়া স্থির হয় ঐশানী ওপর। তার মুখে ক্লান্ত ক্লান্ত ভাব। নাকে তার পরিবার দেওয়া নাকের ফুল চিকচিক করছে। আলোতে কি তার সৌন্দর্য বেড়েছে নাকি? নয়ত অভয়ের চোখ স্থির কেন?
চোখ সরিয়ে নেয় অভয়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে….
–“আমার ঘুম পেয়েছে আমি ঘুমাবো।”

–“তো ঘুমান। আমিও ঘুমাবো। আপনি নিচে শুয়ে পড়ুন।”
ঐশানীর কথায় বিস্ফোরিত চোখে তাকায় অভয়। তার ঘরে তাকেই নিচে ঘুমোতে বলা হচ্ছে? চেঁচিয়ে বলে ওঠে….
–“ওই, আমার ঘর, আমার বেড আমি ওপরে ঘুমাবো। তুমি নিচে।”
–“ওই শুনুন, আঙ্কেল থুরি শ্বশুড় বাবা বলেছে এই ঘড়ে আমারও অধিকার। আপনার ওপরেও। কিন্তু আপনার প্রতি আমার লোভ নেই বলে ছাড় পাচ্ছেন। কিন্তু বেড আমার।”

অভয় ক্লান্তি মাখা চোখেমুখে তাকায়। ঝগড়া করার ইচ্ছে তার একদমই নেই।
–“আচ্ছা ঠিক আছে। একদিন তুমি বেডে ঘুমাবে। একদিন আমি ওকে?”
–“নো ওকে। আমি আপনাকে এই ঘরে ঘুমোতেই দেব না।” (চিল্লিয়ে)
–“কেন এটা তোমার বাপের ঘর?”
ঐশানীর থেকে অতিমাত্রায় চিল্লিয়ে বলে অভয়। ঐশানী আরো চিৎকার দিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে….
–“একদম বাপ তুলে কথা বলবেন না।”
অভয় আরো কিছু বলতে উদ্যত হবে তখনই বেডের নিচ থেকে কেউ বেরিয়ে আসে। কানে হাত দিয়ে কাঁদছে সে। সে আর কেউ নয় অভয়ের ফুপাত ভাই ইশান।

–“আরে ভাই, রোমান্টিক কথাবার্তা শুনতে ঘরে ঢুকেছিলাম। ঝগড়া করে কানের মাথা নষ্ট করতে না।”
তারা এতোই জোরে ঝগড়া করেছে যে বাইরে থেকে সবাই ঘরে এসে ঢুকে পড়ে। অনিন্দিতা হুড়মুড় করে বলে….
–“এই ঘরে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল? আর ইশান ভাইয়া তুমি কি করছো??”
–“ওই দুর্ভাগা হলে যা হয়। যেচে কান নষ্ট করতে এসেছিলাম।”
বলেই দাঁড়িয়ে পড়ে সে। মিসেস. তনয়া অভয় আর ঐশানীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

–“তোমরা বর-বউ নাকি টম অ্যান্ড জেরি? এভাবে ঝগড়া করছিলে কেন?”
দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মিসেস. তনয়া এবার কড়া আদেশ দিয়ে বলেন…..
–“তোমাদের দ্বারা বাসর ঘর টর হবে না আগেই বুঝেছিলাম। তাই কোনো আয়োজন করিনি। কিন্তু তোমাদের বাবা তো শুনল না। আমি ঠিক করেছি তোমরা কেউই এই ঘরে থাকবে না। দুজনেই ঘরের বাইরে থাকবে।”

চলবে…..

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ]