বেলী ফুলের সুবাস পর্ব-০৮

0
332

#বেলী_ফুলের_সুবাস
#পর্ব :৮
#মেঘকন্যা ,(ছদ্মনাম)

পার্সেল টা খুলে দেখলো বেশ বড় একটা গিফট সুন্দর করে রেপিং পেপার দিয়ে মোড়ানো।সময় না নিয়ে বেলী তাড়াতাড়ি খুলে দেখলো সাদা শাড়ি সাথে আছে ম্যাচিং করে সাদা ব্লাউজ,একজোড়া কানের দুল,বেলি ফুলের মালা,চুরি,আর এক জোড়া নূপুর।সাথে রয়েছে একটা চিরকুট

-উপহারটি শুধু মাত্র বক্ষ পিঞ্জিরায় লুকাইতো এক কিশোরী নারীর জন্য।

চিরকুট পরে থমকালো বেলী।হোক একলাইনের কথা কিন্তু কথার মর্ম অনেক বড়।তাহলে কি লোকটা তাকে আগে থেকেই তাকে ভালোবাসে? ভালোবাসলে এতো দিন এমন ব্যবহার করতো কেনো?বিয়ের আগে তো সারাদিন পিছে লেগেই থাকতো। বলতে হবে যে বিয়ের পর ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন এসেছে।তবুও ঝাড়াঝাড়ি যায় নি। এইতো সেদিন শার্ট স্ত্রী করতে যেয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিলো। কতো গুলো কথা শুনালো। সে নাকি ওকামের ঢেঁকি কোনো কাজ তার দ্বারা হবে না আর কত কি।এই লোকের মন বুঝা যায়না ।কখন কি বলে,কখন কি মনে চলে কিছুই বুঝা যায় না।

বেশ অনেক ক্ষন যাবৎ গাড়িতে বসে আছে সুবাস।কয়েকবার বেলীকে ফোন দেয়া শেষ। কোথায় এই মেয়ে? কে জানে।প্রতিবার ফোন দিলে বলে দু মিনিট।অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হয় না।গাড়িতে বসে থাকতে না পেরে যেই যা না আবার কল দেয়ার জন্য ফোন হাতে নেয় তখন আগমন ঘটে কিশোরী কন্যার।

-সরি অনেক লেট করে ফেললাম।
হাঁপাতে হাঁপাতে বললো বেলী

সুবাস একপলক বেলীর দিকে তাকালো।কল্পনায় যতটা সুন্দর ভেবেছিল বাস্তবে তার চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে।শাড়ি টা কি সুন্দর মানিয়েছে মনে হচ্ছে শাড়ি টা তাঁর জন্যই তৈরি হয়েছে।চুল গুলো খোঁপা করে বেলী ফুলের মালা লাগানো।হাতে চুড়ি।খুব বেশি সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে কোনো শুভ্র পরী। ফর্সা গাল লজ্জায় লাল হয়ে আছে। একদম স্নিগ্ধ লাগছে।কপালে নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে দেখেই মনে হচ্ছে যে বেশ তাড়াহুড়া করে এসেছে।

-কি হলো কোথায় হারিয়ে গেলেন ?
নিজেকে পরখ করে খানিকটা অসস্তি নিয়ে বলো বেলী

-হুম ভিতরে এসে বসো।

ছোট্ট করে বলল সুবাস।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজের মতো করে চালাতে লাগলো।পথে বেশ কয়েকবার বেলী জিজ্ঞাস করেছিল যে কোথায় যাচ্ছে।সুবাস শুধু বলেছে গেলেই দেখতে পাবে। বেলীও আর কথা বাড়ায় নি।পথটা উপভোগ করতে লাগলো।কি সুন্দর রাস্তা দু পাশে দাঁড়িয়ে আছে নারকেল গাছ।আকাশটাও বেশ উজ্জ্বল। মেঘ গুলো খেলা করছে। হওয়া এসে বেলীর চোখের সামনে পড়ে থাকা চুল গুলো উড়িয়ে দিচ্ছে।বেশ ভালো লাগছে। বহুদিন পর এভাবে ঘুরতে বের হলো।মনটাও ভালো লাগছে।অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। মেইন রোডে গাড়ি পার্ক করলো সুবাস।তারপর কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো

-কোথায় যাচ্ছি আমরা এবার তো বলুন?

-কথা না বলে চুপ চাপ হটো।গেলেই দেখতে পাবে।

কথা বাড়ালো না বেলী । জায়গা টা সুন্দর।কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খোলা জায়গায় চলে এলো।জায়গাটার একপাশে হচ্ছে কুরে ঘর।মনে হচ্ছে কেউ থাকে । ঘরের পাশেই একটা ছোট্ট দোকান।একটু আগে বেড়েই দেখতে পেলো ছোট্ট একটা বিল। পদ্ম ফুলের বিল।বেলীর অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল পদ্ম বিল দেখার।কি সুন্দর পরিবেশ।যে কারো মন ভালো করতে সক্ষম এই জায়গা।আসে পাশে আরও মানুষ দেখা যাচ্ছে।প্রত্যেকেই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত।সুবাস বেলীকে নিয়ে নৌকায় উঠলো পুরো বিল ঘুরে দেখার জন্য।বেলী সুবাসের হাত শক্ত করে ধরে নৌকায় উঠলো।তা দেখে সুবাস হাসলো।দুজনে নৌকায় বসলো।বেলী নৌকায় ভীষণ ভয় পায়।তাইতো সুবাসের একদম গা ঘেষে বসে‌ পরলো।সুবাস বেলীর দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ মাঝিকে বললো
-কি অবস্থা চাচা কেমন আছেন? চাচীর শরীর ভালো তো ?
-আমরা দুজনেই মেলা ভালো আছি।তো তোমার লগে এটা কেঠা? বউ মা নিহি ?

-হুম চাচা আমার বউ

বেলীর দিকে তাকিয়ে বললো সুবাস।বেলী লজ্জায় চোখ নিচে করে নিলো। যাই হোক এভাবে বউ বলল তো লজ্জা লাগবেই।পুরো বিল ঘুরে দেখলো তারা।কত গুলো ছবি তুলে নিলো অবশ্য বেলী বেশ কয়েকটা ছবি তুললো সুবাসের সাথেও কয়েকটা তুললো।। আকাশটা সুন্দর হওয়াতে ছবি গুলোও বেশ সুন্দর এসেছে।বিল থেকে বেরিয়ে এসে সেই বৃদ্ধ লোকের বাসায় গেলো তারা।বৃদ্ধ লোকের নাম হলো কুদ্দুস মিয়া। তিনি এবং তার স্ত্রী ফিরোজা বেগম এখানে বসবাস করেন।ফিরোজা বেগম তাদের ঘরে তুলে নিলো।ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো একটি ছোট্ট বাচ্চা খেলা করছে চকিতে বসে।বয়স কত হবে দুই কি তিন বছর ।কি সুন্দর বাচ্চা।কি সুন্দর তার হাসি।সুবাস বাচ্চা টাকে কোলে নিলো।পর পর কয়েকটা চুমু খেলো।বাচ্চাটাও দুবাসকে দেখে খিল খিল করে হাসতে লাগলো।সাথে সুবাস ও হাসতে লাগলো।বেলী এই প্রথম সুবাসকে এভাবে হাসতে দেখলো।লোকটার হাসি এত সুন্দর।কই আগে তো কখনও এভাবে লোকটার হাসি দেখে নি বেলী।আগে তো কখনও সুবাসের হাসি এত ভালো লাগে নি।তবে বলতে হবে লোকটার হাসিতে কিছু একটা আছে ।বেলী আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করলো তা হলো সুবাস বাচ্চা টাকে খুব আদর করছে।রিদিতা আপুর মেয়ে চাঁদ কেও ভীষণ ভালোবাসে ।তবে কি লোকটার বাচ্চা খুব পছন্দ?তাদের বাচ্চা হলেও কি ….পরক্ষনেই নিজের চিন্তার জন্য নিজেকে কত গুলো বোকা দিলো বেলী।কি সব ভাবছে সে।বেলীর ভাবনার মাঝে ফিরোজা বেগমকে উদ্দেশ করে বললো সুবাস।

-চাচী কেমন আছেন? আজ কিন্তু আপনার হাতের গরম গরম চাপরি আর ভর্তা খেতে এসেছি। মিলবে কি ?
-হুম, হুম মিলবো।ঘরে যাইয়া বহোগা।

-আমি বসবো না একটু বাইরে আসেন চাচা আমার সাথে।
কুদ্দুস মিয়াকে বললো সুবাস।দুজনেই বেরিয়ে গেলো । ফিরোজ বেগম ঘরের পাশে ছোট্ট দোকানে চোলে গেলো সাথে বাচ্চা কে নিতে গেলে বেলী নিজের কোলে নিয়ে নেয়।বেলী আর একা ঘরে না বসে ফিরোজা বেগমের পাশে গিয়ে বসলো।

-তুমি এদিক আইলা কিয়ের লিগা?
-এমনি চাচী ঘরে ভালো লাগছিল না।আপনের সাথে কথা বলি ভালো লাগবে।
-তয় বহো।সুবাস বাবার লগে তোমার বিয়া কবে হইলো?
-বেশ কিছু দিন আগে চাচী
-আহা কি সুন্দর একটা মানুষ পাইসো রে মা।মন টা কি সুন্দর। জানো আমার কোনো পোলা নাই একটা মাইয়া আছিলো তাও একেবারে লেইগা আমগো ছাইড়া গেসে গা।নাই এই দুনিয়াতে।এই ঘরটার মধ্যে দুইজন থাকি এই নাতনি টারে লইয়া।আমার মাইয়ারে বিয়ে দিসিলাম। জামাই ভালা না।বাচ্চা টা পেটে আহনের পড়ে মাইয়া রে ছাইড়া গেসে গা।আমার নাতনি টা যেদিন হইবো ওই দিন সুবাস বাবার লগে দেহা হইসে।আমার মাইয়া ব্যথায় ছটফট করতাসিলো। এই মেইন রোডে কোনো গাড়ি পাই নাই যে ডাক্তার কাছে নিমু আর টাকাও আছিলো না।শেষ মেষ সুবাস বাবারে আল্লাহ পাঠাইসে।বাবায় আমগো ডাক্তার খানায় লয়া গেছে আমার নাতনি টা হইলো কিন্তু আমার মাইয়া টা আর বাঁচলো না
কথাটা বলেই ফিরোজা বেগম কাদতে লাগলেন।
-কান্না করবেন না চাচী।আপুর জন্য দুয়া করবেন।
-সুবাস বাবায় তো এই ছোট্ট দোকান টা বানায় দিসে।এই পদ্ম বিল যারা দেখতে আহে তাগো কাছে চাপড়ি বেচি।তাই দিয়া দুই জনের সংসার আরামে চলে।তাও সুবাস বাবায় মইধ্যে মইধ্যে আয়া আমগো খোঁজ নেয় হাজার না করণের পরেও আমগো লিগা কিছু না কিছু নিয়া আহে।

তাদের কথা মাঝে সুবাস আর কুদ্দুস মিয়া চলে আসলো।হাতে কত গুলো ব্যাগ।

-দেহো বাবায় আমগো লিগা কত কিছু আনসে
কুদ্দুস মিয়া তার স্ত্রীকে বললেন।
-বাবায় কি আর আমগো কথা হুনবো।বাবায় কিছু না কিছু নিয়াই আইবো। চলো এহন চাপড়ী হয় গেসে।
বলেই চলে গেলেন ফিরোজা বেগম।

বেলী আর সুবাস খাওয়া দাওয়া করে বেশ কিছু ক্ষন বসে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলো।বেলীর আজ দিনটা ভীষণ ভালো কেটেছে।মনটাও ভালো হয়ে গেলো।

চলবে…..?