বেড়ী পর্ব-০৪

0
1999

#বেড়ী পর্বঃ৪
#লেখায়ঃপ্রজাপতি(Nosrat Monisha)

বেল্টের আঘাতে প্রায় বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছে হৃদিতা। হাতে পিঠের ফর্সা খোলা জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। কোন কোন জায়গায় নীল হয়ে গেছে আবার কোথাও রক্ত বের হচ্ছে।
প্রথম দু-একটা আঘাতের পর কেঁদেছিলো এখন গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। আজ জিরিয়ে জিরিয়ে তাকে মেরেছে নির্ঝর। তাই হৃদিতার মনে একটা শঙ্কা বাসা বেঁধেছে হয়তো আবার এখনই মার শুরু করবে ।

সে নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই নির্ঝরের। বেলকনিতে বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে।
এই এক সমস্যা নির্ঝরের যখন মাথা গরম হয় তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। তাছাড়া হৃদিতারও একটা শিক্ষা হওয়া উচিত একে তো অন্যায় করবে তার উপর মুখে মুখে তর্ক।
মুমু ঠিক বলে বউকে সে একটু বেশিই লাই দিয়ে ফেলেছে। ঠিকমতো শাসন না করলে হয়তো বোনের মতো কাজ করবে।

ঘটনা হলো আজ নির্ঝরদের বাড়িতে তার ফুপুদের দাওয়াত ছিলো। নির্ঝরের দুই ফুপু। বড় ফুপুর সন্তানরা দেশের বাইরে তাই আসে নি। ছোট ফুপু তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এসেছে। আজ যত সমস্যা হয়েছে সব ছোট ফুপুর ছেলে অনিককে নিয়েই হয়েছে। সে এবার অনার্সে পড়ছে বলতে গেলে হৃদিতার সমবয়সী ।

ছোট থেকে নির্ঝর অনিককে নিজের আপন ভাই মনে করলেও নির্ঝর আর হৃদিতার বিয়ের দিন যখন হৃদিতাকে দেখে অনিক বললো,
-নির্ঝর ভাইয়া ভাবীর বয়স তোমার তুলনায় একটু বেশিই কম। তোমার চেয়ে তো আমার সাথেই বেশি মানায়।
সবাই অনিকের কথাকে ঠাট্টা হিসেবে নিলেও নির্ঝর নিতে পারে নি।
সেই তখন থেকে অনিক হলো নির্ঝরের চোখের বিষ।

আজকে সবাই যখন গল্প করছিলো। তখন মুমু নির্ঝরকে একটু আড়ালে ডেকে বলে,
-নিজের বউকে সামলাও এত লাই দিও না নাহলে বোনের মতো ।

নির্ঝর মুমুর হেয়ালি বুঝতে পরলো না।
-কি হয়েছে?

টিটকিরি করে মুমু বলে,
-কি আর হবে? রান্না ঘরে গিয়েছিলাম তোমার বউকে তাড়াতাড়ি চা নিয়ে আসার কথা বলতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি রাসলীলা চলছে।

ভ্রু কুঁচকে নির্ঝর জিজ্ঞেস করে,
-মানে?

-মানে তোমার বউ অনিকের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর আড্ডা দিচ্ছে। তাই চা আনতে দেরি হচ্ছে।

নির্ঝরের কিছু বলার আগেই সেখানে চায়ের ট্রে নিয়ে হাসিহাসি মুখে হৃদিতা আসে, তার পেছনে অনিক ।
নির্ঝর কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে তখন মুমু তার হাত টেনে ধরে বলে,
-কি করছো কি পাগল হলে নাকি? বাড়ি ভর্তি মেহমান এখন সিনক্রিয়েট করবে? বউয়ের সাথে রাতে কথা বলো।


মুমুর কথামতো তখনকার মতো চুপ হয়ে যায় নির্ঝর।
কিন্তু রাতে হৃদিতা রুমে এলে সরাসরি তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নির্ঝর,
-অনিকের সাথে কি কথা হচ্ছিলো?

মুমু স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেয়,
-তেমন কিছু না ওই আমার পড়াশোনা নিয়ে। জানেন সে বলছিলো একদিন সময় করে তার এইচএসসির সব নোট আমাকে দিয়ে যাবে।

-শুধু এই না আর কিছু?

-আর কি?

-না তোমাদের এতো হাসাহাসি ঢলাঢলি দেখে আমি ভাবলাম প্রেম-পিরীতির কথা বলছো।

নির্ঝরের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ঘৃণায় হৃদিতার মনটা ভরে যায়,
-ছি! কি বলছেন আপনি? এতো নোংরা কথা আপনি কি করে বলতে পারেন?

-কেন তুমি করতে পারো আর আমি বললে দোষ।

-আপনি অযথা অশান্তি করছেন। আমি কারও সাথে কথা বললে যদি আপনার সমস্যা হয় তাকে বাড়িতে আসতে বারণ করে দিন। কিন্তু দয়া করে আমাকে এসব বলবেন না।

রাগী গলায় চিৎকার করে নির্ঝর বলে,
-আমি কি করবো না করবো তোকে জিজ্ঞেস করে করবো?

একটু জোর গলায় হৃদিতা বলে,
-দেখুন রাত-বিরেতে চেঁচাবেন না, আর আমার সাথে এভাবে কথা বলবেন না। চিৎকার চেঁচামেচি আমিও করতে পারি।

-তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? আসলে তুইও তোর বোনের মতো নষ্ট চরিত্রের। তোদের মা-বাবা তোদের দুই বোনকে মানুষ করতে পারে নি।

মা-বাবা নিয়ে কথা একটু বেশিই গায়ে লাগে হৃদিতার। তাই আগেপিছে চিন্তা না করে সে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে,
-আপনার মা-বাবা বুঝি আপনাকে মানুষ করতে পেরেছে? শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে অসম্মান করে কথা বলা, অন্যের মা-বাবা তুলে কথা বলা, সত্য না জেনে মেয়েদের চরিত্র নিয়ে কথা বলা, নিজের স্ত্রীকে ফালতু কারণে সন্দেহ করা এগুলো বুঝি মানুষ হবার নমুনা?

কথাগুলো শুনেই মাথায় রক্ত উঠে যায় নির্ঝরের। সে সাথে সাথে থাপ্পড় দিয়ে হৃদিতাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে বেল্ট খুলে মারতে থাকে আর বলতে থাকে,
-কি বললি? আমি অমানুষ? আমার মা-বাবা আমাকে মানুষ করতে পারে নি? তুই নোংরামি করবি বেলেল্লাপনা করবি আমি কিছু বলতে পারবো না। আজ আমি তোকে মেরেই ফেলবো।

কয়েকটা বাড়ি খাওয়ার পর হৃদিতার মুখ দিয়ে আর শব্দ বের হয় নি। সে পড়ে পড়ে শুধু মার খেয়েছে।


দরজা বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে ধামাকার জন্য অপেক্ষা করছিলো মুমু। তারপর হৃদিতার চিৎকার শুনে খুশি মনে একরকম নাচতে নাচতে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
একটা অদ্ভুত শান্তি পায় সে হৃদিতার কান্না শুনে। গিয়ে দেখে নিরব ঘুমিয়ে গেছে। এসব কিছু মধ্যে নিরবকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলছে মুমু।
মুমুর প্রতিদিনের অবহেলাগুলো এখন নিরব বুঝতে পারে তাই আগের মতো মুমুকে কাছে টেনে নেয় না কিংবা মুমুর সাথে কথাও বলে না।
মুমু অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না । কারণ চেষ্টা করেও যাকে ভালবাসতে পারে নি তার মন ভালো কি খারাপ তাতে কি-ই-বা আসে যায়?


মধ্যে রাতে ঘরে আসে নির্ঝর। দেখে হৃদিতা একইভাবে পড়ে আছে। সে ভাবলো একটু সোজা করে শুইয়ে দেবে কিন্তু যেই হাত লাগায় ব্যাথায় কুকিয়ে ওঠে হৃদিতা সে ভাবে নির্ঝর তাকে আবার মারবে। তাই অনুনয়ের স্বরে বলে ,
-ও.. আম্মু মরে গেলাম..আমাকে আর মারবেন না।

হৃদিতার কথা শুনে নির্ঝরের কষ্ট হয়।
তাই সে হৃদিতাকে ধরে আঘাত গুলো ধীরে ধীরে স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে। পরিষ্কার করতে গিয়ে বুঝতে পারে এগুলো বেশ ফুলে গেছে। হৃদিতা মাঝে-মধ্যেই কুকিয়ে উঠছিলো।

এরপর ঘায়ে ওষুধ লাগিয়ে দেয় আর হৃদিতাকে একটা ব্যাথার ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেয়।
বিছানায় শুয়ে নির্ঝর ড্রিম লাইটের আলোতেও হৃদিতার আঘাতের চিহ্নগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলো।
নিঝরের এবার হৃদিতার জন্য আরও বেশি খারাপ লাগতে শুরু করলো।
তাই সে হৃদিতাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-তুমি এমন কেন করো চাঁদ? কেন তর্ক করো? কেন বোঝ আমি অন্য কারও সাথে তোমাকে সহ্য করতে পারি না। আমি চাই তুমি আমার সব কথা শুনে চলো আর সবসময় আমার ভালবাসায় আবদ্ধ থাকো।

হৃদিতা অস্পষ্ট স্বরে বলে,
-নির্ঝর এটাকে ভালবাসা বলে না বেড়ী বলে।

নির্ঝরের কানে শব্দগুলো পৌঁছায়। সে মুচকি হেসে বলে,
-তুমি যদি আমার ভালবাসাকে বেড়ী মনে করো তাহলে তাই। তবে একটা কথা মনে রেখো চাঁদ মৃত্যু ছাড়া তুমি এই বেড়ী খুলতে পারবে না।

-চলবে?